বলে।
এই ধরনের কথা বলে এমন কাউরে যদি পাও আমার কাছে নিয়া আসবা, আল্লাহপাকের কেরামতি বুঝায়ে দিব। তোমার জানামতো এমন কেউ আছে?
একজন আছে। তার নাম বল্টু। তিনি বলেন, ঈশ্বর নাই, আত্মা নাই।
হুজুর তৃতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ঈশ্বর নাই বলে—এটা ঠিক আছে। ঈশ্বর হিন্দুদের বিষয়। তবে আত্মা নাই যে বলে—এটা ভয়ঙ্কর কথা। তাকে আমার কাছে নিয়া আসবা, আত্মা গুলায়ে তারে খাওয়ায়ে দিব। বদমাইশ!
হুজুরের কথা শেষ হওয়ার আগেই তার আরেকটা অদৃশ্য আঙুল ফুটল।
হুজুর তৃপ্তিমাখা গলায় বললেন, শুনেছ?
জি।
আগের চেয়েও শব্দে ফুটেছে, ঠিক না?
জি ঠিক।
আল্লাহপাকের কেরামত বুঝতে পারছ?
আমি পা দাবাতে দাবাতে বললাম, আল্লাহপাকের না, আপনারটা বুঝেছি। আমি যখন অদৃশ্য আঙুল টান দেই তখন আপনি নিজের হাতের আঙুল মটকান। সেই শব্দ হয়। ম্যাজিক প্ৰথমবার করা ঠিক আছে, দ্বিতীয়বার ঠিক না। দ্বিতীয়বারে ধরা খেতে হয়। ভবিষ্যতে আপনি পায়ের অদৃশ্য আঙুল ফোটানোর ম্যাজিক দ্বিতীয়বার দেখাবেন না।
হুজুর বিমর্ষ হয়ে গেলেন। আমি তার অদৃশ্য পা দাবাতেই থাকলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে, তবে এখন বের হওয়া যাবে না। গলিতে হাঁটুপানি। অচেনা গলির কোথায় ম্যানহোল কে জানে! হাঁটতে গেলে ম্যানহোলে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
হুজুর গলা খাঁকারি দিলেন। আমি বললাম, কিছু বলবেন?
হুজুর বললেন, তুমি পা দাবাচ্ছ আরাম পাচ্ছি। তোমার উপর সমানে দোয়া বকসে দিচ্ছি।
ভালো করেছেন।
তোমার মতো একটা চালাক চতুর ছেলে আমার দরকার। আগে একজন ছিল, নাম হেকিম। কাজে কর্মে ভালো ছিল। কেরাতের গলা চমৎকার। মাজারের নিয়মকানুন জানে। কী করলে মাজারের আয় হয়, তাও জানে। জানবে না কেন, মাজারে মাজারে খাদেমের অ্যাসিসটেন্টগিরি করাই তার কাজ। হেকিম কী করেছে শোনো, দানবাক্সের তালা ভেঙে টাকা পয়সা নিয়ে পালায়ে গেল। আমি মাফ করতে গিয়েও করি নাই। আল্লাহপাকের দরবারে নালিশ দিয়ে দিয়েছি। ইশারায় পেয়েছি, আল্লাহপাক নালিশ কবুল করেছেন। এখন যে-কোনো একদিন দেখা যাবে, হেকিম এসে আমার পা চাটছে।
আমি বললাম, আপনার তো পা নাই, চাটবে কীভাবে?
হুজুর হতাশ গলায় বললেন, সেটাও একটা কথা। পা না চাটলেও হেকিম আবার যদি আসে, ক্ষমা চায়, ক্ষমা করে দিব। নবীজীকে একবার জিজ্ঞাস করা হলো, হুজুরে পাক! দুশমনকে কতবার ক্ষমা করব? নবীজী বললেন, প্রথম দফায় সত্তর বার। ভালো কথা, তুমি কি আমার এখানে চাকরি করবে?
বেতন কত দিবেন?
হুজুর বিরক্ত গলায় বললেন, মাজারের খাদেমের চাকরিতে বেতন জিজ্ঞাস করা মাজারের প্রতি অসম্মান। বলো, আস্তাগাফিরুল্লাহ!
