টগর বলল, তুমি এখন যাবে?
হ্যাঁ, এখনি যাব। তোমরা দুই ভাইবোন। যদি এখন আমাকে আটকাবার জন্য কান্না শুরু করো তাতেও লাভ হবে না। আমি ফাইন্যাল ডিসিশন নিয়ে নিয়েছি। বাবারা কান্দবে না। প্লিজ।
টগর ও নীলু দুজনের কারোরই কান্না আসছে না। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া মায়ের জন্য নতুন কিছু না। মাসে এক-দুইবার এই ঘটনা ঘটবেই। একই ঘটনার ফল দুই ভাইবোনের জন্যই শুভ। মা বাড়ি ছেড়ে গেলে পরদিন স্কুলে যেতে হয় না। টগরের স্কুল যে খুব অপছন্দ তা না, তবে আগামীকাল স্কুলে যেতে না হলে খুব ভালো হয়। আগামীকাল চৌবাচ্চায় ছোট মামার দ্বিতীয় দিন পার হবে। দ্বিতীয় দিনে অনেক মজা হওয়ার কথা।
সুলতানা বললেন, যাই বাবারা?
দুই ভাইবোন একসঙ্গে বলল, আচ্ছা।
আনন্দে তাদের চোখ চিকমিক করছে।
সুলতানা বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে শুভ্রের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
শুভ্ৰ চৌবাচ্চার দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছে। তার হাতে একটা ইংরেজি বই। বইটার নাম Straw Dogs. সে বেশ মন দিয়ে বই পড়ছে। বই পড়ার সুবিধার জন্য একটা টেবিল ল্যাম্প আনা হয়েছে।
সুলতানা কলঘরে ঢুকে কড়া চোখে শুভ্রের দিকে তাকালেন। শুভ্র বলল, এই ভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
সুলতানা বললেন, তুই কি পানিতেই থাকিবি উঠবি না?
শুভ্ৰ বলল, কেন উঠাব না। অবশ্যই উঠব।
কখন উঠবি?
সময় হলেই উঠব। এখনো সময় হয়নি।
সময় কখন হবে?
তা বলতে পারছি না। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি রেগে আছ। সমস্যা কী? তোর কারণে তোর দুলাভাই আমাকে পাগল বলেছে।
শুভ্র বলল, এতে তো রাগ করার কিছু নেই। তোমার কারণে যদি দুলাভাই তোমাকে পাগল বলতেন তাহলে রাগ করার বিষয় থাকত।
সুলতানা বললেন, তুই যে কী পরিমাণ যন্ত্রণা করছিস তা তুই জানিস না।
শুভ্র বলল, আমি তো কোনো যন্ত্রণাই করছি না। নিজের মনে পানিতে বসে আছি। তোমরা গায়ে পড়ে যন্ত্রণা টেনে আনছ।
শুধুমাত্র তোর কারণে আমি আজ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ঐ বাড়িতে আর ফিরব না।
শুভ্ৰ হেসে ফেলল।
সুলতানা বললেন, হাসছিস কেন?
হাসছি কারণ তুমি কাল দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসবে। তোমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া এবং বাড়িতে ফিরে আসা রুটিন কর্মকাণ্ড।
আমার সবই রুটিন আর তোর সব কিছু রুটিন ছাড়া?
শুভ্ৰ মিষ্টি করে হাসল।
সুলতানা বললেন, হাসবি না। আমার কথার জবাব দে।
শুভ্র বলল, জবাব দেব না। কারণ তুমি রেগে আছ। হিমুরা রাগত মানুষদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করে না। তারা রাগত মানুষদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।
শুভ্ৰ আবারো হাসল।
সুলতানা কলঘর থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে উঠলেন।
চৌধুরী আজমল হোসেন
আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাতটা পঁচিশ মিনিট।
চৌধুরী আজমল হোসেন ঝিম ধরে তার বিখ্যাত ইজিচেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে (ইজিচেয়ারের হাতলে) এক কাপ চা। তিনি এখনো চায়ের কাপে চুমুক দেননি। চা ঠাণ্ডা হয়ে উপরে সব পড়ে গেছে। ইজিচেয়ারের অন্য হাতলে আজকের খবরের কাগজ। সেই কাগজের ভাঁজ এখনো খোলা হয়নি।
প্রথম কাপ চা খাওয়ার ঠিক আধঘণ্টা পরে তিনি দ্বিতীয় কাপ চা খান। সাতটা ত্ৰিশ মিনিটে কাজের মেয়ে সফুরা দ্বিতীয় চা নিয়ে ঢুকল। তিনি সফুরার দিকে তাকিয়ে বললেন, শুভ্ৰ কি এখনো পানিতে?
সফুরা ভীত গলায় বলল, জি খালুজান।
কী করে?
চা খায়।
সারা রাত পানিতে ছিল?
জি।
রাতে ভাত খেয়েছিল?
জি না, রুটি মাংস। আপনার নাশতা কখন দিব খালুজান?
আজ কী বার?
বিষ্যুদবার।
বৃহস্পতিবারে কি আমি নাশতা খাই?
জে না। খালুজান আমার ভুল হয়েছে।
মানুষ ভুল করবেই। ভুল থেকে মানুষ শিখবে সেটা হলো মানবধর্ম। তুমি ভুল করেই যাচ্ছ। ভুল থেকে কিছু শিখতে পরছ না। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তুমি যাও।
বৃহস্পতিবার চৌধুরী আজমল হোসেনের উপাস দিবস। সপ্তাহে একদিন তিনি এই উপাসব্রত পালন করেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কিছু খান না।
দুপুরে একটা কলা এবং এক স্নাইস রুটি খান। রাতে চায়ের কাপে এক কাপ দুধ।
শুক্রবার তার মৌন দিবস। এই দিবসে সূর্য উদয় থেকে সূর্যস্ত পর্যন্ত তিনি কারো সঙ্গে কথা বলেন না। গত দু বছর ধরে এই জিনিস চলছে।
সফুরা বলল, চা কি ফিরত নিয়া যামু খালুজান?
বৃহস্পতিবারে দুপুরের আগে কখনো কিছু খেয়েছি?
জে না।
তাহলে তুমিই বলো ইজিচেয়ারের হাতলে কাপের পর কাপ জড়ো করার কোনো যুক্তি আছে? ঠিক আছে তুমি যাও।
সফুরা পালিয়ে বাঁচল। চৌধুরী আজমল হোসেন আরো কিছুক্ষণ ঝিম-ধরা ভাব নিয়ে চেয়ারে বসে থাকলেন। শুভ্রর সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। কী বলবেন তা মাথায় গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন। একটা বুদ্ধিমান ছেলে কোনোরকম কারণ ছাড়া পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে আছে। এই বিষয়টা তঁাকে প্রচণ্ড বিরক্ত করছে। বিরক্ত মানুষ লজিক দিতে পারে না। তাকে লজিক দিয়ে শুভ্রকে তার হাস্যকর কাণ্ডকারখানা বুঝিয়ে দিতে হবে। এলোমেলোভাবে শুভ্রর সঙ্গে কথা বললে হবে না। নিজেকে তার খানিকটা এলোমেলো লাগছে।
সাতটা চল্লিশ মিনিটে তিনি ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠলেন। তিনি নিজেকে পুরোপুরি গুছিয়ে নিয়েছেন।
শুভ্ৰ চৌবাচ্চায় পা ছড়িয়ে বসে বেশ আরাম করেই চা খাচ্ছে। সে টগরের বড় চাচার দিকে হাসিমুখে তাকাল।
শুভ্র, কেমন আছ?
জি, ভালো আছি।
রাতে পানিতেই ছিলা?
জি।
ঘুম ভালো হয়েছে?
ঘুম ভালো হয়নি। হওয়ার কথাও না। ছাড়া ছাড়া ঘুম হয়েছে। তবে শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই।