- বইয়ের নামঃ ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন
- লেখকের নামঃ মনোরঞ্জন ব্যাপারী
- প্রকাশনাঃ দে পাবলিকেশন্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০০. লেখকের দু’কথা
ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন – মনোরঞ্জন ব্যাপারী
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমি সুপ্রভা মজুমদার স্মারক পুরষ্কার প্রাপ্ত
দে পাবলিকেশনস ১৩, বঞ্চিম স্যাল স্ট্রট কলকা-৭০০০৫৭
.
উৎসর্গ : আমার এগিয়ে চলার পথের পরমপ্রেরণা দাত্রী মহাশ্বেতা দেবী ও শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষকে
.
মনোরঞ্জন ব্যাপারী আমার অনেক বছরের চেনা সেই লেখক, যাকে আমি লেখক হয়ে উঠতে দেখেছি। লিখতে লিখতে লেখক হয়। এইকথাও মনোরঞ্জন নিজের জীবন ও কর্মে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
“ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন” নামকরণটিও সার্থক। আজকের সমাজে স্বীকৃতি পেতে হলে জন্মসুত্রে কেউ ব্রাহ্মণ, না চণ্ডাল, সে বিচার করার মানসিকতা আর নেই। তবু, জন্মসূত্রে কেউ চণ্ডাল হয়ে থাকেন, তাঁর এগিয়ে যাবার পথটা হয়তো আজও কুসুমাস্তীর্ণ নয়।
মনোরঞ্জনের বইয়ের নাম “ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন” কিন্তু এটা তো আজও সত্য, যে শুধুই নিজের যোগ্যতার ভিত্তিতে সমাজে পরিচিতি গড়ে তোলা কঠিন।
জন্ম বা পরিবার সূত্রে যার পরিচিতি নেই, তার পক্ষে আত্মপরিচয়-এর ভিত্তিতে পরিচিতি গড়ে তোলা সম্ভবত আরও কঠিন।
মনোরঞ্জন ব্যাপারী একেবারেই স্বপরিচয়ে স্বীকৃতি পেতে চান। এই দাবী অভিনন্দনীয়। আমার অনুরোধ, সবাই তার আত্মজীবনীটি পড়ুন, এবং অন্যদের পড়ান।
মহাশ্বেতা দেবী
.
ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন বইটির প্রথম খণ্ড পড়ে মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎচমক তৈরি হয়েছিল। আঘাতে আর দীপ্তিতে পূর্ণ এ রকম একখানা বই লিখলেন সমাজের একজন অবহেলিত মানুষ, লিখলেন তার নিজের কটু–কিন্তু অপরাজেয়–অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ রূপটি। শুধু সেই অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্যেই নয়, রচনার কুশলতাতেও সে-বই ছিল মুগ্ধ করার মতো। জনে-জনে পড়াতে ইচ্ছে হয়েছে বইটি।
সে-বইয়ের লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী আজ এক সুপরিচিত নাম। শুধু ওই লেখাটিতেই নয়, আরো বেশ কিছু গল্পকাহিনি লিখে এতদিনে পাঠকসমাজে এক আদৃত মানুষ তিনি।
তাঁর রচনা-উত্তরকালীন জীবনের কিছু নতুন দেখাশোনা আর ভাবনাচিন্তা এর মধ্যে ধরা আছে, আছে অবশ্য আগেকার জীবনেরও ফেলে আসা কিছু কথা। এবারে তিনি এসে পড়েছেন যে সংস্কৃতি সমাজের বা লেখকসমাজের বৃত্তে, সেখানেও আছে কিছু প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত কিছু লাঞ্ছনারও ইতিহাস, আমাদের গোটা সমাজটাকে স্পষ্টভাবে দেখার বা দেখাবার আয়োজন এর মধ্যে আছেছড়িয়ে। তবে, তিনি আজ নিজেই এক স্রষ্টা বলে তাকে নিশ্চয় মনে রাখতে হবে, শিল্পসমাজ থেকে বিশেষ কিছু প্রত্যাশা, নির্মম প্রত্যাখ্যান লেখকের পক্ষে কখনো-কখনো অনিবার্য। এমনকী, কখনো-কখনো তা হয়তো উপকারীও। নিজের লেখায় মগ্ন থাকলে লেখক এর সব কিছুই একদিন ভুলে যেতে পারেন।
মনোরঞ্জন আরো দেখুন, কেননা দেখার চোখ আছে তার। আরো লিখুন, কেননা লেখার হাত আছে তাঁর। পাঠক হিসাবে আমরা আরো প্রতীক্ষা করে থাকব।
শঙ্খ ঘোষ
.
লেখকের দু’কথা
উনিশশো একাশি সাল থেকে দুহাজার ষোল, সময়ের হিসাবে ৩৪/৩৫ বছর। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়–এতগুলো বছর ধরে কাগজ কলমের সাথে কসরত করে কি লিখেছি আমি! গল্প? উপন্যাস?
আমার জবাব হবে, ও সব কিছুই নয়, আমি জীবন লিখেছি। শুধুমাত্র একটা জীবন। তার এগিয়ে চলা। পিছিয়ে পড়া। হেরে যাওয়া, হারিয়ে দেওয়া, হারিয়ে যাওয়া। হারিয়ে গিয়ে খুঁজে পাওয়া। আঘাতে ঠোক্করে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হওয়া। আছাড় খেয়ে মাটিতে পতিত হয়ে আবার সেই মাটিকে অবলম্বন করে উঠে দাঁড়াবার প্রয়াস! আকাশকে ছুঁয়ে দেবার দুর্বার অভীপ্সা-ইত্যাদি।
তাই এ কথা বলা খুব একটা অযৌক্তিক হবে না–আমার প্রতিটা কথা কাহিনিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমারই গোটা জীবন।
কেউ কেউ এটাকে রচনার একটা দুর্বল দিক বলে চিহ্নিত করতে পারেন! যেটা খুব একটা ভুল হবে না। আমি সেই দুর্বলতার নির্মম শিকার। শত চেষ্টায় কিছুতেই যা থেকে বিমুক্ত করতে পারিনি নিজেকে। আসলে নিজের জীবনটুকু ছাড়া আর তো বিশেষ কিছু ছিল না। এইটুকু ছাড়া আজও অন্য কিছু নেই আমার নাগালের সীমায়।
জীবনে যত কিছু পাঠ, যা কিছু আহরণ এবং সঞ্চয় সব পেয়েছি জীবনেরই কাছ থেকে। জীবনই আমার পুঁথি পুস্তক, আমার শিক্ষক-গুরু-মার্গ দর্শক। ও ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই। তাই যা দু লাইন লিখেছি সব জীবন থেকে শেখা, জীবন থেকে জানা, জীবন থেকে পাওয়া, জীবন থেকে নেওয়া জীবনের কথা। সে জীবন-কথা কাহিনির মধ্যে খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া একান্তই আমার জীবন! আমার দৃষ্টির জীবন। আমি লিখতে বসলেই কলমের ডগায় এসে পড়েছে। শুধু আমারই বহুধা বিভাজিত জীবন গাথা। বঞ্চিত-বিড়ম্বিত জীবন গাথা।
নব নামের সেই যে রিক্সাওয়ালা, লাথখোর নামের সেই যে ট্রাক খালাসি, জীবন নামের ক্রোধী-চণ্ডাল, গুড়জল নামের মদখোর, ভগবান নামের সেই চোর, শ্রীপদ নামের মুটে, আগন্তক পরিচয়ের সেই যে ডাকাত, বাঙাল নামের লেখক–সব আমি। এরা সবাই আমার খণ্ডিত সত্ত্বা।
এই সব কথা-কাহিনী কতখানি সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ তা আমার পক্ষে বলা একটু কঠিন। সে বিচারের ভার বিদগ্ধ পাঠক-সমালোচকদের ওপর ন্যস্ত। আমি শুধু এইটুকু জোরের সাথে বলতে পারি–ওতে সত্য আছে। নিটোল নির্মম অপ্রিয় সত্য। যে সত্যের শরীরে কোন পোষাক নেই।
এখন আমার দিকে একটা সুতীব্র প্রশ্নের বর্শামুখ ধেয়ে আসতে পারে, যদি সব কথা ইতিপূর্বে বহুবার বহুভাবে বলা হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আবার আর একটা আত্মজীবনী লেখার আবশ্যকতা কোথায়। নতুনত্ব কি আছে এতে!
সোনাতে যেমন খাদ না মেশালে গহনা হবে না। তেমনই গল্প উপন্যাসকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে হলে কিছু রূপক কিছু অলঙ্কার কিছু উপমা উদাহরণের সাহায্য নিতে হয় তার অবয়ব এবং অঙ্গসজ্জার জন্য। স্থান কাল পাত্র বদলে দিতে হয়। করতে হয় অনেক কারিকুরি। এই সব কৃত-কৌশলে নির্মিত প্রতিমাতে শিল্পীর শিল্প নৈপুণ্য প্রধান হয়ে ওঠে। আর সেই শিল্পকলার করে ঢাকা পড়ে যায় আসল উপাদান–সেই খড়-মাটি-কাঠ অথবা “সত্য”। যে সত্যকে জানাবার অবদমিত আকাঙ্খতেই সে একদা হাতে কলম তুলে নিয়েছিল।
আমার জীবনের তিনটি ভয়াবহ ঘটনা নিয়ে একদা–”শমন সকাশে তিনদিন” নামে একটা বড় লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। বহু পাঠক সেটা গোয়েন্দা গল্প পাঠের আনন্দে পড়েছে। লেখকের লেখার মুন্সিয়ানার প্রশংসাও করেছে। কিন্তু কেউ মানতে পারেনি সত্য বলে। কারণ সেটা যে গল্প। আর যাইহোক গল্প কখনও সত্যি হয় না।
সেই সত্যকেরূঢ় রুক্ষ নির্মম বীভৎস বাস্তবতাকে, মেদ বর্জিত অলঙ্কারবিহীন অমল অবয়বে উপস্থাপনের তাগিদে, সময় সমাজ মানুষের দরবারে ন্যায় বিচারার্থে নিজেকে প্রস্তুত করার নিমিত্তে, এই আত্মজৈবনিক আলেখ্যের অবতারণা।
পাঠক বিশ্বাস রাখতে পারেন, বর্ণনার কোন স্তরে বিন্দুমাত্র সত্য থেকে বিচ্যুত হইনি বা বিকৃত করিনি। যেটুকু পারিনি সে আমার অপারগতা। তবে যেটুকু বলেছি–নিজে যা বিশ্বাস করি সেটাই উচ্চারণ করেছি উচ্চনাদে। ঋজু অকপটতায়।
আমার এই লেখায় কোথাও কোথাও আমাকে মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে মনে হওয়া অসম্ভব নয়। ঘটনাচক্রে আমি এক সময় নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। দেশের শোষিত বঞ্চিত মানুষদের প্রতি তাদের যে দরদ ভালোবাসা সে জন্য কঠোর কৃচ্ছসাধন, আত্মবলিদান–এ আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এমন নিঃস্বার্থ দেশ সেবকদের প্রতি যদি সহমর্মিতা না দেখাই নিজের কাছেই আমি অপরাধী হয়ে যাব। ছোট হয়ে যাব।
আমার নেতা শহিদ শঙ্কর গুহ নিয়োগী বলেছিলেন, আমি নকশালদের প্রতিটা কথা প্রত্যেকটা কাজের সমর্থন করি। শুধু সমর্থন করি না কাঁধের ওই বন্দুকটা। আমি যখন শঙ্কর গুহ নিয়োগীর লোক, তাই তার কথার প্রতিধ্বনি করে বলব–আমি নকশালদের শুধু অন্ধ সমর্থকই নই, বন্ধু সাথী সহযোদ্ধা-কমরেড। কেবল মাত্র সমর্থন করি না ওই বন্দুকটাকে।
আমার যেটুকু যা পড়াশোনা, আন্দোলনে অংশ নিয়ে মানুষকে দেখে বেড়াবার অভিজ্ঞতা তারই নিরিখে বলতে পারি, এ দেশের মানুষের প্রতি যতই শোষণ-বঞ্চনা-দমন পীড়ন হয়ে থাকুক, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শোষণ ব্যবস্থাকে উৎখাত করা তথা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল–এর জন্য এখনও মানসিক দিক থেকে মানুষ সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়। সেই রাজনৈতিক চেতনা তাদের মধ্যে বিকশিত হয়নি। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জঙ্গল পাহাড় কিছু দুর্গম এলাকায় সামান্য কিছু আধিপত্য কায়েম করা গেলেও তা দিয়ে বৃহত্তর মানব সমাজের কোন মঙ্গল সাধিত হবার নয়। সেই সুবৃহৎ সংগ্রাম সঞ্চালন এবং বিজয় অর্জনের উদ্দেশ্য, সফল করার লক্ষ্যে মানুষকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও সুসংগঠিত করবার জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী কার্যক্রম দরকার। যার সূচনা করেছেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী।
নকশাল-তথা মাওবাদীরা য়ে ধরনের ব্যক্তি হত্যার ক্রিয়া কলাপ চালিয়ে ছিল সুস্থ-সাধারণ মানুষ তার সমর্থন করতে পারে না। এতে দেশ দরদী মহান বিপ্লবী নয়, তাদের যে প্রতিকৃতি জনমানসে নির্মিত হয়েছিল তা ভয়াল বীভৎস এক ক্রুর হত্যাকারীর। যাতে প্রকারান্তরে তাদেরই ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্র তার সশস্ত্র বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে বর্বর দমন পীড়ন চালাবার একটা অজুহাত পেয়ে গিয়েছিল। যা তারা চায়। আর সেই গুলির আওয়াজ রক্তস্রোতের নিচে চাপা পড়ে গেছে বুভুক্ষার কান্না। মানুষের মৌলিক দাবি, মানবিক অধিকার ন্যায় অন্যায়ের বিভেদ রেখা।
এ কথা মনে রাখা দরকার যদি সেদিন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের গাড়ির পিছনে ওই পটকাটা ফাটানোনা হতো, এত সহজে কেন্দ্রীয় বাহিনী জঙ্গল মহলে অনুপ্রবেশের অজুহাত পেত না। আর আজ মারা পড়ত না কিষেণজীর মতো বড় মাপের নেতা। যে বিরাট ক্ষতি তাদের স্বীকার করতে হল সেই তুলনায় প্রাপ্তি কতটুকু!
গত ১৪.৪.২০১০ তারিখে যুগ পরিবর্তন পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে লিখেছিলাম “আমি মৃত্যুর বিরুদ্ধে। আমার আন্তরিক কামনা সমস্ত রকম মৃত্যুকে পরাজিত করে জয়ী হোক জীবন। জয়ী হোক মানুষ এবং শুভশক্তি। আমি বিশ্বাস করি এদেশের সমস্ত শ্রমিক কৃষককবি শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সবাই চান হিংসাদীর্ণ দেশে শান্তি আসুক। এত রক্তপাত এত জীবনহানি বন্ধ হোক।”
আমি আমার বিশ্বাসে অটল। আমি আজও মৃত্যুর বিরুদ্ধে, জীবনের পক্ষে। এই কাহিনি যারা পড়বেন জানতে পারবেন-জীবন আমাকে বার বার দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মৃত্যুর মুখোমুখি। এই তো সেদিন ২০১১ সালে যেদিন পশ্চিমবঙ্গে বর্ষার প্রথম বৃষ্টি নামল সেদিন ভীষণভাবে পুড়ে গিয়েছিলাম। নয়-দশদিন এক বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি থেকে ব্যায়বহুল চিকিৎসার মাধ্যমে অনেক বারের মতো আরও একবার প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছি।
বার বার মৃত্যুকে একেবারে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি এই কারণে আমার উপলব্ধিতে, জীবন বড় সুন্দর। জীবনের চেয়ে বড় আর কিছু নেই। সেই সুন্দর জীবনের তপস্যা হোক, মৃত্যুর উপাসনা বন্ধ হোক। জীবন যেন কোন কারণে কারও হাতে নিহত না হয়। পুলিশের রাইফেল থেকে ছুটে যাওয়া বুলেট যেন বিদ্ধ না করে কোন আদিবাসির বুক, জঙ্গল থেকে ছুঁড়ে দেওয়া কোন গুলি যেন না বেঁধে পেটের দায়ে চাকরি করতে আসা সৈনিকের মাথায়।
আসল শত্রু থেকে গেল নাগালের বাইরে আর নিজেরা নিজেদের মারছে দুই দরিদ্র, এই মরণ খেলা বন্ধ হোক। এই মৃত্যুর মিছিল আর চাই না। চাই না।
এই যে সেদিন মরতে মরতে বেঁচে এসেছি, এই জীবন কাহিনি লিখে ফেলার এটাও একটা বড় কারণ। দশবার ফিরেছি–যার কয়েকটা এতে লিখেছি, কয়েকটা কোনদিন লিখব। অবশ্যই যদি বেঁচে থাকি। এখন সর্বদাই ভয়–এতবার ফিরেছি, যদি আর ফিরতে না পারি? আর যদি সম্ভব না হয় তার করাল থাবা থেকে পিছলে যাওয়া।
মরতে আমার ভয় নেই। জন্ম যখন হয়েছে মৃত্যু তো আসবেই। তা না হলে বৃত্ত তো সম্পূর্ণ হবে না। আমার ভয়, আমি মারা গেলে সেই মৃত্যুর সাথে লুপ্ত হয়ে যাবে আমার বিড়ম্বিত জীবন কাহিনি। কেউ কী জানবে কী বীভৎস এক ভয়াল সময়ের গর্ভে কী নিদারুণ যন্ত্রণাবিদ্ধ বুকে বেঁচে ছিলাম এতগুলো বছর?
শিকার কাহিনীর মত উত্তেজক, গোয়েন্দা কাহিনীর মতো রোমাঞ্চকর, ভ্রমণ কাহিনীর মতো বৈচিত্রময় আবার আকাল কাহিনীর মতো হাহাকার মাখা এই যে জীবন, সব যে ছাই হয়ে যাবে আমার মরদেহের সাথে। তলিয়ে যাব বিস্মৃতির অতল তলে। তাই লিখে রেখে গেলাম।
আজ থেকে বহুবছর পরে কোন এক লাইব্রেরির ধুলোমাখা তাক থেকে নামিয়ে বিবর্ণ মলিন এই কাহিনি পড়ে অবাক বিস্ময়ে হয়তো ভাববে কেউ, এমন একজন মানুষ ছিল। সত্যিই কী ছিল। পৃথিবীতে এমনভাবে কেউ কী বাঁচে, পারে বেঁচে থাকতে! আর এই জিজ্ঞাসার মধ্যে আমি তখনও বেঁচে থাকব। সার্থক হবে সেদিন জিজীবিষার সাধনা।
এক এক সময় আমি নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করি, এত ঘটনা-দুর্ঘটনার সমাহার একটা জীবনে, সে কি অকারণ? এর কি কোন মূল্য নেই?
আজ মনে হচ্ছে জীবন আমাকে যে পথের যাত্রী করেছিল, বারবার আমাকে যে ঘাত-প্রতিঘাত বিভিন্ন বিচিত্র অভিজ্ঞতার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা যেন এই জীবন কাহিনীটা লেখার উপাদান সংগ্রহের জন্যই। আর কিছু নয়, মাত্র একখানা আত্মজীবনী।
যেন এই কাজটি সুসম্পন্ন করার জন্যই মৃত্যুর অধিপতি ক্ষমা ঘেন্না করে বাঁচতে দিয়েছে আমাকে এত দীর্ঘ সময়। কাজটি সম্পূর্ণ হবার পরই বোটা থেকে খসে যাব পাকা ফলটির মতো। বিশ্রাম পাবো এক প্রচণ্ড প্রব্রজ্যা থেকে।
পরিশেষে আর একটি কথা, সমাজে লেখক হিসাবে আমার অবস্থিতি কোথায় আমার তা জানা নেই। তবে এই ৩৫/৩৬ বছরে আমার যেটুকু অর্জন, আজ রাখতে পারছি, সে আমার একক। অর্জন নয়। বহু মানুষ বহুভাবে আমাকে সাহায্য করেছে এখানে পৌঁছাতে। তাদের সংখ্যাও এত যে গুণে শেষ করা যাবে না।
ব্যক্তি মানুষের কোন প্রয়াস কখনওই একক প্রচেষ্টায় সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে না। যদি না সময় সমাজ মানুষের সহযোগিতা থাকে। আমার ক্ষেত্রে এই কথাটা বড় বেশি রকম সত্যি। বহু মানুষ যেমন জানেন, আমাকে কী সহযোগিতা দিয়েছেন, বহু মানুষ তা জানতেও পারেননি। আমি উপকৃত, সবার দ্বারা। সেই যে পাথর খণ্ড তার কী ক্ষমতা ছিল ভাস্কর্য হবার। সে তো খোদাই শিল্পীর ছেনি হাতুড়ির আঘাতের ফলাফল।
আমি কৃতজ্ঞ সেই পিঠে টুকরো হওয়া পাঁচনবারি খানার কাছে যে আমাকে গরু খেদাবার মতো খেদিয়ে দিয়েছে ভবিষ্যতের যাত্রা পথে। কৃতজ্ঞ সেই লাইট পোষ্টটার প্রতিও, যাতে চোরের মতো বাধা হয়েছিল আমাকে, বুঝতে সাহায্য করেছিল দারিদ্র কী ভীষণ অপরাধ। কৃতজ্ঞতা জানাই সেই জাল ঢাকা কালো গাড়িখানাকে যে আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়–জেলখানায়। আর আমি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ সেই রিক্সাটার প্রতি–একদিন যার চাকা গড়িয়েছিল আমার ভাগ্যচক্র হয়ে।
০১. এই যে আমি
এই যে আমি। আমি জানি যে আমি আপনার একেবারে অপরিচিত নই। কত শতবার কতভাবে দেখেছেন আমাকে! তবু যদি বলেন যে চিনতে পারছেন না, আমি যদি একটু বিশদ ভাবে বুঝিয়ে বলি, তখন আর তা মনে হবে না। সব অপরিচয়ের অন্ধকার সরে গেলে আপনার মনে হবে, হ্যাঁ একে চিনি, আমি দেখেছি এই মানুষটাকে।
মানুষের স্মৃতি খুব দুর্বল। তাই পুরনো কথা মনে করার জন্য স্মৃতির উপর চাপ দেবার কথা বলছি না! এখনই আপনি জানালা দিয়ে সামনের সবুজ মাঠটার দিকে একবার তাকান। দেখতে পাবেন ছাগল গরুর পিছনে পাঁচনবারি হাতে ছুটে চলা আদুল গায়ে এক রাখাল বালককে। বহু বছর ধরে দেখেছেন ছেলেটাকে। মুখটা তাই আপনার চেনা চেনা। ও-ই আমি। ও-ই হচ্ছে আমার বাল্যবেলা।
এবার একটু বের হয়ে আসুন বাড়ির বাইরে। আপনার গলিটা শেষ হয়ে যেখানে এসে বড় রাস্তায় মিশেছে, একবার তাকান মোড়ের চা দোকানটার দিকে। রুক্ষচুল, গায়ে দুর্গন্ধ যুক্ত ছেঁড়া ময়লা গেঞ্জি, হাতে পায়ে দগদগে হাজা, কিছুক্ষণ আগে মালিকের হাতে মার খেয়ে কেঁদে কেঁদে গেলাস ধোয়া ওই যে ছেলেটা–এই হচ্ছে আমার কিশোর কাল।
এরপর যুবা বয়স! রেল স্টেশনে মোট বওয়া, মাথার উপর এক পাঁজা ইট নিয়ে বাঁশের ভারা বেয়ে দোতলা তিনতলার ছাদে ওঠা, রিকশা চালানো, রাত জেগে পাহারাদারি, দুর পাল্লার ট্রাকের খালাসি, মেথর ডোম–এ ভাবেই কেটেছে আমার যুবা বয়স। এর কোন না কোন পর্বে পথে ঘাটে হাটে মাঠে কখনো না কখনো আপনি আমাকে নিশ্চয় দেখে থাকবেন। বলা যায় না হয়তো দেখে থাকবেন সেই উত্তাল সত্তর দশকে পাড়ার গলিতে বোমা পাইপগান নিয়ে ছুটে বেড়াতে। অথবা হাতে হাতকড়ি পড়িয়ে পুলিশ মারতে মারতে ভ্যানে তুলছে।
জীবন আমার পায়ের তলায় সরষে রেখে দিয়েছিল। তাই কোথাও কোন ভূমিকায় দুদিন স্থির দাঁড়াতে পারিনি। বারবার পিছলে গেছি। সেই পেছল খাওয়া-পিছিয়ে পড়া, পিছু হটা এক জীবনকথা আপনাকে শোনাতে বসেছি। সারা জীবনে “জীবন” আমাকে দিয়ে কত কিছু যে করিয়েছে, চাইলেও তার সব কথা কী লিখতে পারবো? আত্মজীবনীর এই এক মস্ত অসুবিধা কোন আড়াল থাকে না। সে আড়াল উপন্যাসে পাওয়া যায়। তাই অকপটে অনেক কথা বলে দেওয়ায় অসুবিধা থাকে না।
আত্মজীবনী লেখার আর একটা বিড়ম্বনা, নিজের ঢাক নিজে বাজাতে হয় নিজের চোখে সব মানুষই সুন্দর। নিজের কাজ সব মানুষের কাছে প্রশংসার। তাই ভয় হচ্ছে, আমার ছেঁড়া ফাটা বেসুর বেতাল ঢাকের বাজনা শুনে বিরক্ত না হয়ে যান। কারণ যে ছবি আমি এখন আঁকতে চলেছি আপনিও তো সেই সময়-সমাজের মানুষ। কে জানে আমার কোনও অভিযোগের আঙুল আপনার দিকেও উঠে যাবে কিনা!
ঠিক জানিনা কে যেন বলেছেন জীবন নাকি এক যাত্রা। জন্ম থেকে এক পা এক পা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা। আর আঘাতে ঠোক্করে ক্ষত বিক্ষত হয়ে–পথের বাঁকে বাঁকে রক্ত ছড়িয়ে যেতে যেতে সেই অমৃত পরশের অনুসন্ধান করা, যা জীবনকে সমৃদ্ধ করে। মহান করে, অমরত্ব দেয়।
সবাই সে অমৃত পায় না। কেউ কেউ পেয়ে যায়। যে পায় তার জন্ম সার্থক মৃত্যু সার্থক জীবন সার্থক। আপনি যদি আমাকে অহংকারী না ভাবেন তবে সবিনয়ে বলি, আমি সেই অমৃত স্পর্শ পেয়েছি। তাই একথা উচ্চারণ বোধহয় ধৃষ্টতা হবে না যে আমার জীবনটা সার্থক না বলা গেলেও একেবারে ব্যর্থ এটা বলা যাবে না। অবশ্য আমার সত্যিকারের সার্থকতা বা বিফলতা বলতে ঠিক কি বোঝায় এ বিষয়ে পরিষ্কার কোন ধারণাও নেই।
জন্মগত কারণে অপরাধী ঘোষিত অচ্ছুত অস্পৃশ্য এক দলিত পরিবারে আমার জন্ম। যার জীবন শুরু হয় ছাগল চড়ানো দিয়ে, তারপর দুবেলা দুমুঠো অন্নের তাড়নায় কত ধরনের “হীন নীচ জঘন্য বৃত্তি”। স্কুলে যাবার কোনও সুযোগ ঘটে না কিন্তু জেলযাত্ৰা ঘটে যায় বেশ কয়েকবার। সেই মানুষ যাকে “মানুষ” পৃথিবীর জঞ্জাল মনে করে মেরে ফেলারও চেষ্টা করেছিল কয়েকবার, আজ তাকে যখন মঞ্চে বসিয়ে মালা দেওয়া হয়, সে মনে করতেই পারে জীবন তাকে একেবারে বঞ্চিত করেনি।
জীবনে কখনো বিদ্যালয়ে চৌকাঠ ডিঙাতে পারেনি। রিকশা চালাত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। যখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পারেটিভ লিটরেচর বিভাগের জার্নাল-ভলিউম নাম্বার ৪৬/২০০৮-২০০৯ এর ১২৫ থেকে ১৩৭-১২ পৃষ্ঠা জুড়ে তার জীবন এবং সাহিত্য কৃতি নিয়ে আলোচনা থাকে, সে তো নিজেকে ধন্য ভাবতেই পারে। বহু সব স্বনামধন্য সম্মানীয় মানুষ যখন তাদের শক্তিশালী কলমে তার কথা লেখেন–যুগান্তর, রাজার বা এ জাত বর্তমান, আনন্দবাজার, প্রতিদিন, আজকাল, ই.পি.ডব্লু, কথাদেশ, নতুন খবর, দিনকাল, দি হিন্দু, স্টেটসম্যান, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, মেইনস্টীম আরেক রকম, দৈনিক জাগরণ, যুগশঙ্খ, হিন্দুস্থান টাইমস এই সব পত্রিকায় তার নাম পরিচয়, প্রকাশিত হয়, দূরদর্শনের জনপ্রিয় প্রোগ্রাম “খাসখবর”, আকাশ বাংলায় “সাধারণ অসাধারণ” “খোঁজখবর” প্রোগ্রাম, তারা নিউজের “তারার নজর” ২৪ ঘন্টা, ইটিভির সংবাদে যখন তাকে দেখানো হয় RSTV চ্যানেল তথ্য চিত্র বানায় সে ভাবতেই পারে–জীবন সার্থক।
একবার হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রধান শ্রদ্ধেয়া টুটুন দিদির (টুটুন মুখার্জী) আমন্ত্রণে চলেছি হায়দ্রাবাদ। স্টেশন থেকে চলেছি এক অটো রিকশায়। বলি তাকে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায় নিয়ে যেতে। অটো চালক পড়াশোনা জানা! সে দেশ বিদেশের অনেক খবর রাখে। আমি কলকাতা থেকে গেছি শুনে জিজ্ঞাসা করে কলকাতার যে রিকশা চালক, কোনদিন কোন স্কুলে যায়নি, এখন এক লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তাকে আমি চিনি কিনা!
বলেছিলাম-চিনি। এবং একথা একটুও ভুল নয়, যে তাকে আমার মত আর কেউ চেনেনা। আমি চিনি অনেক বেশি। সেই নিয়েই এই আমি। আমার আমি।
.
