টগরের এই কাজের একটাই উদ্দেশ্য, মজা করা। পান-ছেচনি কোথাও নেই, পাওয়া গেল চৌবাচ্চায়। সেখানে গেল কীভাবে? সবাই তা নিয়ে নানান গবেষণা করবে। গবেষণা করে কিছুই বের করতে পারবে না। মজা এইখানেই।
দাদিয়ার স্মৃতিশক্তি খারাপ হওয়ায় একটা বড় সুবিধা হয়েছে। তিনি বলছেন আজ সকালেও পান-ছোঁচনি দিয়ে পান খেয়েছেন। কাল রাতে যে টগর তার ঘরে অনেকক্ষণ ছিল এটাও হয়তো তার মনে থাকবে না।
তোমার মা তোমাকে নিষেধ করে গেছেন?
জি বড় চাচা।
মায়ের কথা শোনা কর্তব্য, তারপরও আমি চাচ্ছি যে তুমি তোমার ছোট মামার কাছে যাবে। তার সঙ্গে কথা বলবে। সে আসলে কী ভাবছে তা জেনে এসে আমাকে জানাবে।
স্পাইদের মতো?
স্পাইদের মতো বলা ঠিক হবে না। স্পাইগিরি কোনো ভালো কাজ না। তার মানসিকতার দিকে লক্ষ্য রাখা এখন আমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আজকের দিনটা দেখে ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করব।
টগর চিন্তিত গলায় বলল, ছোট মামা কি পাগল হয়ে গেছেন?
বড় চাচা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে পাগল হয়নি। তবে অন্য সবাইকে পাগল বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
টগর বলল, হিমুদের তাই নিয়ম।
হিমুদের তাই নিয়ম মানে?
হিমুরা নিজেরা ঠিক থাকে, তবে তাদের আশপাশে যারা থাকে তারা বেঠিক হয়ে যায়।
কে বলেছে?
ছোট মামা বলেছেন।
বড় চাচা গম্ভীর গলায় বললেন, হুম।
আর তখনি হৈচৈ উঠল, পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে। পান-ছেঁচনি পাওয়া গেছে। পানির চৌবাচ্চায় পাওয়া গেছে। বড় চাচা টগরকে পাঠালেন পুরো ঘটনা জেনে তাকে জানাতে। টগর খুবই আগ্রহের সঙ্গে ছুটে গেল।
চৌধুরী আজমল হোসেন চিন্তিত মুখে দোতলার বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। পান-ছেচনি চুরি যাওয়া এবং উদ্ধারের ঘটনা কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। তার মা পান-ছোঁচনি শেষ ব্যবহার করেন আজ ভোরে ফজরের নামাজের পর। দ্বিতীয়বার যখন ব্যবহার করতে যান তখন দেখা যায় বালিশের কাছে পানছেচনি নেই। এই সময়ের ভেতর তার ঘরে কেউ ঢোকেনি। যে পান-ছোঁচনি নিয়েছে সেই বা কেন এত জায়গা থাকতে চৌবাচ্চায় রাখবে। সেই চৌবাচ্চায় যেখানে একজন গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবিয়ে বসে আছে। যে কেউ শুনলে ভাববে ভৌতিক কাণ্ড।
নীলু তার মায়ের ঘরের আয়নার সামনে বসে আছে। সে এখনো সাজতে শুরু করেনি। কান ফুটো করার চিন্তাটা তার মাথায় ঢুকে গেছে। তবে এই কান ফুটানোয় সে এখন আর টগরকে রাখতে চাচ্ছে না। নিজে নিজেই করতে চাচ্ছে। শুধু সাহসে কুলাচ্ছে না। সে একটা বুদ্ধি বের করেছে, বাবার স্ট্যাপলারে কানের লতি ঢুকিয়ে চাপ দেবে। গত বছর মায়ের সঙ্গে সে কান ফুটো করতে গিয়েছিল। সেখানে দেখেছে। এরকম একটা যন্ত্র দিয়েই কান ফুটো করা হয়। নীলু। বাবার পেপার স্ট্যাপলারটা এনে মায়ের ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে রাখল। যদি সাহসে কুলায় তাহলে সে কাজটা করবে। তার মনে হচ্ছে না যে সাহসে কুলাবে।
টগর গেছে কলঘরে। সে ছোট মামার সঙ্গে গল্প করছে।
ছোট মামা, ভূত বলে কি কিছু আছে?
