তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলার জন্য এসেছি। তোমার কি সময় আছে?
অবশ্যই আছে। আপনি বসুন। আপনি আসবেন, আমি জানতাম। আমি আপনার জন্য চেয়ার আনিয়ে রেখেছি।
চৌধুরী সাহেব ভুরু কুঁচকে দেখলেন চৌবাচ্চার ডান দিকে একটা বেতের চেয়ার। ইজিচেয়ার ছাড়া এই একটি চেয়ারেই তিনি বসেন। তিনি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকার এই ব্যাপারটা যে হাস্যকর তা কি তোমার মনে হয় না?
শুভ্র বলল, সব মানুষই এমন কিছু কাজ করে যা অন্যের কাছে হাস্যকর মনে হয়।
উদাহরণ দাও।
আপনাকে দিয়েই উদাহরণ দিই। আপনি মৌন দিবস করেন, উপাস দিবস পালন করেন, এসব দিবস পালন অন্যের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে।
আমি এসব দিবস উদ্দেশু নিয়ে পালন করি। শরীরের পরিপাক যন্ত্রকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য উপাস দিবস। মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়ার জন্য মৌন দিবস। তোমার এই পানি দিবসের উদ্দেশ্য কী?
এটা ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে ফেলে, শরীরে ও মনে তার প্রভাব লক্ষ্য করাই আমার উদ্দেশ্য।
কিছু লক্ষ্য করেছ?
জি।
কী লক্ষ্য করলে তুমি বলো আমি শুনি।
আমি লক্ষ্য করছি যে আমার শরীর হালকা হয়ে যাচ্ছে। ওজন কমে যাচ্ছে।
তার মানে কী?
এটা ব্যক্তিগত অনুভূতির ব্যাপার। অনুভূতি আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না।
তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝতে চাচ্ছি।
বুঝতে হলে আমার অবস্থানে আপনাকে আসতে হবে।
পানিতে নামতে বলছ?
জি।
আজমল হোসেন উঠে দাঁড়ালেন। তার মেজাজ খুবই খারাপ, তারপরও নিজেকে সামলালেন। শান্ত গলায় বললেন, এই বিষয়ে পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব।
টগর ও নীলুনাশতা খেতে বসেছে। দুজনই আনন্দিত। আজ তাদের স্কুলে যাওয়া বাতিল হয়েছে। মা বাড়িতে নেই। নটা-সাড়ে নটার মধ্যে বাবাও থাকবেন না। নীলু। তার প্রোগ্রাম ঠিক করে রেখেছে। সারা দিন টিভি অন থাকবে এবং কার্টুন চ্যানেল চলতে থাকবে, তবে সে যে সারা দিন কার্টুন দেখবে তা না। যখন ইচ্ছা! হবে দেখবে, ইচ্ছা না হলে চলে যাবে। গল্পের বই পড়বে। মায়ের ওয়ারড্রোব থেকে একটা শাড়ি এনে পরবে। সফুরা বুয়া পরিয়ে দেবে। ঠোটে লিপষ্টিক দিয়ে সাজবে। তার কানে এখনো ফুটো করা হয়নি। ফুটো থাকলে কানো দুল পরত। নীলুর হঠাৎ মনে হলো, ফুটো করে ফেললে কেমন হয়?
টগরকে বললে সে একটা না একটা ব্যবস্থা করে ফেলবে। এসব ব্যাপারে তার খুব মাথা খেলে।
টগর, আজ সারা দিন কী করবে তা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি। তবে বেশির ভাগ সময় ছোট মামার সঙ্গে কাটাবে তা প্ৰায় নিশ্চিত। তার ইচ্ছা ছোট মামার সঙ্গে পানিতে নেমে যাওয়া। মা থাকলে নামা যেত না। এখন সেই সমস্যা নেই। পানিতে বসে গল্পের বই পড়তে পারলে ভালো হতো। একটা কোনো বুদ্ধি কি বের করা যায় যে, গল্পের বইটা পানিতে ড়ুবিয়ে রাখা যাবে কিন্তু বই নষ্ট হবে না।
দাদিয়ার ঘরে হৈচৈ হচ্ছে। ছোটখাটো সমস্যাতেই হৈচৈ হয়। আজ মনে হয় বড় কোনো সমস্যা। দাদিয়া সমানে চিৎকার করছেন। টগর নীলুর দিকে তাকিয়ে বলল, দাদিয়ার কী হয়েছে?
