ব্যাখ্যা তো দিলাম। ব্যাখ্যা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না?
আপনি যা বলছেন তা হতে পারে। শুভ্ৰকে পানি থেকে তুলতে আপনার কতক্ষণ লাগবে।
আধঘণ্টার বেশি লাগার তো কথা না। অবস্থাটা দেখি। আপনারা কেউ আমার সঙ্গে যাবেন না। প্লিজ। কেউ যেন উঁকিঝুঁকিও না দেয়।
সাইকিয়াট্রিস্ট এম শামসুল হক পিএইচডি কলঘরে ঢুকে একটা ধাক্কার মতো খেলেন। তিনি ভেবেছিলেন অল্পবয়সী একটা ছেলে চৌবাচ্চার পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকবে। অথচ দেখা যাচ্ছে থলথলে মোটাসোটা এক বৃদ্ধ বসে আছে। বৃদ্ধের মাথার সব চুল সাদা।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, কেমন আছেন?
জি জনাব, ভালো আছি।
কতক্ষণ আছেন। পানিতে?
অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল।
আপনার নামটা কি আমি জানতে পারি?
রকিবউদ্দিন ভূইয়া।
সাইকিয়াট্রিস্টের ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি শুনেছেন পেশেন্টের নাম শুভ্ৰ। এখন পেশেন্ট বলছে তার নাম রকিবউদ্দিন ভূইয়া। এ রকম অবশ্য হয়। ডিলিউশনের পেশেন্ট নিজের নাম নিয়েও বিভ্রান্ত হয়। একেক সময় নিজেকে একেক রকম কল্পনা করে।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, হিমু বলে কাউকে চিনেন? হিমু নাম শুনেছেন?
আগে কোনো দিন শুনি নাই। পানিতে নামার পরে শুনেছি।
সাইকিয়াট্রিস্ট মনে মনে হাসলেন। রোগ কতদূর অগ্রসর হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। পানিতে নেমেই সে হিমুর সন্ধান পেয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুর মতো গলায় বললেন, হিমু সম্পর্কে কিছু বলুন শুনি।
রকিবউদ্দিন বললেন, পানিতে নামেন তারপর বলব। দুইজন দুই জায়গায় থেকে কীসের কথা?
পানিতে নামতে বলছেন?
হুঁ। নেমে দেখেন আরাম লাগবে। শরীর হালকা হয়ে যাবে। শরীরের ভিতরই বাস করে মন। যেহেতু শরীর হালকা সেই কারণে মনও হবে হালকা।
এইসব কি আপনার কথা?
জি না। হিমুর কথা। হিমুর আরো অনেক কথা জানি। পানিতে নামেন বলব। শুভ্ৰ থাকলে সে গুছিয়ে বলতে পারত। সে কিছুক্ষণ আগে উঠে গেল।
সাইকিয়াট্রিস্ট আবারো মনে মনে হাসলেন। ডিলিউশানের গতি-প্রকৃতি ধরা পড়ছে। এখন এই লোক শুভ্রের নাম নিচ্ছে। শুভ্ৰ উঠে গেছে, সে বসে আছে। সাইকিয়াট্রিস্ট রোগীকে প্যাচে ফেলাবার ভঙ্গিতে বললেন। শুভ্র? শুভ্ৰ কে?
সে হিমু।
শুভ্ৰ, হিমু আর আপনি একই মানুষ, না? চট করে জবাব দেবেন না। ভেবেচিন্তে বলুন।
জি না। এক মানুষ হব কেন?
