ছোটকন্যার কথায় বিরক্ত হন সারদা, আঃ বন্নো, অত কথায় তোর কী কাজ, যা বলব, করবি ব্যস। যা তো এখেন থেকে।
সত্যিই লক্ষ্মীজনার্দনের চলে যাওয়ার দুঃখ ভুলতে পারেননি সারদাসুন্দরী। গোপনে ওবাড়িতে গৃহদেবতার জন্য পুজো পাঠান আবার স্বামীর বেম্মো উপাসনাতেও যোগ দেন। কেন, গিরীন তো বেম্মে হয়েছে আবার দেবপূজাও করে। তাতে দোষ হয় না? প্রথম প্রথম পূজা তুলে দেওয়ার কথা ভাবেননি কত্তা, কেবল দুগ্নাপুজোর সময়ে বাড়ি থাকতেন না, বাইরে ভ্রমণে চলে যেতেন। সেই দুঃখে সারদা পুজোর আনন্দে অংশ নিতে পারতেন না, সবাই যখন আনন্দে মাতোয়ারা, তিনি ঘরের কোণে বন্দি করে রাখতেন নিজেকে। যোগমায়া এসে টানাটানি করত পুজোর দালানে যাওয়ার জন্য। একবার কত্তামশায় পশ্চিমে বেড়াতে গেছেন আর তখন শুরু হয়ে গেল সেপাই বিদ্রোহ। কোনও চিঠি নেই, খবর নেই, চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন সারদা। কত্তা হিমালয়ে বেন্মোচিন্তা করছেন আর আমি এদিকে হেদিয়ে মরি। তবু সে একরকম ছিল, পুজো হত, উনি পুজোয় থাকতেন না। তাই বলে পুজো উঠিয়ে দিতে হবে? এমন কথা বললেন বলেই তো গিরীন আর যোগমায়া লক্ষ্মীজনার্দনের মূর্তি নিয়ে আলাদা হলেন। তাই তো আমি বেম্মে উপাসনার বেদিতে বসেও নিজের ইষ্টমন্ত্র জপ করি আবার কত্তার ধম্মোকথাও শুনি। আকবরের হারেমে বসে যোধাবাই যেমন শিবপুজো করতেন।
এর জন্য স্বামীর প্রতি সারদার প্রেম অবশ্য কমেনি। এখনও কর্তা বাড়ি থাকলে সারদা উদগ্রীব হয়ে থাকেন তার রাতের ডাকের জন্য। ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়লে সেই ডাক আসে। সারদা গা ধুয়ে উজ্জ্বল রঙের একটি নরম তাঁতের শাড়ি পরেন, কানে গলায় একটু আতর মাখেন। কখনও চুলে একটা বেলকুঁড়ির মালা জড়ান, কখনও না হলেও চলে। এটুকুই তাঁর সাজ। বাড়ির বউদের মতো এক গা গয়না পরে, খোঁপায় গোরেমালা, আলতা সিঁদুরে পরিপাটি সাজ তার দরকার নেই। কত্তাও সাদাসিধে সাজই পছন্দ করেন। সারা বছর পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান আর ফিরে আসেন বাড়ির টানে, সারদার টানে। প্রথম যেবার দেবেন ঠাকুর বিষয়বৈরাগ্যে গঙ্গাবক্ষে দিন কাটাবেন স্থির করলেন, সারদা কেঁদেকেটে তার সঙ্গে যাওয়ার বায়না জুড়লেন। দেবেন্দ্র তার জন্য গঙ্গার বুকে পিনিস ভাড়া করলেন, তিন শিশুপুত্রকে নিয়ে কত্তার পিছু পিছু সেই পিনিসে গিয়ে উঠলেন অসূর্যম্পশ্যা সারদা। সেই তাঁর অবারিত গঙ্গাদর্শন। সান্ত্বনা এই যে বেম্মেজ্ঞান কত্তাকে বিবাগী করেনি। বরং বছর বছর সারদার কোলজুড়ে সন্তান এসেছে। সবাই বাঁচেনি, সবার দিকে সমান নজর দিতেও পারেন না সারদা। কর্তার সেবা করে আর সোহাগ পেয়েই খুশি থাকেন স্বামীসোহাগিনী।