নীলু বলল, তার পান ছেচার যন্ত্র পাওয়া যাচ্ছে না।
যন্ত্রটা তো সব সময় তার বালিশের কাছেই থাকে। এটা কে নিবে?
নীলু বলল, আমাদের বাড়িতে ভৌতিক কিছু আছে। কয়েক দিন পরে এই যন্ত্রটাই অন্য কোনোখানে পাওয়া যাবে। তোমার মনে নাই দাদিয়ার দাঁত পাওয়া যাচ্ছিল না, তারপর পাওয়া গেল বড় চাচার দ্রুয়ারে। এইগুলা সব ভূতের কাণ্ড।
টগর বলল, ভূত এরকম করবে। কেন?
নীলু বলল, ভূতরা এসব করে খুব মজা পায়। মানুষদের ঝামেলায় ফেলতে পারলেই তাদের আনন্দ।
ছোট চাচার কাছে যাওয়ার আগে টগর দাদিয়ার ঘরে উঁকি দিল। করুণ মুখ করে বলল, দাদিয়া, কী হয়েছে?
দাদিয়া চেঁচিয়ে উঠলেন, দেখ না কী হইছে, চোর। আমার পান-ছেঁচনি নিয়া গেছে।
টগর, বলল, তোমার ঘর ভর্তি এত ভালো ভালো জিনিস। সব ফেলে চোর কেন তোমার পান-ছোঁচনি নিবে?
চোর কী জন্য নিছে সেইটা চোর জানে। আমি কী জানি?
কখন থেকে পাও না?
সকালে একবার পান খাইলাম, তার পরে আর নাই। যা এখন সামনে থাইক্যা যা। অখন কেউ কথা কইলেই ত্যক্ত লাগে। সারা দিন পান না
টগর, বড় চাচার ঘরে উঁকি দিল। আজ বুধবার বড় চাচার উপাস দিবস এটা টগরের মনে আছে। উপাস দিবসে বড় চাচার মেজাজ খারাপ থাকে। টগরের ধারণা মেজাজ খারাপ থাকার কারণ চা না খাওয়া। দাদিয়ার যেমন পান খেতে না পারলে মেজাজ খারাপ থাকে, বড় চাচারও সে রকম চা খেতে না পারায় মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপ মানুষের ঘরে না ঢোকা ভালো। বৃহস্পতিবার বড় চাচার ঘরে ঢুকতে তার ভালো লাগে। সেদিন তার মৌন দিবস। ঘরে ঢুকে হৈচৈ করলেও বড় চাচা কিছু বলেন না। মাঝে মাঝে শুধু রাগী চোখে তাকিয়ে থাকেন। হাত ইশারা করে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলেন। টগর এমন ভঙ্গি করে যেন সে ইশারা বুঝতে পারছে না।
সে বড় চাচার ঘরে উঁকি দিল। বড় চাচা সঙ্গে সঙ্গে ডাকলেন, টগর।
টগর বলল, জি।
এসো, ভেতরে এসো।
টগর ঘরে ঢুকল।
বড় চাচা বললেন, তোমার ছোট মামার সঙ্গে কি আজ সকালে তোমার
দেখা হয়েছে?
টগর বলল, জি না।
তোমার এত খাতিরের মানুষ। সকাল থেকে পানিতে পড়ে আছে, এখনো দেখা করনি কারণটা কী?
টগর, বলল, মা নিষেধ করে গেছেন।
টগরের এই কথাটা মিথ্যা। মা কিছুই বলে যাননি। টগর যে এখনো ছোট মামার কাছে যায়নি তার কারণ আছে। দাদিয়ার পান-ছেচনি ছোট মামার চৌবাচ্চায় ড়ুবে আছে। সেটা উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত চৌবাচ্চার ধারে-কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। কাজটা টগর করেছে গত রাতে। দাদিয়ার পানের ছেচনি অতি গোপনে চৌবাচ্চায় ফেলে এসেছে। দাদিয়া টের পাননি। ছোট মামাও বুঝতে পারেননি।