হবে স্যার।
গুড, ভেরি গুড।
চৌধুরী আজমল হোসেনের দীর্ঘদিনের রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। উপাস দিবসের দুপুরের কলা-পাউরুটি উধাও হওয়ার পর তিনি নিয়ম ভঙ্গ করে ভারপেট ভাত-মাছ-মাংস খেয়েছেন। দিবানিদ্রার অভ্যাস তার কোনোকালেও ছিল না। আজ বিছানায় শুয়ে লম্বা ঘুম দিলেন। সন্ধ্যাবেলায় স্বপ্ন দেখে ঘুম ভািঙল। সেই স্বপ্নও বিচিত্র স্বপ্ন। তিনি চৌবাচ্চায় গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবিয়ে বসে আছেন। তার সমস্ত শরীর মাছের, শুধু মাথাটা মানুষের। পত্রিকার লোকজন তার ছবি তুলছে। ইন্টারভিউ নিচ্ছে। টিভি ক্যামেরার ক্রুও চলে এসেছে। দাড়িওয়ালা এক উপস্থাপক, দেখতে খানিকটা যুবক বয়সের রবীন্দ্রনাথের মতো, তাকে প্রশ্ন করছে। তিনি আবার আগ্রহের সঙ্গে সব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন।
আপনার খাদ্য কী?
মানুষ যা খায় আমিও তা-ই খাই। ভাত-মাছ, ফলমূল।
কত দিন হলো আপনি পানিতে আছেন?
পাঁচ বছর।
আপনার শরীর কি আগেই মাছের মতো ছিল, নাকি পরে শরীরে আঁশ গজিয়েছে?
সঠিক বলতে পারছি না।
মৎস্যজীবন কি আপনার ভালো লাগছে?
জি, ভালো লাগছে, তবে ছোট জায়গা তো! আমাকে বড় কোনো পুকুরে বা নদীতে ছেড়ে দিলে আমি আরো ভালো থাকব বলে আমার ধারণা।
আপনি কি দর্শকদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
অবশ্যই বলব। কেন বলব না!
দয়া করে ইংরেজি এবং বাংলা, দুই ভাষাতেই কথা বলুন। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়বে। সেখানে আপনি যদি বাংলায় কথা কম বলে ইংরেজি বেশি বলেন, তাহলে ভালো হয়। আরেকটা কথা, আপনি যখন কথা বলবেন তখন আপনার লেজটা নাড়াবেন, লেজ দিয়ে পানিতে বাড়ি দেবেন। তাহলে দৃশ্যটা দৃষ্টিনন্দন হবে। তবে বেশি শব্দ করবেন না। তাহলে আপনার কথা শোনা যাবে না। আপনি কি রেডি?
জি রেডি।
লাইটস, ক্যামেরা রোলিং অ্যাকশান!
অ্যাকশানে তিনি লেজ দিয়ে পানিতে প্ৰচণ্ড বাড়ি দিলেন।
এই শব্দে তার নিজের ঘুম ভেঙে গেল।
শব্দের উৎস লেজের বাড়ি না, টগর দাড়াম করে দরজা খুলে ঢুকেছে। সে খুবই উত্তেজিত। উত্তেজনায় সে সামান্য তোতলাচ্ছে।
বড় চাচা, চলে গেছে!
কী চলে গেছে?
কলা।
কী বলছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। গুছিয়ে বলো।
তিনটা টেবিলে আপনি প্লেটে করে কলা-পাউরুটি রেখেছিলেন। পাউরুটি ঠিকই আছে। শুধু কলা নেই। তিনটা প্লেটে শুধু পাউরুটি পড়ে আছে। বড় চাচা, এটা কি কোনো ভৌতিক কাও?
আজমল হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আজ কী বার?
বুধবার।
আজ তোমার টিচার আসার কথা না?
স্যার এসেছেন।
যাও পড়তে বসে। ভৌতিক ঘটনার অনুসন্ধান তোমাকে করতে হবে না। আমি দেখছি, ব্যাপারটা কী। তুমি নীলুকে নিয়ে পড়তে বসো। মা বাড়িতে নেই, এই সুযোগে তোমরা সারা দিন ছোটাছুটি, হৈচৈ করেছ। এখন স্যারের কাছে পড়তে বসবে।
জি আচ্ছা। চেয়ার-টেবিল কি কলঘরে নিয়ে যেতে বলব?