আস্তাগাফিরুল্লাহ!
তোমাকে মাজারের আয়ের অংশ দিব।
মাজারের কোনো আয় আছে বলে তো মনে হয় না।
হুজুর বললেন, কথা সত্য। এখন আয় নাই। দানবাক্স বলতে গেলে খালি। একটা জিনিস খিয়াল রাখতে হবে। মাজারের চন্দ্রের সাথে যোগাযোগ। চন্দ্রের কারণে জোয়ারভাটা হয়। মাজারেও জোয়ারভাটা আছে। এখন ভাটা চলতেছে।
আপনি তো দুপুরে কিছু খান নাই। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা কী?
আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি। উনি একটা ব্যবস্থা নিবেন। দেখবা সন্ধ্যার পর কোনো ভক্ত খানা নিয়া চলে আসবে। অনেকবার এ রকম হয়েছে। কথা নাই, বার্তা নাই, বিয়ে-বাড়ির খানা আসে; আকিকার খানা আসে, সুন্নতে খৎনার খানা আসে। সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকো, দেখো কী হয়।
আমি সন্ধ্যা পার করলাম। মাজার ঝাঁট দিলাম। দানবাক্সের ওপর ধুলা বসেছিল, ধুলা পরিষ্কার করলাম। মাজারের ভেতর পানি জন্মেছিল, পানি বের করার ব্যবস্থা করলাম। হুজুর বললেন, মোমবাতি জ্বালাও। বেজোড় সংখ্যায় জুলতে হবে, তিন অথবা পাঁচ। আল্লাহ একা বলে তিনি বেজোড় পছন্দ করেন।
তাহলে একটা জ্বালাই?
জ্বালাও, একটাতেও চলবে।
রাত আট্টার দিকে সন্দেহজনক চেহারার একজন মাজারে ঢুকল। মাজারের পেছনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে চলে গেল। হুজুর বললেন, দানবাক্সে কিছু দিয়েছে?
আমি বললাম, না।
হুজুর চাপা গলায় বলল, বদমাইশ।
রাত দশটা বাজল, খানা নিয়ে কাউকে আসতে দেখা গেল না। হুজুরের নির্দেশে দানবাক্স খোলা হলো। ভাঙতি পয়সা আর নোট মিলিয়ে একাত্তর টাকা পাওয়া গেল। হুজুর বললেন, দুই প্লেট ভুনা খিচুড়ি আর হাঁসের মাংস নিয়া আসো। বৃষ্টি বাদলার দিনে ভুনা খিচুড়ির উপর জিনিস নাই। রাত অধিক হয়ে গেছে, তুমি থেকে যাও। বিছানা বালিশ সবই আছে। হেকিম বিছানা-বালিশ নেয় নাই। রাত বারোটার সময় আমি জিগিারে বসব। আমার সঙ্গে জিগিারে সামিল হতে পারো। ব্যাংকের একাউন্টে সোয়াব বাড়বে। কি রাজি আছ?
জি হুজুর।
হুজুর গলা নামিয়ে বললেন, রাতে ঘুম ভাঙলে যদি দেখ অস্বাভাবিক লম্বা কিছু মানুষ নামাজে দাঁড়ায়েছে, তখন ভয় পাবা না। এরা ইনসান না, জীন। মানুষের বেশ ধরে আসে, মাজারে মাজারে নামাজ পড়ে।
হুজুর খুব আরাম করে ভুনা খিচুড়ি খেলেন। খিচুড়ি খেতে খেতে বললেন, পায়ের আঙুল ফোটার বিষয়ে তুমি যা বলেছি তা ঠিক আছে। আমি কায়দা করে হাতের আঙুল ফোটাই। তবে শুরুতে পায়ের আঙুল ফুটতো। ভাত হাতে নিয়া মিথ্যা বলব না। তিন মাস ফুটেছে, তারপর বন্ধ। আমার কথা কি বিশ্বাস করলা?
জি হুজুর।
আমার সাথে থেকে যাও, আমার সেবা করো, বিনিময়ে অনেক বাতেনি জিনিস তোমারে শিখায়ে দিব। পরি দেখেছি কখনো?