শুভ্ৰ বলল, অবশ্যই আছে।
তবে যে সবাই বলে, ভূত বলে কিছু নেই!
বললেই হবে? ভূত আছে। প্রেতি আছে। শাকচুন্নি স্কন্ধ কাটা সবই আছে তবে তারা আছে মানুষের মনে। বাস্তবে নেই। এ জন্যই বাস্তবে কখনো ভূত পাওয়া যায় না, শুধু ভূতের গল্প পাওয়া যায়।
তাহলে আমাদের বাসায় ভৌতিক কাণ্ডগুলো কীভাবে ঘটছে?
কী ভৌতিক কাণ্ড?
যেমন ধর, দাদিয়ার র্দাতের পাটি চুরি গেল, পাওয়া গেল অন্য একটা জায়গায়। পান-ছোঁচনি চুরি গেল, পাওয়া গেল চৌবাচ্চায়।
আপাতত ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলেই ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।
সত্যি!
অবশ্যই সত্যি। তোর দাদিয়ার পান-ছেচনি নিশ্চয়ই হেঁটে হেঁটে চৌবাচ্চায় আসেনি। কোনো একজনকে আনতে হয়েছে।
সেই কোনো একজন কি ভূত?
ভূত হবে কেন?
টগর চিন্তিত গলায় বলল, আচ্ছা ছোট মামা, হিমুরা কি ভূত-প্ৰেত এসব বিশ্বাস করে না?
হিমুরা কঠিনভাবে কোনো কিছু বিশ্বাস করে না, আবার অবিশ্বাসও করে না। হিমুদের জগতের অবস্থান বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে।
কিছু তো বুঝতে পারছি না!
বয়স হোক। বয়স হলে বুঝবি। এখন সামনে থেকে যা। আর বকবক করতে ভালো লাগছে না।
টগর বলল, তুমি কত দিন পানিতে থাকবে?
শুভ্র বলল, জানি না।
জানি না, কারণ আমি হিমু। হিমুরা আগে থেকে কিছু ঠিক করে রাখে না। তারা ভাবে যখন যা হওয়ার হবে, আগে থেকে ঠিক করে রাখাব কিছু নেই। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে পানি থেকে উঠে পড়তে পারি, আবার পাঁচ বছরও থাকতে পারি।
কত বছর বললে?
পাঁচ বছর।
টগর, বড় চাচার কাছে গেল। ছোট মামার সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হয়েছে তা বড় চাচাকে জানাতে হবে। সে এখন বড় চাচার স্পাই। স্পাইদের খবর আদান-প্ৰদান করতে হয়।
আজমল হোসেন পড়ার টেবিলের সামনে বসে আছেন। তাকে দুপুরের খাবার দেয়া হয়েছে। একটা কলা, এক স্নাইস রুটি। তিনি যখন কলার খোসা ছাড়াতে শুরু করেছেন তখন টগর চুকাল। শুকনো মুখে বলল, বড় চাচা, আমি ছোট মামার কাছে গিয়েছিলাম। উনি কত দিন পানিতে থাকবেন জিজ্ঞেস করলাম, ছোট মামা বললেন, পাঁচ বছর থাকবেন।
কত বছর থাকবে?
পাঁচ বছর।
কী বললি? পাঁচ বছর! পাঁচ বছর পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকবে?
জি।
আচ্ছা, ঠিক আছে, তুই যা। যা ভেবেছিলাম অবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি খারাপ।