১৮৪০ থেকে পরবর্তী তেইশ বছরে নয় ছেলে ও ছয় মেয়ের জন্ম দিয়েছেন সারদা, তাদের মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র দশজন। দ্বিজেন্দ্রর জন্মর দু’বছর পরে সত্যেন এল, তার দু’বছর পরে হেমেন, একবছর দশমাসের মাথায় বীরেন, আরও দু’বছর পরে কন্যা সৌদামিনী, তারপর জ্যোতিরিন্দ্র। দ্বিতীয় কন্যা সুকুমারী মাত্র চোদ্দো বছর বয়সেই মারা যায়। তার পরের ছেলে পুণ্যেন্দ্র জলে ডুবে মারা গেল মাত্র ছ বছরে। এরপর তিনটি কন্যা শরৎকুমারী, স্বর্ণকুমারী ও বর্ণকুমারী। সোমেন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পরেও জন্মেছিল বুধেন্দ্র, কিন্তু সেও শৈশবে মারা যায়। এতগুলি ছেলেমেয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল দাসী ও চাকরদের হাতে। সেকালের ধনীঘরের নিয়ম ছিল জন্ম থেকেই শিশুরা ধাইয়ের স্তন্যদুগ্ধে লালিত হত। প্রত্যেক শিশুর জন্য একটি স্তন্যদাত্রী ধাই ও একটি পালিকা দাসী নিযুক্ত হত, জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে শিশুদের বিশেষ সম্পর্ক থাকত না। সারদার ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রেও তাই হয়ে আসছে। তবে যতদিন যোগমায়া একসঙ্গে ছিলেন, তাঁর সান্নিধ্যই ছিল ছোটদের আশ্রয়, তার কাছেই ছিল তাদের যত আবদার আহ্লাদ। এখনও তাঁরা তাই মেজোকাকির অভাব বোধ করেন। যদিও পরে জন্মানোর জন্য বর্ণ, সোম ও রবি মেজোকাকির স্নেহের ভাগ থেকে একেবারেই বঞ্চিত। তাঁদের কোনও অভাব বোধ নেই কারণ তাঁরা জানেনই না মাতৃস্নেহের ঘনিষ্ঠ রূপ কীরকম।
ইতিমধ্যে সারদার কুটনোর আসরে এসে উপস্থিত হয়েছেন সদ্যবিবাহিতা স্বর্ণকুমারী। ঠাকুরবাড়ির অন্য বিবাহিতা মেয়েদের মতো তিনি পিতৃগৃহে থাকেন না। ঠাকুররা একে পিরালি তায় ব্রাহ্ম। এঘরে বিয়ে হলে বাপের ঘরে ত্যাজ্য হতে হয়। মেয়ে-জামাইরা তাই বিয়ের পর এখানেই থাকেন। ছেলের বউ এলে তার বাপের বাড়ির লোকদেরও ঠাঁই দিতে হয়। স্বর্ণর স্বাধীনচেতা বর জানকীনাথ ঘোষালকেও তাঁর বাবা ত্যাগ করেছিলেন কিন্তু প্রথম থেকেই জানকীর শর্ত ছিল যে তিনি ব্রাহ্ম হবেন না, ঘরজামাইও থাকবেন না। দুটি শর্তই সসম্মানে মঞ্জুর করেন দেবেন্দ্রনাথ। কিন্তু স্বর্ণ নিজের আলাদা সংসার থেকে প্রায় রোজ জোড়াসাঁকোয় ঘুরে যান। আজ তিনি পরেছেন পেস্তা রঙের ক্রেপ শাড়ি, তাতে পারশি এমব্রয়ডারি করা পাড়। গায়ে লেস লাগানো জ্যাকেট। স্বর্ণ নিজেও বোম্বাই-ধাঁচের শাড়ি পরা আয়ত্ত করেছেন। এব্যাপারে জ্ঞানদার সহযোদ্ধা তিনি। ব্রোচ লাগানো ছোট আঁচলে ঘোমটা টানতে অসুবিধে বলে মাথায় একটি কারুকাজ করা টুপি পরা চালু করেছেন, এটা তার নিজস্ব উদ্ভাবন। স্বর্ণ এসে একটি জলচৌকিতে বসে গল্প করেন। সবাই কৌতূহল নিয়ে তাঁকে দেখতে থাকে।