টগর তার মামার খুবই ভক্ত। অনেক কিছু সে তার মামার কাছে শিখেছে। কিছুদিন আগে শিখল পাঁচ নম্বরি ফুটবলের সাইজ বুদ্বুদ বানানো। জায়ান্ট সাইজ বাবল বানানোর নিয়ম হলো—আধ বালতি পানিতে তিন কাপ ডিসওয়াশিং লিকুইড সাবান মেশাতে হবে, তরকারির চামচে এক চামচ গ্লিসারিন মেশাতে হবে। তারপর চার-পাঁচ টুকরা বরফ মিশিয়ে পানিটা ঠাণ্ডা করতে হবে। এখন কাগজের নল বানিয়ে সেই নল পানিতে চুবিয়ে ফুঁ দিলেই বিশাল বড় বড় বুদ্বুদ হবে। এই বুদ্বুদ ফট করে মরে যাবে না। অনেকক্ষণ ঘরের বাতাসে ঘুরঘুর করবে।
শুভ্ৰ বুদ্বুদ বানানো ছাড়াও এখন টগরকে শেখাচ্ছে কী করে ছবি তোলার সময় ট্যারা হওয়া যায়। জিনিসটা বেশ কঠিন। কপালের শিরায় হ্যাঁচকা টানের মতো দিতে হয়। তারপর তাকিয়ে থাকতে হয় নাকের ডগার দিকে। টগর এখনো শিখে উঠতে পারেনি। তার সময় লাগছে।
টগর, ছোট মামার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মামাকে সে অত্যন্ত পছন্দ করে বলেই তার খুব খারাপ লাগছে। কেউ হিমু হলেই তার জন্য বিচারসভা বসাতে হবে? হিমু হওয়া কি খারাপ? হিমুরা তো কিছু করে না, শুধু হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘোরে।
শুভ্র বলল, কিছু বলবি?
টগর বলল, চা খাবে মামা? বুয়াকে বলে তোমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসি? কড়া করে। চিনি বেশি দিয়ে।
শুভ্র বলল, চা-ফা লাগবে না। হিমুদের এত আয়েশ করে চা খাওয়ার নিয়ম নেই।
হিমুরা চা খায় না?
খায়। রিকশাওয়ালা বা ঠেলাওয়ালাদের সঙ্গে খায়। অ্যারেস্ট হলে থানার ওসি বা কনষ্টেবলের সঙ্গে খায়।
হিমুরা অ্যারেস্ট হয়?
বলিস কী, অ্যারেক্ট হবে না? হিমুদের জীবনের একটা অংশ কাটে জেল— হাজতে। পুলিশের গুতা, বুটজুতার লাগি তাদের নিত্যসঙ্গী। কোনো অপমানই তাদের গায়ে লাগে না।
টগর, ইতস্তত করে বলল, এখন কি তোমার ভয় লাগছে, মামা?
শুভ্র বলল, ভয় লাগবে কেন?
টগর বলল, এই যে আজ সন্ধ্যায় তোমার বিচার হবে, এই জন্য? তোমাকে হয়তো এ বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
শুভ্ৰ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দিক বের করে। সব ঠাই মোর ঘর আছে, আমি সেই ঘর ফিরি খুঁজিয়া। হিমুরা পৃথিবীর কোনো কিছুকে ভয় পায় না। হিমুদের প্রথম যে জিনিসটা জয় করতে হয় তার নাম হলো ভয়।
তুমি ভয় জয় করেছ?
সব ভয় এখনো জয় করতে পারিনি। যেমন ধরা উড়ন্ত তেলাপোকা এখনো ভয় পাই। অন্ধকার ঘরে ঘুমাতে পারি না। বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এই দুটা ছাড়া বাকি ভয় মোটামুটি জয় করে ফেলেছি। তুই এখন আমার সামনে থেকে যা তো!
যাব কেন?