অধুনা বিলুপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের বরিশাল জেলার পিরিচপুরের সন্নিকটে তুরুকখালি নামক একস্থানে হতদরিদ্র এক দলিত পরিবারে আমার জন্ম। সে দিনটা ছিল তাপদগ্ধ বৈশাখ মাসের কোন এক রবিবার।
সেই রাতে কালবৈশাখির প্রবল ঝড় উঠেছিল। যে ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল দরিদ্র মানুষের অনেকগুলো কুড়ে ঘরের খড়ের চাল। ভেঙে পড়েছিল বড় বড় গাছের মোটা মোটা ডাল। মানুষ কাঁদছিল, হাহাকার করছিল, বাজ পড়বার বিকট শব্দে ভীত হয়ে পড়েছিল। মা আমাকে বুকের আড়াল দিয়ে রক্ষা করছিলেন সেই ক্রুদ্ধ প্রকৃতির রোষানল থেকে।
মায়ের মুখে শুনেছি সেদিন আমাদের ঘরে রান্না করবার মত একদানা চালও ছিল না। জনমজুরি দ্বারা সংসার প্রতিপালন করা আমার বাবা–যে নাকি মোষের মত খাটতে পারত, তার সে সব দিনে কোন কাজ ছিল না। যার ফলে তিন-চার দিন আগে থেকে আমাদের রান্নাঘরের উনুন জ্বালা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছিল। আশেপাশের মানুষ যারা আমাদের স্বজাতি, আত্মীয়, তারাও সব আমাদের মতোই হতদরিদ্র-দিন আনা দিন খাওয়া লোক। তাদের কারও ঘরে দয়া জিনিসটার তখন পৰ্যন্ত অবলুপ্তি ঘটেনি। তাই তাদের কেউ কেউ একটু কম খেয়ে নিজের ভাগ থেকে একমুঠো ভাত বাঁচিয়ে আমার মাকে দিয়ে যেত। এইভাবে গর্ভস্থ সন্তান নিয়ে কোনভাবে বেঁচে ছিল এক গ্রাম বাংলার ভাগ্যাহত গৃহবধূ।
সেদিন সকাল বেলা আমার বাবা মুখে জল না দিয়েই বের হয়ে পড়েছিলেন পথে, কোথায় কিছু চাল পাওয়া যায় সেই সন্ধানে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে অবস্থাপন্ন পরিবার ছিল জনৈক ভটচাজ বাবুরা। মায়ের মুখে শুনেছি, চাষের পরে তাদের খামারে চার চারটে ধানের গাদা মারা হত। সে এতবড় আর এত উঁচু যে ধান গাদার মাথার দিকে তাকালে মহিলাদের মাথা থেকে নাকি ঘোমটা খসে পড়ে যেত। বাবা সেই বাড়িতে গিয়েছিলেন কিছু চাল ধার পাবার আশায়।
এরা অঞ্চলের গরিব মানুষকে বিপদের সময় ধান চাল নগদ টাকা ধার দেয়। সে ধার চাষের মরশুমে খেটে পরিশোধ করতে হয়।
কিন্তু এখন সময়টা একটু অন্য রকম। মাত্র বছর চার-পাঁচ আগে দেশভাগ হয়ে গেছে। এ সময়ে দলে দলে লোক দেশ ছেড়ে “ইন্ডিয়ায়” পালাচ্ছে। ভটচাজ পরিবারের কিছু লোক ইতিমধ্যেই ওদেশে চলে গেছে। বাকি যারা আছে আজ যাই কাল যাই করছে। এত জমি জায়গার একটা যথাযথ ব্যবস্থা করে যাওয়া সোজা ব্যাপার তো নয়। এই সময় ধার দিলে তা আর আদায় করা যাবে কিনা কে জানে! সেই জন্য তারা চালের বিনিময়ে তখনই কিছু কাজ করিয়ে নেওয়া উচিং মনে করে বাবাকে দিয়ে একটা আমগাছ কাটিয়ে কাঠের চলা–যা দিয়ে রান্না করা হয়, তা বানিয়ে নেয়।
এ যেন সেই মুনশি প্ৰেমচাঁদের আর এক গল্প অন্য এক পটভূমিতে। তবে সেই গল্পের প্রধান চরিত্রের মত ক্ষুধা তৃষ্ণা পরিশ্রমে বাবাকে প্রাণ হারাতে হয়নি। কাজ শেষ করে গামছার পোটলায় কিছুটা চাল বেধে তিনি ঘরে ফিরে আসতে সক্ষম হন। সারা দিন পরে যখন তিনি ঘরে ফেরেন তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আর আকাশ কালো করে ধেয়ে আসা শুরু করেছে কালবৈশাখি ঝড়ের আভাস। যা কিছুক্ষণ পরে এক ভীষণ তাণ্ডব শুরু করবে এ অঞ্চল জুড়ে।
আমি মা বাবার প্রথম সন্তান। আমার পরে আরও দু ভাই দু বোনের জন্ম হয়। তখনকার দিনে নিয়ম ছিল বধূ তার প্রথম সন্তানের জন্ম দেবে মাতৃগৃহে। সে সময় খুব ছোট্টবেলায় মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। আর অল্প বয়েসে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বহু মেয়ে মারাও যেত। যে কারণে ওই নিয়ম। পাছে দোষ না পড়ে “প্রসুতির ঠিক মত সেবা শুশ্রূষা করেনি শ্বশুর শাড়ির লোক।” দুর্ভাগ্য, আমার মায়ের কোন মাতৃগৃহ ছিল না। আমার দিদিমা ছিলেন বাল্য বিধবা। তিনি বারো বছরে বিবাহ এবং ষোল বছরে মা হন। তারই কিছুদিন পরে আমার মাতামহ মারা যান। তখন দিদিমার ভরণ পোষণের ভার নেবার মত আর কেউ না থাকায় তিনি তার শিশু কন্যাটিকে নিয়ে নিজের মাতৃগৃহে চলে আসেন। যেখানে আগে ভাগে তার পাঁচ বোন বিধবা হয়ে এসে বসে আছে। সে কারণে অঞ্চলে এই বাড়িটার নাম “বিধবা বাড়ি” হয়ে গিয়েছিল। এই ছয় বোনের সন্তান ছিল মাত্র দুটি। আমার মা আর তার এক মাসতুতো দাদা।
আমার দিদিমা মাকে তার বোনদের হেপাজতে রেখে গ্রামের সম্পন্ন লোকদের বাড়ি চাল চিড়ে কুটে, কাঁথা সেলাই করে, মুড়ি ভেজে, যা সামান্য মজুরি পেতেন তা দিয়ে মা মেয়ে কোনভাবে বেঁচেবর্তে ছিলেন। যখন এই মেয়ের বয়স আট কি নয়, তখন সেই বাড়ির সামনের বড় গাঙ বেয়ে নৌকো নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন আমার ঠাকুরদা। হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটি ছোট্ট মেয়ে পিঠময় একরাশ কালো চুল নিয়ে জলঘাটে জল ভরছে তার ছোট্ট ঘটিতে। তখনই তিনি নৌকা থামিয়ে পাড়ে উঠে পড়লেন। খোঁজ নিলেন মেয়েটি কার! আর তারপর মেয়ের অভিভাবকদের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে ফেললেন। এবং একদিন এককুড়ি একটাকা কন্যাপন দিয়ে বধু করে নিয়ে এলেন সেই মেয়েকে তুরুকখালি গ্রামের বিখ্যাত “আট ভাইয়ের বাড়ি”-ব্যাপারী বাড়িতে।
আমাদের পূর্ব পদবি ছিল মণ্ডল। ঠাকুরদার কারণেই আমাদের সেই পদবিটি খসে যায়। তার একবার শখ হয় তিনি ব্যবসা করবেন। সেই মনোস্কামনায় এক নৌকা সুপারি নারকেল নিয়ে বরিশাল শহরে যান। তা ব্যবসা মোটামুটি খুব একটা মন্দ হয় না। তাই শহর থেকে ফেরার সময় বউয়ের জন্য দশ টাকা দামের একখানা শড়ি কিনে ফেললেন। সেই শাড়ি দেখে গ্রামের লোকের মুখে তো আর রা সরে না। একজন জানতে চায়–“কত দিয়া কেনলা শাড়িখান?” তখন দাম বলতে গিয়ে সতর্ক হল ঠাকুরদা। লোকে বলে “উনি যদি কিছু বেঁচেন–ঠকেন আট আনা। যদি কিছু কেনেন ঠকেন ষোল আনা। সেই কথা মনে পড়ে যাওয়ায় সঠিক দাম বলতে ইতস্তত করেন। কে জানে এবারও ঠকে এসেছেন কিনা! অবশেষে অনেক ভেবে শেষে বলেন তিনি–”দোকানদার আট টেহা চাইছিল। কইয়া বইলা সাড়ে সাতে আনছি। এয়ার কোমে হালায় পো হালায় কিছুতে দিতে রাজি হইল না।” বলে লোকটা–“তুমি মিছা কতা কওনা তো?” ঠাকুরদা জোরের সাথে জবাব দেয়, মিছা কতা কইয়া আমার কী লাভ! আমি যদি কই দশ টেহায় আনছি কেউ কী তা মাইনা নেবে? তখন মুচকি হেসে বলে সেই লোকটা–“ওই দামে মোরে এ্যাকখান এই শাড়ি আইন্যা দিবা?” “এ্যাকখান কি, কও যদি তো দশখান আইন্যা দিমু” বলে ঠাকুরদা। যথারীতি ঠাকুরদা পরের বার যখন সুপারি নারকেল নিয়ে বরিশাল যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠেছেন, দেখেন, কেউ সাড়ে সাত কেউ পনেরো টাকা নিয়ে ধেয়ে আসছে তার দিকে। সবারই একটা দুটো শাড়ি দরকার। সংখ্যায় তারা অনেক।
কথায় বলে–বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি একবার বের হয়ে গেলে আর ফেরানো যায়না। একবার কথা দিয়ে ফেলার পরে আর কিছু করার ছিল না ঠাকুরদার। তাই নিজের গাট থেকে প্রতিটা শাড়িতে আড়াই টাকা করে ভর্তুকি দিয়ে, পুঁজিপাটা সব শেষ করে বরিশাল শহর থেকে সেই যে ফিরে এলেন, আর কোনদিন ওমুখো হননি।
ঠাকুরদার এই বুদ্ধিমত্তার খবর খুব বেশিদিন গোপন ছিল না। বরিশাল শহরে তো আরও এক দুজন ব্যাপারী যায়, যখন মানুষ ঠাকুরদার এই ব্যবসা বৃত্তান্ত অবগত হল–তারা প্রচুর হেসে ঠাকুরদার নামের পিছনে বসিয়ে দিল ব্যাপারী পদবি। যে কারণে আমি মনোরঞ্জন মণ্ডল নই, মনোরঞ্জন ব্যাপারী। এই হল ব্যাপারী হবার আসল ব্যাপার।
এই দেশে মনোরঞ্জন অনেক আছে। খুঁজলে ব্যাপারীও দুপাঁচটা মিলে যাবে। কিন্তু মনোরঞ্জন ব্যাপারী আর একজনও পাওয়া যাবে না। আমিই এক এবং এককও আমিই আদি এবং আমাতেই অন্ত।
সেদিন যখন আমার বাবা চালের পোটলা নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছিলেন তার অল্প কিছুক্ষণ আগে মাতৃ জঠর থেকে ধরণীর মৃত্তিকায় অবতরণ করেছি আমি। বাবার এক খুড়িমা-যিনি আমার বাবারও জন্মের সময় ধাত্রীর ভূমিকায় ছিলেন, এখন আমার জন্মের সময়ও সেই একই ভূমিকা পালন করলেন। বাঁশের চটা দিয়ে নাড়ি কেটে ধুয়ে মুছে ন্যাকড়া জড়িয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন আমাকে আমার মায়ের পাশে। বাবা এলে তখন সেই “খুড়িমা” বাবাকে বলেছিলেন একটু মধু যোগাড় করে আনতে। আমাদের সমাজের প্রবীণ মানুষদের বহু পুরাতন এক বিশ্বাস, নতুন মানুষ পৃথিবীতে এলে তার মুখে মধু দিতে হয়। তা না হলে জাতকের জীবন মধুময় হয় না। তিক্ত বিষাক্ত হয়ে রয়ে যায়। বাবা তখন খুব কেঁদেছিলেন। কারণ যে ঘরে চালই নেইমধু আসবে কোথা থেকে? বাবার জন্মের সময়ও তার মুখে মধুর ফোঁটা পড়েনি। মধু বঞ্চিত জীবন যে কত কষ্টের, গ্লানি আর অপমানের তিনি তা মর্মে মর্মে জানেন। কিন্তু তখন সেই প্রবল কালবৈশাখির ঘনিয়ে ওঠা দুর্যোগে কোথায় যাবেন মধুর সন্ধানে! ফলে আমার আর মুখে মধুপাত হল না। জীবন সুমধুর হল না। হতভাগ্য দলিত বাপের অভাগা ছেলে রয়ে গেল মধু বঞ্চিত এক তিক্ত জীবন পথের যাত্রী হয়ে।
.
আমার বাবা তার জাতি পরিচয় দিতে গিয়ে বড়ই গর্ব আর অহংকারের সঙ্গে বলতেন “মোরা নোমোশুদুর, কাশ্যপ গোত্র”। যদিও উচ্চবর্ণের লোকেরা আমাদের অচ্ছুত অস্পৃশ্য ভাবতো, চরম ঘৃণাভরে চাড়াল চণ্ডাল এই সব বলত। বাবা বা আমাদের সমাজের কোনও মানুষ কিন্তু নিজেদের চণ্ডাল বলে স্বীকার করতে চাইত না। তাদের দাবি ছিল, আমরা উঁচু জাত। ব্রাহ্মণের রক্ত আছে আমাদের শরীরে এবং এটা শুধু মাত্র নমঃশুদ্র মানুষেরাই নয়, বর্ণবাদী ব্যবস্থায় সর্বনিম্নধাপে অবস্থানরত প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠিই দাবি করে। তাদের প্রত্যেকের নিজের হীনমন্যতা আড়াল করে আত্মগর্বে স্ফীত হবার মত একটা লোক গাঁথা প্রচলিত আছে। নমঃশূদ্র সমাজেও এই রকম একটা গল্প প্রাচীনকাল থেকে প্রবহমান।
বিশ্বস্রষ্টা ব্রহ্মার এক পুত্রের নাম মারিচ। মারিচের এক পুত্রের নাম কাশ্যপ সেই কাশ্যপ মুনির এক পুত্রের নাম নমস মুনি। নমস মুনির বিবাহ হয় ব্রহ্মার এক মানস পুত্র রুচির কন্যা সুলোচনার সাথে। সেই কন্যার গর্ভে নমস মুনির ঔরসে দুটি যমজ পুত্রের জন্ম হয়। যার একজনের নাম রাখা হয় উরুবান আর একজনের কীর্তিবান। পুত্রদ্বয়ের জন্মের কিছুকাল পরে নমস মুনি বনে চলে যান তপস্যা করতে। সেই তপস্যায় উনি এমন নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে দিনমাস বছরের কোন হিসেব রাখতে পারেন না। এভাবে পার হয়ে যায় চৌদ্দ বৎসর।
শাস্ত্রানুসারে সব মানুষই জন্মমাত্রেই শুদ্র। এরপর উপনয়ন দ্বারা সে হয় দ্বিজ। আর তারপর অধ্যয়ন ও সাত্বিক তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হলে তখন হয় ব্রাহ্মণ। ডাক্তারের পেটে জন্মালেই যেমন ডাক্তার হওয়া যায় না, সেই কালে ব্রাহ্মণের ঔরসে জন্মালেই ব্রাহ্মণ হবার সুযোগ ছিল না। কঠিন শ্রমে তাকে তা অর্জন করতে হত। বিদ্বান হবার প্রথম ধাপ যেমন বিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশ, ব্রাহ্মণত্বের দিকে অগ্রগমনের প্রথম ধাপ উপনয়ন। যা দিতে হবে চৌদ্দ বছর অতিক্রান্ত হবার পুর্বে। নমস মুনির অসাবধানতায়বালকটির সে বয়স তখন পার হয়ে গেছে। এখন কী উপায়! এরা যে শূদ্র রয়ে গেল। তবে নমস মুনির পুত্র বলে কথা। শূদ্র হলেও এরা নমস্য। তাই এদের নাম হল নমঃশূদ্র।
এত গৌরবময় যাদের অতীত আজ তাদের এমন দীনহীন দশা কেন! মাথায় তেল, পেটে ভাত, পরনের ত্যানা, পায়ের চপ্পল, ঘরের চালে খড় কিছুই কেন নেই! কেন এত লাঞ্ছনা অপমান অত্যাচার?–আছে। নমঃশূদ্র মানুষের কাছে সেই প্রশ্নের উত্তর আছে।
পাল রাজত্ব শেষ আর সেন রাজত্ব শুরু এর মাঝে অল্প কিছু কাল বঙ্গদেশের কোন এক অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা শুর বংশের রাজা আদিশূরের অধিকারে ছিল। উচ্চবর্ণের ঐতিহাসিকরা যার কথা বিশেষ কারণে লিপিবদ্ধ করেননি। পাল রাজারা সবাই ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এদের প্রচেষ্টায় সমগ্র বঙ্গদেশ তখন প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের বন্যায়। যখন পাল রাজত্বের পতন ঘটে গেছে, তখন রাজা আদিশূর বৈদিক ধর্মের পুনরুত্থান প্রচেষ্টায় এক মহাযজ্ঞ করবার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। কিন্তু যজ্ঞ করতে হলে তো বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ চাই। বঙ্গে তখন আর তেমন ব্রাহ্মণ কোথায়! বৌদ্ধ ধর্মে তো কোন পূজাপাট হোমযজ্ঞ নেই। রাজ্যবাসীরা কেউ সে সব করে না। ফলে দীর্ঘ অনভ্যাসে ব্রাহ্মণরা মন্ত্রতন্ত্র সব ভুলে বসে আছে।
অগত্যা নিরুপায় রাজা আদিশূর দূর দেশ কান্যকুজ থেকে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আনার উদ্দেশ্যে একজন দূত পাঠালেন সে দেশে। দূতের নিকট গেল রাজা আদিশূরের আবেদন–বঙ্গে বৈদিক ধর্মের পুনঃ প্রতিষ্ঠাকল্পে যে মহাযজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে এতে আপনার সহযোগিতা চাই। কিন্তু কান্থকুজের রাজা বীরসিংহ আদিশূরের আবেদনে সাড়া দিয়ে বঙ্গে ব্রাহ্মণ পাঠাতে রাজি হল না। বঙ্গে নাস্তিকদের (বৌদ্ধ) প্রাদুর্ভাবে ধর্মকর্ম বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সেখানে ব্রাহ্মণেরা গেলে সব স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়বে। সে পাপের দায়ভার রাজার উপরেই বর্তাবে। রাজা বীর সিংহ বড় ধর্মপ্রাণ মানুষ। তিনি কেমন করে এমন মহাপাতকী কর্ম করতে পারেন!
তখন রাজা আদিশূর আর কোন গত্যান্তর না দেখে অবশেষে মনঃস্থির করে ফেললেন, যে, যুদ্ধ করেই পাঁচজন ব্রাহ্মণ ধরে নিয়ে আসবেন। তৈরি হল সাতশত সাহসী যোদ্ধা। যে কোন যুদ্ধের প্রধান উদ্দেশ্য হয় বিজয়। তা সে ছলে বলে কলে কৌশলে যেভাবেই হোক না কেন। তাই আদিশূরের আদেশে সব সেনা গলায় পড়ে নিল একটা করে ধবধবে সাদা পৈতে। চড়ে বসল গরুর পিঠের উপর এবং একদিন তারা গিয়ে দাঁড়াল ‘রণং দেহী’ হুংকার দিয়ে কান্বকুব্জের রাজ্যের সীমানায়। হয় যুদ্ধ কর, নয় পাঁচজন ব্রাহ্মণ দিয়ে দাও। এই না দেখে ধর্মপ্রাণ রাজা বীরসিংহ পড়ে গেল মহা ফাপড়ে। এখন কান্যকুজের সেনা যদি প্রতি আক্রমণ করে, তাদের অস্ত্রে হয় গরু, নয় ব্রাহ্মণ কেউ না কেউ তো মারা পড়বে। বেদজ্ঞ যদি নাও হয় তবু তো ব্রাহ্মণ। শাস্ত্রে ব্রাহ্মণ এবং গরু দুটোকেই অবধ্য প্রাণী বলেছে। এদের যেকোন একটাকে বধ করলে মৃত্যুর পরে অনন্তকাল নরক বাস। নিরুপায় বীরসিংহ তখন পরাজয় স্বীকার করে পাঁচজন বৈদিক ব্রাহ্মণ বঙ্গে পাঠাবার শর্ত মেনে নিলেন। সেই পাঁচ ব্রাহ্মণ তাদের সেবা করার জন্য সাথে করে নিয়ে এল পাঁচজন সেবক। ওই পাঁচ ব্রাহ্মণ আর ওই পাঁচ ভৃত্য পরবর্তীকালে আর স্বদেশে ফিরে যেতে পারেনি। পাকাপাকিভাবে রয়ে গেছে বঙ্গদেশে। শূদ্র জাতির ওই পাঁচভৃত্য এদেশে পরিচিত হয়েছে এক নতুন জাতি হিসেবে কায়স্থ পরিচয়ে।
সে যাই হোক, আদিশূরের মহাযজ্ঞ তো মহা আড়ম্বরে সমাপ্ত হয়ে গেল। রাজা এখন মহাখুশি। এবার সেই সাতশত সেল্লাকে পুরস্কার দেবার পালা। ঝক্সবির্শে বিভুই থেকে পাঁচ পাঁচখানি অমূল্য রতন ধরে নিয়ে এসেছে। “বলো তোমরা কী চাও?” জানতে চাইলেন রাজা আদিশূর। তখন সেনাদের প্রধান এগিয়ে এল সামনে। বলল–মহারাজ আমরা আর কিছু চাইনা। শুধু এইটুকু নিবেদন, যা আপনি দিয়েছেন তা আর ফিরিয়ে নেবেন না। আমাদের এই পৈতাখানি পরে থাকার অনুমতি দিন।
আদিশূর অধার্মিক নন, অকৃতজ্ঞও নন। আদেশ দিলেন তিনি, আমার রাজত্ব সীমায় আজ থেকে তোমরা ব্রাহ্মণ বলেই পরিচিত হবে। সমাজে ব্রাহ্মণের যে সম্মান, তোমরাও আধিকারি হবে সেই সম্মানের।
রাজ্যবাসীগণ রাজার সেই আদেশ নত মস্তকে মেনে নিলেও বেঁকে বসল অনমনীয় নমঃশুদ্র সমাজ। নমসমুনির বংশধর আমরা। না হয় সামান্য ভুলে পৈতেটা পাইনি; তা বলে ওরা আমাদের চেয়ে বড় জাত হয়ে যাবে? আমরা ওদের কিছুতে ব্রাহ্মণ বলে মেনে নেব না। প্রণত হব না এই সব ব্রাহ্মণদের পায়ে। শুরু হয়ে গেল নব ব্রাহ্মণদের সাথে নমঃশূদ্র সমাজের বিরোধ। যা চলতেই থাকল।
এরপর সমগ্র বঙ্গভূমিতে এল সেন রাজত্বের কাল। রাজা হলেন বল্লাল সেন। কিছুকাল পরে রাজা বল্লাল সেন তার এক রক্ষিতার পুত্রকে সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবার উদ্দেশ্যে এক পংক্তি ভোজের আয়োজন করলেন। নিমন্ত্রণ পাঠান হল রাজ্যের সর্বত্র। প্রতিটা জাতিগোষ্ঠি থেকে সেই ভোজ সভায় প্রতিনিধি এল কিন্তু এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করল নমঃশুদ্র সমাজ। তারা বলল হোক রাজবীর্যে জন্ম, সন্তান তো রক্ষিতারই। আমরা অংশ নেব না ওই অনুষ্ঠানে।
রাজা প্রজাদের এই ঔদ্ধত্য সহ্য করবেন কেন! এতে ভীষণ ক্রদ্ধ হলেন বল্লাল সেন। নব ব্রাহ্মণরা তো নমঃশূদ্রদের উপর আগে থেকে বিরূপ হয়ে ছিলই। পূর্বাগ্রহ থেকে তারা রাজার ক্রোধকে আরও উস্কে দিল–”দেখলেন তো মহারাজ স্পর্ধাটা। এর একটা বিহিত করুন। ওদের কঠোর কোন সাজা দিন।” তাদের চাটুকারিতায় তুষ্ট হয়ে বল্লাল সেন কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন করে কিছু স্তাবক চাটুকারদের সমাজে উচ্চস্থান দিয়ে পুরস্কৃত করলেন আর শাস্তি দিলেন নমঃশুদ্র সমাজের মানুষকে সমাজচ্যুত করে। ঘোষণা করে দিলেন তিনি–“আজ থেকে এরা সব চণ্ডাল বলে গণ্য হবে। সমাজে চণ্ডালদের যে স্থান, নমঃশূদ্রদের প্রাপ্য হবে সেই স্থান।”
ভারতীয় বর্ণ ব্যবস্থায় চতুবর্ণ বিভাজনে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা হয়েছে ব্রাহ্মণকে। যার নিচে ক্ষত্রিয় তার নিচে বৈশ্য এবং সবার নিচে শূদ্র। যাদের কাজ উপরোক্ত তিনবর্ণের সেবা করা এবং তাদের দয়া কৃপা দানের অন্নে জীবন নির্বাহ করা। যে কারণে শূদ্রের আর এক নাম দাস। বলা হয়ে থাকে যে ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উদর থেকে বৈশ্য ও পা থেকে শুদ্রের জন্ম। পা তো দেহের সব চেয়ে নিম্ন ও নিকৃষ্ট স্থান। যার উৎপত্তি ওই স্থানে সে আর উচ্চ হবার অধিকার কি করে পাবে। যে কারণে ওই তিন বর্ণের বিচারে শূদ্র এক হীন নীচ ঘৃণ্য মানবেতর প্রাণী। শাস্ত্র অনুসারে এদের জ্ঞান, বিদ্যার্জনের ধন সম্পদ সঞ্চয়ের, ভদ্রচিত পরিচ্ছদ পরিধানের কোন অধিকার নেই। যদি কেউ শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করে তার জন্য প্রচলন আছে কঠোর শাস্তির। শম্বুক নামের এক শূদ্র বেদ পাঠ করার কারণে রামচন্দ্র তাকে হত্যা করেছিলেন।
আমাদের মহান হিন্দুধর্মের শাস্ত্রে নির্দেশ আছে, যদি কোন উচ্চবর্ণ ওই হীন নীচ শূদ্র মানুষকে দয়া পরবশ হয়ে কোন খাদ্যদ্রব্য প্রদান করে সে খাদ্য অবশ্যই হতে হবে উচ্ছিষ্ট যা পরিবেশন করতে হবে কোন ভগ্ন পাব এর তাও
যদি কোন শুদ্র ধন সম্পদ সঞ্চয় করে, সেটা হবে শাস্ত্রবিরোধী কাজ। সে ধন সম্পদ কোন ব্রাহ্মণ ছিনিয়ে নিলে, সেটা কোনমতেই অন্যায় কর্ম হবে না।
যদি সে বেদ পাঠ করে তার জিভ কেটে দিতে হবে। যদি সে বেদপাঠ শোনে সিসা গরম করে ঢেলে দিতে হবে তার কানে। যদি কোন শূদ্র সজ্ঞানে কোন ব্রাহ্মণের অঙ্গে পদস্পর্শ ঘটায়, রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। আর যদি কোন ব্রাহ্মণ ক্রোধবশতঃ কোন শূদ্রকে হত্যা করে তিন দিন গায়ত্রী মন্ত্র জপ এবং গঙ্গাস্নানে সব অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাবে। হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ট মনীষীদের দ্বারা লিখিতশাস্ত্র সমূহে একদল মানুষকে চির পদানত করে রাখার চেষ্টায় এইরকম নীতি নির্দেশিকা শত সহস্র।
যারা শূদ্র জাতির মানুষকে কোন মান মর্যাদা দিতে রাজি ছিল না, যাদের শাস্ত্র শূদ্রকে ঘোষণা করেছে, কাক ও কুকুরের সমগ্রোত্রের জীব বলে, তারা কী করে চাইতে পারে যে তাদের ঘরের কোন মেয়ে ওই “নিকৃষ্ট জাতির” কোন পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হোক। তার বীর্যে গর্ভে সন্তান ধারণ করুক। সেটা যে উচ্চবর্ণের পুরুষ কুলের অযোগ্যতার প্রমাণ। বড় লজ্জা আর অপমানের বিষয়। তাই তারা সমাজের অন্দরে কঠোর প্রহরা বসিয়ে বর্ণসংকর সৃষ্টির পথে বহু কাটা বিছিয়ে রেখেছিল। তবু কখন কখনো বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোয় পর্যবসতি হয়ে যেত। ওই সমাজের কোন কোন নারী কোন শূদ্র পুরুষের পরিশ্রমী পেশিবহুল সুগঠিত শরীর আর তার মনের আদি অকৃত্রিম সারল্য দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ত। তখন সে প্রলুব্ধ করত ওই পুরুষকে তার ইচ্ছে পূরণের সক্রিয় সহযোগী হবার জন্য। যার ফলে কখন কখনো সেই নারী সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ত।
শাস্ত্রের বিধান আছে, যদি কোন শুদ্র কোন ব্রাহ্মণ কন্যাতে উপগত হয়, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করবার। এটা অনুমান করা কঠিন নয় যে একটি মহিলার আবেদন, আকুলতা কতখানি তীব্র হলে একজন পুরুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ত। সে যাই হোক তখন সেই ব্রাহ্মণ কন্যার গর্ভে শুদ্র পুরুষের বীর্যে উৎপন্ন সন্তানকে উচ্চবর্ণ সমাজ আর তাদের সমাজে স্থান দিত না। তারা সেই সন্তানকে ঘোষণা করত অচ্ছুত অস্পৃশ্য চণ্ডাল বলে।
শাস্ত্র বলেছে–চণ্ডালের নিবাস হবে লোকালয় থেকে দূর কোন নির্জন নদী তীরে। শবদাহ ও শুয়োর কুকুর পালন হবে তার পেশা। পরিধান বস্ত্র হবে তার শবগাত্র থেকে খুলে ফেলা পরিত্যক্ত পরিচ্ছদ। শত প্রয়োজন হলেও রাত্রিকালে কোন নগরে প্রবেশ করতে পারবে না। একস্থানে দীর্ঘদিন বসবাস করবার অধিকারও থাকবে না। স্থান থেকে স্থানান্তরে সতত পরিভ্রমণ করে বেড়াতে হবে। বিদ্যার্জনের সুযোগ থাকবে না। রাখতে পারবে না কোন সুভদ্র নাম। সদা সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যেন তার ছায়া কোন ব্রাহ্মণের শরীরে না পড়ে। শুধু মাত্র এই অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
নমঃশূদ্র সমাজের মানুষ রাজ রোষানলে–এক আদেশে সামাজিক সম্মানের নিজস্ব অবস্থান থেকে এক ধাক্কায় পতিত হল এই অসহ্য অপমানজনক নরকতুল্য জীবনের অন্ধকার গহ্বরে।
সে কবে কতকাল আগেকার কথা। সেন রাজত্ব শেষ হবার পর বঙ্গে এল মুসলমান শাসন। যা চলে প্রায় সাতশ বছর। এরপর আসে ইংরেজ শাসন। সেও চলে প্রায় দুশো বছর। এই ন’শ বছরে দেশ জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য–নানা শাখায় কত না এগিয়ে গেছে। কিন্তু এক তিলও অগ্রগতি হয়নি আজও হিন্দুধর্মের বর্ণবাদী মানসিকতার। মানুষকে বিনা কারণে অপমানিত, প্রতারিত করবার যে ধর্মীয় বিধান তাকে আজও বর্জন করতে পারেনি। তারা তা বর্জন করতে চায়ও না।
নমঃশূদ্র থেকে চণ্ডাল হয়ে যাবার হাজার বছর পেরিয়ে আসার পর কেমন ছিল সেই মানব গোষ্ঠীর জীবনযাপন তা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯১১ সালে লিখিত ধর্মের অধিকার শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠে অবগত হওয়া যায়। তিনি লিখেছেন–
“আমি পল্লী গ্রামে গিয়া দেখিয়া আসিলাম, সেখানে নমঃশূদ্রদের ক্ষেত্র অন্য জাতিতে চাষ করে না, তাহাদের ধান কাটে না, তাহাদের ঘর তৈরি করিয়া দেয় না। অর্থাৎ পৃথিবীতে বাঁচিয়া থাকিতে হইলে মানুষের কাছে মানুষ যে সহযোগিতা দাবি করিতে পারে আমাদের সমাজ ইহাদিগকে তাহারও অযোগ্য বলিয়াছে; বিনা অপরাধে আমরা ইহাদের জীবন যাত্রাকে দুরুহ ও দুঃসহ করিয়া তুলিয়া জন্ম হইতে মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইহাদিগকে প্রতিদিনই দণ্ড দিতেছি।”
এত অসহযোগ অপমান অত্যাচার অভাব অনটন অনাহার তবু নমঃশূদ্র সমাজের মানুষ প্রাগঐতিহাসিক প্রাণীদের মত বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আজও তারা স্বীয় ক্ষমতায় টিকে রয়েছে। এতেই তাদের জীবনীশক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়।
এই দেশে সর্ব প্রথম জনগণনার কাজ শুরু হয় ইংরেজ শাসনকালে। ১৮৭২ সালে সেই প্রথম জনগণনার ভার এদেশীয় যে সব উচ্চবর্ণ রাজকর্মচারীদের উপর ন্যস্ত হয়েছিল তারা অভ্যাস এবং ঘৃণাজনিত কারণে নমঃশূদ্রদের জাতি পরিচয় স্থলে নমঃশূদ্র না লিখে চণ্ডাল লেখা শুরু করে দেয়। এরই প্রতিবাদে নমঃশূদ্র সমাজ প্রবল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বরিশাল ফরিদপুর খুলনা যশোর নমঃশূদ্র অধ্যুষিত এই চার জেলায় এক সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। তখন নমঃশূদ্র সমাজ জীবনে এক ঝলক আলো প্রবেশ করেছে। ১৮১২ সালে এই সমাজে জন্মেছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুর নামে এক মহান মানুষ যিনি মারা যান ১৮৭৮ সালে। এঁর প্রবর্তিত মতুয়া ধর্মের মাধ্যমে সমস্ত নমঃশূদ্র সমাজের মানুষ তখন সংঘবদ্ধ হচ্ছিল। হরির্চাদ ঠাকুরের সুযোগ্যপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর, যার জন্ম ১৮৪৮ সালে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের উদ্যোগে খৃষ্টান ধর্মর্যাজক মিঃ মীড সাহেবের সহযোগিতায় ওড়াকান্দি সহ নানাস্থানে স্থাপিত হয়েছে অনেকগুলো স্কুল। “শিক্ষা আনে চেতনা”–জ্ঞানের আলো পেয়ে নমঃশুদ্র সমাজের মানুষ তখন আলোকিত হয়ে উঠেছে। তাই একদল তরুণ সেই অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, সমাজ বদলের–সম্মানিত জীবনের স্বপ্নে এগিয়ে চলেছে। সে এক মহা জাগরণের সূচনাকাল, নিদ্রোথিত লক্ষ লক্ষ নমঃশূদ্রদের তখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন হরিচাঁদ ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর। বেদ ব্রাহ্মণ বিরোধী এক নতুন ধর্মমত “মতুয়া” ধর্ম সংগঠনের মাধ্যমে গুরুচাঁদ ঠাকুর তাদের সংঘবদ্ধ করে, সচেতন করে, মানুষদের মনে জ্বালিয়ে তুলেছেন আত্মসম্মানের দীপ্ত মশাল–আমরা কারও চেয়ে ছোট নই, কেউ বড় নয় আমাদের চেয়ে।তখন নমঃশূদ্র সম্প্রদায়। সংঘবদ্ধ এমন এক শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে যে তাদের ক্ষমতাকে অস্বীকার করবার সাহস কারও ছিল না। তারা ওই অপমানজনক চণ্ডাল শব্দ বদলের দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলল। অবশেষে গণ আন্দোলনের চাপে ইংরেজ সরকার ১৯১১ সালে নমঃশূদ্রদের সমস্ত সরকারি নথি পত্রে নমঃশুদ্র জাতি পরিচয় লেখবার আদেশ দেয়। সেই আদেশনামায় এদেশীয় রাজকর্মচারী গণকে সতর্কীকরণ করে বলা হয়, যদি কোন রাজকর্মচারী নমঃশূদ্রদের জাতি পরিচয় স্থলে নমঃশুদ্র না লিখে চণ্ডাল বা অন্য কোন অপমানজনক শব্দ লেখে তাহলে তার চাকরি হারাতে হবে, এই কারণে উচ্চবর্ণের সরকারি কর্মচারীরা আর চণ্ডাল লেখবার সাহস করে না। তখন থেকে নমঃ শূদ্ররা পাকাপাকি ভাবে নমঃশূদ্র নামেই স্বীকৃতি পেতে থাকে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা ১৮৭২ থেকে ১৯১১–প্রায় চল্লিশ বছর কালের এই দীর্ঘ লড়াই সবটা এক অকারণ পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত হয়েছে। ১৯১১ থেকে ২০১১ শত বছর অতিক্রান্ত। চণ্ডাল নাম বিমুক্ত হয়ে, নমঃশূদ্র নামে হিন্দুধর্মের চতুবর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে অনুপ্রবেশ পেয়ে, তারা কী ফিরে পেয়েছে তাদের হৃত সামাজিক সম্মান? পাচ্ছে কী বর্ণপ্রভুদের কাছ থেকে সেই মানবিক ব্যবহার?
আজ নমঃশূদ্র সমাজের মানুষের মধ্যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার রাজনেতা কবি শিল্পী সাহিত্যিক কম নেই। ডাক্তার তার রোগীর কাছে শিক্ষকতার ছাত্রছাত্রীর কাছে কবি সাহিত্যিক তার পাঠক পাঠিকার কাছে রাজনেতা জনতার কাছে সাধারণতঃ যে শ্রদ্ধা সম্মান পাবার অধিকারী সেটুকু তিনি পেশাগত কারণে হয়ত পেয়ে থাকেন, কিন্তু যখন সমপেশার সম প্রতিভার দশ জন একত্রিত হন, স্বাভাবিক কারণেই সেই দশজনের নয় জন হবে উচ্চবর্ণ, কেউ কী বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন যে সেই সংখ্যাগরিষ্ট উচ্চবর্ণ মানুষরা নমঃশুদ্র মানুষটির প্রতি সমসম্মান প্রদর্শন করে? মুখ নিচু করে, আড়ালে হাসাহাসি, নিন্দামন্দ, বিদ্রূপ করে না? যে সব বিশিষ্ট নমঃশুদ্র মানুষদের সাথে আমার মেলামেশা এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা বড় তিক্ত, বড় মনোকষ্টের। তাই আজ মনে হয় সেদিনের সেই নাম বদলের আন্দোলন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। নামটির বদল নয়, প্রয়োজন ছিল মানসিকতা পরিবর্তনের আন্দোলন। সেটা হয়নি বলে নমঃশূদ্র সমাজ সামাজিকভাবে আজও রয়ে গেছে সেই অবজ্ঞা অবহেলা অপমানের স্তরে। এক ইঞ্চিও সম্মান বেড়েছে এমন প্রত্যয় হবার মতো কারণ ঘটেনি।
আমার তো এমন মনে হয়, হিন্দু ধর্মের দাসত্ব স্বীকার করে নিয়ে চতুবর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে নমঃশূদ্র সমাজ বর্ণ প্রভুদের গোলাম হয়ে যাবার চেয়ে সেই “পঞ্চমবর্ণ” চণ্ডাল থাকাই অনেক মঙ্গল ছিল। আর যা কিছু হোক সে তো কারও দাস ছিল না। শাস্ত্রে শূদ্রকে দাস বলা হয়েছে। এবং দাসত্ব, তা সে সামাজিক আর্থিক ধর্মীয় যাই হোক তা কোন দিন মনুষত্বের বিকাশের সহায়ক হয় না।
.
আমার মা বাবা দুজনেই ছিলেন সরল সোজা মানুষ। ফলে তারা সঠিক ভাবে বলতে পারেননি আমার জন্ম সাল কোনটি। তবে আমার অনুমান সেটা সম্ভবতঃ ১৯৫০-৫১ সালই হবে। যার মাত্র কয়েক বছর আগে সেই চরম বিপর্যয় ঘটে গেছে যার নাম দেশভাগ। যে দেশভাগের অল্প কিছুদিন আগে সারা দেশকে ঝলসে দিয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহ আগুন। কবীর-নানক-বুদ্ধদেব-শ্রীচৈতন্যের প্রেমবাণী পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল সেই আগুনে, স্বার্থপর রাজনেতাদের ধুর্ত বেওসায়িক কৌশলে। প্রথমে কলকাতা তারপর নোয়াখালি তারপর বিহার, এক দাঙ্গা প্রস্তুত করেছে আর এক দাঙ্গার প্রশস্ত সুতিকাগার। যেখানে জন্ম নিয়েছে শুধু ঘৃণা আর ঘৃণা, হিংসা আর প্রতিহিংসা। যার সর্বশেষ পরিণাম দেশভাগ। দেশভাগের কারণেই লক্ষ লক্ষ প্রাণভয়ে ভীত মানুষ প্রিয় স্বদেশ–“জননী জন্মভূমি” পরিত্যাগ করে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে এক অচেনা ভুগোল অজানা ইতিহাস আর অনেক অপমান অত্যাচানা বঞ্চনার অসহ্য এক অধ্যায়ের দিকে। আজও যার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হয়নি।
বরিশাল জেলার তুষখালির সন্নিকটে যে গ্রামে আমাদের বসবাস ছিল তখন পর্যন্ত সেখানে কোন ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা হয়নি। আজ হয়নি কিন্তু কাল যে হবে না, এর তখন কোন নিশ্চয়তা ছিলনা। সবাই জানে, দাঙ্গার বীজ সমাজ গর্ভে মজুদ হয়ে আছে। দুর কিংবা নিকট ভবিষ্যতে সে বীজে যে বিস্ফোরণ ঘটবে না এমন ভরসা তখন কে দেবে!
আমার ঠাকুরদারা ছিলেন তিনভাই। বরিশাল জেলার জল মাটির এমন গুণ যে সেই জলমাটির স্পর্শ পাবে সে সব জাড্যতা ঝেড়ে ফেলে ভীষণ রকম সাহসী হয়ে উঠবে। যে কারণেই এই মাটি ইংরেজ শাসকদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া বহু বীর বিপ্লবীর জন্ম এবং কর্মভূমি।
আমার ঠাকুরদার ছোট ভাই একদিন সেই “বরিশাইল্যা” সাহসের নৌকায় সওয়ার হয়ে বের হয়ে পড়ে এক দূরদেশ যাত্রায়। সে যাবে উড়িষ্যার কটক জেলায় মোষ কিনে আনতে। খাল বিলের দেশ বরিশালে এখনও রেল লাইন বসেনি, তখন দেশের অন্যত্রও তা সম্পূর্ণ হয়নি। কটকে যেতে হলে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া অন্যভাবে যাবার বিশেষ সুযোগ ছিল না। আর পথে পথে। তখন ছিল চোর ডাকাত ঠগির খুব উৎপাত। ছিল কলেরা ম্যালেরিয়া প্লেগ এই সব মারণ ব্যাধি। তবে এই সব বিঘ্ন বিপদ তুচ্ছ করে সেখানে গিয়ে দুচার খানা মোষ কিনে, এক দু মাস পায়ে হেঁটে ফিরে আসতে পারলে, এখানে যে দামে সেই মোষ বেঁচা যাবে, আর তাতে যা লাভ হবে, ছয় মাস খেটেও অত টাকা চোখে দেখা দুষ্কর।
কিন্তু ভাগ্য মন্দ তার। স্বদেশ স্বভূমি থেকে দশবারো দিনের পথ পার হয়ে এসে হঠাৎ সে আক্রান্ত হয়ে পড়ল মারণ রোগ কলেরায়। সেইকালে গ্রামবাংলায় কলেরা রোগের আর এক নাম ছিল মড়ক। যা একজনের হলে জনে জনে সংক্রামিত হয়ে পড়ত। মড়ক লেগে যেত সারা গ্রামে। উজার হয়ে যেতনগর জনপদ। মাত্র কিছু বছর আগে ভরত কাঠি নামক এক গ্রামে মড়ক লেগেছিল। প্রায় তিনশো পরিবারের সেই গ্রামে নাকি সব মানুষ মরে গিয়েছিল। ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাবার মতো একজনও আর অবশিষ্ট ছিল না।
ছোট ভাইয়ের সঙ্গী সাথী ছিল সাত আটজন। যাদের মনে ভরত কাঠির স্মৃতি আতংক তখনও বড় টাটকা। ছোট ভাইয়ের রোগ দেখে সবার বুকে জেগে উঠল মৃত্যু ভয়। প্রাণ বড় মূল্যবান বস্তু। সে একবার যদি যায় আর ফেরে না। “আমি মরে গেলে আমার বউ বাচ্চার প্রতিপালন কে করবে।” অবশেষে তারা যুক্তি পরামর্শ করে মৃতপ্রায় ছোটভাইকে সেই গাছতলায় ফেলে যে যার প্রাণ নিয়ে পালিয়ে চলে এল এবং গ্রামে এসে বলে দিল, সে মারা গেছে।
যে রোগের কবলে সে পড়েছিল বিনা চিকিৎসায় বিনা সেবা শুশ্রূষায় মারা যাবারই কথা। সেটা হলে ভালই হোত অনেক বড় বিপদের সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পেত এখানকার মানুষ। কিন্তু সে মারা গেল না। এক মুসলমান ভোরবেলা যাচ্ছিলেন ফজরের নমাজ পড়তে। তার চোখে পড়ে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে। মানুষটা একা মরছে না তার সাথে মারা যাচ্ছে মানব সমাজের মনুষত্ব, বিবেক দয়া মায়া মানবিকতা সব কিছু। তার আর নমাজ পড়তে যাওয়া হল না। ছোট ভাইকে তুলে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে, এবং দীর্ঘ সেবা শুশ্রূষায় সুস্থ করে তুললেন তাকে। এরপর যেদিন সে নিজের গ্রামে ফিরে এল ততদিনে দুই দাদা শ্রাদ্ধশান্তি সেরে ফেলেছে তার।
যারা তাকে ফেলে গিয়েছিল তারা তো গ্রামে গিয়ে এই কথাই বলেছিল যে সে মারা গেছে। এখন সে জীবিত ফিরে আসায় সারা অঞ্চলে হৈ চৈ পড়ে গেল। দুটো পক্ষ হয়ে গেল গ্রামে। একদল বলল-এভাবে ফেলে এসে মিথ্যা কথা বলাটা ঘোরতর অন্যায়। আর একদল বলল, না, কোন অন্যায় নয়। একজনার জন্য কী পাঁচজন মরবে! এই নিয়ে বেঁধে গেল দুপক্ষের ঝগড়া লড়াই কঁজিয়া। এরপর গ্রাম সভায় বিচার গেল। গ্রাম্য মাতব্বরগণ বিচার করে, যারা ছোটভাইকে ফেলে এসেছিল তাদের দোষী সাব্যস্থ করে মোটা অংকের টাকা জরিমানা করলেন।
এরপর কেটে গেল বেশ কিছুদিন। হঠাৎ একদিন দূর দেশের সেই মুসলমান লোকটি কয়েকজন সঙ্গীসাথী নিয়ে খোঁজ খবর নিতে চলে এল ছোট ভাইয়ের। তখন গ্রামের সবাই জেনে গেল যে সে মুসলমানের অন্নজল খেয়ে বেঁচে এসেছে। এ যেন সেই লালন ফকিরের প্রাণে বাঁচার মতো আর এক ঘটনা। তখন সেই জরিমানা দেওয়া লোকেরা প্রতিহিংসাবশতঃ গিয়ে হাজির হল গ্রামের মাতব্বরদের দরজায়–“আমরা যা দোষ করছি তার জইন্য আপনেরা দশজোনে যা সাজা দিছেন আমরা মাতা পাইত্যা নিছি। এইবার আপনেরা ছোডোর বিচার করেন। হে যে মিয়াগো ঘরে ভাতগোস্ত খাইয়া আইছে তার কী হইবে”।
তখনকার গ্রামবাংলার বিচার ব্যবস্থা বড় কঠোর। জাতধর্ম রক্ষার জন্য ভীষণরকম নির্দয়। তাদের বিবেচনায়, আগুনে যে হাত দেয়, সে জেনে দিক আর না জেনে, হাত তো পুড়বেই। “ছোট” মুসলমানের অন্নজল খেয়েছে, সে বুঝে খাক আর না বুঝে, এর বিচার তো হবেই। ছেড়ে দেবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। জাত ধর্ম বলে কথা! তাই বিচার হল অপরাধীর। সমাজপতিরা রায় দিল সে জাতি দ্রুত ম্লেচ্ছ, বিধর্মী হয়ে গেছে। আর তার সুমহান সনাতন ধর্মে কোন স্থান নেই। ফলে আমার সেই ঠাকুরদাকে জাত খুইয়ে “খেড়ে” হয়ে যেতে হল। যারা সরাসরি হিন্দু থেকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে, তাদের বলা হয় খেড়ে। আর যারা বৌদ্ধধর্ম থেকে মুসলমান হয় তারা নেড়ে বলে চিহ্নিত হয় হিন্দু সমাজে।
সেদিন সে ছিল সারা গ্রামে একেবারে একা এবং অসহায় এক মানুষ। পরবর্তী কালে দিনে দিনে নানাভাবে “জাতমারা” যাওয়া লোকের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়ে গেছে তাদের অন্য গ্রামের একই ধরনের লোকজনদের সাথে ঘনিষ্টতা। ধর্মীয় নিপীড়ন যাদের বেঁধেছে একসূত্রে।
প্রথম দিকে যারা সংখ্যায় ছিল কম এবং সামাজিক দিক থেকে খুবই দুর্বল; কারণ হিন্দুরা তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু ধর্মীয় বিধি পালন না করার জন্য মুসলমানরাও কাছে টেনে নেয়নি। বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাক্রম এবং অন্যান্য মুসলমান ভাইদের সাহস ও সহযোগিতায় তারা এসময়ে ভীষণ রকম বলবান। তারা যে কোনদিন হিন্দুধর্মের অতীত-অন্যায় অবিচারের প্রতিশোধ নিতে ক্রদ্ধ হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যুগ যুগান্তের সঞ্চিত ক্রোধে যদি একবার বিস্ফোরণ ঘটে তাহলে সে যে কতখানি নির্মম আর বিভৎস হতে পারে তারই বোধহয় প্রকৃষ্ট উদাহরণ “মুলাদির রায়ট”।
সেখানকার এক ইস্কুলে আশ্রয় নিয়ে ছিল প্রায় চারশো দাঙ্গায় ঘর পোড়া প্রাণভয়ে ভীত নরনারী শিশুবৃদ্ধ। পালাবার সব পথ বন্ধ করে দিয়ে তাদের সারারাত ধরে একে একে জবাই করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। শোনা যায়, এখানে ঘাতকেরা নাকি পায়ে নুপুর বেঁধে নেচে নেচে মানুষ কেটে ছিল। কে বলতে পারে যে তুষখালি, পিরিচপুর, জালোকাঠি, নাজিরপুর, এসব অঞ্চলেও একদিন দাঙ্গা হবে না!
দাঙ্গা! দু অক্ষরের ছোট্ট এই শব্দটার মধ্যে লুকোনো আছে সেই ভয়ংকর মারণ বিষ যা মানুষকে বোধবুদ্ধি বিচার বিবেচনা হীন একটা পাগলা কুকুর তুল্য জীবে পরিণত করে দেয়। যার কাছে তখন দয়ামায়া স্নেহমমতা আশা করা বৃথা।
তুষখালি অঞ্চলে আগে কোনদিন কোন মুসলমান ছিল না। শুধু এখানে কেন, অনেক অঞ্চলেই ছিল না। দুই বাংলা এক করলে জনসংখ্যার নিরিখে এখন হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। এরা কেউ ইরাক ইরান সৌদিআরব থেকে আসেনি। সব এই দেশের মানুষ, যাদের পূর্ব পুরুষরা ছিল হিন্দু। এদের একটা বড় অংশ জন্ম নিয়েছে অসহিষ্ণু হিন্দু ধর্মের সংরক্ষকদের ভুল ভ্রান্তির ফাঁক ফোকর থেকে। এখন সেই বিষবৃক্ষের বিষময় ফল ফলতে শুরু করেছে। শত শত বছরের অপমান অবমাননার বদলা নিতে রক্তখেলায় নেমে পড়েছে চির অপমানিতের দল।
এ কী অমানবিক বিধান হিন্দুধর্মে? যে মানুষটা কাল পর্যন্ত ছিল আমার প্রতিবেশী, আত্মীয়, আপনজন, আজ সে যে কোন কারণে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে গেছে বলে অচ্ছুত অস্পৃশ্য! সে যদি আমার উঠোনে এসে দাঁড়ায় কোন দরকারে, তো আমার উঠোনের মাটি অপবিত্র হয়ে যাবে! আর সেই মাটিকে পবিত্র করবার জন্য ছেটাতে হবে গরুর পায়খানা গোলা জল! সে যদি আমাকে ছুঁয়ে দেয়, স্নান করতে হবে শুদ্ধ হবার জন্য। অথচ বিষ্টাভোজী এক কুকুরের বাচ্চার জন্য এসব কিছুই করবার দরকার নেই। সে ইচ্ছা করলে আমার বিছানায়ও শুতে পারে। এই অপমান-অমানবিক বিধানের বিরুদ্ধে যে খেপে না ওঠে সে তো মনুষ্যপদবাচ্যই নয়। ওই একই ধরনের অপমান, ঘৃণা হিন্দুধর্মের উচ্চবর্ণের নিকট থেকে নমঃশূদ্ররাও পেয়ে থাকে। তাকে ছুঁয়েও ওরা চান করে, উঠোনে দাঁড়ালে গোবর জল ছেটায়। সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নমঃশূদ্ররা তেমন কোন তীব্র প্রতিবাদ করতে পারেনি। কিন্তু মুসলমানরা পেরেছে। খেপে গেছে তারা, যে ধর্ম-যে মানুষ আমাদের ঘৃণা করে আমরা আর তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে রাজি নই।
এই কারণে পুর্ব পাকিস্থান থেকে ভয়ে আতংকে–অসুরক্ষায়, ভিটে মাটির মায়া ছেড়ে, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল মানুষ “ইন্ডিয়া” নামক এক অচেনা ভূভাগের দিকে। যারা শিক্ষিত, আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল, সমাজের মাথা, উচ্চবর্ণের লোক তাদের প্রায় সবাই পালিয়েছে সবার আগে। যে দু পাঁচ জন আছে তারাও সব পালাই পালাই করছে। এই অবস্থায় যারা নির্ধন নিম্নবর্ণ নিম্নবর্গ তারা সেদেশে বাস করবে কোন সাহসে?
আমার বাবার মোটেই দেশত্যাগ করে আসবার ইচ্ছা ছিল না। মায়ের মুখে শুনেছিমুসলমানদের সাথে তার বেশ সুসম্পর্কই ছিল। তারা বাবাকে দেশে থেকে যাবার জন্য অনুরোধও করেছিল, “থাহো তুমি, দেহি কোন হালায় তোমার কী ছেড়ে।” কিন্তু বাবা তাদের অনুরোধ রাখতে পারেননি। আমাদের জ্যেঠাকাকা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী প্রায় সবাই ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। ভাঙা দেশে ভাঙা মন নিয়ে দুরুদুরু বুকে বাবা কেমন করে বাস করবেন! তাই একদিন স্ত্রী পুত্রের হাত ধরে রওনা দিয়েছিলেন এপাড় বাংলায়।
আমার তখন সঠিক বয়েস কত জানি না। তবে একদিন আমাদের ঘরের সামনের গাঙপাড়ের রাস্তা ধরে জনা কয়েক লোক ভোটের প্রচার করতে শ্লোগান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল–সেটা মনে আছে। “ভোট দেবেন কাকে, চিত্ত সুতার কে”! কে সেই চিত্ত সুতার, তিনি কোন পার্টির লোক, আমার সে সব জানা নেই, তবে আমার পরের যে ভাই, আর নাম রাখা হয়েছিল সেই নেতার নামে চিত্ত, চিত্তরঞ্জন।
মা বাবা আমি আমার ভাই চিত্ত এবং একমাত্র মেয়ের মায়া ত্যাগ করতে না পারা আমাদের বুড়ি দিদিমা এই পাঁচজন একদিন এসে পৌঁছেছিলাম এই দেশে–“মহান দেশ ভারতবর্ষে।”
এপাড় বাংলায় এসে আমাদের বেশ কয়েকটা দিন কাটাতে হয় শিয়ালদহ স্টেশনের প্লাটফর্মে। সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় বাঁকুড়া জেলার শিরোমণিপুর ক্যাম্পে। এখানে আমরা আসবার অনেক আগে এনে রাখা হয়েছে আমাদের মতো আরও কয়েক হাজার পরিবার। বিশাল একটা মাঠে সার সার খাটালে আছে লাল লাল ত্রিপলের ছাউনি। হাত আটেক লম্বা হাত ছয়েক চওড়া সেই তাঁবুর মধ্যে গুঁজে দেওয়া হয়েছে পাঁচ ছয় সাত সদস্যের এক একটা পরিবার।
শিরোমণিপুর ক্যাম্পের ঠিক মাঝখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে উত্তর থেকে সোজা দক্ষিণে। ক্যাম্পবাসীরা নিজেদের সুবিধার জন্য পুবদিকের অংশের নাম রেখেছিল আমবাগান। কেননা এখানে কিছু আমগাছ ছিল। আর পশ্চিম প্রান্তের নাম দিয়েছিল শালবাগান। বলাবাহুল্য এখানে ফরেষ্ট বিভাগ দ্বারা রোপিত একটি শালবন আছে। আমাদের তাবু পড়েছিল আমবাগানে।
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বাঁকুড়া একটি খরাপ্রধান উষ্ণ জেলা। যে সময়ে আমাদের এখানে আনা হয় সেটা গ্রীষ্মকাল। প্রখর দাবদাহে তখন চারিদিক যেন জ্বলে যাচ্ছে। ক্যাম্পে তখন মানুষের জলকষ্ট ছিল বড় প্রবল। আম ও শাল দুই বাগানের লোকের জলের প্রয়োজন মেটাবার জন্য সদাশয় সরকার বাহাদুরের পক্ষ থেকে বসানো হয় দুটো টিউবয়েল। এ ছাড়া জলের আর কোন জোগানের পথ ছিল না। ফলে জলের কলের সামনে সারাদিনই মহিলাদের লম্বা লাইন লেগে থাকতো। এক দু ঘন্টা লাইন দিয়ে যে এক দু বালতি জল যোগাড় হোত সেই দিয়ে রান্না খাওয়া বাসন ধোওয়া চান সব কিছু।
এখন আর সঠিক পরিমাণটা মনে নেই তবে মনে আছে, প্রতি চৌদ্দদিন অন্তর আমাদের কিছু চাল ডাল দেওয়া হোত সরকারি গুদাম থেকে। একে বলা হোত ডোল। দেওয়া হোত মাথা পিছু কিছু নগদ টাকা। আমাদের পাঁচজনের পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত সে অর্থের পরিমাণ ছিল কুড়ি টাকা তের আনা। তের আনা মানে একাশি পয়সা। আমরা যে বছর এখানে আসি তখনও দশমিক মুদ্রার প্রচলন হয়নি। সেটা হয়েছিল এক দুবছর পরে। তবে মানুষ তখনও পুরানো হিসাবে “আনার” হিসাবই করত। ছয় নয়া পয়সায় এক আনা বারো নয়া পয়সায় দু আনা। আবার পঁচিশ পয়সায় চার আনা। এক আনা সের পুইশাক। একই দোকান থেকে চার সের কিনলে এক পয়সা বেশি যায় বলে আমাদের পাশের তাবুর রাইচরণ দুসের দুসের করে দুই দোকান থেকে কিনে এক পয়সা বাঁচিয়ে নিত। বাবার মাথায় কোনদিন সে বুদ্ধি আসেনি।
বাবা ডোল পেত যখন তখনও সেই ফুটো পয়সার প্রচলন ছিল, আমাকে একটা পয়সা দিতেন। মা তাকে গেথে দিতেন কোমরের তাগায়। বলে দিতেন এই পয়সা যেন খরচ না করি। যেন জমিয়ে রাখি কোন এক পুজো পার্বণ আনন্দের দিনে খরচা করবার জন্য। না হলে সবাই যখন খাবার কিনবে, খাবে, আমার তখন লোকের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে।
ডোল পাবার পরেরদিন বাবা ক্যাম্প অফিসে জানিয়ে এক বেলার ছুটি নিয়ে বিষ্ণুপুরের চক বাজারে বাজার করতে চলে যেতেন। সেইদিন আমাদের মাছের ঝোল, আর ভাল চালের ভাত পেট ভরে খাওয়া হোত। চৌদ্দদিনের পঁচা পোকা কাঁকর পাথর খাওয়া মুখে সেদিন যেন অমৃত বর্ষা হোত। ক্যাম্পের সরকারি গুদাম থেকে আমাদের “ভোল” বাবদ যে চাল ডাল দেওয়া হোত ধুলো ময়লা কাকরে মাখামাখি সে চাল যে কতকালের পুরনো তা কে জানে। কেউ কেউ বলত এ চাল নাকি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর জন্য গুদামজাত করে রাখা হয়েছিল, দশ বারো বছরে যা পঁচে গোবর হয়ে গেছে। সে চালে ভাত রান্না করলে কেমন একটা টকটক বোটকা গন্ধ বের হোত। কেরোসিন তেল তো ছিল না। সারা ক্যাম্পের বেশির ভাগ তাঁবুতে কেরোসিনের অভাবে সূর্য ডোবার আগে রাতের রান্নাখাওয়া সেরে ফেলা হোত। এত তাঁবুতে এক সাথে ভাত রান্না হবার ফলে সেই বোটকা গন্ধে সারা অঞ্চল প্লাবিত হয়ে যেত।
এই চালের ভাত খাওয়ার ফলে প্রথম প্রথম কিছুদিন সবারই পেট পেট গুঢ় করত। জলের মতো পাতলা পায়খানা হোত। ক্যাম্পের ভিতর কোন পায়খানার ব্যবস্থা ছিল না। সবাইকে সে কাজ সারতে যেতে হোত বনে বাদারে মাঠে জঙ্গলে। যারা সুস্থ মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা সূর্য ওঠার আগে বা সূর্য ডোবার পরে একর্ম সেরে নিত। তবে যাদের পেট খারাপ-পাতলা পায়খানা হচ্ছে, সে আর অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা কী করে করবে, দুরের মাঠে বা কেমন করে যাবে! সে বসে পড়ত তাবুর আড়ালে। যার ফলে ক্যাম্পের চারদিকে জমে গিয়েছিল মলমূত্রের মহাসাগর। পথ চলবার সময়ে সতর্কভাবে পা না ফেললে বিষ্ঠা মাড়িয়ে দেবার সম্ভাবনা ছিল বড় প্রবল। আর এটা আমাদের অর্থাৎ শিশুদের প্রায়ই হয়ে যেত।
এই অখাদ্য চাল ডাল খেয়ে মানুষের নানাবিধ পেটের রোগ, তার উপর ছিল অসহ্য গরম। জলবিহীন শুষ্ক গরম জেলা যেখানে এই সময় “লু” বাতাস বয়। সে বাতাসে যেন আগুনের হল্কা যা শরীরে লাগলে চামড়া ঝলসে যায়। তখন দুপুর হলে মনে হতো আমাদের চারিপার্শ্বে যেন দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। সূর্যের শরীর থেকে ছুটে আসা তপ্ত রশ্মিকণা মাটিতে আঘাত করে আবার কেঁপে কেঁপে উপরের দিকে উঠতে থাকত। তখন খালি পা মাটিতে রাখা যেত না। মনে হোত মাটি যেন রুটি সেঁকা চাটুর মতো উত্তপ্ত। এখানকার সব মানুষই নদী মাতৃক দেশ পূর্ববাংলার অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় আজন্ম লালিত পালিত। তারা হঠাৎ ভাগ্য বিপর্যয়ে এমন শুষ্ক নীরস কঠিন মাটিতে আছড়ে পড়ে, সব যেন জলবিহীন মাছের মত ছটফট করে মরছিল।
এমনিতে তো নির্দয় আকাশ আগুন ঢালছে, সে আগুন আবার এসে পড়ছে মোম মাখানো ত্রিপলের ওপর। যার ফলে তাঁবুর মধ্যে তাপমাত্রা চতুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। এই অসহনীয় অবস্থায় বেশ কয়েক মাস ধরে ক্যাম্পে মৃত্যুর হার অসম্ভব বৃদ্ধি পেয়েছিল। যেন মড়ক লেগে গিয়েছিল সারা ক্যাম্প জুড়ে। আমাদের সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে অনবরত চলছিল অন্তহীন এক মৃত্যুর মিছিল। একটি মৃতদেহ দাহ করে ফিরে এসে লোজন আর একটা মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবার প্রস্তুতি শুরু করে দিত।
ক্যাম্পের মাঝখান থেকে যে রাস্তাটা পুবদিকে চলে গেছে মাইলটাক সামনে গেলে ছিল একটা ছোট্ট ডোবা। এখানেই দাহকরা হোত সব মৃতদেহ। দিনরাত সেখানে চিতা জ্বলতমড়াপোড়া ধোয়ায় ঢেকে যেত আকাশ। এই সব মানুষের মধ্যে বৃদ্ধ বৃদ্ধা ও শিশু মৃত্যুর হার ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে দাহ করা হোত শুধু বয়স্কদের। শিশুদের দেওয়া হত মাটি চাপা।
ক্যাম্পে তখন বার্ডফ্লু রোগ লাগা মুরগির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মারা যাচ্ছে আর সদাশয় সরকার বাহাদুর কী করছে? তবে কী ক্যাম্পে ন্যুনতম কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না? না, না, মহান ভারত সরকারের মহান মন্ত্রী আমলাদের এমন অপবাদ মরে ভুত হওয়া লোকজনও দিতে পারবে না। রীতিমত উত্তমকুমারের মত সুদর্শন, চুলে ঢেউ তোলা একজন ডাক্তার ছিল। তার চোখে দামি চশমা, মাথায় ইংরেজদের মত টুপি ছিল। মালার মত গলায় ঝোলাবার জন্য ছিল একটা স্টেথেস্কোপ, আর চড়বার জন্য ছিল টুংটাং বেল বাজানো সাইকেল। শুধু তার কাছে ছিল না সেই প্রাণদায়ী ওষুধ যা খেলে রোগী রোগমুক্ত হয়।
সে আর ও বেচারার কী দোষ। সে তো বার বার সরকারের হেলথ ডিপার্টমেন্টে–ওকে কী বলে, রিকুইজেসান পাঠিয়েছে, তারা যদি ওষুধপত্র না পাঠায় ডাক্তার আর কী করবে? ডাক্তারের কাছে ওষুধ বলতে ছিল স্রেফ দু রকম জল। যার একটা মেয়েদের পায়ে পড়বার আলতার মত লাল। আর একটা চুনগোলা জলের মতো সাদা পদার্থ। সর্দিকাশি জ্বরজারি মাথাব্যথা পেটব্যথা আমাশয়, দাস্ত থেকে শুরু করে টাইফয়েড টিবি কলেরা জন্ডিস–সব রোগের এক দাওয়াই ওই সাদা জল দিনে তিনবার। আর কাটা ফাটা পোড়াফোঁড়া সব রোগের জন্য ওই লাল রঙ দিনে দুবার।
যদি আলতা আর চুনজলে রোগ সেরে যায়, রোগী তো বেঁচে উঠবে কিন্তু মরে যাবে হাজার বছর ধরে হাজার মানব দরদি চিকিৎসকদের বহু পরিশ্রমে গড়ে তোলা চিকিৎসাশাস্ত্র। এই যে এত সব নামিদামি ডিগ্রিধারী ডাক্তার বড় বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, এত ওষুধ পত্র মেশিন যন্ত্র সব ফালতু, বেকার, মিথ্যে হয়ে যায়। তাই রোগীরা মরে যেত। মরে যেত এই বিশ্বাস নিয়ে যে বিনা চিকিৎসায় মরছি না। এম.বি.বি.এস. ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে মরছি।
ক্যাম্পের শিশুরা যাদের বয়েস সাতআট বছরের নিচে, সেই বাচ্চাগুলোই মারা যাচ্ছিল সবচেয়ে বেশি। তখন এমন রাত খুবই কম আসত যে দিন ক্যাম্পের কোন না কোন তাঁবু থেকে সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা কাতর কান্না শোনা না যেত।–”ওরে সোনা মানিকরে আমার, মায়রে ফালাইয়া কই গেলিরে বাবা।” সে কান্নায় সারা ক্যাম্পের আকাশ বাতাস বেদনাতুর হয়ে উঠত। ওই রকম আর্তকান্নার সময়ে অন্ধকার হাতড়ে মা আমাদের দুইভাইকে বুকের মধ্যে চেপে ধরতেন। বিড়বিড় করে তার ইষ্টদেবতাকে ডাকতেন। গ্রামবাংলার সরল মমতাময়ী মা ভক্তি বিশ্বাসে বুঝি এই রকম ভাবত যে তার বুকে থেকে যমরাজ তার সন্তানকে কেড়ে নিতে পারবে না।
ধর্ম বিশ্বাসী মায়ের সে বিশ্বাস টাল খেয়ে গেল একদিন। যেদিন শমনের সমন এসে পৌঁছল আমার কাছে। “চলরে ভোলা, খোল রে ভেলা, সাঙ্গ হল ভবের খেলা।” ছোট্ট পেটটা আমার জয়ঢাকের মতো ফুলেফেঁপে উঠল, সেই সাথে ধুম জ্বর, মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। একদিন পরে শুরু হল পাতলা পায়খানা। দিন দুয়েক পরে পায়খানার সাথে কাঁচা রক্তের স্রোত। এর ওপর পেটের মধ্যে নাড়িছেঁড়া যন্ত্রণা। দিন পাঁচ সাতেকের মধ্যে গোড়া কাটা পুইগাছের মতো নেতিয়ে পড়লাম আমি। অবসন্ন হয়ে গেল সারা শরীর। তখন আর বিছানা ছেড়ে ওঠবার উপায় রইল না। শুয়ে শুয়েই মলমূত্র ত্যাগ। দিনে দশ পনের বিশবার। তখন কেঁৎ পাড়লেই কাজুফুলের মত মলভাণ্ডটা গুহ্যদ্বার থেকে বাইরে বের হয়ে আসছে। সেটা মা বা দিদিমা হাত দিয়ে ঠেলে ভিতরে যতক্ষণ না ঢুকিয়ে দিচ্ছে, ঝুলে থাকছে বাইরে।
আমার এখন মনে নেই দশ না পনের দিন এইভাবে রোগভোগের পর শেষ পর্যন্ত ‘মারা’ গিয়েছিলাম আমি। আমাদের জাতের লোক মৃত শিশুদের পোড়ায় না। তা ছাড়া সেই সময় এত বয়স্ক মানুষ মারা যাচ্ছিল যে জঙ্গলে শুকনো কাঠের আকাল পড়ে গিয়েছিল। তাই বন্দোবস্ত হয়েছিল আমাকে “গোর” দেবার। পূর্ববঙ্গ থেকে পলাতক এই সব মানুষ আসবার সময় সাথে করে অনেক দামি দরকারি জিনিসপত্রই নিয়ে আসতে পারে নি। সব ফেলে রেখে এসেছে। তবে আর শাবল কোদালের মত জিনিস বয়ে আনবে কী করে। রিফিউজিদের সুবিধার্থে সদাশয় সরকার সে সব যোগাড় করে ক্যাম্প অফিসে রেখে দিয়েছে। একটা কী! একসাথে দশটা মারা গেলেও মাটি দেবার সাজ সরঞ্জামে ঘাটতি পড়বে না।
আমাদের কয়েকজন প্রতিবেশী অফিসে গিয়ে শাবল কোদাল সব নিয়েও এসেছিল। আমি মারা গিয়েছিলাম সন্ধ্যার বেশ কিছু সময় পরে। ফলে তাদের তখন আর গোরস্থানে যাবার ইচ্ছা হয়নি। শাবল কোদাল গুছিয়ে রেখে বসেছিল রাতটা শেষ হবার অপেক্ষায়। তাদের ইচ্ছা ছিল, সকাল হবার সাথে সাথে আমাকে নিয়ে চলে যাবে, আর রোদের তেজ বাড়বার আগেই কাজ সেরে ফিরে আসবে। এবার এই কোন সে অলৌকিক অবিশ্বাস্য অসম্ভব কাণ্ড আমার তা জানা নেই, মায়ের মুখে শুনেছি, সন্ধ্যে রাতে মরে গিয়ে, সারারাত মৃত থেকে ভোরবেলা যখন মোরগ ডাক দেয়, পুণর্জন্ম হয়েছিল আমার। নড়েচড়ে উঠেছিলাম আমি। বেলা যত বাড়ছিল, আমার শরীরে একটু একটু করে প্রকাশ পাচ্ছিল প্রাণের স্পন্দন। এবং এক সপ্তাহের মধ্যে আমি রোগ মুক্ত হয়ে গিয়ে সুস্থ হয়ে যাই।
এই শিরোমণিপুর ক্যাম্প কতদিনের পুরনো সে আমি জানি না। তবে আমরা এখানে এসেছিলাম যখন সেটা মনে হয় ১৯৫৩-৫৪ সাল হবে। তার প্রায় এক দুবছর ধরে সারা ক্যাম্প জুড়ে প্রবল দাপাদাপির পর মৃত্যুর দেবতা দয়া করে অসহায় মানুষগুলোকে একটু রেহাই দিয়েছিল। কথায় বলে, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাহা সয়। তখন রিফিউজিদের এখানকার পচা পোকা ধুলো কঁকর যুক্ত চাল ডাল, এখানকার জল হাওয়া রোদ মাটি সব সয়ে নেবার ক্ষমতা বেড়ে গেছে। মানুষ আর অত অল্পে কাতর হচ্ছে না, পোঁকা মাকড়ের মতো মরছে না।
এবার আমার বাবার শখ হল আমাকে চক্ষুম্মান বানাবেন। অর্থাৎ লেখাপড়া শেখাবেন। যে লেখাপড়া জানে না সে চোখ থাকতেও অন্ধ। অন্ধ এক বাপ তার ছেলেকে আর অন্ধ রাখতে চাননা। অন্ধত্বের যে কী কষ্ট তা তিনি মর্মে মর্মে জানেন। লেখাপড়া জানা বাবুদের কাছে যদি কখনো একটা সামান্য চিঠিও পড়ে শোনাবার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, এক প্রহর বেগার না খাঁটিয়ে কিছুতে সে চিঠি পড়ে শোনাবে না।
পূর্ববঙ্গে গরিব-নিম্নবর্ণের মানুষের লেখাপড়া শেখবার তেমন বিশেষ একটা সুযোগ সুবিধা হাতের নাগালে ছিল না। ইচ্ছা থাকলেই তারা লেখাপড়া শিখতে পারত না। এখানে সেই সুযোগ আছে। ক্যাম্পের মধ্যেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটা প্রাইমারি স্কুল খোলা হয়েছে। সারা ক্যাম্পের বালক বালিকারা এখানে পড়ে।
যেদিন আমাকে স্কুলে ভর্তি করার মনোবাসনা, তার দিন সাত আট আগে থেকে শুরু হয়েছিল তার প্রস্তুতি। বাবা চলে গিয়েছিলেন খুঁজতে কোথায় তালগাছ ও বাঁশঝাড় আছে। শিশুশিক্ষায় এই দুটোর অবদান অসামান্য। তালগাছ পেয়ে তরতর করে বাবা চড়ে গিয়ে ছিলেন তার মাথায়। আর সেখান থেকে বেছে বেছে নামিয়ে এনেছিলেন একগোছা তালপাতা। এরপর বাঁশ বাগানে গিয়ে কেটে এনেছিলেন দুখানা কঞ্চি। একখানা বিঘত খানেক ছোট আর একখানা হাত দেড়েক বড়। ছোটখানার মাথা থেঁতো করে হবে কলম, আর বড়খানা হবে বেত। আমি পড়া না পারলে যা দিয়ে মাষ্টার আমার ছাল তুলবে। বাবা খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করেছেন যে, বাচ্চারা পড়া না পারলে মাষ্টার মারবার জন্য তাকেই ঢোলকমলির লাঠি ভেঙে আনতে বলে জঙ্গলে পাঠায়। বাবার বিচারে এটা ঠিক নয়, বনে জঙ্গলে সাপ বিছে থাকতে পারে। তারা যদি কামড়ায় বাচ্চার লঘুদোষে গুরুদণ্ড হয়ে যাবে। বাবা তাই শক্তপোক্ত একটা লাঠি নিজেই দিয়ে দেবেন আমার কাছে। ঢোলকমলি ভাঙবার সেই ভয়াবহ মুহূর্ত এলে আমি যেন সেটা মাষ্টারের শ্রীহস্তে অৰ্পণ করি।
এরপর সেই শুভদিনে, সকালে আমাকে চান করিয়ে, কানের পাশ থেকে গড়িয়ে আসার মত মাথায় চপচপে সরষের তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে, নববস্ত্র পরিয়ে, এক বগলে বামুনে পৈতার মত দড়িবাধা একগোছা তালপাতা অন্য বগলে এক বোতল ভুষিকালি, পকেটে কঞ্চির কলম, তালপাতা পোছবার জন্য জল ন্যাকড়া, বসবার জন্য ছেঁড়া চট, দুপুরে যখন খিদে লাগবে, অর্থাৎ টিফিন টাইমে খাবার জন্য খুদের নাড়ু। এসব দিয়ে আমার হাত ধরে বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন স্কুলে। স্কুলটি আমাদের তাবু থেকে অতি সামান্যইঁদুরে। স্কুলে ঘন্টা বাজালে আমাদের তাবু থেকে শোনা যায়। বাবা চেয়েছিলেন আমার চোখে আলো জ্বালবেন, স্কুলের সামনে পৌঁছে তার সে আশার আলো দপ করে নিভে গেল। কারণ, স্কুল আর খুলবে না। আজ থেকে সব পড়াশোনা বন্ধ।
এরপর বেলা যত বাড়তে থাকল একটার পর একটা দুঃসংবাদ পাওয়া যেতে লাগল। জানা গেল রিফিউজিরা এতদিন ধরে ডোল বাবদ যে সব চালডাল অর্থ সাহায্য পেত সে আর পাওয়া যাবে না। যার যার দায়িত্ব এখন তার তার। আজ থেকে সরকার রিফিউজিদের আর কোন দায় দায়িত্ব নেবেনা। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া, আর্থিক দিক থেকে দুর্বল একটা সরকারের পক্ষে এভাবে দিনের পর দিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ান আর সম্ভবপর হবে না। এতে দেশের যে রকম, প্রকারান্তরে সেই মানুষটির নিজেরও বিরাট ক্ষতি। সে বসে বসে খেতে পেয়ে অলস কর্মভীরু হয়ে যাচ্ছে। এটা কাম্য নয়।
একথা এই সরকার ছাড়া কারও পক্ষে অস্বীকার করবার উপায় নেই যে নমঃ পোঁদ জেলে মালো এই সব লোক কঠোর পরিশ্রমী। এরা কেউই শখ করে ক্যাম্পে বসে খাবার জন্য দেশত্যাগ করে আসেনি। এসেছে প্রাণের দায়ে মান সম্মানের ভয়ে। এদের এসব ভয় না থাকলে কোনদিন দেশ ছেড়ে আসত না। যে মানুষ দেশভাগ জনিত কারণে বাঁধভাঙা বন্যার জলের মত, একান্ত বাধ্য হয়ে আছড়ে পড়েছিল এপার বাংলায়, এই সব ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে ছিল স্পষ্টতঃ দুটো ভাগ। একভাগ সচ্ছল শিক্ষিত উচ্চবর্ণ–এক কথায় যাদের বলা হয় ভদ্রলোক। আর একদল হল নিঃস্ব নিরক্ষর নির্ধন, নিম্নবর্ণ।যারা তথাকথিত ভদ্র লোকদের কাছে ছোটজাত ছোটলোক। যারা ভদ্রলোক তারা তাদের চিরকালের বর্ণবিদ্বেষ প্রসূত মানসিকতার কারণে নমঃ পোঁদ জেলে কামার কুমোর জোলা হাড়ি মুচি মানুষদের সাথে সহাবস্থানে রাজি ছিল না। তাই তারা কেউ খাতায় নাম লিখিয়ে ডোল নির্ভর ক্যাম্প বাসিন্দা হতে চায়নি। এরা সরকারের স্বজাতের নেতামন্ত্রীদের সমর্থন সহযোগিতায় কলকাতা ও তৎসংলগ্ন নানা অঞ্চলে একের পর এক প্রায় দেড়শত জবরদখল কলোনী গড়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। কিছু লেখাপড়া জানা থাকার কারণে কিছু রাজনৈতিক যোগাযোগের ফলে, কিছু জাতিগত ধূর্ততা শঠতার কৌশলে চাকরি ব্যবসা বা অন্য কোন উপায়ে রুজিরোজগার ধনাগমের সুব্যবস্থা করে নিতে বিশেষ কোন অসুবিধার সামনে পড়েনি। এরা সুখেই ছিল এবং সত্য এটাই যে অনেকে এত সুখ পূর্ববাংলায়ও ভোগ করতে পারেনি।
এর বাইরে যে লক্ষ লক্ষ নিম্নবর্ণ নিম্নবর্গ বাস্তুহারা মানুষ, যারা ওপার বাংলায় সতোর সাথে কায়িকশ্রমে দিনগুজরান করতে বাধ্য ছিল সেই সব মানুষ যারা দেশ ছেড়ে এসেছেশূন্যহাতে তারা নিরুপায় হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল রিফিউজি ক্যাম্পে। কারণ কোথাও কোন জবরদখল কলোনিতে নীচু জাত হবার অপরাধে এদের জন্য কোন প্লট দেবার নিয়ম ছিল না। ওই সব কলোনি স্থাপনার প্রাথমিক শর্ত এই ছিল–”এখানে শিক্ষিত ভদ্রলোক ছাড়া আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।” নীচু জাতির কোন কোন সচ্ছল শিক্ষিত মহাশয় নামধাম গোপন করে বিত্তের জোরে কোন কোন কলোনিতে ঢুকে টিকে গেছেন। কেউ কেউ আবার আসল নাম পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়লে গলাধাক্কা খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এই কারণে কলকাতা এবং তার আশেপাশে গড়ে ওঠা ১৪৯টি জবরদখল কলোনির একটাতেও একটি নমঃশূদ্র জেলে মুচি পরিবার পাওয়া যাবে না। যদি পাওয়া যায়, জানা যাবে সে পরিবার এসেছে অনেক পরে।
বামুন কায়েত বদ্যিরা তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যে বুদ্ধিমান হয়, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং আত্মস্বার্থ ভালো বোঝে! তারা সেই উথালপাথাল অস্থির সময়ে খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে একাধিক কলোনিতে প্লট দখল করে রেখেছিল। এ নিয়ে অনেক সময় দখলকারি এক কলোনির লোকের সাথে আর এক কলোনির লোকের তুমুল মারামারি পর্যন্ত হয়ে যেত। যার অনেকগুলোকে জমিদারের গুণ্ডাবাহিনীর হামলা বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। অবস্থা কিছুটা শান্ত হয়ে গেলে দুচার বছর বাদে, নিজের পছন্দমত একটা প্লট দখলে রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দেয়। তখন আর ক্রেতার জাতপাতের ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা থাকে না। মাথায় ঘোরে দরদামের বাস্তব ব্যাপারটা। এই কারণেই নিচুজাতের কিছু পয়সাওয়ালা লোক কলোনিতে প্রবেশ পেয়ে যায়। আর এইভাবে জমি বিক্রি করে বহু কলোনিবাসী হঠাৎ লাখপতি হবার সুযোগ পায়। এইসব ভাগ্যবানের বাইরে ক্যাম্পবাসী যে হতভাগ্য লক্ষ লক্ষ নিম্নবর্ণ যাদের শিক্ষাদীক্ষা নেই, পেটে ভাত পরিধানে ত্যানা নেই, যাদের হয়ে কথা বলার মতো কোন রাজনৈতিক মুরুব্বিও নেই, এরা কোথায় যাবে। এরা তো সেই মানুষ যাদের দিয়ে দেশের কোন মঙ্গল হবার নয়। বলতে গেলে এরা সব দেশের কাছে–উদ্বৃত্ত অপাঙক্তেয় আবর্জনা বিশেষ কোথায় নিয়ে ফেলা হবে এগুলোকে? সদ্য ক্ষমতা হাতে পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ প্রাণভরে উপভোগ করতে চেটেপুটে খাবার সুযোগ পাওয়া রাজনেতাদের কাছে এ সময়ে এটা যেন গোঁদের উপর বিষফোঁড়া।
আমরা তো প্রায় ছয়বছর, কারও কারও আরও বেশি। এতদীর্ঘ সময়কাল ধরে এক নারকীয় অবস্থার মধ্যে ক্যাম্পে ফেলে রাখা হয়েছিল হাজার হাজার মানুষকে। কে জানে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের হয়ত আশা ছিল, এত কষ্ট সহ্য না করতে পেরে এরা যে যেখানে পারে চলে যাবে। যখন কেউ ক্যাম্প ছেড়ে নড়ল না তখন তাদের উচ্চবর্ণ উচ্চমস্তিষ্ক থেকে বের হল এক পরিকল্পনা–যেমন মানুষ তাদের পাঠান হবে তেমনই এক উপযুক্ত স্থানে, আর সেটা আন্দামান। ইংরেজ শাসনকালে সাজা দিয়ে যেখানে খুনি ডাকাতদের পাঠান হতো। এগুলোকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়া যাক। এরপর মরুক বাঁচুক যা পারে হোক।
বাঙালী মননে চিন্তনে তখনও আন্দামানদ্বীপ কোন মনুষ্য বসবাসের উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচিত হয়নি। তাদের ধারণায়, ওটা কঠোর শাস্তিদানের স্থান। যেখানে সব মারাত্মক ধরনের অপরাধীদের মরবার জন্যই প্রেরণ করা হয়। তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির বলতে গেলে পায়ের নিচে শক্ত মাটি ছিল না। গোটা কয়েক নেতা সর্বস্ব এই দল থেকে সাধারণ মানুষ ছিল শত মাইল দুরে। গুটি কয়েক বিদ্বান নেতা এর তত্ত্ব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা, পত্র পত্রিকায় নিবন্ধ লেখা এই নিয়ে মগ্ন ছিলেন। এবার ঘোলাজলে মাছ ধরার একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলেন। যে সুযোগের তারা প্রতীক্ষায় ছিলেন। আঁপিয়ে পড়ল তাই নিজেদের উচ্চাশা পূরণের নিমিত্তে রিফিউজিদের মাঝে, পার্টি গড়ার কাজে। নানা রকম কথা বলে বাড়িয়ে দিল তাদের ভয়ভীতি আর জাগিয়ে তুলল আশা।–”আমরা তোমাদের পাশে আছি। কেউ যেওনা আন্দামান। আমরা আন্দোলন করে তোমাদের এই বাংলাতেই পুনর্বাসন দেওয়াব।” এর ফলে রিফিউজিরা আর আন্দামান যেতে রাজি হল না। বন্ধ হয়ে গেল কেন্দ্রীয় সরকারের সেই পুনর্বাসন প্রকল্প।
আজ এত বছর পরে মনে হয় সেদিন রিফিউজিদের জন্য সরকার পক্ষ যা করতে চেয়েছিল, আর কমিউনিস্ট পার্টি যা করেছিল, দুই তরফের কোথাও কোন দয়া দরদ আন্তরিকতার লেশমাত্র ছিল না। ছিল দুরভিসন্ধি, কাপট্য, বেড়ালব্রত, উদ্দেশ্য পূরণের নকড়াছকড়া। তবে সেদিন যদি রিফিউজিরা কমিউনিস্টদের প্ররোচনার ফাঁদে পা না দিয়ে আন্দামান চলে যেত, সেটা অন্ততঃ মন্দের ভাল হোত। এখন যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, যারা সেদিন মনভোলানো কথায় না ভুলে চলে গিয়েছিল তারা ভাল আছে, সুখে আছে। অন্ততঃ পশ্চিমবঙ্গের রিফিউজিদের চেয়ে শতেকগুণে ভাল।
এসব যখন ঘটে, আমার বাবা তখনও এদেশে আসেননি। আমরা শিরোমণিপুরে আসবার পূর্বেই সম্ভবতঃ আন্দামান পর্ব চুকেবুকে গিয়েছিল। কারণ এই বিষয় নিয়ে তখন সরকার বা কমিউনিস্ট বা রিফিউজি কোন তরফে কোন হেলদোল কোন আলোচনা তাপ উত্তাপ কিছুই ছিলনা। তখনকার রিফিউজি ক্যাম্পগুলো ছিল একটা বদ্ধ জলাশয়ের মতো নিথর নিশ্চুপ নির্জীব। মানুষগুলোর চোখের মণিতে কোন আলো আশা ঔজ্জ্বল্য ছিল না। মুখে ছিল না গল্প গান হাসি কথা। সব যেন তখন হতাশায় দড়িবাধা জাবরকাটা গরুর মত ধুঁকছে। কীযে হবে আর না হবে সেই ভয় ভাবনায় অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে শুধু দিন গুনছে।
এইভাবে আরও বেশ কয়েকটা অলসমন্থর বছর পার হবার পর সরকারি কর্তা নেতা মন্ত্রীদের মগজে এল দ্বিতীয় পরিকল্পনা। যার নাম দণ্ডকারণ্য পুনর্বাসন পরিকল্পনা। দণ্ডকারণ্য অথরিটি স্থাপিত হয় ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ সালে। এখন যার নাম ছত্তিশগড়, এর সাতটি জেলার মধ্যে সবচেয়ে অনুন্নত জেলা বস্তর। ঠিক অনুরূপ উড়িষ্যার সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অনুন্নত জেলা মালকানগিরি। এই দুই প্রদেশের দুই জেলার অনুন্নত দুর্গম অস্বাস্থ্যকর বন্ধ্যাভূমির কিছু বনাঞ্চল নিয়ে গঠন করা হয়েছে দণ্ডকারণ্য অঞ্চল। এখানেই “পুনর্বাসন” দেওয়া হবে এই সব রিফিউজিদের।
এ এমন এক অঞ্চল যেখানে কোন সভ্য জগতের মানুষের পদচিহ্ন পড়েছে কিনা তা বোঝা যায় না। এখানে বসবাস করে একদল আদিম জনগোষ্ঠীর প্রায় বিবস্ত্র মানুষ। যাদের ভাষা সংস্কৃতি ধর্মাচারণ খাদ্যদ্রব্য সবকিছুর সাথে বঙ্গজীবনের তিল পরিমাণ মিল খুঁজে বের করা মুশকিলই নয়, অসম্ভব কঠিন। এই বনরাজ্যে আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতি, জ্ঞান বিজ্ঞানের অতি সামান্য বিকিরণও অনুপ্রবেশ করার পথ পায়নি। সভ্যতা এখানে যেন সদ্য অন্ধকার গুহা ছেড়ে বাইরে এসেছে। প্রস্তর যুগ শেষ হয়ে মানব সমাজ এইমাত্র প্রবেশ করেছে লৌহ যুগে।
এখানকার মাটিতে মুরোম কাঁকর পাথরের মাত্রা খুব বেশি। এই মাটিতে হাল চলে না, কোদাল বসে না তাই ফসল ফলে না। আদিবাসীরা চাষবাস বিশেষ একটা করে না। চাষ করতে জানেও না। বনে যে সব ফলমূল পশুপাখি সাপ ব্যাঙ ইঁদুর বাদর যা পায় ধরে মেরে খেয়ে বেঁচে থাকে। যারা বেঁচে থাকে তার মধ্যে একটা ভাগ নানাবিধ রোগে, জন্তু জানোয়ারের আক্রমণে মরে যায়। এই সব কারণে বিশাল এই অঞ্চলে তুলনামূলক ভাবে জনসংখ্যার পরিমাণ খুবই কম।
এখানে রিফিউজিদের নিয়ে গিয়ে ফেলে দিতে পারলে একঢিলে দুটো পাখি মারা যায়। একটা–রিফিউজিদের পুনর্বাসনের বিচ্ছিরি ঝামেলাটার সহজ সমাধান, আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, এই যে বিশাল বনাঞ্চল যেখানে রয়েছে শাল সেগুন বীজা মহুয়া করর্যা গাছ আর বাঁশের অপার সম্ভার। রয়েছে কেন্দুপাতার অফুরন্ত উৎপাদন। বাঁশে যেমন কাগজ __ মহুয়ার ফুলে মদ, ফলে তেল। শাল সেগুন বীজা গাছে দামি আসবাব।
এখানকার মাটির নিচে আছে লোহা, তামা, সিসা, ডলোমাইট বক্সাইট আরও কত খনিজ সম্পদ। মেহনতি মজদুরের অভাবে সেসব যথাযথ সংগ্রহ সম্ভব হয় না। আদিবাসী মানুষরা সাধারণতঃ এসব কাজে পারদর্শী নয়। তারা শ্রমজীবনের উৎপাদনমুখী শৃঙ্খলাও মেনে চলে না। তাদের দিয়ে এসব কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করা যায় না। রিফিউজিদের এখানে নিয়ে এলে এই সমস্যা মিটে যায়। এখানকার জমি তো এমন নয় যে শুধু চাষবাসে বছর চলে যাবে। তখন পেট চালাতে হলে অন্যকাজ না করে উপায় থাকবে না। এই সব দুষ্ট পরিকল্পনা মাথায় রেখে গঠিত হয়েছে দণ্ডকারণ্য পুনর্বাসন প্রকল্প।
এই পাটিগণিতের হিসাবে একদিন ক্যাম্পের অফিস ঘরের নোটিস বোর্ডে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটা নোটিশ। সেই নোটিশের যা বক্তব্য একজন ঢেড়া পিটিয়ে ক্যাম্পের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সবাইকে জানিয়েও এসেছিল। এতদ্বারা মহামান্য ভারত সরকারের পুনর্বাসন বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো যাচ্ছে যে শিরোমণিপুর ক্যাম্পের সমস্ত রিফিউজিদের পুনর্বাসনের নিমিত্তেদণ্ডকারণ্য ডেভেলাপমেন্ট অথরিটির অধীনে রিফিউজি প্রেরণ শীঘ্রই শুরু করা হবে। যে আগে নাম নথিভুক্ত করাবে সে আগে যাবে। আপনাদের নিকট আবেদন সত্বর নাম নথিভুক্ত করান।
দণ্ডকারণ্য! পুনর্বাসন! ক্যাম্পের যারা সামান্য অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন, রামায়ণ মহাভারত পড়তে পারে, দণ্ডকারণ্যের নামে বুক হিমশীতল হয়ে গেল তাদের। কোথায় পুনর্বাসন?–এ-তো পুনঃ নির্বাসন। দণ্ডকারণ্য, সে যে এক মহাঅরণ্যের নাম। মহাকবি বাল্মীকি তার মহাকাব্যে লিখেছেন অতীব বিপদ সঙ্কুল সে স্থানের বিশদ বর্ণনা। সেখানে এমন ঘনঘোর অরণ্য যে দৃষ্টি চলে। সে বনে ঘুরে বেড়ায় নরমাংস ভক্ষক রাক্ষস খোক্কসের দলবল। একবার মানুষকে নাগালে পেলে আর কথা নেই, ধরে কচক করে চিবিয়ে খেয়ে নেয়। ওই বনে গিয়ে নররূপী নারায়ণ রামচন্দ্র কী ভীষণ বিপদে না পড়েছিলেন, আর আমরাতো সামান্য মানুষ।
ভয়তাড়িত এইসব সরল সোজা মানুষের ভয়ভীতিকে মূলধন করে আবার রাজনীতির আসর গরম করতে পথে নেমে পড়ল কমিউনিস্ট নামধারী নেতারা। সেই ১৯৫১-৫২ সালে আন্দামান পুনর্বাসন প্রকল্প বানচাল করবার পর এই ৬/৭ বছর আর বানচাল করার মতো কোন কাজ ছিল না। আবার একটা সুযোগ এসেছে। সুদূর কলকাতা মহানগর থেকে বাঁকুড়ার শালবনে-শিরোমণিপুর ক্যাম্পে ছুটে গেলেন এক নেতা। মাইকে মুখ রেখে তারস্বরে চেঁচিয়ে তিনি মানুষকে খুঁসলানি দিয়ে বেড়াতে লাগলেন “আপনারা কেউ যাবেন না দণ্ডকারণ্য। কেন যাবেন! আপনারা এই বাংলার মানুষ। আপনাদের বাংলাতে পুনর্বাসনের অধিকার আছে। আর তাই আপনারা পাবেন। আমি দিল্লি যাব। গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে বলবো বাংলার মানুষকে বাংলার বাইরে পাঠানো চলবে না। ভয় পাবেন না, হতাশ হবেন না, আমরা আপনাদের পিছনে আছি।”
সরকারি দপ্তর থেকে নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানিয়ে নাম নথিভুক্ত করার যে আবেদন জানানো হয়েছিল, সেদিন এক অফিসার মোটা একটা খাতা নিয়ে অফিস ঘরে বসেছিলেন, কিন্তু নাম লেখাতে বিশেষ কেউ এল না। পরের দিন লোক নিতে এসে বেশ কটা ট্রাক খালি ফিরে গেল। কারণ, যারা যাবার জন্য নাম দিয়েছিল শেষ পর্যন্ত তাদেরও বড় একটা অংশ ট্রাকে উঠল না।
এইভাবে প্রায় বছর খানেক ধরে বারবার অফিসঘরে নোটিশ দেওয়া হল। বারবার ব্যর্থ হল সরকারি প্রয়াস। অবশেষে একদিন সকালে যে ট্রাকগুলো এসেছে সেগুলো আর খালি গেল না। অফিসের সব চেয়ার টেবিল আলমারি তোলা হচ্ছে তাতে। অফিসাররা সবাইফিরে যাচ্ছেবিষ্ণুপরের হেড অফিসে। বলে যাচ্ছে তারা যদি কেউ দণ্ডকারণ্য যেতে ইচ্ছুক হয় সে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেড অফিসে গিয়ে নাম লেখায়। আগামী সাতদিনের জন্য এই সুযোগ থাকবে।
কাজেই অমানবিক ভারত সরকার রিফিউজিদের দায়দায়িত্ব দুম করে কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে সেটা বোধহয় বলা চলে না। বার বার রিফিউজিদের সময় দেওয়া হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে, “এই সব ভণ্ড কপটাচারী কমিউনিস্টদের প্ররোচনায় ভুলবেন না। এরা আপনাদের ভুল বোঝাচ্ছে।” যখন মানুষ সে কথায় কর্ণপাত করেনি, বাধ্য হয়ে সরকারের যা করবার ছিল তা করে দিয়েছে।
এবার কী হবে আমাদের, কী হবে এরপর? রিফিউজিদের আকুল প্রশ্নের জবাবে বলে নেতারা–এবার আন্দোলন হবে। ঘোর আন্দোলন। এমন একখানা আন্দোলন করব যে সরকার আমাদের ন্যায্য দাবি মেনে না নিয়ে পালাবার পথ পাবে না। বাংলায় পুনর্বাসন দেবে না! দণ্ডকারণ্য পাঠাবে। মামদোবাজি নাকি?
বিষ্ণুপুর শহর থেকে যে বাস রাস্তাটা সোজা কামারপুকুর চলে গেছে সেই রাস্তার ধারে আরও তিনটে রিফিউজি ক্যাম্প ছিল। বাসুদেবপুর ১.২.৩ নাম্বার ক্যাম্প। ওই তিন ক্যাম্প আর শিরোমণিপুর, চার ক্যাম্পের প্রায় হাজার পনের কুড়ি মানুষ এবার প্রস্তুত হল উক্ত নেতার নেতৃত্ব আন্দোলনে ঝাপাবার জন্যে। প্রথম দফায় আন্দোলন শুরু হল অনশন ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। একটা গাছের নিচে, লোক চলাচলের পাকা রাস্তার ধারে ত্রিপল খাঁটিয়ে প্রায় শ’খানেক লোক বসে পড়ল আমরণ অনশনে। রিফিউজিদের পক্ষে তখন ছিল এটা সব চেয়ে সহজতম একটা আন্দোলন। সরকারি গুদাম থেকে শেষ খেপ যে চালডাল ডোল দেওয়া হয়েছিল সেটা মাস তিনেক আগের। বলা চলে যা প্রায় এক বিস্তৃত অতীতের ঘটনা। এখানকার মানুষগুলো যে জাতি গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের মানুষ সেই নমঃ পোঁদ জেলেদের সংসারে তো চিরকালের অভাব দাপাদাপি করে বেড়ায়। এদের সবার সঞ্চয় বলতে শুধুই হা হুতাশ আর দীর্ঘশ্বাস। এদেশে যখন তারা পালিয়ে আসে হাতের মুঠোয় শূন্যতা ছাড়া আর কিছু তো ধরা ছিল না। পেট প্রতিপালন হচ্ছিল সরকারি ডোলের আনুকূল্যে। ফলে সেই শেষ পাওয়া ডোলের চালটুকু ফুরিয়ে যাবার পর ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেছে অরন্ধন-উপবাস-অনাহার। এখন আর কারও কোন আলাদা ভাবে প্রস্তুতি নেবার প্রয়োজন ছিল না। শুধু গাছতলার ত্রিপলের ছাউনির নিচে গিয়ে বসে পড়লেই আমরণ অনশন।
মানুষ কী খায়, আর কী খায় না, এই প্রশ্নের উত্তর আমার অন্ততঃ জানা নেই। সেদিন সেই ক্ষুধার রাজ্যের পাগলপ্রায় মানুষকে আমি যে কত কী খেয়ে পেটের দাউদাউ আগুনকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টায় প্রাণপাত করতে দেখেছি সে বলে শেষ করতে পারব না। বুনো ডুমুর, জংলা কচু, যার আর এক নাম খারকোল, কচি খেজুরের আঠি, খেজুর গাছের মাথি, শাপলা গাছের গোড়ায় জন্মানো ড্যাপের খই, বুনো কুল, মহুয়া ফল, চরোটা গাছের পাতা সেদ্ধ আরও কত কী!
