কাদম্বরী হেসে বললেন, হদিশ করার সময় কোথায় তোমার?
রবি বলল, আমি দোষ করেছি। পথভ্রান্ত হয়েছিলাম, কিন্তু সেই দোষ কি একেবারে ক্ষমার অযোগ্য?
কাদম্বরী বললেন, ক্ষমার প্রশ্ন আসেই না, রবি। তুমি কি সর্বক্ষণ বাড়িতে বসে থাকবে নাকি আমার জন্য? আমি বুঝি তা বুঝি না?
রবি বলল, একটা লাভ হল কি জান, নতুনবউঠান, এই কয়েক মাস অন্যদের কাছে ঘুরে ঘুরে আমার উপলব্ধি হল, তোমার কাছাকাছি থাকতেই আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে।
দুদিন বাদে রবির জ্বর ছাড়ল। কাদম্বরীর ছাড়ল তার পরেরদিন। আবার শনিবারে দুজনেরই একসঙ্গে জ্বর এল। নীলমাধব ডাক্তার দুজনকেই ওষুধ দিলেন। সেই ওষুধে জ্বর ছাড়ে, আবার আসে। এই পালা জ্বর ক্রমে গা-সহ্য হয়ে গেল।
জ্বর যখন থাকে না তখন রবি লিখতে বসে যায়, কাদম্বরী ঘর গুছোতে শুরু করেন। সন্ধের পর দুজনে মুখোমুখি বসে গল্প করে কিংবা গান গায়। রবি তার সদ্য লেখা কবিতাটা পড়ে শোনায়। কাদম্বরী রবির সব লেখার প্রথম পাঠিকা কিংবা শ্রোতা।
.
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই রবির কানে আসে কী একটা পাঠের শব্দ। কে পড়ছে, এটা তো বউঠানের গলা না! কৌতূহলী হয়ে দ্রুত বারান্দা পার হয়ে বউঠানের ঘরে ঢুকে পড়েন তিনি।
রবি ঘরে ঢুকতেই মালিনী পুঁথিপত্র গুটিয়ে উঠে পড়তে যায়। রবি তার আগেই জানতে চান, কী বই পড়া হচ্ছিল মালিনী? তাতে যেন আমার নাম শুনলাম।
রবির হঠাৎ আবির্ভাবে মালিনীর চোখের ঘোর কেটে গেল, কে যেন ধাক্কা দিয়ে তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। রবিবাবু এ-সব শুনলে যে তাকে পাগল ভাববেন!
মালিনী পুঁথিটি ঝুলিতে পুরে ফেলতে চায়, কিন্তু রবি তরিৎগতিতে প্রায় ছোঁ মেরে সেটা হাতে তুলে নিলেন। তিনজনের অবাক দৃষ্টির সামনে রবির হাত লেগে ভূর্জপত্রের পৃষ্ঠাগুলি ঝুরঝুর করে গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেল।
১৬. বিনোদিনী
ঠাকুরবাড়ির বাঁধাধরা গণ্ডিতে জ্ঞানদা ক্রমশই হাঁপিয়ে উঠছিলেন। ছেলেমেয়েকে নিয়ে কিছুদিন তিনি সিমলা পাহাড়ে বাসা বাঁধলেন। তার। ধারণা হয়েছে, কলকাতার বিশেষত জোড়াসাঁকো বাড়ি থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল। সিমলার স্কুলেই ভরতি হল বিবি ও সুরেন কিন্তু তাদের আসল শিক্ষা ঘরের মধ্যে, মায়ের কাছে।
জ্ঞানদা নিজের প্রিয় কাব্যসাহিত্য পড়ে শোনান ছেলেমেয়েকে। তার পছন্দ শেলির সেনসিটিভ পয়েন্ট আর দি ক্লাউড, টেনিসনের মে কুইন আর দি ব্রুক। আবার ভারতী পত্রিকা থেকেও পড়ে পড়ে শোনান নতুন লেখা। সুরেন বিবির প্রতিদিনের আর-একটি কাজ হল সমবয়সি ভাইবোনদের আঁকাবাঁকা অক্ষরে চিঠি লেখা। এভাবেই ব্যাকরণের গতেবাধা নিয়ম এড়িয়ে তাদের শিক্ষা শুরু হয় প্রাণের স্পর্শে, সাহিত্যের উত্তেজনায়।
জ্ঞানদার আর-একটি প্রিয় কবিতা টমাস মুরের লাল্লারুখ। মুরের কবিতা ঠাকুরবাড়িতে খুব চর্চা হত, আইরিশ মেলোডির কারণেই। সত্যেন পাঠিয়ে দিয়েছেন হান্স আন্ডারসন আর গ্রিমভাইদের রূপকথা, সুরেন বিবি রাতদিন কাড়াকাড়ি করে বইদুটি নিয়ে। বড়দের পছন্দের সব উত্তরাধিকার ছড়িয়ে পড়তে লাগল সুদূর সিমলায় বসে থাকা ছোট ছোট দুটি বালক-বালিকার তন্ত্রীতে।
কিছুদিন পর ছেলেমেয়ে নিয়ে একা একা পাহাড়ে থাকার চেয়ে কলকাতায় নেমে আসাই সুবিধেজনক মনে হল জ্ঞানদার। অবশ্য ঠাকুরবাড়িতে নয়, আলাদা বাড়ি ভাড়া করে ওঁরা উঠে এলেন ভবানীপুরের বির্জিতলাও পাড়ায়। মস্ত দোতলা বাড়ি, বিলিতি স্টাইলে মাঝখানে বড় হলঘর, তার চারপাশে চারটে ঘর, গাড়ি-বারান্দার ওপরে আরও একখানা। এখন এরকম বাড়িতে থাকতেই আরাম পান জ্ঞানদা।
ইংল্যান্ডে বাস করার ফলে তার অভ্যেসগুলি পালটে গেছে। সুরেন বিবিরা ম্যাট-ন্যাপকিন সাজানো ডাইনিং টেবিলে না বসলে খেতে পারে না। ঠাকুরবাড়ির সনাতন পরিবেশে তাদের অসুবিধে হচ্ছিল। তা ছাড়া কূটকচালি-ভরা মেয়েমহলের দমবন্ধ করা পরিবেশ এখন আর জ্ঞানদার সহ্য হয় না। ছেলেমেয়েরা ওখানে বেড়ে উঠুক সেটা তিনি কখনওই চান না।
জ্ঞানদার বাড়িই হয়ে উঠল রবি-জ্যোতির ঘরোয়া আড্ডার নতুন ঠিকানা। ভারতীর মিটিং থেকে পিয়ানো বাজিয়ে গান রচনার আসর– সবকিছুই এখন এই বাড়িতে। এখানেই জড়ো হন অক্ষয়, প্রিয়নাথ, বিহারীলালের মতো বন্ধুজন। এই আড্ডার নিয়মিত সদস্য স্বর্ণকুমারী ও জানকীনাথ। স্বর্ণকুমারীকে ঠাকুরবাড়িতে রেখে জানকীনাথ বিলেত গিয়েছিলেন পড়তে, কিন্তু ঊর্মিলার মৃত্যুর খবরে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কখনও কখনও সৌদামিনী বা বর্ণকুমারীও এসে হাজির হন। বাদ শুধু একজন, সদর স্ট্রিটের বাড়ির নতুনবউ। জ্ঞানদার বাড়িতে তার আমন্ত্রণ থাকে না। জ্ঞানদা নিজেই এ-সব গানবাজনা কবিতার আসরের মধ্যমণি হয়ে থাকতে ভালবাসেন, সেখানে কোনও প্রতিদ্বন্দিনীকে তিনি ডেকে আনতে চান না। তিনি সবাইকে উৎসাহ দেবেন, তার প্রেরণায় সবাই নাটক বা গীতিনাট্যে মেতে উঠবে, তার সঙ্গেই রবি-জ্যোতিরা সাহিত্য আলোচনা করবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এইজন্য তিল তিল করে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন জ্ঞানদা।
স্বর্ণ যে দাদাদের সঙ্গে প্রকাশ্য সভায় গিয়ে কবিতা পড়ছে বা কাদম্বরী যে ডিঙিনৌকোয় চড়ে জ্যোতির বন্ধুদের গান শুনিয়ে মুগ্ধ করছে, এসবের সুযোগ কে করে দিয়েছে? চোদ্দো-পনেরো বছর আগের সেই সময়ে তিনি জোর করে অন্ধকারের চৌকাঠ ভেঙে না বেরলে এতদিনেও ওরা আলোর মুখ দেখত না। জোড়াসাঁকোর চারদেওয়ালে বন্দি হয়ে থোড়-বড়ি-খাড়া নিয়েই জীবন কাটাতে হত।