আই উইল ভিজিট মাই এলড়েষ্ট ডটার।
মোটামুটি হয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করছি, তুমি এই ফাঁকে তোমার বাবার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে রাখে। কোন পারমিশন বুঝতে পারছ তো? তোমাদের গাড়ি কিছুক্ষণ বেশি রাখব সেই পারমিশন।
বুঝতে পারছি, স্যার। পারমিশন বানান করতে হবে?
না, বানান করতে হবে না।
রকিবউদ্দিন ভূইয়া ছাত্রের দিকে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন।
টগরদের বাড়ির চৌবাচ্চাঘর মূলত কাপড় ধোয়া এবং বাসন মাজার কাজে ব্যবহার করা হয়। চৌবাচ্চা ভর্তি করা হয় পানিতে। সারা দিন সেই পানি ব্যবহার করা হয়। আজ দুপুর থেকে বাসন মাজা এবং কাপড় ধোয়া বন্ধ। চৌবাচ্চায় গলা ড়ুবিয়ে শুভ্র বসে আছে। কাজের মেয়েরা শুরুতে খুব উকিঝুকি দিচ্ছিল। এখন তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শুভ্র মামা চুপচাপ পানিতে বসে আছে এই দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না।
হেডমাষ্টার রকিবউদ্দিন ভূঁইয়া যখন টগরকে নিয়ে চৌবাচ্চাঘরে ঢুকলেন তখন রাত আটটা বাজে। তিনি শুভ্ৰকে দেখে কিছুক্ষণ। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। শুভ্ৰ বলল, কেমন আছেন, স্যার?
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, ভালো। তুমি বয়সে অনেক ছোট, তোমাকে তুমি করে বলি—কোনো অসুবিধা আছে?
কোনো অসুবিধা নেই।
এসএসসি পরীক্ষায় তুমিই তো ফার্স্ট হয়েছিলে?
জি স্যার।
পেপারে ছবি দেখেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল চোখে সমস্যা আছে। চোখ তো দেখি ঠিক আছে।
ও!
স্যার, আপনাকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। কী নিয়ে চিন্তা করছেন?
হেডমাষ্টার সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, তুমি পানিতে কতক্ষণ থাকবে?
শুভ্র বলল, কতক্ষণ থাকব কোনো ঠিক নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে উঠে পড়তে পারি। আবার ধরুন মাসখানেকও থাকতে পারি।
ও!
হিমুদের কাছে সময় বলে কিছু নেই। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ—সব তাদের কাছে একাকার।
ও!
হেডমাস্টার সাহেব তাকিয়ে আছেন। শুভ্র বলল, স্যার, আপনি কি কিছু বলবেন?
হেডমাষ্টার সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, কী বলব বুঝতে পারছি না। মনে হয় কিছু বলার ছিল।
বলুন।
মনে পড়ছে না।
মনে পড়লে বলবেন। আমি পানিতেই আছি।
ও!
শুভ্র বলল, জলচিকিৎসার নাম কি শুনেছেন?
ও!
প্রাচীন ভারতে জলচিকিৎসার ব্যাপার ছিল। বৈদিক চিকিৎসকরা জলচিকিৎসার ব্যবস্থা দিতেন। অনেক ক্রনিক ব্যাধি এই চিকিৎসায় আরাম হতো। ইউনানী চিকিৎসায় রক্তক্ষরণ ব্যবস্থা যেমন ছিল, জলচিকিৎসাও ছিল। ইউনানী চিকিৎসা কী বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। গ্রিক চিকিৎসা।
জলচিকিৎসায় বাত কি সারে?
বাত ব্যাধি অবশ্যই সারে।
কতক্ষণ থাকতে হয় পানিতে?
যত বেশি সময় থাকবেন, চিকিৎসা ততই ভালো হবে। জলের প্রাণীরা দীর্ঘায়ু হয় এটা তো নিশ্চয়ই জানেন?
জানি না তো।
কচ্ছপের কথা। ধরুন। কচ্ছপ তিন শ সাড়ে তিন শ বছর বাঁচে। পানিতে বাস করে বলেই বাঁচে।
হুঁ।
স্যার, আপনার কি বাত আছে?