এখানে দেখেছিলাম খিদেকে মায়ের মমতা স্নেহ সন্তানের প্রতি যে দরদ তা কেমন করে খেয়ে নেয়। এক মা তার শিশু পুত্রের “মা ভাত দাও আমার খিদে পেয়েছে,” এই কাতর কান্না সইতে না পেরে দুঃখে রাগে উন্মাদিনী হয়ে বাচ্চাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছিল এক কুয়োর মধ্যে। জল না থাকায় শিশুটি অবশ্য প্রাণে বেঁচে যায়।
এই দেশে যখন ইংরেজ শাসন বলবৎ ছিল এক নেতা অনশনকে অস্ত্ররূপে প্রয়োগ করেছিলেন। তখন কেউ অনশনে বসলে শাসকদের বুক কেঁপে যেত। ইংরেজরা ছিল সাগর পাড়ের মানুষ। তাদের প্রাণে দয়ামায়া বেশি। তারা মানুষের প্রাণের মায়া-মূল্য বুঝত। অনাহার যে কী কষ্টকর তা জানত। তাই কেউ কোন দাবি নিয়ে অনশনে বসলে তারা ছুটে আসত। আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান বের করার চেষ্টা চালাত। ওই সর্ব সাহেব শাসকদের নামে নির্দয়তার যে সব গল্প চালু আছে, হিসেব করলে দেখা যাবে এদেশীয় শাসকশ্রেণীর তুলনায় তা পাহাড়ের পাশে উইঢিবি, হাতির পাশে পিঁপড়ে, সমুদ্রের সামনে শিশির বিন্দু।
এইজন্য অনশনের আঠাশদিন অতিক্রান্ত হবার পরেও সরকার পক্ষের কেউ অনশনকারীদের কোন তত্ত্ব তালাশ নেবার প্রয়োজন বোধ করল না। এখানকার মত তখন সংবাদ মাধ্যম এত শক্তিশালী ছিল না। তাই সে খবর বিশ্ববাসীর কানে পৌঁছাল না। বাঁকুড়া জেলার ঘনবনের আড়ালে চাপা রয়ে গেল চিরকালের মতো।
অনশন অস্ত্র তখনই শক্তিশালী যখন মানুষের সংবেদনশীল দরদি একটা মন থাকে। সে মন মরে গেলে, অন্ধবধির হলে, আর কোন কাজ হবার নয়। তাই নুন লেবুর জল খেয়ে নিজেরাই অনশন ভেঙে দিল অনশনকারীরা। ঠিকমত স্মরণ নেই, খুব সম্ভবত এর মধ্যে একজন মারাও গিয়েছিল।
নেতা বলল-এত নরম দাওয়াইয়ে হবে না। সরকারকে এবার একটা কড়া ভোজ দিতে হবে।
একদিন স্থির হল, সবাই মিলে মিছিল করে, শ্লোগান দিয়ে হামলে পড়তে হবে বিষ্ণুপুর শহরে। যত কোর্ট কাছারি থানা অফিস যানবাহন বাজার হাট সব অচল করে দিতে হবে। একে বলে জঙ্গি আন্দোলন। যতক্ষণ সরকার আমাদের দাবি মেনে না নেয়, বসে থাকতে হবে সব ঘেরাও করে।
আমার মা নরম মনের মানুষ। তিনি বাবাকে বারণ করেছিলেন “যেতে হবে না আন্দোলনে।” কিন্তু বাবা মায়ের বারণ শুনলেন না। অভুক্ত দুর্বল শরীর নিয়ে তিনিও পা মেলালেন মিছিলে, গলা মেলালেন শ্লোগানে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। আমাদের দাবি মানতে হবে, নইলে গদি ছাড়তে হবে। আমরা বাংলার মানুষ আমাদের বাংলায় পুনর্বাসন দিতে হবে। এই সব শ্লোগান দিয়ে সামনে এগিয়েছিল মিছিল। কিন্তু সে মিছিলকে শহরে প্রবেশ করতে দিল না পুলিশ। তারা লাঠিসোটা কঁদানে গ্যাস নিয়ে শহরের প্রবেশ পথের সামনে আটকে দিল। তাদের কাছে গোপন সূত্রে খবর পৌঁছেছিল–ডোলবন্ধ একদল অনাহারী মানুষ, যারা শহরে মিছিল নিয়ে আসছে, এরা শান্তিপূর্ণ নাও থাকতে পারে। এতে নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। লুঠপাট হতে পারে খাদ্যদ্রব্যের দোকানপাট বাজার হাট। তাই সতর্কতার অঙ্গ হিসাবে জেলা শাসক সারা শহরে একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে সব রকম জমায়েত মিটিং মিছিলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য আনিয়ে রেখেছেন কমব্যাট ফোর্স। যারা একহাতে বেতের ঢাল আর একহাতে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে রিফিউজিদের পথরোধ করে। “খবরদার, আর এগিও না”। রিফিউজিরা এসব ধারা উপধারার এত মানে জানে না। তারা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে জোর করে ঢুকে পড়তে চাইল শহরের মধ্যে। তখন পুলিশ লাঠি চালাল। ছুড়ল কাদানে গ্যাস। বেপরোয়া সেই লাঠির আঘাতে আহত হল প্রায় দেড়শত মানুষ। আমার বাবারও মাথা ফেটে গিয়েছিল। ছেঁড়া গামছায় মাথা বেধে অনেক রাতে তাবুতে ফিরে এসেছিলেন তিনি। ঔষধ পত্রের তো কোন ব্যবস্থা ছিল না, মা গাদা ফুলের পাতা থেতো করে ক্ষতস্থানে পট্টি বেধে দিয়েছিলেন। সেই পট্টি বাধা ফাটা মাথার যন্ত্রণায় বাবা কাতরাচ্ছিলেন,কাঁদছিলেন, নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছিলেন। আর আমি। আমি সেই শিশু বয়সে শিশুমনে শপথ শানাচ্ছিলাম-যে পুলিশ আমার বাবাকে মেরেছে বড় হয়ে তাকে আমি ঠিক মারব। কোথায় লুকাবে সে। পায়ে বুট গায়ে খাকি জামা, মাথায় টুপি, হাতে লাঠি না হয় বন্দুক, তাকে আমি ঠিক খুঁজে বের করব।
সেদিন পুলিশ প্রশাসন চেয়েছিল “বিয়ের রাতে বেড়াল মারা” নীতি অনুসরণ করতে। প্রথমদিনই আন্দোলনের উপর এমন বর্বর আক্রমণ করে রিফিউজিদের মনোবল ভেঙে দিতে তারা কিছু পরিমাণে সফলও হয়েছিল বলা চলে। ফলে এরপর আরও বেশ কয়েকবার মিছিল নিয়ে বিষ্ণুপুর গিয়েছিল রিফিউজিরা, নেতারা মঞ্চে বসে গরম গরম বক্তৃতাও দিয়েছিল, কিন্তু পুলিশ আর লাঠি টিয়ার গ্যাস চালায়নি। হতে পারে প্রথমদিনের তুলনায় মিছিল মিটিংয়ে লোক সমাগম কমে যাওয়ায় তাদের আর ভয় পাবার কিছু ছিল না।
পুলিশ প্রশাসন তখন একটা অন্য ধরনের পদ্ধতি নিয়েছিল। তারা মিটিংয়ে জমা হওয়া একদল লোককে ধরে ট্রাকে তুলে নিত। তারপর সে ট্রাক চালিয়ে কুড়ি পঁচিশ মাইল দূরে কোন জনহীন মাঠে নিয়ে গিয়ে জোর করে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিয়ে খালি ট্রাক নিয়ে ফিরে চলে যেত। তখন আন্দোলনকারীদের সেই পথ ফিরে আসতে হতো পায়ে হেঁটে। পথশ্রমে ক্ষুধাতৃষ্ণায় তারা। বড় কাহিল হয়ে পড়ত।
প্রশাসনের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত উচ্চবর্ণের অফিসারগণ বড় ধূর্ত। তারা তাদের বর্ণবুদ্ধি দিয়ে বুঝে গিয়েছিল এদের ধরে জেলখানায় নিয়ে যাওয়ায় অসুবিধা আছে। সব না খাওয়া মানুষ, যদি এরা জেনে যায় জেলখানায় গরম ভাত তরকারি পাওয়া যায় তাহলে মিটিং মিছিল করার উৎসাহ বেড়ে যাবে। তাই ওই ব্যবস্থা। খালি পেটে এবার হেঁটে দ্যাখ কেমন লাগে। সেইদীর্ঘপথ পার হয়ে কতজন ফিরে আসতে পারত আর অক্ষম অশক্ত শরীর নিয়ে কতজন পথে পড়ে মরত তার হিসাব কে জানে!
বোমা গোলা বন্দুক কামান নয়, যে কোন যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র পেটের রসদ। যে কারণে ইংরেজ শাসকরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাজার ঝেটিয়ে সব খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে ফেলেছিল। আকাল এসেছিল সারা বাংলায়। যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর খাদ্য আপূর্তিতে কোন ঘাটতি রাখা চলে না। কারণ না খাওয়া মানুষ লড়াই করতে পারে না। লড়াই জিততে পারে না।
আন্দোলন–সেও তো একটা যুদ্ধ। রিফিউজিদের সামনে এখন সেই যুদ্ধ। প্রবল প্রতাপ রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এক মানসিক, সাহসিক সর্বাত্মক সংগ্রাম। কিন্তু যার পেটে ভাত নেই, চোখের সামনে ছোট ছোট বাচ্চারা খিদের জ্বালায় ছটফট করছে, সেই সৈনিক রণক্ষেত্রে অটল থাকবে কী করে? এর চেয়ে কোথায় শাপলা শালুক কঁচুঘেঁচু মেলে সেই সন্ধানে ছুটবে না? তাই হতে লাগল। যারা পুলিশি অত্যাচার উপেক্ষা করে তখন পর্যন্ত মিছিলে যাচ্ছিল, এবার মিছিল ফেলে মাঠে জঙ্গলে ছুটতে শুরু করে দিল।
এরপর যা হয়, ক্যাম্পের লোক সংখ্যা অর্ধেক কমে গেল। এরা সরকারের দরজায় দয়া পাবার আশায় মাথা খোঁড়া বৃথা বুঝে কেউ চলে গেল শহর কলকাতার আশেপাশে কোন রেল লাইনের ধারে, কেউ কোন খালপাড়ে, কেউ ফুটপাতে, কেউ রেল স্টেশনে, কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে বিষ্ণুপুর গিয়ে পুনর্বাসন দপ্তরে নাম লিখিয়ে পাড়ি দিল সেই নরখাদকদের দেশ দণ্ডকারণ্যে। মরি তো মরব। মরার বেশি আর কীবা হবে, এই ছিল শেষদলের মনের ভাবনা।
যারা তখনও ক্যাম্পে ছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ জনমজুর খাটতে, বিড়ি বাঁধতে, রিকশা চালাতে এবার বিষ্ণুপুর শহরে যেতে আরম্ভ করল। আগে বিনা অনুমতিতে রিফিউজিদের ক্যাম্পের বাইরে যাবার উপায় ছিল না। এখন তো অফিস নেই, অফিসঘর নেই, কে কাকে অনুমতি দেবে। আমার বাবা গেলেন জঙ্গলের শুকনো ঈঠ কেটে জ্বালানি হিসাবে বিষ্ণুপুরের মানুষের কাছে বিক্রি করে আসতে। এক বোঝা কাঠ যার ওজন পঞ্চাশ ষাট কিলো তা বেঁচে বাবা দু আড়াই টাকা পেয়ে যেতেন। এতে আমাদের সংসার মোটামুটি ভাবে চলে যাচ্ছিল। পরে বাবার দেখাদেখি ক্যাম্পের আরও বেশ কিছুনোক কাঠ ব্যবসায় নেমে পড়ল। ফলে জঙ্গলে দেখা দিল শুকনো কাঠের আকাল। কথায় বলে প্রয়োজন কোন নীতি মানে না। তখন ক্যাম্পের শত শত মানুষ প্রয়োজনের তাড়নায় কোপ বসাতে শুরু করে দিল কাঁচা গাছে। এটা ভারত সরকারের বনরক্ষা আইনে ঘোর অপরাধ। যাতে জেল এবং জরিমানা দুটোই হতে পারে। তবে বন বিভাগের কর্মচারীরা রিফিউজিদের অবস্থা জানত। তাই তারা এদের ধরে নিয়ে যাবার চাইতে জঙ্গলে দেখতে পেলেই কুড়ুলখানা কেড়ে নিয়ে চড়চাপড় মেরে তাড়িয়ে দিতে লাগল।
আমার বাবা ছিলেন খুবই ভিতু মানুষ। তিনি এর ফলে ভয় পেয়ে কাঠ কাটতে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। এরপর চেষ্টা করেছিলেন বিষ্ণুপুর শহরে গিয়ে জনমজুরের কাজ করতে। তাতে সফল হলেন না। ছোট্ট শহর বিষ্ণুপুরের সাধ্য ছিল না এত হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। এরফলে মাঝে মাঝে আমাদের ঘরের উনুন একটু আধটু যা জ্বলছিল এবার তা পুরোপুরি নিভে গেল। তখন যে কী ভীষণ অভাব অনটন ভরা দিন আমাদের ঘিরে ধরে ছিল, আমার ভাষার সে ক্ষমতা নেই যে কাউকে বলে বোঝাতে পারি।
বিষ্ণুপুর শহর থেকে আটদশ মাইল দূরে একটা ক্যাম্প। যার পূর্বদিকে মাঠ পেরিয়ে মাইল চারেক গেলে একটা মুসলমান গ্রাম। ছোট ছোট মাটির ঘরে সেখানে যে মানুষরা বাস করে, তারা এত গরিব যে যখন আমরা ডোল পেতাম, আমাদের কাছে খাবার চাইতে আসত।
উত্তর দিকে শশ্মান পার হয়ে, মাইল তিনেক গেলে একটা সাওতাল পল্লী এদের অবস্থাও তথৈবচ। খিদের জ্বালায় এরা সাপ ব্যাঙ সব খায়! দাদন নিয়ে কোথায় কোন দূরদেশে কাজে যায়।
আর আমাদের ক্যাম্পের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে তো কোন জনবসতিই নেই, শুধু ঘন জঙ্গল। এই এখানকার পরিবেশ। এখানে আশেপাশে আমাদের এমন কোন সম্পন্ন আত্মপরিজনও নেই যার কাছে বিপন্ন সময়ে গিয়ে সাহায্যের হাত পেতে দাঁড়ান যায়।
পেটে ভাত নেই, অসুখে ওষুধ নেই, হাত আছে, কাজ নেই, কোথাও যে চলে যাবে তেমন কোন জায়গা নেই। তখন যেন আমাদের জীবনকে বৃত্ত করে দাঁড়িয়ে একটা বিরাট বিশাল “নেই”। এমন যে পানীয় জল, যার বিহনে প্রাণ বাঁচে না সেও তখন আর পাবার উপায় নেই। “যখন ক্যাম্প ছিল” তখন ভেঙে গেলে অফিসে গিয়ে জানালে ভাঙা টিউবওয়েল সারাবার জন্য মিস্ত্রি এসে যেত। এখন আর কেউ আসে না। বহুদিন জলের কল খারাপ হয়ে পড়ে আছে। ক্যাম্পের কয়েকজন লোকবি.ডি.ও অফিসে কল মেরামতের আবেদন নিয়ে গিয়েছিল বি.ডি.ও বলে দিয়েছে–ওখানে তো কোন লোক নেই জল কী হবে!
আগে আমাদের থাকবার তাবুখানা বছরে একবার বদলে দেওয়া হতো। এবার আর বদলান হয়নি। পচে ছিঁড়ে যাওয়া তাবুর ফোকর থেকে উঁকি দিচ্ছে দিনের সূর্য রোদ রাতের চাঁদ তারা। বর্ষাকালের আর খুব বেশি বাকি নেই, তখন কী যে হবে কে জানে!
সমস্ত ক্যাম্পটা এখন থেকেও “নেই” হয়ে গেছে। শুধু সরকারি কাগজ পত্রেই নয়, পরিবেশ পরিস্থিতিতেও। আগে তবু বাচ্চারা কাঁদত, বুড়োরা কাশত। জলের কলের লাইনে দাঁড়িয়ে মহিলারা ঝগড়া করত, যা থেকে বোঝা যেত এখানে মানুষ আছে–প্রাণ আছে। কয়েক মাসের মধ্যে এখন ধুঁকতে শুরু করেছে সব প্রাণ। আর কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। মানুষ হাসে না, কথা বলে না। সব যেন মরে পচে গলে শেষ হয়ে গেছে।
আমার বয়েস তখন মনে হয় দশ বছর হবে। তবে বয়েসের তুলনায় রোগে, অপুষ্টিতে শরীরটা সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। যে কারণে মা আমাকে বাবার জেদাজেদি সত্ত্বেও, অন্য বাচ্চাদের তুলনায় একটু দেরি করে বিদ্যাশিক্ষার জন্য স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কলে জল আনতে গিয়ে মা রোজ দেখতে পেত স্কুলের বাচ্চারা পড়া না পারলে কী নির্মম পেটাই হয়। তার ভয় ছিল আমার এই রোগা শরীরে মাষ্টারের বেত সহ্য হবে না। তাই বেত সহ্য করার মত গায়ে মাংস হবার অপেক্ষায়–আর স্কুলের পাঠ নেওয়া হয়নি আমার।
এখন আমার শরীরটা বাড়ছে। তাই পেটও বড় হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে পেটের খিদে। সেই খিদের কষ্ট আর সহ্য করা যায় না। খিদে পেলে তখন মনে হয় কেউ যেন নাড়িভুঁড়িগুলো ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে। কান মাথা আঁ আঁ করে। চোখ ঘোলা হয়ে আসে। হাত পা বুক সব তিরতির করে কঁপে।
একদিন নিরূপায় হয়ে আমাদের ক্যাম্প থেকে বহু দূরের এক গ্রামে, মোটামুটি সচ্ছল এক মধ্যম চাষির বাড়িতে ছাগল গরু চড়াবার কাজ নিলাম। কথা রইল তারা আমাকে দু বেলা খেতে দেবে, আর এক বছর টিকে থাকলে পূজোর সময় দেবে একটা গেঞ্জি একটা প্যান্ট আর একখানা গামছা। যে বয়সে শিশুরা বাস করে নানা রঙের এক মায়াবী জগতে, হেসে খেলে নেচে গেয়ে দুষ্টুমি করে দিন কাটায়, জীবন আমাকে ঠেলে দিল রঙরস স্বপ্নহীন এক কঠোর বাস্তবতার কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দুটো বালতি বাঁকে বেধে প্রায় দেড় মাইল দূর থেকে জল বয়ে এনে সবজি ক্ষেত ভিজিয়ে দুটো শুকনো মুড়ি চিবিয়ে ছাগল গরু নিয়ে মাঠে যাওয়া, দুপুরে এক ফাঁকে এসে ভাত খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে থাকা।
লোকে বলে, সকালটা দেখলে নাকি বোঝা যায় সারাদিন কেমন যাবে। যে ভাবে আমার জন্ম, যেভাবে শুরু হয়েছে আমার বালকবেলা এরইমধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল সেই বার্তা–আগামীদিনগুলো কী নিয়ে অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য বড় হতভাগ্য এক বালক আমি যার কোন বাল্যকালই ছিল না। রঙিন ঘুড়ি রঙবেরঙের কাঁচের গুলি আমার বাবা কোনদিন আমাকে কিনে দিতে পারেনি। দুর্গা পূজার সময়ে বাচ্চারা যখন নতুন জামাপ্যান্ট পড়ে হুটোপুটি খেলে আমি তখন প্যান্টের পেছনের ছেঁড়া জায়গায় হাত দিয়ে ঢেকে দুরে দাঁড়িয়ে থেকেছি। দোল পূর্ণিমার দিন, যখন সবাই রঙে মাখামাখি হয়, আমি তখন রঙের ভয়ে ছুট মেরে পালিয়ে গেছি দূরে–বিবর্ণ নির্জনতার কোটরে। ভয়, গায়ে রং লেগে গেলে তুলব কী করে। সাবান কেনার পয়সা কই?
আমি সেই দুঃখী বালক যাকে তার দিদিমা কোনদিন কোলের কাছে শুইয়ে রাজারানির রাজকন্যার গল্প শোনায়নি। আমার শিশু স্বপ্নে কোন দিন লাল নীল পরীরা সোনালি পাখনায় ভর করে উড়ে আসেনি। আমার কোনদিন কোন স্বপ্ন রঙিন ছিল না, ছিল কৃষ্ণকুটিল অমানিশাঘন ভীতি দায়ক। আমি অনবরত দেখেছি দাঁত নখ বের করা এক রূঢ় রাক্ষসী বাস্তবতাকে। যে প্রেমহীন পৃথিবীর পথে উদ্দাম ছুটে বেড়াচ্ছে। তার মৃত্যুমাখা করাল মুখব্যাদান সর্বনাশা চোখের নীলাভ অগ্নিশিখা আমার জীবন যাত্রাকে ভীত ত্রস্ত ছিন্ন দীর্ণ করেছে সর্বক্ষণ।
জীবনের সেই প্রথম “চাকরিতে” আমি বোধহয় মাস তিনেক টিকতে পেরেছিলাম। তারপর আর পারিনি। যার কারণ অনেকগুলো। যা আমি আমার “অভিশপ্ত অতীত অন্ধকার ভবিষ্যৎ” নিবন্ধে বিস্তারিত লিখেছিলাম। তাই এখন আর জাবর কাটতে চাইনা। তবে কাজ ছেড়ে চলে আসার একমাত্র কারণ মালিকের ব্যবহারই নয়–তার চেয়ে বড় কারণ, মায়ের জন্য বড় মন কেমন করছিল। এর আগে মাকে ছেড়ে কখনও এতদূরে আসিনি, এতদিন থাকিনি।
ক্যাম্পে ফিরে এসে দেখি আমার একটি কালো কুচকুচে বোন হয়েছে। এর আগে একটা ভাই হয়েছিল মেজ ভাই চিত্তরঞ্জনের পরে! বোন হওয়ায় এখন আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাত হয়ে গেল। সেই নিয়ে বাবার দুশ্চিন্তা সাতটা প্রাণী এই অবস্থায় বাঁচব কেমন করে। এ এমন এক সংসার যেখানে জন্ম কোন উৎসব নয়, একটা বাড়তি বোঝা। একজন উদ্বৃত্ত মানুষ।
এবার আমার বাবা স্থির করলেন যে অনেক হয়েছে, শিরোমণিপুর ক্যাম্পে আর থাকা নয়। যাবেন তিনি যেখানে আমার কয়জন কাকা জ্যেঠা থাকেন সেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ঘোলা দোতলার রিফিউজি ক্যাম্পে। দেশ থেকে আগে বের হবার কারণে যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে ওই ক্যাম্পে গিয়ে পড়েছে। আমাদের সেই আত্মীয়দেরও দণ্ডকারণ্য না যেতে চাওয়ার অপরাধে ডোল বন্ধ হয়ে গেছে।নাম কাটা গেছে ক্যাম্প রেজিস্ট্রার থেকে। এখন এরা–এইনাম কাটা যাওয়া মানুষেরা, আর এদেশের কেউ নয়। এদের আর দেশ বলে কিছু নেই। কোন দেশেরই এরা কেউ নয়। কলমের কী অসীম ক্ষমতা। যার এক আঁচড়ে হাজার লক্ষ মানুষ “নেই” হয়ে যায়।
আমার কাকাজ্যাঠাদের আর্থিক অবস্থা আমাদের চেয়ে ভাল নয়। এক দেশ এক বংশ এক রক্ত যে। তবে এই ক্যাম্প কলকাতা মহানগরের সন্নিকটে বলে এখানকার লোক সেখানে গিয়ে কোন কাজ কর্ম, ছোটখাটো ব্যবসাপাতি করে দু চার টাকা রোজগার করবার পথ করে নিয়েছে। কেউ সজি কেউ হোগলা পাতার মাদুর, কেউ ডিম যে যা পারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে আসে। কেউ কেউ যায় জনমজুর খাটতে।
একদিন বাবা আমাদের নিয়ে চলে এলেন সেই ঘোলা দোতলার ক্যাম্পে। কাকারা কেউ বাঁশ কেউ খড় কিনে দিয়ে খালপারে আমাদের থাকার জন্য একটা ঝুঁপড়ি বানিয়ে দিল। বানিয়ে দিল একখানা মাদুর বোনার তাত। সে সময় গড়িয়া স্টেশন থেকে শুরু করে বানতলা পর্যন্ত হাজার হাজার বিঘে জলাভূমি ছিল। এতে মাছ চাষ হত। এই সব মাছের ঘেরিতে প্রচুর পরিমাণে হোগলা জন্মাত। যে হোগলা পাতায় মাদুর বোনা হয়। ঘোলা দোলতলার রিফিউজিরা এই মাদুর শিল্পের সহায়তায় সেদিনের সেই ভয়ংকর দুর্দিনে কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছিল। এখানকার সব ঘরেই মাদুর বোনা হয়। আমরাও মাদুর বোনা আরম্ভ করলাম।
প্রথমদিকে হোগলা পাতা বিনামূল্যে পাওয়া যেত শুনেছি। ঘেরি মালিকরা ঘেরি সাফ করার জন্য এমনি এমনি দিয়ে দিত এবং খুশি হতো এই ভেবে যে এ কাজে তার পকেটের পয়সা লাগেনি। পরে যখন বুঝতে পারল এর একটা ব্যবসায়িক দিক আছে, তারা দাম হাঁকতে লাগল!
এখন দু আঁটি হোগলার দাম একটাকা, সুতলির দাম আট আনা। এই পুঁজির সাথে দুজন মানুষের সারা দিনের শ্রম যুক্ত হলে যে দুখানা মাদুর তৈরি হবে তার বিক্রয় মূল্য বর্তমান বাজারে তিন থেকে সাড়ে তিন টাকা। সেই সাড়ে তিন টাকা থেকে পরের দিনের হোগলা সুতলির দাম সরিয়ে রেখে যে টুকু যা পয়সা বেঁচে থাকে তা দিয়ে আমাদের এত মানুষের পেট কী চলে।
সেটা সেই কুখ্যাত ছয়-এর দশকের শুরুর দিক। যখন গ্রাম বাংলা ধীরে ধীরে এক ভয়াবহ খাদ্যসংকটের দিকে হাটিহাটি পাপা করে এগিয়ে চলেছে। শোনা যাচ্ছে আর এক অঘোষিত মন্বন্তরের পদধ্বনি। তখন ঘোলা দোতলার বাজারে সবচেয়ে মোটা চালের পালি (আড়াই সের) একটাকা বারো আনায় পৌঁছে গেছে। একপালি চাল না হলে আমালের সংসার চলে না। এর সাথে আছে নুন লংকা আর জ্বালানি। তাই চাল কেনবার সামর্থ আমাদের ছিল না। সে সময় কোথা থেকে কে জানে বাজারে বস্তাবস্তা খুদ আসত। যার অর্ধেক ছিল ধুলো কঁকড়। খুদ যে কোথায় সে বহুকষ্টে খুঁজে পাওয়া যায়। ছয়আনা সের সেই ধুলোকাকড় আমরা দুসের বারো আনা দিয়ে কিনে আনতাম। মা তাকে পুকুরে নিয়ে গিয়ে ঘন্টা খানেক ধরে চেলে চেলে ধুয়ে আনতেন। তারপর তা জ্বাল দিয়ে পাতলা জাউ বানিয়ে, না চিবিয়ে আমরা নুন লংকা দিয়ে গিলে গিলে খেতাম। এর চেয়ে আর একটু সস্তায় পাওয়া যেত মাইলোর আটা, আধভাঙা ভুট্টা। এসব খুদ ভুট্টা মাইলো সবই মুরগির খাদ্য। পোলট্রি জন্য তৈরি করা “সুষম আহার”। কী আমাদের ভাগ্য, মানুষ হয়ে আমরা তখন তাই খেয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছি।
আমরা মনে হয় ১৯৬০ সালের প্রথমদিকে ঘোলা দোতলার ক্যাম্পে এসেছিলাম। এর দু বছর পরই তো সেই ভারত চীন সীমান্ত সংঘর্ষের সময় কাল। যার দু বছর পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন। এরই এক বছর আগে ১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলন। যে আন্দোলনে পুলিশ মানুষকে সাপ পেটার মত পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। আমি ঠিক জানি না, সেদিন আট না আশি কতজন মানুষ মারা গিয়েছিল। তবে এটা জানি সেদিন শুধু খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন করা মানুষইমরেনি, মারা গিয়েছিল একনির্দয় পাষণ্ড সরকারের সব বিচারবুদ্ধি বিবেচনা শক্তি। জনগণকে খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা বাসস্থান চিকিৎসা দেবার জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত একটি সরকার বুভুক্ষু জনগণের উপর এমন নির্মম আক্রমণ চালাতে পারে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
সেই ছয়-এর দশকে প্রায় সারা দশক জুড়ে পুরো পশ্চিমবঙ্গে নেমে এসেছিল এক ভয়াবহ আকাল। খাদ্যাভাবে চারদিক যেন জ্বলতে আরম্ভ করেছিল তীব্র ক্ষুধার দহনে। মানুষকে তখন আর মানুষ বলে চেনবার উপায় ছিল না। কিছু ধনী আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাদে সারা গ্রামবাংলা জুড়ে দেখা যাচ্ছিল আপামর মানুষের কঙ্কালসার মৃতপ্রায় এলোমেলো চলাচল।
আমাদের সেসব দিনে আর ভুট্টা মাইলো খুঁদ কেনবার মতো ক্ষমতাও ছিল না। তখন মাদুর যে আর বিক্রি হয় না। মানুষের পেটে খাদ্য নেই, মাদুর কিনে কী করবে! সেই সময় আমাদের বঙ্গদেশের একবুদ্ধিমান মুখ্যমন্ত্রী অন্নহীন বঙ্গবাসীকে বাণী দিয়ে ছিলেন-কঁচাকলা খাও, কাঁচাকলায় ভাতের চেয়ে প্রোটিন বেশি। মনীষীদের বাণী কোন ফালতু জিনিস নয়। কিন্তু কলা তা সে পাকা হোক বা কঁচা সে তো মুফতে মেলে না। পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। পয়সা কোথায় আমাদের কাছে। অবশ্য নিজের কলা বাগান থাকলে সে কথা আলাদা। আমাদের তো বাগান করার মত একফালি মাটিও নেই। আমরা এক খাল পাড়ে কুড়েঘর বানিয়ে বাস করি। সে এমন কুড়ে যার মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়ান যায় না, ঘরের চাল মাথায় ঠেকে যাবে। ঘরে ঢুকতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে, বের হতে হয় হামাগুড়ি দিয়ে। মনে হয়, সেই আদিম অতীতকালে প্রথম গুহাবাসী মানুষ গুহা ছেড়ে যেদিন বাইরে এসেছিল আর বসবাসের প্রয়োজনে সেদিন তার অনভিজ্ঞ হাতে প্রথম যে কুড়ে ঘর খানা বানিয়ে ছিল, সে-ও ছিল এর চেয়ে মজবুত এবং সুন্দর।
এ এমন এক ঘর, এ ঘরে যে সব মানুষ বাস করে নত হতে হতে সারা জীবনের মতো বেঁকে যায়। আর সেই বাঁকা মেরুদণ্ড সোজা করে কোনদিন উঠেদাঁড়াতে পারে না। রেল বস্তি খালপাড়ের এই সব ঘরে সুশিক্ষা সুস্বাস্থ্য সভ্যতার কোন আলো অনুপ্রবেশ করতে পথ পায় না। তাই মানুষ বুনো হয়ে যায়, মানবেতর প্রাণী হয়ে যায়।
আর মাত্র কয়েকটা বছর, বছরও নয়, মাস, তারপর চাঁদের মাটিতে পড়বে পৃথিবীর মানুষের পথচিহ্ন। বিজ্ঞানের জয় জয়কার হবে। আর সেই পৃথিবী গ্রহের আর একদল মানুষ ক্রমে পিছোতে পিছোতে পরিণত হয়ে যাবে ইঁদুরতুল্য এক গর্তবাসী জীবে।
সে সময় দিনে দিনে গ্রামবাংলায় আকালের হা মুখ এতখানি প্রশস্ত হল যে সরকার মৌনিবাবা হয়ে বসে থাকলেও দয়ালু মানুষের পক্ষেচুপ হয়ে থাকা সম্ভবপর হয়নি। তারা বেশ কিছুসমাজসেবী সংস্থার মাধ্যমে কিছু কিছু স্থানে লঙ্গরখানা খুলেছিল। চাল ডাল গমের কুচি মিলিয়ে তা দিয়ে পাতলা খিচুড়ি বানিয়ে এক এক হাতা মেপে বিলানো হয়েছিল বুভুক্ষু মানুষের মধ্যে। সেই এক হাতা খিচুড়ির জন্য এক দেড় মাইল লম্বা লাইন পড়ে যেত। সূর্য ওঠার সময় লাইন দিয়ে সূর্য মাথার উপর এলে খিচুড়ি মিলত। তাও দিনে মাত্র একবার। দিন দশ পনের চলবার পর সে লঙ্গরখানা বন্ধ হয়ে যায়।
একটু পরের কথা আগে বলা হয়ে গেল। ফিরে যাই ৬৪ সালে। আমার বাবা সে সময়ে যাদবপুরে মজুরের কাজে যেতে শুরু করেছিলেন। তখন দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরের বহু অঞ্চল দখল করে একের পর এক জবর দখল কলোনি গড়ে উঠেছিল। দখলকারীরা উচ্চবর্ণ কায়িকশ্রমে পরাজুখ বাবুশ্রেণির মানুষ। কাজেই তাদের ঘরবাড়ি পথঘাট নির্মাণে চিরকালই যাদের সহায়তা নিতে হয়, সেই নমঃ পোদ কাওড়া বাগদি মুসলমানদের এখানেও সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
এটা একটা ওকে কী বলে–উলঙ্গ সত্য, যে, সে সরকার পক্ষই হোক বা বিরোধী পক্ষ সব দলের শীর্ষে বসে আছে একমাত্র উচ্চবর্ণের লোকেরা। যারা সেই বেদের কালের বর্ণঘৃণায় এখনও আচ্ছন্ন। সেই ঘৃণ্য মানসিকতার কারণে ক্যাম্পবাসী নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রতি সেদিন যতটা নির্মম নির্দয় অমানবিক ব্যবহার করেছিল, নিজের আপন আত্মীয় স্বজাতির জবরদখলকারীদের প্রতি ততটা হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের জবরদখল কলোনি পত্তনের দিকদিশারী–সর্ব প্রথম জবর দখল কলোনির নাম বিজয়গড়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাদের জন্য ইংরেজ সরকার এদেশীয় জমিদারের কাছ থেকে বিশেষ এক আইন বলে এই বিশাল মাপের জমিটা অধিগ্রহণ করে। ফলে এই জমির উপর জমি মালিকানার কোন আইনি অধিকার দেশীয় ভূস্বামীদের আর ছিল না। যুদ্ধ শেষ হবার পর মার্কিন সেনা দেশে ফিরে যায়, আর শহর কলকাতার মধ্যে বিশাল ওই ভূ-ভাগ যেটা বহুমূল্যবানও বটে, সেটা খালিই পড়ে থাকে। যেহেতু এখানে মিলিটারি ক্যাম্প ছিল পথঘাট জল বিদ্যুৎ আবাগমন সুবিধা সবকিছু উন্নত ছিল। এক দু কিলোমিটারের মধ্যে দু দুটো বাস রুট, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস–কী ছিল না?