তার মানে কী? চেয়ার-টেবিল কলঘরে নিতে হবে কেন?
স্যার তো চৌবাচ্চায় বসে আছেন।
বড় চাচা হতভম্ব হয়ে বললেন, চৌবাচ্চায় বসে আছেন মানে!
উনি দুপুরে এসেছেন। তখন থেকেই চৌবাচ্চায় আছেন। ছোট মামার সঙ্গে গল্প করছেন। পান খাচ্ছেন। বড় চাচা, চেয়ার-টেবিল কি কলঘরে নিতে বলব? টেবিল না নিয়ে শুধু চেয়ার নিলেও হয়।
আজমল হোসেন গম্ভীর গলায় বললেন, তোমাদের আজ পড়তে বসতে হবে না। সামনে থেকে যাও। তোমার মাকে টেলিফোন করে এক্ষুনি বাড়িতে আসতে বলো।
এখানে যে ভূতের উপদ্রব্ব, সেটা কি মাকে বলব?
তাকে বলবে যে বড় চাচা তোমাকে এক্ষুনি আসতে বলেছে। তোমার বাবা কোথায়? তাকে তো আমি দুপুরেই টেলিফোন করে আসতে বললাম।
বাবা এসেছিল। আপনি ঘুমুছিলেন বলে আপনাকে আর জাগাইনি।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
টিভি দেখতে পারি বড় চাচা?
যা ইচ্ছা করো। আমার সামনে থেকে যাও। সফুরাকে বলে আমাকে চা দিয়ে যেতে।
টগর ঘর থেকে বের হতেই নীলু চুকাল। বড় চাচার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে দাদিয়া ডাকে। এক্ষুণি যেতে বলেছে।
চৌধুরী আজমল হোসেন চিন্তিত মুখে মায়ের ঘরের দিকে রওনা হলেন। কোনো একটা সমস্যা বাড়িতে অবশ্যই হচ্ছে। সমস্যার শুরুটা কোথায়? চৌবাচ্চায়? রকিবউদ্দিন ভূইয়ার মতো সিরিয়াস টাইপ একজন হেডমাষ্টার কেন চৌবাচ্চায় গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকবে? হারানো কলা তিনটা এখন কোথায়? চৌবাচ্চার পানিতে? পান-ছেঁচনি তো সেখানেই পাওয়া গিয়েছিল।
টগরের দাদিয়া পা ছড়িয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসেছেন। তার হাতে পান-ছোঁচনি। তিনি আগ্রহের সঙ্গে পান ছেচে যাচ্ছেন। তঁর মুখ হাসি হাসি। যেন মজার কোনো একটা ঘটনা কিছুক্ষণ আগে ঘটেছে। সেই স্মৃতি তার মাথায়। তাঁর হাসিখুশি অবস্থান বিপজ্জনক। এর মানে তিনি কারো ওপর রেগে আছেন। চরম রাগ।
আজমল হোসেন মায়ের পাশে বসতে বসতে বললেন, আজ। আপনার শরীর কেমন?
ফাতেমা বেগম পান ছেচা বন্ধ করে কঠিন গলায় বললেন, তুই পাইছস কী? মানুষ মারতে চাস?
মানুষ কেন মারব?
শুভ্ৰ যে পানিতে ড়ুব দিয়া আছে, তারে তুলনের ব্যবস্থা নিছস? তুই এই বাড়ির ‘পরধান’। তুই দেখবি না? এমন ভালো একটা ছেলে। যেমন লেখাপড়ায়, তেমন আদব-কায়দায়। হে পইড়া আছে পানিতে।
তোলার ব্যবস্থা করছি।
ব্যবস্থা আবার কী? এক্ষণ যা। হাতে ধইরা টান দিয়া তোল।
মা শুনেন, হাত ধরে টান দিয়ে যদি তুলি তাহলে আবারো কোনো একদিন সে পানিতে থাকতে চলে যাবে কিংবা এই ধরনের উদ্ভট কিছু কাণ্ড করবে। পানি থেকে তোলার আগে তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে যে, ব্যাপারটা হাস্যকর পাগলামি ছাড়া কিছু না। তার মাথা থেকে হিমুর ভূত দূর করতে হবে।