তোর সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। অকারণে কথা বলাও হিমুদের জন্য নিষিদ্ধ। সামনে থেকে যা। তবে এক কাপ চা এনে দিতে পারিস। তোর কাছ থেকে চায়ের কথা শোনার পর থেকে চা খেতে ইচ্ছা করছে। হিমুদের উচিত খাদ্যবিষয়ক সমস্ত লোভ জয় করা। এখনো পারছি না।
টগর বলল, তুমি যে এতক্ষণ ধরে এক জায়গায় বসে আছ, তোমার খারাপ লাগছে না?
শুভ্র বলল, খারাপ লাগার ব্যাপারটাই হিমুদের মধ্যে নেই। কোনো কিছুতেই তাদের খারাপ লাগে না। প্রচণ্ড শীতে তারা খালি গায়ে বরফের চাঙের ওপর শুয়ে থাকতে পারে। আবার কম্বল গায়ে দিয়ে চৈত্র মাসের রোদে হাঁটাহাটি করতে পারে। ঠাণ্ডা-গরম হিমুদের কাছে কোনো ব্যাপার না। হিমুরা শারীরিক বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
টগর বলল, মামা, আমাকে কবে হিমু বানাবে?
শুভ্ৰ বিরক্ত গলায় বলল, তোর এখনো অনেক সময় লাগবে। সামান্য ট্যারা হওয়া শিখতে পারলি না। হিমু হবি কীভাবে? যা চা নিয়ে আয়।
টগর রান্নাঘরের দিকে গেল। টগরের মা সুলতানা মুরগির মাংস নিয়ে কী যেন করছেন। দুজন কাজের বুয়া তাকে সাহায্য করছে। সুলতানাকে খুবই হাসিখুশি দেখাচ্ছে। নিশ্চয়ই নতুন ধরনের কিছু রান্না করছেন। নতুন ধরনের রান্নাবান্না করার সময় তাকে খুবই হাসিখুশি দেখায়। তার জীবনের শখ তিনি একটা রেস্টুরেন্ট দেবেন। রেস্টুরেন্টের নাম উনুন। সেই রেস্টুরেন্টে স্পেশাল আইটেম ছাড়া অন্য কোনো আইটেম থাকবে না।
সুলতানা স্পেশাল আইটেম রান্না খুব পছন্দ করেন। প্রায়ই তিনি স্পেশাল কিছু না কিছু বানাচ্ছেন। বেশির ভাগ সময়ই জিনিসটা হয়- অদ্ভুত এবং খেতে বিস্বাদ। টগরের বাবা চৌধুরী আলতাফ হোসেন এমনিতে খুব হাসিখুশি মানুষ। একেবারেই রাগেন না। শুধু সুলতানা নতুন কিছু রান্না করেছেন শুনলে চট করে রেগে যান। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া যা হয় নতুন রান্না নিয়ে হয়। যেমন টগরের বাবা কোনো একটা খাবার মুখে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, এটা কী? এই বস্তুটার নাম কী?
সুলতানা হাসিমুখে বললেন, ডেজার্ট। আপেল দিয়ে কানানো ডেজার্ট। আমেরিকানরা বলে, অ্যাপল টার্ট।
ডেজার্ট তাহলে ঝাল কেন?
সামান্য গোলমরিচ দিয়েছি, এই জন্য বোধ হয় ঝাল হয়েছে। এরকম রাণী রাগী চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছ কেন? খেতে ইচ্ছা না হলে খেও না।
মিষ্টি জাতীয় একটা খাবার রান্না করছ, এর মধ্যে ঝাল কেন? ঝাল দিয়ে কেউ মিষ্টি রান্না করে?
চিৎকার করছ কেন? বললাম তো খেতে ইচ্ছা না হলে খাবে না। তোমাকে তো আমি সাধাসাধি করছি না।
ঝাল রসগোল্লা, মিষ্টি গরুর মাংসের কালিয়া এইসব বন্ধ করে নরমাল কোনো রান্না রাঁধতে পার না? সাধারণ ভাত-মাছ, আলুভর্তা, ডাল।
সাধারণ খাবার তো রোজই হচ্ছে। দু-একটা স্পেশাল রান্না হবে না?
না, হবে না। আবার যদি স্পেশাল কিছু রান্না করো, আমি অবশ্যই বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাব।