দাদিয়া, প্যাঁক বাবা কি এখনো মানুষকে প্যাঁক খাওয়াচ্ছেন?
আরে না। অনেক দিন আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে তার কবরে মাজার শরিফ করেছে। লোকে বলে প্যাঁক বাবার মাজার। চৈত্র মাসের সাত তারিখ উরস হয়। উরসের দিন প্যাঁক বাবার ভক্তদের জন্য বিরাট পিতলের হাঁড়িতে তেল মরিচ, পেঁয়াজ রসুন দিয়া মাটি রান্না হয়। ভক্তরা ভক্তি নিয়া খায়।
তুমি কোনো দিন খেয়েছ দাদিয়া?
আমি কি বোকা যে মাটি খাব। তয় তোর দাদা খেয়েছে। তার কাছে শুনেছি খাইতে নাকি ভালো। মাষকলাইয়ের ডাইলের মতো স্বাদ।
টগর বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, আরেকটা গল্প বলো দাদিয়া।
টগরের দাদিয়া অতি বিরক্ত হয়ে বললেন, বিনা অজুতে বিছানায় উঠছস। নাম বিছনা থাইক্যা। অনেক গফ করছি। আর না।
সুলতানা বেশি রাত জগতে পারেন না। নটা থেকে তার হাই উঠতে থাকে। চেষ্টা করেন সাড়ে নটার মধ্যে শুয়ে পড়তে। বেশির ভাগ সময়টা বিছানায় যেতে রাত দশটা বেজে যায়। আজ এগারোটা বেজে গেছে। তিনি এখনো ঘুমুতে যেতে পারেননি। কারণ শুভ্র এখনো চৌবাচ্চার পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছে। রাতের খাবার সেখানেই খেয়েছে।
টগরের বাবা আলতাফ হোসেন শুভ্রের চৌবাচ্চার ব্যাপারটা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে মোটামুটি বড় ধরনের ঝগড়া করেছেন। ঝগড়া শুরু হয়েছে খাবার টেবিলে। সূত্রপাত করেছে টগর। তিনি দেখলেন টগর কিছু খাচ্ছে না। তিনি তার স্বভাবসুলভ হাসিমুখে বললেন, বাবা তুমি খাবে না?
টগর, বলল, না।
খাবে না কেন?
খিদে হয়নি?
টগর, বলল, আমি ছোট মামার সঙ্গে চৌবাচ্চায় ডিনার করব। আলতাফ হোসেন সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে বললেন, সে কি এখনো চৌবাচ্চায়? এখনো পানিতে খাবি খাচ্ছে?
টগর বলল, খাবি খাচ্ছে না বাবা। পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছেন।
এই যন্ত্রণা কতক্ষণ চলবে?
টগর বলল, এখনো বলা যাচ্ছে না, বাবা। তিন-চার মাসও চলতে পারে। হিমুদের তো কোনো টাইম টেবিল নেই।
নীলু ভাত মাখতে মাখতে বলল, তিন-চার মাস পানিতে থাকলে মামার গায়ে মাছের মতো আঁশ গজিয়ে যাবে, তাই না। বাবা?
আলতাফ হোসেন জবাব দিলেন না। তিনি খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলেন। নীলু বলল, আচ্ছা বাবা, ছোট মামা যদি চার মাস পানিতে থাকে, তাহলে কি গিনেজ বুক অব রেকর্ডে মামার নাম উঠবে?
আলতাফ হোসেন বললেন, উঠবে কি না জানি না, তবে পাগলামির যদি কোনো বুক অব রেকর্ডস থাকে। সেখানে অবশ্যই উঠবে। তোমার বড় চাচা কি জানেন সে এখনো পানিতে?
টগর বলল, জানেন। উনি রাত আটটার সময় একবার দেখে এসেছেন।
কিছু বলেননি?
না।
কিছুই বলেননি?
বড় চাচা শুধু বলেছেন, কেমন চলছে জল-খেলা?
ছোট মামা বলেছেন, ভালো চলছে।
আলতাফ হোসেন গভীর মুখে খাওয়া শেষ করলেন। শোয়ার ঘরে গিয়ে সুলতানাকে বললেন, কিছু মনে কোরো না, পাগলামিটা কি তোমাদের বংশগত ব্যাধি?
সুলতানা বললেন, তার মানে?
এই যে একজন গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবিয়ে বসে আছে। শোনা যাচ্ছে সে এই অবস্থায় চার মাস থাকবে।
সুলতানা বললেন, শুভ্ৰ এই কাজটা করছে বলে তুমি পুরো বংশ তুলে গালি দেবো? শুভ্র ছাড়া আর কেউ কোনো পাগলামি করেছে। আমি করেছি?
তুমি তো বলতে গেলে প্রতিদিনই করো।
প্রতিদিন কী কবি?
মাংসের হালুয়া বানাও। মাছের মিষ্টি মোরব্বা। রসগোল্লা দিয়ে ঝাল তরকারি। কাঁচা মরিচের আইসক্রিম।
সুলতানা। থমথমে গলায় বললেন, কবে করলাম এইসব?
রোজই তো করো। মাথার দোষ না থাকলে কেউ এই জাতীয় রান্না করতে পারে না। সুস্থ মাথায় এ ধরনের রেসিপি আসতে পারে না।
আমি অসুস্থ, আমি মেন্টাল পেশেন্ট আর তোমরা সবাই সুস্থ?
আলতাফ হোসেন জবাব দিলেন না। তার ক্ষীণ সন্দেহ হলো, রাগারগিটা বেশি হয়েছে। সুলতানা বললেন, জবাব দিচ্ছ না কেন? আমি এবং আমার ভাই আমরা দুজন উন্মাদ আর তোমরা সুস্থ মাথা সুস্থ মনের অধিকারী একদল সুপার হিউমেন বিয়িং। তোমাদের মতো সুপার মানুষদের সঙ্গে তো আমার বাস করা সম্ভব না। আমি এক্ষুনি বিদায় হচ্ছি।
কোথায় যাবে?
কোনো একটা পাগলা-গারিদ খুঁজে বের করব। পাগলা—গারদে ভর্তি হয়ে যাব। ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো।
রাতদুপুরে কোথায় যাবে? পাগলামি কোরো না তো।
আমি পাগল, আমি তো পাগলামি করব। তোমার মতো সুস্থামি করতে পারব না। গাড়ি বের করতে বলো।
তুমি বলো। আমাকেই ড্রাইভার ডেকে আনতে হবে কেন।
বেশ, আমিই বলছি। আপনার বিশ্বাস না হলে টগর আর নীলুকে জিজ্ঞাস করুন। ওদের সামনেই বলেছে। সুলতানা গাঁটগট করে শোয়ার ঘর থেকে বের হলেন। পনেরো মিনিটের মধ্যে সুটকেস গুছিয়ে তার শাশুড়ির কাছে বিদায় নিতে গেলেন। সুলতানা কঁদো কঁদো গলায় বললেন, মা আমি চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না। পায়ের কাছে মাথা কুটলেও ফিরব না। আমাকে কিনা পাগল বলে।
ফাতেমা বেগম অবাক হয়ে বললেন, তোমাকে কে পাগল বলেছে?
টগরের বাবা বলেছে।
ফাতেমা বেগম উৎসাহিত গলায় বললেন, তাহলে শোনো এক পাগলের গফ। নাম জালাল মুনশি। পরে তার নাম হয়ে গেল প্যাঁক বাবা পীর। আমি তখন ছোট…
সুলতানা বললেন, মা, এই গল্প আমি অনেক দিন শুনেছি। আর শুনতে পারব না। গল্প শোনার মুড আমার নেই। আমি আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি।
আচ্ছা মা, যাও আল্লাহ হাফেজ।
সুলতানা টগর ও নীলুর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ধরা গলায় বললেন, বাবারা শোনো, আমি চলে যাচ্ছি। এই বাড়িতে আবার ফিরে আসব সেই সম্ভাবনা নাই বললেই হয়। তোমরা ভালো থেকো। ঠিকমতো পড়াশোনা কোরো। দুইজনই লক্ষ্মী হয়ে থাকবে। কেমন?