এই জমি জনৈক সন্তোষ দত্তের নেতৃত্বে দখল করা হয় এবং যে কলোনি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম কলোনির স্বীকৃতি পায়। প্রথমটির সম্মান থাকে ইজরাইলের ললাটে।
যখন এই জবরদখল ঘটে, সরকারের পক্ষ থেকে কোন বাধা তো আসেইনি উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গের তৎকালিন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়, রাজ্যপাল মি. কাটজু, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহেরু, মেজর জেনারেল সত্যব্রত সিংহ, এ ছাড়া ত্রিগুণা সেন, সমর মুখার্জী, সরোজিনী নাইডু, সহ বহু বড় বড় মানুষ স্বজাতি প্রেমে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে অভয় বাণী দিয়ে গেছেন। যাদের প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী অভয় দেন, তাদের এমন কে আছে যে একটা চুল ছিঁড়ে নেয়?
নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য কার বুকে এমন উথলে ওঠা দরদ ছিল? আজ যখন এই ঘটনার পাশে রেখে মরিচঝাঁপির সেই পৈশাচিক হত্যালীলার বিচার বিশ্লেষণ করতে যাই ক্রোধে দিশেহারা হয়ে পড়ি, কোন হিসাব মেলাতে পারি না। একই কারণে একদেশ থেকে একই সময়ে বিতাড়িত একদল মানুষ। যাদের একদলকে জামাই আদরে কলকাতা শহরের মধ্যের বহুমুল্য জমি বিনা বাধায় দিয়ে দেওয়া হল। আর একদল মানুষকে সুদূর সুন্দরবনের এক দ্বীপ মরিচঝাঁপির নামমাত্র মূল্যের জমি থেকে নৃশংসতায় হত্যা ধর্ষণ অগ্নি সংযোগে লুঠপাট দ্বারা ভীত সন্তস্ত্র করে উৎখাত করে দেওয়া হল। প্রায় তিরিশ হাজার পরিবার গিয়েছিল সেখানে বসবাস করবার জন্য, যাদের দু হাজার মানুষের আজও কোন হদিশ মেলেনি। এর মধ্যে কতজনকে বাঘের পেটে কত জনকে কুমিরের পেটে আর কতজনকে পাথর বেধে সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে তা কেউ জানে না। আমার বাবাও গিয়েছিলেন ওই চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হত্যাকারীদের উল্লাসভূমি, মরিচ ঝাঁপি দ্বীপে। বুকের হাড় ভেঙে গিয়ে ছিল তার। সে লোমহর্ষক কাহিনী পরে বলব।
এখন একটাই প্রশ্ন, শাসকশ্রেণি দু দল মানুষের প্রতি এই দু-ধরনের মনোভাব কেন দেখিয়ে ছিল? এর পিছনে রয়েছে সেই চিরকালীন বর্ণঘৃণা। ওই মানুষগুলো যদিনমঃ পোদ জেলে না হয়ে বামুন কায়েত বদ্যি হতো, সে যে সরকার তোক কোনদিন এদের উপর এমন পাশবিক অত্যাচার চালাতে পারত না, তখন কলজে পড়ত।
সে যাইহোকতখন এই যাদবপুরে কুড়ি পঁচিশটা এইরকম জবরদখল কলোনি গড়ে উঠেছিল। সে সব কলোনির বাড়িঘর নির্মাণে মুর্শিদাবাদের মুসলমান রাজমিস্ত্রি পূর্ব বাংলার নমঃ পোদ পশ্চিমবঙ্গের কাওড়া বাগদিদের একটা বড় ভূমিকা ছিল।
আমার বাবা রোজ রাত তিনটে সাড়ে তিনটের সময় যখন আকাশে ধ্রুব তারা দেখা দেয়–ঘুম থেকে উঠে ঝুড়ি কোদাল আর গামছা নিয়ে ঘোলা দোতলা থেকে সাত আট মাইল পথ পায়ে হেঁটে এসে পৌঁছাতেন ঘুটিয়ারি শরিফ রেল স্টেশনে। এই পথ হেঁটে আসতে তার প্রায় দেড় দু ঘন্টা লেগে যেত। তখনও ক্যানিং লাইনে দ্রুতগামী ইলেকট্রিক ট্রেন চালু ছিল না। চলত টিকিস টিকিস করে চলা কয়লার ট্রেন। সিঙ্গল লাইনের সে ট্রেন একবার কোথাও দাঁড়িয়ে পড়লে কখন যে নড়বে কোন ঠিকঠিকানা ছিল না। বাবা ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুটিয়ারি শরিফ থেকে ট্রেনে চেপে ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ পৌঁছাতে পারতেন যাদবপুর স্টেশনে। তারপর আবার মাইল দুই আড়াই হেঁটে পৌঁছতেন বাঘাযতীন মোড়ে। এই মোড়ে শতশত মজুর জমা হতে কাজের আশায়। মোড়ের সেই ভিড়ের উপর পথচলতি মানুষ আর স্থানীয় দোকানদারদের রাগ ছিল ভীষণ রকম। পরে যখন আমিও কাজের সন্ধানে ওই মোড়ে গিয়ে দাঁড়াতাম তখন দেখেছি, বাঘাযতীন মোেড় থেকে বাঘাযতীন স্টেশনে যাবার যে রাস্তা তার ডান দিকে মোড়ের মাথায় একটা মিষ্টির দোকান ছিল। সেই দোকানের সামনে দাঁড়ালে ঢাকা জেলার দোকানদার মগে করে গায়ে জল ঢেলে দিত। সর সর, সরে যা। দোকানের সামনে দাঁড়াবি না।
বাবা সেই মোড়ের মাথায় একটা কোণ খুঁজে নিয়ে কালীঘাটের ভিখিরির মতো সামনে ঝুড়িকোদাল রেখে বসে থাকতেন, যদি কেউ কাজে নিয়ে যায় সেই আশায়। এদেশে সর্বক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কম। সে তুলনায় কর্মীর সংখ্যা বহুগুণ বেশি। সব মানুষের তাই সবদিন কাজ হয়না। যদি বাবার সেদিন কাজ না হয়, না খেয়ে অথবা শুধু জল খেয়ে সারাটা দিন বসে বা গামছা বিছিয়ে শুয়ে থাকতে হতো রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। তারপর খালি হাতে ওই একই পথ পাড়ি দিয়ে একই রকম কষ্ট করে অনেক রাতে একবুক হাহাকায় নিয়ে ঘরে ফিরে আসতেন। ইচ্ছা থাকলেও বাবা দিনের বেলা ট্রেনে চাপতে পারতেন না। কারণটা আর কিছু নয়, তিনি যে বিনাটিকিটের যাত্রী। দিনের বেলা ট্রেনে চেকার থাকে। চেকার বিনা টিকিটের যাত্রী ধরতে পারলে জেলে নিয়ে যায়। সে কারণে তার সাহস হতো না ট্রেনে চড়বার।
যেদিন বাবাকে কেউ কাজে ডেকে নিয়ে যেত সেদিন দুপুর বেলায় মালিকের কাছ থেকে আটআনা পয়সা আগাম চেয়ে নিয়ে একটা পাউরুটি এক প্লেট আলুর দম দিয়ে দুপুরের খাওয়া। সারতেন। বাদবাকি যা মজুরি সেটা কাজের শেষে হাতে পেয়ে অনেক রাতে বাজার করে বাসায় ফিরতেন। সেদিন আমাদের ঘরে রান্না হতো, আমরা খেতে পেতাম।
ঘোলা দোলতলা আসবার কিছুদিন পরে আমার আর একটি বোনের জন্ম হয়েছে। আমাদের সেই আটজনের পরিবার একা বাবার রোজগারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাবার সবদিন কাজ না হবার কারণে আর তার সারাদিন না খেয়ে থাকার ফলে একদিন পেটে ব্যথার রোগ ধরে গেল। প্রথম প্রথম কিছুদিন চিনচিনে থেকে শেষে দাউদাউ হয়ে উঠল সেই ব্যথা। তখন আর বাবা কাজে যাবার মতো অবস্থায় রইলেন না। বিছানায় শুয়ে কাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে লাগলেন। ঘরে আমাদের কোন টাকা পয়সা তো ছিল না যে বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাই। বিনা ওষুধ পথ্যে রোগ সারে না, দিনে দিনে বেড়ে চলে।
যে রোজগেরে মানুষ সে যদি বিছানায় পড়ে থাকে তবে তার ঘরের উনুন কী করে জ্বলে? আমাদের খাবার দাবার যোগাড়ের কোন পথ না থাকায় শুরু হয়ে গেল অরন্ধন-অনাহার। না খেতে পেয়ে শুকিয়ে আমরা সব চিমসে মেরে গেলাম। আমার বড় বোন মঞ্জু মরে গেল।
লোকে বলে দারিদ্র্য, গরিবি, অভাব অনটন। কিন্তু এই সব নরম কোমল সাহিত্যের শব্দ দিয়ে আমাদের সেই সময়কার দুরবস্থাকে কোনভাবেই বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শুধু বাংলা কেন, বোধ হয় পৃথিবীর কোন ভাষার মধ্যে এমন শব্দ নেই যা আমাদের জীবনের সেই দুঃসহ সময়ের চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম।
তখন বাজারে এক আনা দামের প্রায় একশো গ্রাম ওজনের গোল কালো একটা সাবান পাওয়া যেত। আমাদের সেই এক আনা দামের সাবান কেনার মতো সামর্থ ছিল না। ধুলোমাটি পড়ে মাথার চুল এঠেল হয়ে জট বেধে যেত। তখন পুকুর পাড় থেকে মাটি তুলে মাথা ঘসে ঘসে সাফ করতাম। আমাদের ছোট চুল এভাবে সাফ হলেও মায়ের হবে কী করে। শুনেছি আমার মায়ের মাথার একরাশ ঘনকালো চুল দেখেই নাকি আমার ঠাকুরদা তাকে নিজের পুত্রবধূ করে নিয়ে এসেছিলেন। সাবান তেলের অভাবে সে চুলে এমন জট পাকাল যে আর খোলা গেল না। শেষে সব চুল গোড়া ঘেসে কঁচি দিয়ে কেটে ফেলে দিতে হল। মায়ের গায়ের রঙ এক সময় বেশ ফরসা ছিল। সে রঙ এখন রোদে জলে অযত্নে তামাটে আর খসখসে হয়ে গেল। সেই শিরোমণিপুর ক্যাম্পে থাকাকালে সরকার বছরে একবার কিছু কাপড় চোপড় দিত। সেই শেষ। তারপর আর কারও জন্য পরিধানের কিছু কেনা যায়নি। এখন বস্ত্রাভাবে আমার তিনভাই বোন সব উদোম হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আমি আমার পেছন ছেঁড়া প্যান্ট পড়ে লোকের সামনে যেতে হলে হাত দিয়ে ঢাকতে লাগলাম ছেঁড়া স্থান।
সবচেয়ে করুণ অবস্থা আমার মায়ের। সেই কবে পাওয়া সরকারি কাপড় এখন পচে ছিঁড়ে ন্যাতা। তা দিয়ে আর লজ্জা নিবারণ করা যায় না। শেষে নিরুপায় আমার মা কবেকার ছেঁড়া এক টুকরো মশারি অঙ্গে জড়িয়ে কুড়ে ঘরের এক অন্ধকার কোণ খুঁজে আত্মগোপন করলেন। শত প্রয়োজনেও আর তার দিনের আলোয় ঘরের বাইরে আসবার উপায় রইল না।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে মানুষ নাকি ঈশ্বরের এক মহান সৃষ্টি। চুরাশি কোটি যোনি ভ্রমণ করবার পর মানব জনম মেলে। এ এক দুর্লভ জনম। আমি মানব কুলে জন্ম গ্রহণ করেছি। তাহলে যিনি আমাকে এমন মহান এমন সার্থক জীবন দিয়েছেন তাকে তো ধন্যবাদ দিতেই হয়!
আমার জন্মদাতা পিতা আমার চোখের সামনে পেটের ব্যথায় বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে মারা যাচ্ছেন। আমার গর্ভধারিণী মা এক টুকরো বস্ত্রের অভাবে গর্তে ইঁদুরতুল্য জীবন যাপন করছেন। দিনের আলো তার ভাগ্যে নেই। প্রবল শীতের দিনে যে একটু রোদে এসে বসবেন তা আর পারবেন না। কেননা দিনের আলোয় ওত পেতে থাকে অসংখ্য রাক্ষুসে চোখ। যে চোখ উদোম অঙ্গ প্রত্যঙ্গ শবদেহের কৃমিকীটের মত খুবলে খেতে চায়। আমার একটা বোন না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরে গেছে। তিনটে ভাইবোন শুকোচ্ছে। কদিন পরে মরবে। আমার বুড়ি দিদিমা থলি নিয়ে বাজারে পঁচা আলু পোকা বেগুন শুকনো শিম যা চাষিরা ফেলে দিয়ে গেছে কুড়িয়ে বেড়ায়। যদি ওই পরিত্যক্ত বস্তুর মধ্যে একটু বেঁচে থাকার উপাদান মিলে যায়।
এ জীবন যদি মহান আর সার্থক না হয়, তবে আর সার্থকতা কী!
আমার বাবা ছিলেন একজন সৎ মানুষ। সারা জীবনে কোনদিন কারও অপকার করেননি, মিথ্যা বলেননি। তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। মায়ের মুখে শুনেছিকাকারাও বলেছেন আশেপাশের দশগ্রামে বাবার মত পরিশ্রম করার ক্ষমতা কারও ছিল না। এক বস্তা ধান এক ঝটকায় একা মাথায় তুলে দুক্রোশ পথ হেঁটে যেতে পারতেন এবং তিনি ছিলেন ভীষণ রকম ঈশ্বর বিশ্বাসী। জীবনে তার কোন বড় আশা ছিল না। দু বেলা দুমুঠো মোটাচালের ভাত। আর তার সাথে যদি একটু তরকারি মিলে যায় তবে তো কোন কথাই নেই। সে যেন উৎসব। কিন্তু তার সত্যবাদিতা সারল্য কঠোর পরিশ্রম ও ঈশ্বর ভক্তি কিছুতেই তার ভাগ্যে সেটুকু সুখ প্রাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হয়নি। সারা জীবন আমি বাবাকে কোনদিন পেট ভরে ভাত খেতে পেয়েছে এমন দেখিনি। কোনদিন দেখিনি গায়ে জামা, পায়ে জুতো। তার বুকের হাড়গুলো গোনা যায়।
এমন মানুষের ভাগ্যে এত দুরবস্থা কেন? আমার কিশোর মন যে এই প্রশ্নের উত্তর দাবি করে। কার কাছে আছে এর উত্তর।
উত্তর চাই। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম উত্তর খুঁজতে এবার ঘর ছেড়ে পথে বের হতে হবে। ঘরকুনো হয়ে থাকা আর নয়। খুঁজে দেখতে হবে পৃথিবীর কোন কোণে আমার ভাগ্য আমার জন্য কিছু ফেলে রেখেছে কিনা। নাকি আমার জীবনও নিঃস্ব রিক্ত কপর্দকহীন কাটবে, যেমন কেটেছে আমার বাবা কাকা ঠাকুরদার।
তখন সেই কিশোর ছেলেটির জানা ছিল না পৃথিবী কত রুক্ষ, কঠিন হৃদয়, নির্দয়। এখানকার সকল সুখ সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে মুষ্টিমেয় কিছু লোক। যারা তা থেকে এক কানাকড়িও কাউকে দেবে না। সবাই তাকে বঞ্চিত করবে ঠকাবে। শেষে শূন্যহাতে আবার ফিরিয়ে দেবে পুরানো অবস্থায় পুরানো অবস্থানে।
জানত না সেই কিশোর আজ যে ভাবে যে পথ ধরে হেঁটে পৃথিবী পরিক্রমায় চলে যাচ্ছে, সেই পথে সে ভাবে আর ফিরে আসা হবে না। সমস্ত শরীর মনে জড়িয়ে যাবে পথের ধুলো। যার আর এক নাম হতে পারে তিক্ত অনুভব। যা তার আগামী ভাবনা চিন্তা জীবন যাত্রাকে প্রভাবিত করবে, নিয়ন্ত্রণ করবে। সে আর তাকে বাধ্য বিনয়ী সুশীল থাকতে দেবে না, অবাধ্য দুর্বিনীত অসামাজিক, যা কিছু শ্রদ্ধেয়, শ্রেষ্ঠ মহোত্তম সব কিছুর প্রতি এক অসহিষ্ণু ধ্বংস প্রবণ করে তুলবে।
ঘোলা আর দোতলা দুটো গ্রাম। যার মাঝখান থেকে বয়ে যাচ্ছে একটা নোনা জলের খাল। পশ্চিম থেকে সোজা পূর্বদিকে। এই খালের দুপাড় জুড়ে কয়েক হাজার রিফিউজিদের বসবাস। এই খাল পাড় ধরে কিছুটা হাঁটলে সামনে পড়বে রামধারি ব্রিজ। যার উপর দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে একটা পাকা রাস্তা। এই রাস্তায় ক্যানিং থেকে গড়িয়া পর্যন্ত আশি নম্বর বাস চলাচল করে। বাস রাস্তা পার হয়ে, রামধারি ব্রিজ পিছনে ফেলে, কেটে নেওয়া ধান ক্ষেতের মধ্য থেকে সরু পায়ে হাটা পথ ধরে একে বেকে এগিয়ে গিয়ে সামনে রেল লাইন। লাইনের পাশের পথ ধরে পশ্চিম দিকে মাইল ছয় সাত হেঁটে সামনে ঘুটিয়ারি শরিফ রেল স্টেশন। এ সেই পথ যে পথ ধরে আমার বাবা ঝুড়ি কোদাল কাঁধে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে রোজ রাত এক প্রহর বাকি থাকতে হেঁটে যেতেন। সেই ধুলো পথে আজ আমি হেঁটে যাচ্ছি ভাগ্যসন্ধান করতে। মনটা এখন বড় কাঁদছে। মা বাবা ভাই বোন সব পড়ে রইল, পড়ে রইল আমার বুড়ি দিদিমা। তাদের দেখার মত কেউ নেই। কী হবে তাদের তা কে জানে! কিন্তু না চলে গিয়ে আমার যে আর কোন পথ নেই। এখানে পড়ে থাকলে সব এক সাথে না খেয়ে মরে যাব।
মহাভারতে একটা গল্প আছে, দুর্যোধন আর দুঃশাসন তার মামা শকুনি এবং তার আরও নিরানব্বই ভাই সবাইকে মাটির তলে এক অন্ধকার ঘরে বন্দী করে রেখেছিল। দুর্যোধনের ভয়। ছিল, শকুনিরাও একশো ভাই। শক্তি সক্ষমতায় সংখ্যায় কৌরবদের সমান সমান। যদি তারা কোনদিন ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে তখন কী হবে। তাই দুর্যোধন চেয়েছিল সবাইকে মেরে ফেলবে। বাঁচিয়ে রাখবে মাত্র একজনকে। যে দুর্যোধনের বৈভব দেখবে আর ঈর্ষায় জ্বলবে। সেই বদ উদ্দেশ্যে দুর্যোধন বন্দী একশো মামার মধ্যে মাত্র একজনার খাবার দেবার নির্দেশ দিয়েছিল। খাবার নিয়ে মারামারি করে নিরানব্বই জন মরে গেলে শেষ পর্যন্ত যে একজন বেঁচে থাকবে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে।
দুর্যোধনের উদ্দেশ্য শকুনির বুঝতে বিলম্ব হয়নি। বুঝেছে তার সব ভাইও। তখন তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান শকুনি। এই ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ একমাত্র সে-ই নিতে সক্ষম হবে। এ খাদ্য তারই গ্রহণ করা সমীচীন তারই বেঁচে থাকা যুক্তিযুক্ত এবং ভাইয়েরা মৃত্যুবরণ করে বাঁচিয়ে রেখেছিল শকুনিকে। তার ফলাফল কী হয়েছিল সে মহাভারতে লেখা রয়েছে।
আমাকে কি এই গল্প কোনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে? আমি ঠিক তা জানি না। তবে এটুকু জানি, আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি মরতে চাই না। একবার মরতে মরতে প্রাণ ফিরে পেয়েছি, তাকে এমন কুকুর বেড়ালের মত নষ্ট করতে চাই না।
ঘর থেকে বের হয়েছিলাম সন্ধ্যে ঘোর হয়ে গেলে। ঘুটিয়ারি শরিফ স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নেমে গেল। এসব অঞ্চলে তখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছায়নি। স্টেশনের বাতি স্তম্ভের ওপর জ্বলত কেরোসিন তেলের কুপি। ট্রেন আসত এক একখানা এক দেড় ঘন্টা পরে পরে। তখনও গ্রামের মানুষের মধ্যে শহর নির্ভরতা এত বৃদ্ধি পায়নি। যে কারণে ট্রেনে খুব একটা ভিড় হত না। সারাদিন মুখে একটা কুটিও কাটিনি, তার ওপর এতটা পথ হাটা; পথশ্রমের ক্লান্তিতে বসে পড়লাম দু নাম্বার প্লাটফর্মে এক কাঠের বেঞ্চিতে। আর কিছুক্ষণ পরে শুয়ে পড়লাম। শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম, তলিয়ে গেলাম ঘুমের এক অতল মহা সমুদ্রে।
অনেক রাতে যখন দূর কোন বাঁশবনে যেন শেয়াল ডাকছে, আমার ঘুম ভেঙে গেল একজন অপরিচিত মানুষের গলার শব্দে। সে আমার কাছে জানতে চাইছে, এই খোকা, তুই কোথায় যাবি রে? এমন বেমক্কা প্রশ্নে ফ্যালফ্যাল করে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কোন জবাব দিতে পারি না। আমি কি জানি কোথায় যাব। কোথায় আমাকে নিয়ে চলেছে আমার ভবিতব্য। শুধু এইটুকু জানি, দুর্ভিক্ষের এই অন্ধকার হা মুখ থেকে আমাকে দূরে পালাতে হবে। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে হবে, পৃথিবীর সব অন্ন সব শস্য সর্বসুখ লুঠ হয়ে গ্যাছেনাকি সবার অলক্ষ্যে কোথাও আমার, আমাদের জন্য এককণা পড়ে আছে।
যখন বাসা ছেড়ে চলে আসি, মা বাবাকে বলে আসা হয়নি। বললে তারা আমাকে এমন নির্বান্ধব পথে নিরুদ্দেশ যাত্রায় যেতে দিত না। এমন যে হিংস্র বাঘ সে-ও তার বাচ্চাকে চোখের আড়ালে যেতে দেয় না। মানুষের তো মায়ার শরীর। আমার মা এখন নিশ্চয় জেগে বসে আছেন, আমার অপেক্ষায় পথের দিকে তাকিয়ে। রাত যত বাড়বে তার চিন্তা তত বেড়ে যাবে। শেষে দুচোখ জুড়ে নামবে প্রবল বর্ষণ ধারা।
মাকে কাঁদিয়ে আজ দূর পরবাসের পথে চলেছি ওই মা বাবা ভাইবোন এদের সবার জন্য। যদি কোন দিন সন্ধান পাই, যদি সেখান থেকে সবার জন্য কিছু সুখ কিছু আয়ু নিয়ে ফিরে আসতে পারি সেদিন আবার এই পথ ধরে ফিরে আসব। নচেৎ এই শেষ, এই আমার অগস্ত্য যাত্রা। আমি ঠিক জানি না আমার এই যাত্রার সমাপ্তি কোথায়।
আমি কোন জবাব দিতে পারছি না দেখে আবার প্রশ্ন করে সেই জমাট বাধা অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা। যার হাতে একটা টর্চ। যে টর্চের আলো আমার মুখ মাথা শরীরে। এ্যাই তোরা রেফুজি? তখন মাথা নাড়ি আমি। আর আমার কিছু বলবার দরকার ছিল না। আমার মাথা নাড়ায় সব জবাব পেয়ে যান তিনি। জেনে যান আমার বিগত অতীত আগত ভবিষ্যৎ। রিফিউজি। বাংলা ভাষার অভিধানে এর চেয়ে দরিদ্র নিকৃষ্ট অপমানজনক শব্দ আর একটাও নেই।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে রিফিউজি আর বাঙাল সমার্থক শব্দ। যা স্থানিক পরিভাষায় একটা গালাগালিও বটে। যেমন বুর্জোয়া, প্রতিক্রিয়াশীল, জোতদার, সুদখোর, রাস্তার কুকুর। কী ভীষণ বিড়ম্বনা। কী অভিশপ্ত অপরাধময় জীবন আমাদের। আমরা নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেই, মূর্তি পূজা করি, সেই অপরাধে একদল মুসলমান আমাদের কাফের বিধর্মী শত্রু বলে। আমরা নিম্নবর্ণ-নমঃশূদ্র জনগোষ্ঠির মানুষ বলে, একদল তথা কথিত উচ্চবর্ণ আমাদের অচ্ছুত অস্পৃশ্য চণ্ডাল বলে গাল দেয়। ঘৃণায় থুতু ছেটায়। এখন এদেশে এসে পড়তে হয়েছে–ওদেশে জন্মাবার অপরাধে আর এক গালাগালির সামনে–বাঙাল। “বাঙাল মনুষ্য নহে, উড়ে এক জন্তু লাফ দিয়ে গাছে ওঠে, লেজ নাই কিন্তু।” এটি এক ঘটি কবি দ্বারা রচিত কবিতার লাইন। ঘটিদের চোখে বাঙালরা সব বহিরাগত। যারা অন্য এক দেশ থেকে এদেশে এসে চাকরি ব্যবসা রাজনীতি শিল্প সাহিত্য সব কিছু কজা করে নিয়েছে। বর্তমানে এই বাঙাল ঘটি বিরোধ এমন তুঙ্গে যে নিকট ভবিষ্যতে শিয়া সুন্নিদের মত একটা রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়।
যা ভেবেছিলাম তা নয়, এই ভদ্রলোক ঘটি নন–বাঙাল। বাঙাল, তবে রিফিউজিও নন। ওদেশ থেকে এদেশে এসে নগদ টাকায় জমি জায়গা কিনে ঘরদোর পুকুর সব বানিয়েছেন। লেখাপড়া জানা মানুষ, উনি তাই জানেন কোন শব্দের প্রয়োগে এক রিফিউজি বাচ্চাকে পেড়ে ফেলা যায়। সেই শব্দবাণ ছুড়লেন তিনি, আমার বাড়ি যাবি? থাকবি আমার বাড়ি? ভাত খেতে দেব।
ভাত। আহা রে! সেই কবে কতকাল আগে যেন ভাত খেয়েছিলাম। কী তার রঙ রূপ ঘ্রাণ আর স্বাদ। সে স্বাদ গন্ধে যেন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ভাতের নামে কাত হয়ে যায় এক যুগান্তের অনাহারি বালক। সে লোকটার পিছন পিছন হেঁটে গিয়ে পৌঁছায় তার বাড়ি। কেন আমাকে ভাত দেওয়া হবে পথে আসতে আসতে তা বুঝিয়ে বলে দেন তিনি–কটা গরু আছে, তাদের একটু খড় বিচালি ঘাস জল দেওয়া, গোয়ালটা একটু সাফ সাফাই করা, এই সব আর কী।
লোকটি পেশায় একজন ডাক্তার এবং জাতিতে বামুন। দেশ ভাগের কারণে দেশ ছেড়ে এলেও উনি যে রিফিউজিদের মত ক্যাম্পে গিয়ে ঢোকেননি, কলোনিতে পরের জমি জবরদখলও করেননি, নিজের টাকায় বাড়িঘর বানিয়েছেন সে নিয়ে ওনার খুবই গর্ব ও অহংকার।
মানুষের মধ্যে কত যে ভাগ বিভাগ তা কিছুতেই আমি বুঝে উঠতে পারি না। মানুষের সাথে মানুষের অবাধ মেলামেশার দরজা কতভাবে যে বন্ধ করার অপচেষ্টা করে চলেছে মানুষ, তার তল খুঁজে পাই না। এখন জানলাম বাঙালদের মধ্যে আরও একটা উপভাগ রয়েছে, যারা রিফিউজি বা কলোনি বাসিন্দা নয়।
আমার ছোট্ট জীবন এতদিন যে দুই ক্যাম্পের সীমানার মধ্যে কেটেছে, সেখানে কোন বামুন কায়েত ছিল না। ফলে বর্ণব্যবস্থা জিনিসটা যে কী তাও আমার খুব একটা জানাবোঝর অবকাশ ঘটেনি। বিয়ে বা শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়াতে বাইরে থেকে মাঝে মধ্যে যে দু একজন বামুন ক্যাম্পে আসত, তারা কখনও জাতিগর্বে বুক ফোলাবার মত সাহস দেখাতে পারত না। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় নিজেকে সংযত করে রাখত। এই বাড়িতে এসে প্রথম বর্ণবাদের কুৎসিত কদাকার রূপটা প্রত্যক্ষ করলাম। বুঝতে পারলাম যে হিন্দু ধর্মের মানুষ বলে আমরা পরিচয় দিয়ে গর্বিত হই, সেই ধর্মে আমাদের স্থান কোথায়।
আমি নমঃশুদ্র, যাদের আগে চণ্ডাল বলা হোত, এরা সে কথাটা জানে। ফলে বাড়ির লোক আমাকে এমন ঘৃণিত জীব বলে মনে করে যেন আমি কোন ছোঁয়াচে রোগের রোগী। ভাত খাবার সময়ে ডাক্তারের গিন্নি একটা কলাই করা বেড়ানো থালায় যেন ছোঁয়া না লেগে যায় এমন ভাবে উঁচু থেকে ছরছর করে ভাত তরকারি ঢেলে দিত। যা উঠোনের এক ধারে বসে কাঙালের মতো খেয়ে নিজের থালা নিজে ধুয়ে আনতে হত। সে থালা ওরা ঘরে ঢোকাতনা। গোয়াল ঘরের মধ্যে রাখা থাকত। আমার ঘুমাবার জন্য বরাদ্দ স্থান ছিল গোয়ালের একধারে গাদা মারা ঘুঁটের বস্তার উপর। গরুর চোনার গন্ধে আর মশার কামড়ে সারা রাত ঘুমাতে পারতাম না। ঘুমাতাম দিনের বেলায় গরু চড়াতে গিয়ে, মাঠের কোন গাছ তলায় গামছা পেতে। সেই ঘুমের কারণেই একদিন পিঠেপড়েছিল কঁচা কঞ্চি বাড়ি। আমি সেদিন গরুরপাল নিয়ে রেল লাইনের দিকে চলে গিয়েছিলাম ট্রেন দেখব বলে। ট্রেন আসতে দেরি ছিল তাই গরু মাঠে চড়তে দিয়ে আমি শুয়ে পড়েছিলাম এক গাছের ছায়ায়। যখন ট্রেন এল অবলা জন্তুগুলো সে আওয়াজে আতংকিত হয়ে ছুট দিল ঊর্ধ্বশ্বাসে যে যেদিকে পারে। আর তাতেই পা পিছলে গর্তে পড়ে পা ভেঙে গেল একটা গরুর। সেই অপরাধে ডাক্তার আমার পিঠে ভাঙলেন পাঁচনবাড়ি।
ঘুটিয়ারি শরিফ একটা মুসলমান প্রধান অঞ্চল। এখানে গাঁজিবাবা নামক এক পিরের মাজার আছে। যাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আগমন ঘটেছে কিছু বিহারি মুসলমানের। যারা বাঙালী মুলমানদের মত অতটা” নিরামিশ” প্রবৃত্তির নয়। এখানকার এক রেল লাইনের ধারে এনে বসানো হয়েছে পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত একদল ছিন্নমূল মানুষকে। পুরাতন ক্ষতে খোঁচা দিতে এদের কাছে নিয়মিত আসাযাওয়া করে থাকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকজন। ফলে এ সময়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে থম থম করে একটা চাপা উত্তেজনা। যা যে কোন সময় ফেটে পড়বার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান।
ডাক্তার লোকটি খুবই চালাক। সে খুব বুদ্ধি করে স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের ক্ষমতাবান লোকেদের সাথে মনের ঘৃণা হিংসা ক্রোধ মনে চেপে রেখে একটা সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে থাকেন।
একদিন ডাক্তার পাশের গ্রামের কয়েকজন মাতব্বর গোছের মুসলমানকে নিমন্ত্রণ করে নিজের বাড়ি নিয়ে এল পায়েস খাওয়াবে বলে। যদি এখানে কোনদিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, সেদিন এই পায়েস তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে এই তার ধারণা। কিন্তু ডাক্তারের গিন্নি এত সব কুট কৌশল জানে না। যাদের জন্য দেশত্যাগ করে আসতে হয়েছে সেই গরুষোর নেড়ের জাত উঠোনে এসে দাঁড়াবে, বারান্দায় এসে বসবে, খাবে, সে তার ঘোর অপছন্দের। আজ বারান্দায় বসবে, কাল রান্নাঘরে ঢুকবে। তাহলে আর জাতধর্মের কী রইল!
গিন্নির গজগজানিতে কর্ণপাত না করে ডাক্তার তাদের বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বসতে দিলেন। যে বারান্দায় “স্বজাত” হয়ে আমি কোনদিন উঠতে পারিনি, সেইখানে নিয়ে বসানো হল বিধর্মী ম্লেচ্ছদের। গরজ বড় বালাই যে। শোনা যায় মুসলমান শাসনকালেও এমন হোত। নিম্নবর্ণের যে মানুষ হিন্দু উচ্চবর্ণের কাছে কোন মান সম্মান সাম্য ব্যবহার পেত না, যেই সে নিজের জাত ত্যাগ করে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করত সাথে সাথে বৰ্ণহিন্দুদের কাছে সম্মানীয় হয়ে উঠত। রাজার জাত বলে কথা। তখন সম্মান না দিলে অবজ্ঞা দেখালে পেয়াদা এসে যখন প্যাদাবে, কোন বাপবাঁচাবে? এই কারণে নাকি দলিতশ্রেণির বহু মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।
সে যাইহোক সমস্যা হল তারা পায়েস খেয়ে চলে যাবার পর। তখন আর ডাক্তারের গিন্নির গলায় কোন রাখঢাক রইল না। চিৎকার করে তিনি ডাক্তারের বেআক্কেলে কাণ্ডজ্ঞানের জন্য ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। আর আমার উপর আদেশ হল গোবর জল গুলে যেখানে তারা দাঁড়িয়েছিল, বসে ছিল, সর্বত্র তা ছিটিয়ে শুদ্ধ করবার। তারা যে থালায় খেয়েছে তা ধুয়ে সাফ করবার। এসময়ে তিনি আমাকে “অচ্ছুত হওয়া সত্ত্বেও” মুসলমানের চেয়ে উচ্চে স্থান দিয়েছিলেন।
ওই নিমন্ত্রিত মুসলমানদের একজনের একটা রেডিও সেট ছিল সে সেটা সর্বক্ষণ সাথে নিয়ে ঘুরত। ওটা সে এখানে ফেলে চলে গিয়েছিল। সুইচ অফ থাকায় তার অস্তিত্ব কেউ টের পায়নি। কিছুদূর পথ পার হয়ে গিয়ে রেডিও ফেলে যাবার বিষয়টা মনে পড়ে যাওয়ায় সেটা নিতে তারা ফিরে এসেছিল। কিন্তু ডাক্তারের গিন্নির বিষবাক্য আর গোবর জলের বন্যা দেখে তারা আর বাড়ির ভিতর ঢুকতে পারেনি। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল পুকুর পাড়ের রাস্তার উপর।
বাড়ির কেউ তাদের দেখতে পায়নি। পুকুরে জল আনতে গিয়ে দেখে ফেলেছিলাম আমি। মৃদুজোছনার আবছা আলো অন্ধকারে অপমানে পাথর হয়ে যাওয়া সেই মানুষগুলোর দুচোখে যেন জ্বলছিল সর্বনাশা আগুন। যে আগুনে ঘর পোড়ে শান্তি সম্প্রীতি পোড়ে সমাজ পোড়ে দেশ পোড়ে।
কেন জানিনা সেদিন আমার অপরিণত কিশোর মনে ছায়া ফেলেছিল একটা অশুভ আশংকা, ওরা এই অপমান হজম করতে পারবে না। কোন একদিন পেটের মধ্যে যাওয়া পায়েস বমি হয়ে বেড়িয়ে আসবে। সেই ঘৃণার স্রোতে ভেসে যাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সকল প্রয়াস। কারণ ঘৃণা তো ঘৃণারই জন্ম দেয়, যেমন ভালোবাসা জন্ম দেয় ভালোবাসার। যে ঘৃণা নিয়ে আজ এরা ফিরে যাচ্ছে, কাল দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দিতে আসবে।
শত শত বছর ধরে এই অভাগা দেশে একদল মানুষ আর একদল মানুষকে ধর্মের নামে বর্ণের নামে বিনা কারণে যে অপমান অত্যাচার করে চলেছে নিউটনের সূত্র যদি সত্যি হয় তবে তা একদিন ফেরত আসবেই। কোন উপায় নেই সেদিন চোখের জলে, বুকের দীর্ঘশ্বাসে তোমার পাওনা, তোমাকে বুঝে নিতেই হবে।
সেদিনের সেই আশংকা আমার সত্যে পরিণত হয়েছিল মাত্র অল্প কিছুদিন পরেই। সেটা যতদূর মনে পড়ে ১৯৬৩ সাল। যেবার কাশ্মীরের কোন এক মসজিদ থেকে যেন হজরত সাহেবের “বাল” চুরি গিয়েছিল। সত্যিই চুরি গিয়েছিল না নিজেরাই লুকিয়ে রেখে গুজব ছড়িয়ে ছিল কিছু দুষ্ট লোক, তা কে জানে। তবে সেই উপলক্ষ্যে সারাদেশ জুড়ে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। যে দাঙ্গায় বহু নিরীহ মানুষও মারা যায়। সে দাঙ্গার রক্তদাগ আমার কিশোর হাতেও লেগে ছিল। আমার হাতে লেগে যাওয়া সে রক্তের গন্ধ এখনও টের পাই।
শুনেছি সেই সময়ে কে বা কারা ডাক্তারের বাড়িতে রাতের অন্ধকারে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার আগে ঘরের মূল্যবান যা কিছু লুঠপাট করে নেয়।
.
শহর কলকাতার মধ্যে একটা জায়গার নাম আমার জানা ছিল। সেটা যাদবপুর। একদিন এসে পড়লাম সেই যাদবপুরে। যেখানে নানা রকম কাজ পাওয়া যায়। আমার বাবা এখানে এসে কাজ পেতেন। বাবা যখন পেয়েছেন ছেলেও পাবে। তাই ট্রেন থেকে নেমেছিলাম এখানে। প্রথম রাতটা কাটাতে হল এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এখন যেখানে গণশক্তি সাঁটা হয় সেই দেওয়ালের কাছে পানের পিক পোড়া সিগারেটের টুকরো ছেঁড়া কাগজ ধুলোময়লার মধ্যে শুয়ে। সে রাতে ধুম জ্বর এসেছিল আমার। সারা গায়ে ছিল পাকা ফোঁড়ার মত বিষ ব্যথা। ডাক্তারের বেপরোয়া কঞ্চি চালনায় শরীরের নানা জায়গা ছিল দাগড়া দাগড়া ফোলা।
পরের দিন সকালে জ্বর আর ছিল না, ছিল পেটে ভীষণ খিদে। আর গায়ের ব্যথাটা বেড়ে গিয়েছিল বেশ খানিকটা। কিন্তু এইসব অসুবিধার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকলে সমস্যা যে বেড়ে যাবে। তাই সব শারীরিক ক্লেশ অস্বীকার করে খুঁজতে বের হলাম একটা কাজ। তখন কতই বা বয়স আমার। এই বয়সে এমন কীবা কাজ আমি পেতে পারি। তাই যে কাজ আমার সামর্থে কুলায় যে কাজের আমি যোগ্য, পেয়েছিলাম সেই কাজ, এক হিন্দুস্থানির চায়ের দোকানে গেলাস ধোবার চাকরি। যার মাইনে মাসে দশটাকা। আমার মনের মধ্যে ডাক্তারের বাড়ির স্মৃতি তখন একেবারে টাটকা, নিম্নবর্ণ হবার যে যন্ত্রণা-অপমান তা আমার হাড়ে হাড়ে জানা। তাই নিজের নামটা বদলে একটা নাম রেখে নিলাম যাতে আমাকে কেউ নমঃশূদ্র বলে শনাক্ত করতে না পারে। তাহলে হয়ত আর কাজেই রাখবে না। যদি বা রাখে ব্যবহার করবে ঘৃণ্য কোন জীবের মত। দোকান মালিক উত্তর প্রদেশের লোক। যাদের মধ্যে জাতপাত ছুয়াছুত বাঙালীদের চেয়ে ঢের বেশি। তবে আমার ভাগ্য এসময়ে ভালো বলে তারা আমার জাত বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখাল না।
সঠিক মনে নেই বোধ হয় চার পাঁচ মাস এই দোকা্নে কাজ করেছিলাম। এরা মাসমাইনের দশ টাকা মাসের শেষে চাইলেই দিয়ে দিত। তবে ধোবার সময় হাত ফসকে পড়ে গিয়ে গেলাস ভেঙে গেলে তার দামটা মাইনে থেকে কেটে নিত। এটা শাস্তি, যাতে কাজের লোক কাজের প্রতি অমনযোগী না হয়। প্রায় মাসেই শত সাবধানতা সত্ত্বে একটা দুটো গেলাস ভেঙেই যেত। একবার প্রায় চারসের দুধ হাত থেকে পিছলে নিচে পড়ে গিয়েছিল। সে মাসে মাইনে মেলেনি।
আমি তখনও কোন খুন জখম দেখিনি। দাঙ্গা কাকে বলে জানি না। রামায়ণ মহাভারত পাঠ শুনেছি, মানুষ মানুষকে বধ করে সেটা জানি। কিন্তু সেটা যে কী মর্মান্তিক দৃশ্য। সেই দৃশ্যের সামনে পড়তে হল একদিন।
এক সকালে দেখি সামনের রাস্তা ধরে বাঁশ টালি বয়ে নিয়ে দলে দলে লোক চলেছে পুর্বদিকে। কারা এরা! যাচ্ছে বা কোথায় এইসব নিয়ে? এরা চলেছে সন্তোষপুর খাল পার হয়ে এখন যেখানে ইস্টার্ন বাইপাস সেখানে। ওখানে বিশাল এলাকা জুড়ে জমিদারদের কবজা করে রাখা জমি এরা দখল করে নিচ্ছে। এখানে আর একটা জবরদখল কলোনি করবে। অহীন রায় চৌধুরী নামের এক কংগ্রেস নেতার নেতৃত্বে এসব হচ্ছে। তার সাথে রয়েছে সোনাইয়া নামের আর একজন। যে পরে হাতকাটা সোনা নামে খ্যাত হয়। যখন জমি জবর দখল হয় তখন তার হাত ছিল। প্রায় আট দশ দিন ধরে চলল এই পথে দখলদার লোকদের মিছিল। এক দুপুরে আমি সেই নতুন কলোনি দেখতে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম যতদূরে চোখ যায়, তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট ঘর। কোনটা হোগলার কোনটা মুলিবাঁশের। গোনা যায় না, তবে মনে হয় কুড়ি পঁচিশ হাজার পরিবার বসে গেছে ইতিমধ্যে। ইচ্ছে হয়েছিল এখানে এক খণ্ডভূমি আমিও দখল করব। আমাদেরও তো কোথাও থাকবার মত জায়গা নেই। কিন্তু আমার ভাবনাটা ছিল যে পরিমাণ বড় বয়স আর শরীরটা ছিল সে তুলনায় ছোট। তাছাড়া একটা ঝুপড়ি খাড়া করতে যে কটা বাঁশ আর হোগলা দরমা দরকার সে টাকাই বা কোথায় পাব।
গল্পে আছে একজন লোক ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠতে দেরি করার ফলে ট্রেন ফেল করেছে। এতে তার প্রচুর লোকসান হয়ে যাবার জন্য মনভার। কিন্তু যখন আধ ঘন্টা পরে খবর পেল সেই ট্রেনখানা দুর্ঘটনায় পড়েছে তখন আর তার ট্রেন ফেল হবার জন্য মন খারাপ রইল না। তখন ওই ট্রেনে না উঠতে পাবার জন্য নিজেকে নিজে ধন্যবাদ জানাল।
কদিন পরে একরাতে গনগনে আগুনের শিখায় পুবাকাশ লাল হয়ে গেল। শোনা গেল শতশত কণ্ঠের সম্মিলিত আর্তনাদ। নৈশ নিস্তব্ধতা ভেদ করে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ। সারা রাতে এ শব্দের বিরাম ছিল না।সকাল হতেই দেখতে পেলাম, যে পথে কাল মানুষ পায়ে হেঁটে গিয়েছিল, এখন সেই পথেই ফিরে আসছে বাঁশের মাচায়, ঠেলাগাড়ি ভ্যান রিকশায়। সবার শরীর থেকেই পথের ধুলায় ঝরে ঝরে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। মানুষের রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে পথের ধুলো। সারারাত ধরে পুলিশ আর জমিদারদের পোষাগুণ্ডা বাহিনী যে নৃশংস তাণ্ডব চালিয়েছে এ সব তারই নিদর্শন। একসঙ্গে এত রক্তাক্ত আহত নিহত মানুষ দেখে সেদিন সেই কিশোর মন কাতর হয়েছিল আমার। সেদিন পৃথিবীটাকে আমার সভ্য মানুষের বাসভূমি বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছিল একদল হত্যাভিলাষী ঘাতকদের উল্লাস ভূমি। এই বধ্যভূমিই আমার দেশ। এই হত্যাকারির উল্লাস মঞ্চই আমার দেশ।
আমার বাবাকে একদিন বিনা অপরাধে পুলিশেরা মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। সেইদিন থেকে পুলিশ নামটার প্রতি আমার জন্মে আছে ঘৃণা ভয় আক্রোশ। এবার সেই সাথে যুক্ত হল আর একটা নাম সেটা হচ্ছে জমিদার। পুলিশ গুণ্ডা আর জমিদার এরা মানুষের শত্রু। এদের মাত্র একটাই কাজ মানুষকে অত্যাচার করা। ডাক্তারের বাড়ির অমানবিক ব্যবহারে বর্ণ প্রভুদের প্রতি ক্ষোভ রাগ সেও যাবার নয়। এই রাগ ক্ষোভ ঘৃণায় ত্রিবেণী সঙ্গমের ঘোলা স্রোতে ভেসে চলল আমার ছোট্ট জীবন তরীখানা। মনের মধ্যে জমা হতে রইল বিস্ফোরণউন্মুখ বারুদ।
জীবন এক যাত্রা, জীবন এক যুদ্ধ, জীবন এক অভিজ্ঞতার নাম। আমি কি তখন জানি যে জীবন আমাকে কোথাও থিতু হতে দেবে না। ক্রমাগত তাড়িয়ে নিয়ে যাবে এক বিভৎসতা থেকে আর এক বিভৎস অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে। রক্ত ধ্বংস চোখের জলের বহু পথ পার হতে হবে এই ছোট পায়ে। এই পথই আমার জন্য পূর্ব নির্ধারিত। কেউ আমাকে টানছে, কেউ আমাকে ঠেলছে সেই দিকে চালিত করার জন্য। আমি এক ক্ষুদ্র মানুষ, আমার সাধ্য কোথায় সেই অমোঘ নির্দেশ উপেক্ষা করবার।
যাদবপুর ত্রিকোণ পার্কের সেই দোকনে থেকে কাজ ছেড়ে দিয়ে এবার কাজ খুঁজে নিয়েছিলাম পার্ক সার্কাসের এক চায়ের দোকানে। আগের মালিক মাইনে দিচ্ছিল মাসে দশ টাকা, এ মালিক দেবে তার দেড়গুণ বেশি। মাসে পঁচিশ টাকা।
এই দোকানদার বৃদ্ধ। রোজ সন্ধ্যেবেলায় তার দোকানে তারই মত জনাকয়েক বুড়ো লোক আড্ডা দিতে আসে। একদিন এদের আলোচনায় জানা গেল মুসলমানদের কোন এক মসজিদ থেকে নাকি পবিত্র “হজরত বাল” চুরি গেছে। এদের সন্দেহ ওসব চুরি ফুরির গল্প স্রেফ বানানো। ওই বস্তু নিয়ে কার কী লাভ। এই সব বলে মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে কিছু বদমাশ লোক একটা দাঙ্গা বাধাতে চাইছে। এবং একদিন সত্যি সত্যি সারা দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরুই হয়ে গেল। কারণ মুসলমানদের মধ্যে কিছুলোক বিশ্বাসই করে বসল যে এটা হিন্দুদেরই কাজ। দেশের পরিস্থিতি তো অনেক আগে থেকেই পারস্পরিক ঘৃণা ভয় সন্দেহ বিদ্বেষে অগ্নিগর্ভ হয়েছিল। দরকার ছিল মাত্র একটা ছুতোর। সে ছুতো পাওয়া মাত্র পাগলা কুকুরের মতো এক সম্প্রদায় ঝাঁপিয়ে পড়ল আর এক সম্প্রদায়ের টুটি লক্ষ্য করে, দাঁতে কামড়ে ছিঁড়ে নেবে বলে।
পার্ক সার্কাস অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি। উস্কানি যথেষ্ট আছে, তবে এখন পর্যন্ত এ অঞ্চলে দাঙ্গা হয়নি। পথেঘাটে হাটেবাজারে তারই ইঙ্গিত আভাষ বড় প্রকট। রাত নামলে সবার চোখে মুখে ঘনিয়ে ওঠে ভয়ের কালো ছায়া। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পথচলা মানুষ ঘরে ফিরে দরজা এটে বন্ধ করে নেয়। শুনশান হয়ে যায় সব অলিগলি। এখন বড় ভয়ানক দিন। এসব দিনে সন্ধ্যা নামলে কোন মা কোন বাবা তার সন্তানকে ঘরের বাইরে যেতে দেয় না। যদি ঘরের বাইরে থাকে সে ফিরে না আসা পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় মা বাবার বুক কাপে।
আমি এক অভাগা মানুষ। আমার এই বিপন্ন “বিদেশে” কোন আপনজন নেই, যে, আমি হারিয়ে গেলে খুঁজবে, মরে গেলে কাঁদবে। আমি কাজের লোক। আদেশ পালন করা যার কাজ। “পারব না” বলা যার মুখে মানায় না। সেটা গর্হিত অপরাধ। কর্মচারিদের প্রতি মালিক শ্রেণির কোন মায়া মমতা থাকেনা। সেটা তাদের মানসিক দুর্বলতার লক্ষন। চিত্ত দুর্বল মালিক–মালিক শ্রেনির–উপহাসের পাত্র। কষাই পাঠা ছাগলের প্রতি মমত্ব দেখালে তার ব্যবসা ফেল মেরে যাবে।
ত্রিকোণ পার্কের দোকান থেকে সরাসরি পার্কসার্কাসে আসিনি। এর আগে দিন কয়েক পালবাজারে এক দোকানে কাজ করেছিলাম। সে দোকানের মালিক রোজ রাত সাড়ে নটার সময়ে আমাকে তার বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতে পাঠাত। তার বাড়িটা ছিল কালিকাপুর মাঠ পার হয়ে মাইলখানেক আগে। পালবাজার থেকে সে বাড়ির পথ চারপাঁচ মাইলের বেশি নয়। তবে গরফা স্কুল পার হবার পর পুরো পথটাই ছিল এবরো খেবরো–অন্ধকার আর বনজঙ্গলে পূর্ণ। তখনও এ অঞ্চলে এত ব্যাপক জন সমাগম ঘটেনি। সেইসব বনজঙ্গলে বাস করত সাপ শেয়াল অজস্র পোকামাকড়। অত রাতে এ পথে কোন লোকজন থাকত না। একা যেতে খুবই ভয় করত আমার। গরফা স্কুল পার হয়ে অন্ধকার পথে নেমে ভয়ের তাড়সে জোরে জোরে গান গাইতাম আমি। গান মাত্র এক কলি–ভজ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ, হরে কৃষ্ণ হরে রাম শ্রীরাধা গোবিন্দ। অন্যসব নাম তো ফালতু ফালতু নেওয়া–আসল নাম হচ্ছে রাম। সবাই যা জানে আমিও তা জানি, রাম নামে ভূত পালায়। এখানে যা জঙ্গল ভূতপ্রেত না থাকার কোন কারণ নেই। তাই খুব দ্রুত উচ্চারণে ভজ থেকে রামে পৌঁছে যেতাম।
এক নিশুতিরাতে এভাবেই গান গেয়ে–দুরুদুরু বুকে কাঁপা কাঁপা পায়ে পথ হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ কালিকাপুর খালের এপাড়ের ঘন জঙ্গল থেকে বের হয়ে এল আটদশটা ক্ষুধার্ত শেয়াল। যেভাবে ওরা ছাগল ছানাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে শিকার করে সেভাবে ঘিরে ফেলল আমাকে। আমার পালাবার কোন পথ নেই।
আমার কাছে তখন আত্মরক্ষা করার মতো কোনকিছুই নেই। এক হাতে টিফিন ক্যারিয়ার অন্যহাতে দু-ব্যাটারি একটা ছোট টর্চ। টর্চের আলোয় দেখতে পাচ্ছি শেয়ালগুলোর নরমাংস লোভী চোখগুলো চক্ করছে। এখানে কোন ঘরবাড়ি নেই যে চিৎকার করলে কেউ এসে আমাকে বাঁচাবে। বেশ কিছু দূরে পাতলা পাতলা কটা পাকা বাড়ি দেখা যাচ্ছে বটে সে সব বাড়ির আলো নেভানো দোর দরজা আঁটা। এতে কোন লোকজন আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
আমার অবস্থা এখন চক্রব্যুহে পড়া অস্ত্রহীন অভিমুন্যের মত। এক অসহায় বালককে খাবে বলে বৃত্ত করে থাকা শেয়ালগুলো ক্রমে বৃত্ত ছোট করে আনছে। আর আমি অসহায়ভাবে মাঝখানে দাঁড়িয়ে–কোন দিক থেকে আক্রমণ আসবে সেই ভয়ে ঘুরপাক খাচ্ছি। সেই গ্রাম বাংলার দাড়িয়াবান্ধা খেলার মত নানা দিক থেকে শেয়ালগুলো ‘ঝোল’ মারছে।
আমার পরিধানে কোমরের কাছ বরাবর রবার লাগানো কালো ছাতার কাপড়ের একটা প্যান্ট। গায়ে–এককালে যার রঙ সাদাই ছিল, এখন মেটে মেটে সেই স্যান্ডোগেঞ্জি। প্যান্টের উপর কষে বাঁধা একখানা গামছা। গ্রামবাংলার চাষির ছেলে, গামছা আমার সদাসঙ্গী। গামছা আমার কাছে শুধু চান করবার এক টুকরো বস্ত্র নয়, ঘাম মোছার রুমাল, মাথায় বাঁধার পাগড়ি, গায়ে দেবার চাদর, বিছিয়ে শোবার বিছানা, কোমরের বেল্ট।
আজ এখন মনে হল এটা একটা যুদ্ধের অস্ত্রও হতে পারে। যা আমাকে আত্মরক্ষায় সাহায্য করতে পারে। তাই চট করে পাথের পাশে পড়ে থাকা এক খানা ইটের টুকরো কুড়িয়ে বেঁধে নিলাম গামছার এককোণে। তারপর গামছার অন্যপ্রান্ত ধরে বনবন করে চক্রাকারে ঘোরাতে শুরু করে দিলাম। শেয়ালগুলো বুদ্ধিমান এবং যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ। তারা বুঝে গেল দূর থেকে যতই পায়তাড়া দেখাক আমার কাছে আর এগিয়ে আসতে পারবে না। তাই রণেভঙ্গ দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে গেল।
সামান্য একটা ইঁটের টুকরো যে আমার প্রাণ বাঁচাতে পারে তা আগে জানা ছিল না। আসলে জীবন তো এই। পথে পথে ঠোক্কর হোঁচট খেতে খেতে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা। এই সমৃদ্ধি যার যত বেশি সে তত অকুতোভয় সাহসী নির্ভীক বেপরোয়া।
পার্ক সার্কাসের বুড়ো দোকান মালিকের একটা বিশেষ শখ, রেল লাইনের পাশে যে ছোট গুমটি মতো বিড়ির দোকান সেই দোকানের মাথা চ্যাপ্টা লাল সুতোর নেপানি আর গুজরাটি তামাকের মিশ্রণে দাড়িআলা বুড়োর হাতে বানানো বিড়িতে। সে এমন বিড়ি যা ভূভারতে আর কোথাও মিলবে না। সে বিড়ির ধোঁয়ায় কলজে মন প্রাণ সব শীতল হয়ে যায়। রোজ রাত সাড়ে নটার সময়ে–চা দোকান বন্ধের ঠিক আধ ঘণ্টা আগে আমাকে পাঠানো হয় সেই বিড়ি আনতে।
আগে এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল, এখন অন্যরকম। আজ এই অন্ধকার রাতে–যখন ছুরি হাতে নিয়ে কষাইয়েরা ওত পেতে আছে, মানুষের গলার নলি কাটবে বলে, তখন মালিক রোজকার মত হুকুম দিল–যা, বিড়িটা গিয়ে নিয়ে আয়। আমি নিশ্চিন্ত জানি, সেদিনের সেই রক্তস্নাত শহর কলকাতায় যদি কারও উপর কারও সামান্য দরদ থাকে, জীবনের মূল্য কানাকড়িও মনে হয়, তাকে রাত সাড়ে নটায় পাঠাতে পারবে না ওই রকম এক এলাকায়। যেখানে ‘দাঙ্গা’ শুরুর আগেই দু-দলে দাঙ্গা চলে রাতদিন। চাকু চলে বোমা পড়ে মানুষ মরে।
আমি মালিকের বেতনভুক ভৃত্য। তার মুখের উপর না বলার কোন অধিকার নেই। তাহলে কাজ চলে যাবে পঁচিশটাকা মাস মাইনের। পঁচিশটাকা অনেকটাকা। সাড়ে বারো কিলো চাল হয়। তাই নিরপায় এক বালক নির্জন অন্ধকারে হাঁটা দিল জীবনের এক রক্তাক্ত বিভৎস অধ্যায়ের দিকে।
সে সময় পার্ক সার্কাস রেল স্টেশনটা তৈরি হয়নি। চারদিকের ঝোঁপঝাড় গাছপালায় এলাকার পরিবেশটা ছিল কেমন বন্যবন্য। যেন বাঘ সিংহ বুনো শূকর বুনো মোঘ অবাধে ঘুরে বেড়ায়।
যাবার সময়ে ঠিকঠাক গেছি, পথে কোন অসুবিধাই হয়নি। বিড়ি কিনেছি এক বাণ্ডিল। ঠিক মাঝখান থেকে একটা বিড়ি বের করে দোকানের পাশে ঝোলানো দড়ির আগুনে ধরিয়ে নিয়ে সুখটান দিতে দিতে ফিরে চলি চায়ের দোকানের দিকে। হঠাৎ এক মোড়ে অন্ধকার ফুড়ে আমার পথরোধ করে দাঁড়াল তিন চারজন ছেলে। দেখলেই বোঝা যায় এরা কোন ভদ্র সভ্য নয়–রেল বস্তির বখাটে বাচ্চা। তারা বয়সে উচ্চতায় ছোট হলেও একজনার হাতে ধরে থাকা চাকুখানা মোর্টেই ছোট নয়, বেশ বড়। একে কানপুরি বলে। ছেলেটার গলার গর্জনও বেশ বড়দের মতো। সে সেই চাকুখানা আমার সামনে বাগিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করে, “আবে এই, তোর কী জাত রে?” ছেলেগুলো কথা বলছে বাংলায়। তবে এ আমার পরিচিত বাংলা ভাষা নয়, হিন্দির মিশেলে বিকৃত বাংলা বা বাংলা ভাষার “এই সি কী তেইসি”।
এখন চারিদিকে দাঙ্গা। রাজাবাজার খিদিরপুর জ্বলছে, মানুষ মরছে। এই অকটবিকট সময়ে এরা অন্যকোন জাত নয়, স্রেফ আমি হিন্দু না মুসলমান সেটাই জানতে উৎসুক। যদি ওদের স্বজাতির হই গলাগলি করবে। যদি অন্য জাতির হই গলার নলিতে চাকু চালিয়ে দেবে। এই হনন অভিলষিত সময়ে এর বাইরে আর কোন ব্যাসকূট নেই। “বলনা রে কী জাত তোর”। তাড়া দেয় তারা–“জলদি বল”। কিন্তু তখন যে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে বৈশাখের মাঠ। গলা দিয়ে কোন স্বর সরে না। বুঝেও উঠতে পারি না কোন জাত বলব। কোন জাতের কথা বললে এরা আমাকে না মেরে ছেড়ে দেবে। ওদের মুখে দাড়ি নেই, মাথায় টিকি নেই, পরিধানে লুঙ্গি নেই, কপালে ফোঁটা নেই। কারও শরীরে এমন কোন চিহ্ন নেই যা দেখে চিনতে পারি ওরা কী জাত। তবে তো বলতে পারি–আমি ভাই তোমাদেরই জাত। আমার জবাব দিতে দেরি হওয়ায় ওদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। বারবার তাগাদা দিচ্ছে “বলনা রে কোন জাত”। আমাদের সমাজের লোকেরা বলে থাকে, বোবার শত্রু নেই। এখন মুখ বন্ধ করে রাখাটাই যে বিপদ ডেকে আনছে। বুঝতে পারি একটা কিছু বলতেই হবে। না হলে এরা আমার পথ ছাড়বে না।
তখনও কেউ আমাকে বলে দেয়নি যে আক্রমণই আত্মরক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। সে শিক্ষা দিল সেই অস্থির অবিশ্বাসী সময়ের উদ্ভুত এক পরিস্থিতি। তখন আর আমার এ কথা মনে করবার মতো অবস্থা বা অবকাশ ছিল না, ওরা এক একা কিশোরকে পেয়ে ভয় দেখিয়ে একটু মজা পেতে চাইছে। কিনা! চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কোথাও কোন জনমানব নেই। রাস্তার পাশের নিরেট দেওয়ালের ওপাশের মানুষগুলো বিশ্ব জগৎ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ঝড়ের মধ্যে বালির ভিতর মুখ গুঁজে পড়ে থাকা উটের মত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। তাকালাম আমার ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে। দেখলাম সামান্য কিছু দূরে একখানা আধলা ইট পড়ে আছে। এ সেইইট যা একবার আমার জীবন বাঁচিয়ে ছিল। সারা দেশটায় এখন শেয়াল কুকুরে ভরে গেছে। এ সময়ে মানুষকে বাঁচতে হলে বারবার ইট পাথর তুলতে হবে।
ওরা কিছু বুঝে উঠবার আগে বিদ্যুৎ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুড়িয়ে নিলাম আধলা খানা তারপর সমস্ত শক্তি দু-হাতে সংহত করে সেটা বসিয়ে দিলাম চাকু বাগিয়ে থাকা ছেলেটার ব্রহ্মতালুতে। এটা সেই জায়গা যেখানে সাধারণ একটা আঘাতে মানুষ মরে যেতে পারে। ইঁটের একটা কোন বসে গেল মাথার মাঝখানে। ছিটকে নিচে পড়ে গেল তার ধারাল চাকু। গোঁ গোঁ করে সে লুটিয়ে পড়ল পথের ধুলোর উপরে। চাকুটা কুড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি–আয় এইবার কেডা আবি। কিন্তু তারা কেউ এগিয়ে এল না। আহত সঙ্গীকে পেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাল অন্ধকারের মধ্যে।
ছোটবেলায় প্রচণ্ড রোগে ভুগেছিলাম। কোনদিন পেট ভরে খেতে পাইনি। সে কারণে শরীরটা ছিল খুবই রোগা আর দুর্বল। আমার বয়সে যে ভাবে বাচ্চাদের শরীর বৃদ্ধি পায় আমার তা হয়নি। ফলে খেলাধুলোয় আমি সব সময় হেরে যেতাম। কারও সাথে ঝগড়া মারামারি হলে মার আমিই খেতাম। সেই আমি–পরাজিত দুর্বল অক্ষম আমি আজ বিজয়ী হয়েছি। আমার পায়ের কাছে এখন পড়ে আছে সবল সশস্ত্র প্রতিপক্ষ। যার গরম রক্তের ছিটে লেগে রয়েছে আমার হাতে। জীবনে কখনও একটা ইঁদুরও মারতে পারিনি। পারব সে বিশ্বাসটাই মরে গিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, পারি। আমিও মারতে পারি। আর মারতে যখন শিখে গেছি বাঁচাটাও শিখে নিতে পারব।
আমার আর এরপর বিড়ি নিয়ে সেই দোকানে ফিরে যাওয়া হল না। কে জানে পালিয়ে যাওয়া ওই ছেলেরা কেউ হয়ত আমাকে চেনে। কোন দোকানের কর্মচারী সেটা জানে। ওরা এতক্ষণে নিজেদের মহল্লায় গিয়ে খবরটা নিশ্চয় দিয়েছে। তখন মহল্লার লোক অবশ্যই ধাওয়া করে আসবে চা দোকানের দিকে। আমাকে নাগালে পেলে ধরে পাঠা কাটা করে দেবে। তাই পালিয়ে গেলাম দোকান মালিককে কিছু না বলে, আমার পাওনা পয়সাও না নিয়ে।
সেদিন সেই ভয়ানক রাতে আমার দিগ্বিদিক কোনও জ্ঞান ছিল না। অর্ধচেতন অধঅচেতন একটা বোধশূন্য ঘোরের মধ্যে কেবলই ছুটে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে। সর্বক্ষণ মনে হচ্ছিল আমার পিছনে পিছনে কেউ তাড়া করে আসছে। আমি থামলেই সে ধরে ফেলবে।
