একেবারে বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে?
হ্যাঁ, চলে যেতে হবে। বনে-জঙ্গলে থাকব। ঘাস-লতা-পাতা খাব। তোমার টার্ট-ফার্ট খেতে পারব না।
রান্না নিয়ে বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে টগর অভ্যস্ত। এই ঝগড়া দেখতে তার ভালো লাগে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে সে সব সময় বাবার পক্ষ নেয়। যদিও ছোট ছেলেদের উচিত মায়ের পক্ষ নেয়া। ছেলেরা নেবে মায়ের পক্ষ, মেয়েরা নেবে বাবার পক্ষ । এটাই নিয়ম। টেগরের নিয়ম মানতে ভালো লাগে না। আশপাশে যত বেশি অনিয়ম হয় টগরের ততই ভালো লাগে।
রান্নাঘরে মায়ের আনন্দিত মুখ দেখে টেগরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে এত বড় বিচারসভা বসবে অথচ কারোর কোনো মাথাব্যথা নেই। মা কেমন হাসাহাসি করতে করতে মুরগির মাংস ছানাছানি করছেন। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু বানাচ্ছেন।
সুলতানা টগরের দিকে তাকিয়ে বললেন, রান্নাঘরে ঘুরঘুর করিস না তো! ছেলেপুলেকে রান্নাঘরে ঘুরঘুর করতে দেখলে আমার খুবই বিরক্তি লাগে। ঘণ্টাখানেক পরে আয়, মুরগির মাংসের মিষ্টি কাবাব খাইয়ে দেব। নতুন রেসিপি। কাশ্মিরে এইভাবে মুরগির মাংস রান্না হয়।
টগর, বলল, আমি মিষ্টি কাবাব খাব না।
খাবি না কেন, অবশ্যই খাবি। রসমালাই দেখলে হামলে পড়িস, মুরগির মিষ্টি কাবাব খেতে পারবি না? বাবার স্বভাব দেখি পুরোটা পেয়েছিস। সামনে থেকে যা, ঘুরঘুর করিস না।
আমি ঘুরঘুর করছি না, কাজে এসেছি।
কী কাজ?
ছোট মামা চা খাবে। চা দাও।
সুলতানা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, ফাজিলটার নাম মুখে আনবি না। ওকে চা খাওয়াতে হবে না। ওর হিমুগিরি আগে বের হোক, তারপর চা। গা থেকে হলুদ পাঞ্জাবি খুলে কানে ধরে দশবার উঠবোস করবে তারপর ফরমাশ দিবে।
হিমু হওয়া তো দোষের কিছু না, মা।
দোষের না গুণের তা নিয়ে তোর সঙ্গে তর্ক করতে পারব না। দুই আঙুল ছেলে, আমার সঙ্গে তর্ক করতে এসেছে। যা সামনে থেকে।
টগর অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, এমন করছ, কেন মা? দাও না এক কাপ চা বানিয়ে। চিনি—দুধ বেশি।
সুলতানা কঠিন গলায় বললেন, সামনে থেকে যাবি নাকি মুরগিমাখা হাতে একটা থাপ্পড় খাবি?
টগর রান্নাঘরের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। ছোট মামা বেচারা চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে, অথচ তাকে সে চা দিতে পারছে না। খুবই খারাপ ব্যাপার। টগর দ্রুত চিন্তা করছে কোনো একটা বুদ্ধি বের করা যায় কি না। তার মাথায় কোনো বুদ্ধিই আসছে না। যখন কোনো বুদ্ধির দরকার হয় না। তখন মাথায় নানা রকম বুদ্ধি আসে আর যখন প্রয়োজন হয় তখন কোনো বুদ্ধিই আসে না।
টগর, ছোট মামার ঘরে চলে এল। মামা ঠিক আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে, তবে চোখ বন্ধ। সে চোখ না খুলেই বলল, আমার চা কই?
টগর। এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবারো ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার কাছে মনে হলো সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত সে এই কাজই করবে। একবার নিজের ঘরে ঢুকবে। ছোট মামা বলবেন, চা কই? সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে যাবে। আবার ঢুকবে। আবার বের হবে। আবার ঢুকবে। আবার বের হবে। আসা-যাওয়া চলতেই থাকবে।
ছোট মামার ঘর থেকে বের হয়ে একসময় কী মনে করে যেন টগর দাদিয়ার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল। টগরের দাদিয়া তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, এ চায় কী? এই ছাগলা কী চায়? আমার ঘরে ঢুকছে কী জন্য? আমার ঘরে কি সোনার খনি আছে?
টগর বলল, দাদিয়া, আমি টগর। আমি তোমার ঘরে ঢুকিনি। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।
তুই আমার দরজার সামনে দিয়া একবার যাস একবার আসস। তুই তাঁতের মাকু হইছস? তোর ঘটনা কী?
কোনো ঘটনা নাই।
কেউ তোরে বকা দিছে? তুই কি আমারে নালিশ করতে চাস?
না।
বকা দিলে আমারে তার নাম কি। আমি ব্যবস্থা নিব। আমি যতদিন বাঁইচ্যা আছি ছোট পুলাপানের ওপরে বকা চলাব না। কে তোরে বকছে? তোর মা? ডাক দেখি তোর মারে।
মা বকে নাই।
তাইলে বকছে কে? তোর বড় চাচা? হে মাথা ছিলা বান্দর হইয়া বকা মাষ্টর সাজছে? যারে তারে-হ্যামকি ধমকি? ডাক তারে।
দাদিয়া আমাকে কেউ বকে নাই।
না বকলে সামনে থাইক্যা যা। ত্যক্ত করিস না।
টগর দাদিয়ার ঘরের সামনে থেকে চলে এল। আর তখনি তার ভেতর থেকে দুঃখ দুঃখ ভাবটা পুরোপুরি চলে গেল। কারণ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। কীভাবে ছোট মামার জন্য এক কাপ চা জোগাড় করা যায় সেই বুদ্ধি। দাদিয়ার সঙ্গে কথা না বললে মাথায় এই বুদ্ধি আসত না। ভাগ্যিস সে কথা বলেছিল।
টগর রান্নাঘরে মায়ের সামনে এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, মা, চুলা কি বন্ধ?
সুলতানা বললেন, চুলা বন্ধ না খোলা এটা দিয়ে তোর কী দরকার? শুধু শুধু বিরক্ত করা।
টগর, বলল, শুধু শুধু বিরক্ত করছি না। দাদিয়া চা খেতে চাচ্ছেন।
সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, বলিস কী, ওনার কি শরীর ঠিক হয়েছে নাকি?
টগর বলল, শরীর ঠিক হয়েছে কি হয়নি। আমি জানি না। দাদিয়ার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, দাদিয়া বললেন, টগর, এক্ষুনি তোর মাকে গিয়ে বল আমাকে কড়া করে এক কাপ চা দিতে। চিনি বেশি।
চিনি বেশি কী জন্য? ওনার ডায়াবেটিস। উনি তো চায়ে চিনিই খান না।
আমাকে যেটা বললেন, আমি সেটা তোমাকে বললাম। হয়তো অসুখ থেকে সেরে ওঠার পর দাদিয়ার চিনি খেতে ইচ্ছা করছে। তুমি এক্ষুনি চা বানিয়ে আমার হাতে দাও। দাদিয়া আমাকে চা নিয়ে যেতে বলেছেন। অন্য কেউ নিয়ে গেলে চলবে না। উনি রাগ করবেন।