গেঁটেবাত আছে।
জলচিকিৎসার ব্যাপারটা মাথায় রাখতে পারেন, স্যার।
হুঁ।
রকিবউদ্দিনকে খুবই চিন্তিত মনে হলো। টগর তাকে গাড়ি পর্যন্ত উঠিয়ে দিতে গেল। রকিবউদ্দিন টগরের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছোট মামার কথা রাখতেও পারছি না। আবার ফেলে দিতেও পারছি না। চিন্তার উদ্রেককারী বিষয়।
টগর বলল, জি স্যার, চিন্তার উদ্রেককারী।
চিন্তার উদ্রেককারী ইংরেজি কী?
জানি না স্যার।
থট প্রভোকিং। তুমি পড়ার টেবিলে যাও, থট প্রভোকিং এই সেনটেন্সটা পঞ্চাশবার লেখো। তাহলে আর ভুলবে না। প্রভোক থেকে এসেছে প্রভোকিং। প্রেজেন্ট কনটিনিউয়াস। ডিকশনারি থেকে প্রভোক বানান শিখে রাখবে।
জি আচ্ছা, স্যার।
টগর, পঁচিশবার থট প্রভোকিং লেখার সময় তার দাদিয়া তাকে ডেকে পাঠালেন।
দাদিয়া বাঁশের চোঙায় পান ছেঁচছিলেন। টগরকে দেখে পান ছেঁচা বন্ধ করে বললেন, এইসব কী শুনতাছি?
টগর বলল, কী শুনছ?
তোর ছোট মামার নাকি মাথা আউল হইছে। পানির মধ্যে ড়ুব দিয়া আছে।
মাথা আউলা হয়নি দাদিয়া। উনি হিমু হয়েছেন।
টগরের দাদিয়ার মাথায় একবার যে কথা ঢুকে যায় সেটাই থাকে। কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে তা দূর করা যায় না। তিনি পান ছেঁচতে ছেঁচতে বললেন, মাথা কি পুরোপুরি গেছে?
মাথা ঠিক আছে, দাদিয়া।
ছোটবেলায় দেখছি আমরার গোরামের জলিল মুনশির মাথা খারাপ হইছিল। হে অবশ্যি পানিত থাকত না। সারা শইল্যে প্যাঁক মাইখ্যা বইস্যা থাকত। প্যাঁক চিনস?
চিনি।
তরার শুদ্ধ ভাষায় প্যাঁকরে কয় কেদো।
কেদো না দাদিয়া, কাদা।
ওই একই কথা। কেদো আর কাদা একই জিনিস। তারপর শোন, জলিল মুনশি কী করত। কেউ তার ধার দিয়া গেলে সুন্দর কইরা বলত, ভাইসব, একটু প্যাঁক খাইবেন? খাইয়া দেখেন সোয়াদ আছে। কিছু আমার সামনে বইস্যা খান আর কিছু বাড়িতে নিয়া যান। পুলাপানরে দিবেন।
টগর বলল, কেউ কি সেই কাদা খেত?
দাদিয়া নড়েচড়ে বসলেন। ছেঁচা পান খানিকটা মুখে দিয়ে বললেন, অখন শোন আসল গল্প। মানুষ জাত বড়ই আজব জাত। একজন দুইজন কইরা সেই প্যাঁক খাওয়া শুরু করল।
কেন?
তারা ভাবল জলিল মুনশি পীর হইয়া গেছে। পীর-ফকির এই করম করে। মাইনষেরে প্যাঁক-কাদা গু-গোবর খাইতে বলে। বছর না ঘুরতেই জলিল মুনশির নাম হইল প্যাঁক বাবা। দূর-দূরান্তের মানুষ তার কাছ থাইক্যা প্যাঁক নিতে আসে। তার সামনে বসে প্যাঁক খায়। মাটির হাঁড়িতে কইরা প্যাঁক নিয়া যায় পুলাপানরে খাওয়াইতে।
বলো কী।
দুনিয়া বড় আজবরে টগর। দুনিয়া বড় আজব। দুনিয়া আজব। দুনিয়ার মানুষ তারচেয়েও বড় আজব।