আমি যদি বলি আপনি শুভ্র আবার আপনিই হিমু। পানির এক রূপ বরফ, আরেক রূপ বাম্প। আপনি সাপ আবার আপনিই ওঝা।
আপনি বললে তো হবে না। আমি কী, সেটা আমি জানি।
না, আপনি জানেন না। যাই হোক বুঝিয়ে বলছি।
বুঝিয়ে বলার আগে পানিতে নামেন। তারপর যত ইচ্ছা বুঝান।
নামছি। নামছি।
আজমল হোসেন ইজিচেয়ারে বি॥ম ধরে বসে আছেন। তাকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। তিনি খবর পেয়েছেন। শুভ্ৰ পানি থেকে উঠেছে। নিজের ঘরে বসে চা খাচ্ছে। তবে সাইকিয়াট্রিস্ট নেমে পড়েছে পানিতে। সে পানিতেই আছে।
পরিশিষ্ট (টগরের লেখা ডায়েরির অংশ)
পরিশিষ্ট
[টগরের লেখা ডায়েরির অংশ]
আমাদের বাড়িতে যে ভৌতিক উপদ্রব হয়েছিল তার রহস্য ভেদ হয়েছে। সব করেছে নীলু। সে মার কাছে স্বীকার করেছে সে নিজেই ষ্ট্যাপলার দিয়ে তার কান ফুটো করেছে। তাকে নিয়ে গতকাল রাতে বিচারসভা বসেছিল। বড় চাচা তাকে বলেছেন, মা নীলু, তোমাকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করি। তুমি যদি তোমার সব অপরাধ স্বীকার করে তাহলে আমার স্নেহের পরিমাণ আরো বাড়বে। তুমি অনেক দিন থেকে একটা ওয়াকম্যান চাচ্ছিলে, আমি নিজে সেই ওয়াকম্যান কিনে দেব। মা, এখন বলো তুমি কি তোমার দাদিয়ার পান-ছেঁচনি লুকিয়ে রেখেছিলে?
নীলু সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ। [সে এটা বলল, বড় চাচার বেশি স্নেহ পাওয়ার জন্য এবং ওয়াকম্যানটা পাওয়ার জন্য।]
বড় চাচা বললেন, তুমি যে অপরাধ স্বীকার করেছ এতে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। মা, এখন বলো তুমি নিজেই কি তোমার অঙ্ক বই লুকিয়ে রেখে বলেছ বই খুঁজে পাচ্ছ না?
হ্যাঁ।
কেন এই কাজটা করলে?
আমি জানি না, বড় চাচা।
আর কখনো এ ধরনের কাজ করবে?
না?
আমার ঘর থেকে কলা এবং পাউরুটি তুমিই তো সরিয়েছিলে। তাই না, মা?
হ্যাঁ, আমি।
তোমার সত্যবাদিতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো। আমি এক্ষুনি তোমাকে ওয়াকম্যান কিনে দেব।
থ্যাঙ্ক য়্যু, বড় চাচা।
নীলু তার ওয়াকম্যান পেয়েছে। আমাকে হাত দিতে দেয় না। এমন পাজি মেয়ে।
ছোট মামা হিমু হওয়া কিছু দিনের জন্য বাদ রেখেছে। কারণ সামনেই তার পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হলেই সে হিমু হওয়ার সেকেন্ড পার্টে যাবে। সেকেন্ড পার্টে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে সেই গর্তে ঢুকে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে হবে। সমস্ত শরীর থাকবে গর্তের ভেতর। গর্তের ওপর শুধু মাথাটা বের হয়ে থাকবে। ছোট মামা বলেছে জোছনা দেখার সময় আমি তার সঙ্গে থাকতে পারি।
আমি একবার ভেবেছিলাম বড় হয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট হব। এখন ঠিক করেছি সাইকিয়াট্রিস্ট হব না। কারণ সাইকিয়াট্রিস্ট হলে সবাই আমাকে গাধার বাচ্চা গাধা বলে গালি দিবে।
আমাদের বাসায় যে সাইকিয়াট্রিস্ট এসেছিলেন তাকে আমাদের বাসার সবাই গাধার বাচ্চা বলে গালি দিয়েছে। কারণ তিনি এসেছিলেন ছোট মামার চিকিৎসা করতে। তার বদলে তিনি পানিতে ড়ুবে রকিব স্যারের চিকিৎসা করেছেন। তিনি সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টা পানিতে ছিলেন। তিন ঘণ্টা পর স্যারকে নিয়ে পানি থেকে উঠলেন। পানি থেকে উঠে ভেজা কাপড়ে বড় চাচার ঘরে ঢুকে বললেন, রোগ অত্যন্ত কঠিন পর্যায়ে আছে। তবে অনেকটা সামলে ফেলেছি, আর দশটা সেশন পার করলেই উনি বুঝতে পারবেন উনি আসলে রকিবউদ্দিন ভূঁইয়া না, ওনার আসল নাম শুভ্ৰ।