এইভাবে কতক্ষণ ছুটে ছিলাম, কতপথ পার হয়েছিলাম, কোথায় গিয়ে পৌঁছে ছিলাম তার কিছুই জানা নেই। সামনে একটা পার্ক দেখতে পেয়ে পথশ্রমে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম তার মধ্যে। একটা অন্ধকার কোণ খুঁজে নিয়ে সেখানে লুকিয়ে কাটিয়ে ছিলাম সারাটা রাত। সূর্য ওঠার আগে পার্ক থেকে বের হয়ে আবার শুরু করেছিলাম ছোটা। ছুটে ছুটে আমি যেন পৌঁছে যেতে চেয়েছিলাম পৃথিবীর সেই প্রান্তে যেখানে কোন মানুষ থাকে না। হিন্দু মুসলমান থাকে না, শ্মশান গোরস্থান মন্দির মসজিদ থাকে না। হন্তা থাকে না হন্তব্য থাকে না।
সেটা সেই ১৯৬৫ সালের কথা। যে বছর ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে একটা যুদ্ধমতো হয়েছিল! দু-দেশই ছিল অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। তাই মানুষের দৃষ্টি মূল সমস্যা থেকে অন্যদিকে ঘোরাতে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা না খেলে উপায় ছিল না। সে সময় একটা পাকিস্তানি প্লেন উড়ে এসে ব্যারাকপুরে বোমা ফেলে গিয়েছিল। জনরব ছিল, পাকিস্তানি বোমারু বিমান নাকি হাওড়া ব্রিজ গুঁড়িয়ে দেবে। যে কারণে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিভাগ ব্রিজ পাহারার ব্যবস্থা খুবই জোরদার করে রেখেছিল। পঞ্চাশ ফুট অন্তর একজন অস্ত্রধারী পুলিশ।
আমি এক পলাতক ‘খুনি’। বহুদিন ধরে বহু পথ পার হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছেছিলাম হাওড়া ব্রিজের উপর। যার নীচ থেকে বয়ে চলেছে হিন্দুধর্মের কাছে বড়ই পবিত্র নদী গঙ্গা। এ নদীতে নাকি একবার স্নান করলে সব পাপ ধুয়ে যায়। যে কারণে কলকাতার বড় বাজারে একটি বেওসায়ি জাতি গোষ্ঠির মানুষ ব্যবসা ফেঁদে ছিল। সারা দিন লোক ঠকাবে আর পরদিন সকালে গঙ্গায় ডুব মেরে আসবে। লোক ঠকানো পয়সায় ইহকাল, গঙ্গাস্নানের পুণ্যে পরকাল, দুকালই সুখে কাটবে।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গঙ্গা দেখছিলাম। গঙ্গা নদীর বুক বেয়ে ভেসে চলেছে কত লঞ্চ জাহাজ নৌকা। মানুষ ভেসে চলেছে জলযানে কোথায় কোন নিরুদ্দেশে তা কে জানে। ওই ভাসমান জলযানে চেপে আমার মনটাও ভেসে যাচ্ছে। আমার বাবা কাকা, উধ্বর্তম দশ পুরুষ এমনই জলপথে নৌকা নিয়ে চলে যেতেন মাছ ধরতে। যদি দেশভাগ না হোত আমিও একদিন বাবা কাকার সাথে যেতাম। বলা যায় না, কোন এক নদীর মোহনায় আমার সাথে দেখা হয়ে যেত অতল জলের তল থেকে উঠে আসা কোন এক জলপরীর। সুলোচনা, সুকেশী, সুনাসিকা সেই জলকন্যার দর্শন পেয়ে পূর্ণ হয়ে যেত জীবন। এই সব কত কী ভাবছিলাম তখন সেই কিশোর মনে, ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে। যা একান্তই নাবালক ভাবনা।
কতক্ষণ এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ আমার কাঁধে একটা মৃদু টোকা পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ঠিক আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে রাইফেল হাতে একজন পুলিশ। বহুদিন পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি এখন আর পালাবার কোন পথ নেই। এবার আর কী! হয় ফাঁসি নয় দীপান্তর। মা বাবা ভাইবোন কারও সাথে দেখা হবে না আর কোনদিন। সেই দুঃখে ভয়ে কেঁদে ফেললাম আমি।
পুলিশ লোকটা আমার কান্নায় বিব্রত হয়ে জিজ্ঞাসা করে কাঁদছিস কেন! কী হয়েছে? তার কথায় আমি আশ্চর্য হই। গোলাপ যেমন জানে না কেমন তার গন্ধ পুলিশ তেমনই জানে না তারা কী জিনিস। যাকে পুলিশে ধরে তার কদবার কোন দরকার পড়ে না। চোখ ফেটে আপনা আপনি জল বের হয়ে আসে। আমি তো বাচ্চা, এখনও সতের পার হইনি এই রকম বিপদের সময় বড়বড় লোকের চোখের জলে বুক ভেসে যাবে।
পুলিশ লোকটা আবার জানতে চায়–এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন! হারিয়ে গেছিস বুঝি! কঁদিস না, তোর বাড়ি কোথায়? আমরা পাঠিয়ে দেব। চুপ কর।
আমার মনের জোর এবার খানিকটা ফিরে আসে। যে ভাবে লোকটা কথা বলছে, মনে হচ্ছে সে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। পুলিশ হলেও লোকটা ভাল লোক। এমন ভাল মানুষের কাছে মিথ্যা কথা বলতে নেই। ওতে পাপ হয়। যা থাকে ভাগ্যে এর কাছে সত্যি কথাই বলব। কী আর হবে, হয় ধরে নিয়ে যাবে, না হয় যাবে না।
আমি শুনেছি ভারতীয়–বিশেষ করে বাঙালী লেখকদের মধ্যে লেখক কম দার্শনিক গুণ বেশি। যার হাতে কলম, কমবেশি সবাই দার্শনিক। যেহেতু এখন আমার হাতে কলম, নীরস এই গদ্য রচনা থেকে সরে গিয়ে একটু দার্শনিক আলোচনা সেরে নিতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, সত্য জিনিসটা কী? সত্য সেটাই যা আমার কাঙ্খিত, অভীষ্ট ফল লাভের সহায়ক। এই জন্য কবি বলে গেছেন–সেই সত্য যা তুমি রচিবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে, যেন জনগণ মিথ্যা বলে তাকে দুয়ো না দিতে পারে। পৃথিবীর যত মহান সাহিত্যকৃতি তার কোনটা সত্যি? সবেতেই ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যার সমাহার। তবে ওই–এমনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে যে সত্যের চেয়ে বড় সত্য হয়ে গেছে। কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে বলুক দেখি রাম কৃষ্ণ কাল্পনিক চরিত্র। “রামকৃষ্ণ” কোন অবতার ফবতার নয়, আমাদের মতোই মানুষ।
সত্য, একমাত্র সত্য এটাই যে, সত্য কোন অটল বিষয়বস্তু নয়। স্থান ভেদে কাল ভেদে পাত্র ভেদে প্রয়োজন বোধে তার আকার আকৃতি বদলে যায়, সংকোচন সম্প্রসারণ ঘটে। প্রয়োজন বোধে সিরাজউদুল্লা হয়ে যায় মহান দেশপ্রেমিক, প্রয়োজন বোধে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসকে বানানো হয় বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী।
এখন আমি বিশেষ প্রয়োজনে সময় উপযোগী একটি সত্যের বিনির্মাণ করি। বাবু গো মোরা যাদবপুরে কলোনিতে থাহি। ছোটবেলায় মোর মায় মইরা গ্যাছে। হেই লইগ্যা মোর বাপে ফির এট্যা বিয়া করছে। হেই মায় মোরে দুই চক্ষে দেখতে পারে না। দুই বেলা ধইরা ধইরা মারে। প্যাট ভইরা খাইতেও দেয় না। হেই কারণে বাড়ি থেইকা চইল্যা আইছি। যেদিক দুই চক্ষু যায় চইল্যা যামু। কোন চা দোকানে হোটেলে কম করমু। বাড়ি আর যামু না।
এক মাতৃহারা দুঃখী বালকের করুণ জীবন কাহিনি শুনে দ্রবীভূত হয়ে পড়ে পুলিশ লোকটার মন। যদিও আমাদের দেশীয় আইনেঅকারণে পথে পথে ঘোরা, ফুটপাতে ঘুমানো একটা অপরাধ, তবুও কর্তব্য কর্মে ত্রুটি ঘটালেন তিনি। আমাকে ধরে জেলগারদে ঠুসে দিতে চাইলেন না। চাইলেন নিয়ে গিয়ে গরম ভাতের সামনে বসিয়ে দিতে।
বললেন, আমাদের মেসে কাজ করবি? তাহলে আমার সাথে চল। খাবি দাবি থাকবি। মাস গেলে কিছু মাইনেও পাবি।
বহুবার মানুষের মুখে শুনেছি, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। এতদিন কথাটার মানে বুঝতে পারিনি। এবার বুঝলাম। আমি এক ফৌজদারি কেসের ফেরারি আসামি। যে কেস কখনো আপনা আপনি মরে যায় না। উকিল ধরে কোর্টে মামলা লড়ে মেরে ফেলতে হয়। নিয়মমত পার্ক সার্কাস থানায় আমার নামে একটা কেস থাকার কথা। কে জানে এখনও হয়ত পুলিশ সেই কেসের আসামিকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর অমি–সেই অপরাধী এখন লুকিয়ে পড়লাম তাদের সবচেয়ে সুরক্ষিত–সব সন্দেহের ঊর্ধ্বের এক ঘাঁটির মধ্যে। শিবপুর পুলিশ লাইনের এক মেসের কর্মী হয়ে।
আমি দেখিনি তবে শুনেছি মানুষের মধ্যে নাকি দেবত্ব থাকে। আমার ধারণা মানুষের দেবতা হবার খুব একটা দরকার নেই, মানুষ হয়ে থাকলেই যথেষ্ট। যদি সেখান থেকে অধোগমন না ঘটে, অমানুষ না হয়। তখন মানুষ পশু থেকেও ইতর প্রাণী হয়ে যায়। পশুরা পায়ুকামী অগম্যাগমন ধর্ষণকারী প্রকৃতি বিরুদ্ধ কোন কাজ করে না। মানুষের সেই অবনমন নীচতা আমি যেন আমার ছোট্ট জীবনে অনেক বেশি দেখে ফেলেছিলাম। যা আমার সারা জীবনকে প্রভাবিত করেছে। মন মস্তিষ্কে ভরে দিয়েছে অবিশ্বাস অশ্রদ্ধার বিষ। কে যেন বলে গেছেন–মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। আমি জীবনভর সেই মানুষকে খুঁজে বেড়িয়েছি যে আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে সচেষ্ট।
এই পুলিশ লাইনের মেইন গেট থেকে কিছুটা ভিতরে ঢুকলে ডানদিকে একটা বড় মাঠ। এই মাঠে প্যারেড হয়। পনেরই আগস্ট মাঠের এক ধারে ওড়ে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা। ঠিক মাঠের ওপাশে পুলিশ ব্যারাক। এই ব্যারাকে থাকে এক বছর পঁয়ত্রিশের সেপাই। এমনিতে মানুষের সমাজে যে সব দোষ থাকে যে সব কারণে পুলিশ তাদের ধরে মারে পুলিশরাও তা থেকে মুক্ত নয়। তফাৎ শুধু এই যে, তারা প্রশাসনের পরোক্ষ প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। সাধারণ চোর ডাকাত গুণ্ডা বদমাশ তা পায় না। তবে এই পুলিশকর্মীটির একটা বিশেষ দোষ বা অভ্যাস আছে, সেটা হল গঞ্জিকা সেবন।
একরাতে সে বাইরের এক গাঁজার ঠেকে বসে এক পুরিয়া গাঁজা আদারকুচি ধুতরার বিচি আরও কী সব মশলা দিয়ে বানিয়ে বেশ মৌতাত করে খেয়ে মাঠের মাঝখান থেকে হেঁটে ব্যারাকে ফিরে যাবার সময় তার চোখে পড়ে যায় মাঠের আধো আলো আধো অন্ধকারে শোয়া, সদ্য যুবতী হয়ে ওঠা এক কুকুর কন্যাকে। তখন আর সে ধৈর্য রাখতে পারে না। কামেমোহিত হয়ে তাকে বলাৎকার করবার চেষ্টা করে। আর তখন সেই কুকুর কন্যা নিজের মান সম্মান রক্ষার্থে কামড়ে দ্যায় পুলিশ পুঙ্গবের পুরুষাঙ্গে। জখম কিছু বেশি ছিল, ভয় ছিল জলাতঙ্ক হবার তাই তাকে ছুটতে হয় হাসপাতালে। হাসপাতাল পুলিশ ব্যারাকের কাছে। ফলে ঘটনাটা আর চাপা রইল না। পরদিন সে নিয়ে সবাই প্রচুর হাসাহাসি করে। পুলিশ লাইনের অফিসারগণ নিজের বাহিনীর এমন অপকর্মে যারপরনাই বিব্রত হয়ে তাকে একমাসের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
এই পুলিশ লাইনে মেস অনেক কটা। নেপালিদের আলাদা বিহারিদের আলাদা, আবার বাঙালীদের দুটো। আমি যেটায় কাজ করি সেখানে যে রান্না করে তার নাম অমূল্য ঠাকুর। গলায় তার একখানা পৈতা ঝোলানো আছে বটে তবে সেটায় চাবি ঝোলানো ছাড়া অন্য কোন কাজে ব্যবহৃত হয় না। নরেশ ঠাকুরের গলায়ও এমন একখানা ময়লা তেল চিটচিটে পৈতা থাকে, সেও রান্নার কাজ করে। যার কথা পরে লিখব। আমার কাছে এটা একটা ধন্দ যে রান্নার কাজ করলে তার গলায় পৈতা কেন থাকতে হবে।
অমূল্য ঠাকুর এই মেসে নাকি কুড়ি বাইশ বছর ধরে রান্নার কাজ করছে। তাই তার পাওয়ার যেন সুপারিডেন্ট পাওয়ার। মেসে তার কথাই শেষ কথা। আমি এখানে আসবার দিনই সে আমাকে বলে দেয়–এতগুলো লোকের খাওয়ানোর ভার আমার উপর। আমি যা বলব যদি মেনে চলিস কাজ থাকবে। যদি না চলিস, কারও বাপের ক্ষমতা নেই তোকে এখানে রাখে।
প্রায় একশো মেম্বার এখানে দু-বেলা খায়। সকালে ভাত ডাল একটা তরকারি আর মাছের ঝোল। রবিবারে মাছের পরিবর্তে মাংস। রাতে রুটি ডাল তরকারি। এই সব মেম্বারের এঠো থালা বাটি গেলাস ধোয়া রান্নার বাসনপত্র মাজা, তরিতরকারি কাটা, টিউবয়েল থেকে পাম্প করে বালতি ভরে জল বয়ে আনা, আটা মাখা, রুটি সেকা, এই সব আমার কাজ। এর জন্য মাসের মাইনে চল্লিশ টাকা। অমুল্য ঠাকুরের বিচারে এ সব কাজ, কোন গুণ নয়। আমার বিশেষ গুণ থাকাটা দরকার।
কী সেই বিশেষ গুণ, যা আমার চাকরির স্থায়িত্ব দিতে সক্ষম তা জানতে পারলাম এক শুক্রবারে। এদিন পুলিশ লাইনে পুলিশদের রাম নামক একটা মদ পান করতে দেওয়া হয়।
পুলিশের চাকরি বড় কঠিন চাকরি। যার সাথে কোন চেনা জানা শত্রুতা নেই, শুধু মাত্র চাকরি রক্ষার প্রয়োজনে উপর ওলার আদেশে তার বুকে গুলি চালিয়ে দেওয়া–এতে সবার না হোক কিছু পুলিশের একটা মানসিক যন্ত্রণা তো হয়ই। পীড়িত হতে পারে পাপবোধের দ্বারা। তাই এই মদের ব্যবস্থা। মনোবেদনা চাপা দিতে মদের মত বন্ধু আর কে আছে! মদ খাইয়ে তাই শাসক পক্ষ পুলিশ মিলিটারিদের মাতাল করে রাখে হুকুম পালনের একটা বিচার বুদ্ধি বিবেক শূন্য মেশিন বানিয়ে দ্যায়। যাদের আত্মা পরমাত্মা ন্যায় অন্যায় পাপ পুণ্যবোধ কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। যার এ সব থাকে দীর্ঘকাল এ চাকরি করতে পারে না।
মদের একটা কোটা অমূল্য ঠাকুরেরও আছে। শুক্রবার খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে বড় পবিত্র দিন। যে কোন পবিত্র দিনই আনন্দের উদ্দাম খুশির জোয়ারে ভেসে যাবার দিন। সেই কারণেই সম্ভবতঃ ইংরেজ শাসকরা মদ্য পরিবেশনের জন্য এই দিনটা বেছে নিয়েছিল। ভারতীয় শাসকরা সেই দিনটা আর বদলায়নি। তো সেই পবিত্র শুক্রবারে অমূল্য মদ্যপান করেছিল একগলা। তখন মেসের মেম্বাররা রাতের খাবার খেয়ে চলে গিয়েছিল। সেদিনের মত শেষ হয়ে গিয়েছিল আমার কাজ। খেয়েদেয়ে আমিও শোবার আয়োজন করছিলাম। এমন সময় অমূল্য ঠাকুর এগিয়ে এল আমার কাছে। খুব কাছে। তারপর সে তার ময়লা তেল চিটচিটে লুঙ্গিটা সরিয়ে বের করল তার কালো মোটা দুর্গন্ধযুক্ত–বমন উদ্রেককারী পুরুষ অঙ্গখানা। তৈল জাতীয় কিছু একটা মাখানো। কোন রকম সংকোচ না করে সেটা চাপিয়ে দিল আমার হাতের তালুর উপর।–“নে, একটু খেঁচে দে তো।”
গা ঘিন ঘিন করে আমার। মনটা বিদ্রোহ করে। তবু নাক টিপে চোখ বুজে আদেশ পালন করি আমি। আর সময় গুণতে থাকি কখন এই বিচ্ছিরি ব্যাপারটা থেকে পরিত্রাণ পাই। কিন্তু সে এক অসহায় বালককে অত অল্পে রেহাই দিতে ইচ্ছুক নয়। সে চাইল শেষ এবং চরমতার চূড়ান্তে পৌঁছে যেতে। ব্যাস, ব্যাস হয়েছে, নে এবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়।”
পরবর্তীকালে যখন আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল তখন জেনেছি এটা কারও কারও কাছে বড় প্রিয় বিষয়। তারা পায়ু মৈথুন করে বড় আনন্দ পায়। তবে আমার জন্মজনিত সংস্কার ও শিক্ষার এটা এক বিপরীত মেরুর বিষয়। যা ভীষণ ঘৃণ্য এবং নিন্দনীয়। অন্তরাত্মা রিরি করে ওঠে আমার। কণ্ঠনালি থেকে বের হয় একটা থুৎকার–না।
আমার অসম্মতিতে সে একটু ক্রুদ্ধ হয়, এবং ক্রোধ ভরে একটা লাল দু’টাকার নোট এনে আমার দিকে ছুঁড়ে মারে–নে এবার আর বেশি সতীগিরি দেখাস না, প্যান্ট খোল। কিন্তু তবু নিজেকে কুকুর বানাতে মনের সায় পেলাম না। না, কুকুর নয়, তার চেয়ে খারাপ। এই অবস্থায় কুকুরও তো কামড় দিয়েছিল।
এরপর যা হবার তাই হল। পরের দিন থেকে সে আমার সবকাজে খুঁত ধরতে লাগল। আমি তরকারি ধুলে তাতে বালি থাকে, মশলা বাটলে মিহি হয় না, রুটি সেকলে হয় পুড়ে যায় নয় কাঁচা থাকে। সে নিয়ে তর্ক করলে গালে চড় এসে পড়ে। এত অসন্তুষ্টির কারণ আমার জানা। তবে তা দূর করা আমার সাধ্যের বাইরে। তাই একদিন নিশ্চিন্ত আহার আশ্রয় ছেড়ে পথের মানুষ পথের উপর এসে দাঁড়ালাম আবার। সেই পথঘাট সেই গাড়িঘোড়া লোকজন সেই হাওড়া ব্রিজ সেই গঙ্গা সব একই আছে, শুধু আর একটু বড় হয়ে উঠেছি আমি, আর একটু অভিজ্ঞ।
.
এবার আবার ফিরে এসে আশ্রয় নিলাম সেখানে, যেখানে সব আশ্রয়হীন মানুষ আশ্রয় নেয়। চোর পকেটমার বেশ্যা পাগল ভবঘুরে ভিখারি মাতাল মুটে মজুর আরও বহু বিচিত্র সব মানুষের মিলন মেলা এখানে। এর নাম রেল স্টেশন। ভারি বোঝা বইবার মত শক্তি নেই, সারা দিনে হালকা পলকা এক আধটা মোটফোট বয়ে দুচার পয়সা পেয়ে গেলে তা দিয়ে মুড়ি আলুর দম, রুটি ঘুগনি খেয়ে পড়ে থাকি প্লাটফর্মে। এভাবেই কেটে যায় দিন মাস।
একদিন স্টেশনেই পরিচয় হল ঠিক আমারই মত একটা ভবঘুরে বাউন্ডুলে ছেলের সাথে। আমার চেয়ে বছর চার পাঁচ বড়, রোগা লম্বা কালো এই ছেলেটা মনের কষ্ট পেটের খিদে সবকিছু চেপে রেখে অসম্ভব হাসতে জানে। একে দেখেই ভালো লেগে গেল আমার। বিশ্বাস জন্মে গেল। কথায় কথায় জানাল ও আসাম যাবে। সেখানে নাকি কাজের কোন অভাব নেই। আর তার মজুরি নাকি এখানকার চেয়ে তিনচারগুণ বেশি।
আমার টাকা চাই, অনেক টাকা। বাবার চিকিৎসা করাতে হবে। মাকে বস্ত্র পরিয়ে দিনের আলোয় ঘরের বাইরে আনতে হবে। ভাইবোনকে মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে বাঁচাতে হবে। এর জন্য টাকা চাই। আমার তখন আর সুস্থ মাথায় ভাবনা চিন্তার অবকাশ কোথায়! তৃষ্ণার্ত মানুষ যেমন জল ভেবে মরীচিৎকার দিকে পাগলের মত ছুটে যায় আমিও ছুটে গেলাম সেই সদ্য চেনা ছেলেটার পিছনে–আমিও তোমার লগে আসামে যামু।
আমার কাছে বিষ খাবার মত পয়সাও নেই। পরিধানে নেই কোন ভব্যপোষাক, পেটে নেই জল ছাড়া অন্য পদার্থ। সেই দূরদেশে আপন বলতেও কেউ নেই যে বিপন্ন সময়ে পাশে এসে দাঁড়াবে। তবু এক অসম্ভব সাহস–যার আর এক নাম হতে পারে মহামুখতা, সেই পথ সম্বল নিয়ে বের হয়ে পড়েছিলাম সদ্যচেনা একটা ছেলের সাথে। যে আমাকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিতে পারত সেই অপরাধ চক্রের কাছে যারা বাচ্চাদের চোখ অন্ধ হাত পা ভেঙে দিয়ে ভিখারি বানায়। আরবে পাঠায় উটের দৌড়ে উটের পেটে বেঁধে ঝোলাবার জন্য। কিডনি কেটে বের করে নেয়। পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে হিজড়া বানায়। এই রকম কত কী সেদিন ঘটে যেতে পারত যা ভাবলে আজ বুক কেঁপে যায়।
সেই বিচিত্র বিচ্ছিরি ভ্রমণ কাহিনী লিখেছিলাম আমার ‘চণ্ডাল জীবন’ উপন্যাসে।
যা লিখেছিলাম, যেমন লিখেছিলাম সেটাই তুলে দিলাম এই আত্মজীবনীর মধ্যে।
০২. শিয়ালদহ রেল স্টেশন
শিয়ালদহ রেল স্টেশন। নামের অভিধানিক অর্থ খুঁজতে গেলে মনে হয় কোন এক কালে এখানে কোন জলাশয় ছিল যাতে শেয়াল পড়ে গিয়ে থাকবে। নানা পথ ঘুরে ঘুরে এখানে এসে পৌঁছেছে বিপন্ন সময়ের গর্তে পা পিছলে পড়া এক কিশোর। যার নাম জীবন। অজানিত এক ভয় তাড়া করে নিয়ে ফিরছে তাকে। মনে হচ্ছে যেন একপাল হিংস্র হায়না ধাওয়া করে আসছে। নাগালে পেলে ধারালো দাঁতে ফালা ফালা করে ফেলবে। কত বা বয়স এখন জীবনের! সেই নাবালক বয়সের তুলনায় অন্যায়েরকার বিশাল ও শিয়ালদহ রেল স্টেশন। শুধু এই রেল স্টেশনই নয়, সব রেল স্টেশনেরই একটা বিমূর্ত কিন্তু সংবেদী সত্তা আছে। যাকে দেখতে বা বুঝতে হলে মনটাকে খানিকটা দার্শনিক ভাবালুতার শিকড়ে নিয়ে বসাতে হয়। গোপন প্রবাহিত সেই ফতার আদিম অনাবিল শেকড়ে আছে জাতিধর্ম বর্ণের উর্ধ্বে এক চিরায়ত মানবাত্মার সুগভীর মেল বন্ধন। হাজার হাজার মানুষ, নানা বয়সের নানা পোষাকের নানা ভাষার। কেউ কারও পরিচিত নয়, কিন্তু কোন দক্ষ মালাকার যেন এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছে সব ফুলের এক অদৃশ্য মালা।
সকালবেলায় যখন দিনের প্রথম ট্রেনখানা এসে প্লাটফর্মে থামে সেই যন্ত্রযানের গর্ভ থেকে একইভাবে পিলপিল করে প্রসব হয় মানুষ। তারপর একই রকম, ধেয়ে চলা মিছিলের মতো সামনে ছোটে। প্রতিটি পায়ের চলায় ফুটে ওঠে একই রকম ছন্দ তাল ধ্বনি। ফুটে ওঠে দায়িত্ব কর্তব্যের সাথে নিখুঁত শ্রম জীবনের বার্তা। আবার দুপুরে বিকালে রাতে ফিরতি এই পাগুলোয় জড়িয়ে থাকে শ্রান্তি ক্লান্তি অবসাদ। মনে জড়িয়ে থাকে ঘরে ফেরার তাড়ার সাথে কিছু উৎকণ্ঠা। যদি ট্রেন না আসে! যদি ট্রেন না ছাড়ে! যদি মাঝপথে গিয়ে থেমে যায়! ট্রেনের আজকাল হাজার বিপদ। বর্ষায় লাইনে জল জমে যেতে পারে। ওভার হেড তার ছিঁড়ে যেতে পারে। কেটে নিয়ে যেতে পারে কোন চোর। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকতে পারে। হঠাৎ কোন নাগরিক বা রাজনৈতিক অবরোধে বন্ধ। তখন আর ট্রেন চলবে না। ট্রেন না চললে সব মানুষের মুখ একই দুশ্চিন্তায় কালো হবে। বুকে জমবে একই রকম মেঘ বাদল যা বৃষ্টি হয়ে ঝরাও বিচিত্র নয়। সবার ঘরের মানুষ একই রকম আশংকায় পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে একই কামনা নিয়ে। ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরে আসুক ঘরের মানুষ। কারো সাথে কারো দেখা সাক্ষাৎ চেনা জানা পরিচয় পরিচিতি নেই, তবু একই রকম দীর্ঘশ্বাস পড়বে সবার একই দুর্ভাবনায়। জীবন দার্শনিক নয়। দর্শনের গভীর তথ্যে বিচরণের পক্ষে ষোল সতের বছর বয়েসটা বড় কম। সে এই স্টেশনে বলতে গেলে আত্মগোপন করে আছে স্কুল এক জৈবিক তাড়নায়। স্টেশনে সে একা নয়, তার মত ভবঘুরে ভিখারি পাগল গৃহহারা বহু মানুষের বসবাস। এর মধ্যে আর একটা নতুন বাড়তি বালক বিশেষ কারো শিরঃ পীড়ার কারণ ঘটায় না।
সেদিন দুপুরবেলা স্টেশনময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল জীবন। এ সময়ে স্টেশনে খুব একটা ভিড় থাকে না। লাল জামা পড়া রেলের কুলিরা এখানে সেখানে শুয়ে পড়েছে গামছা বিছিয়ে। কেউ কেউ বসে গেছে তাস নিয়ে। শহর কলকাতার অরাজকতা এখানে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারে নি। স্টেশনের প্লাটফর্মের বাইরে ইটের উনুনে কাঠপাতার জ্বালে কালো কালো হাড়িতে ভাত রান্না করছেন কয়েকজন মহিলা। তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে বোগা, উদোম কিছু বালক বালিকা। মানুষের হাড়ি কুড়ি সংসারের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে কতগুলো ছাল ওঠা নেড়ি কুকুর। তারা বর্তমান সময়ের মানুষের মতই মারামারি কামড়া কামড়ি করছে।
বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরার পর ক্লান্ত হয়ে খানিকটা কলের জল খেয়ে একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে পড়ে জীবন। এমন সময়ে পাশে এসে বসল ওর চেয়ে দু-তিন বছরের বড় একটা ছেলে। একটু লম্বাটে ধরনের চেহারা। গায়ের রঙটা কালো। মাথায় উস্কোখুস্কো লম্বা চুল। পরিধানে একটা বেমানান ফুল প্যান্ট। গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর মুখে জ্বলন্ত বিড়ি। ছেলেটা এখানে নতুন আমদানি। জীবন আগে কখনো দেখেনি তাকে। পাশে বসে সে জীবনকে অতি পরিচিতের মত বলে, এই তোর নাম কি রে?
–মোর নামে তোমার কি কাম?
–নাম না জানলে তোকে কি বলে ডাকবো।
–আমায় ডাকবা ক্যান?
–এক সাথ এক জায়গায় থাকলে ডাকা লাগবে না। মানুষ মানুষের কত সময় কত দরকারে লাগে। আমি কটা দিন তোদের এখানে থাকব ভাবছি তো। সেই জন্য নামটা জানতে চাইলাম।
ছেলেটার গলার স্বরে সারল্য এবং সত্যের সংমিশ্রণ। মনে হয় জীবনের একে নিজের নাম পরিচয় দেওয়ায় কোন সমস্যা হবে না। বলে, মোর নাম জীবন।
বলে সে, আমার কী নাম জানিস? শুনলে চমকে যাবি। রাজা, আমার নাম রাজা। তোর চেয়ে বয়সে চার পাঁচ বছরের বড়ো হব আমি। তবে তোকে দাদা ফাদা বলে ডাকতে হবে না। নাম ধরেই ডাকিস।
তাকে রাজা বলে মেনে নিতে কোন আপত্তিকরে না জীবন। কষাইয়ের নাম যদি দয়াময় হতে পারে তাহলে এক পথ বালকের নাম রাজা মহারাজা সম্রাট কেন হতে পারে না।
জীবন চা দোকানে রেল স্টেশন ফুটপাতে অনেক দিন কাটাচ্ছে। লোকমুখে গল্পকথায় জেনেছে কোন কোন সময় রাজারাও রাজত্ব হারিয়ে ভিখারি হয়ে যায়। যেমন হরিশচন্দ্র যেমন নবাব সিরাজ। আবার কোন কোন সময় নিজেরাই ভিখারি ফকির সন্ন্যাসী সেজে বের হয়ে পড়ে ভ্রমণে। এই রাজাটি কোন কারণে এখানে এসেছে সেটা এখনো জানা যায়নি। এক গাল হেসে সেই খবরটাই পরিবেশন করে সে–আমি আসামে যাবো। বলতে পারিস, আমার হচ্ছে আসামে যাওয়া আসার কারবার। বছরে একবার যাই একবার আসি। আমার এক বন্ধু এবার আমার সাথে যাবে বলেছে। সে যতক্ষণ বাড়ি থেকে পালিয়ে না আসতে পারছে আমাকে এইখানে অপেক্ষা করতে হবে। তারই জন্য বসে আছি। না হলে কি আর আমাকে এখানে দেখতে পেতিস। কবে ফুরুত হয়ে উড়ে যেতাম। অনেক দূরের পথ তো। কেউ একজন সাথে থাকলে গল্প গাছা করতে করতে যাওয়া যায়। একা একা বোকা হয়ে ঠিক ভালো লাগে না।
আসাম নাম জীবনের অজানা নয়। যাদবপুর স্টেশনে একজন লোক মাদুলি বেচতে আসে। মাটিতে শুইয়ে সে একটা ছেলেকে মন্ত্রের সাহায্যে মাটি থেকে শুন্যে তুলে দেয়। একটাকা হাতের তালুতে নিয়ে দশটাকা বানাতে পারে। তার এসব মন্ত্র নাকি আসাম গিয়ে শেখা। আসাম হচ্ছে পাহাড় জঙ্গল ঘেরা অতি দুর্গম একটা স্থান। যেখানে আছে দেবী কামাক্ষ্যার মন্দির। সেখানে নাকি কোন পুরুষ লোক সহসা যেতে পারে না। যদি যায় সেখানকার জাদুকরী মেয়েরা তাকে ধরে জাদুমন্ত্র বলে ভেড়া বানিয়ে ফেলে।
কিন্তু রাজা নামের এই ছেলেটা এ নাকি অনেক বার আসাম গেছে। তবু এ ভেড়া না হয়ে ফিরে এল কেমন করে? বলছে আবার নাকি যাবে। ধাপ্পা দিচ্ছেনা তো?কিছু বিশ্বাস কিছু অবিশ্বাস নিয়ে জানতে চায় জীবন, তুমি কামরূপ কামাক্ষ্যার মন্দিরে গেছো?
অনেক বার।
সত্যি কইতে আছো?
তোর কাছে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ?
মাইনষে যে কয় ওইখানে কেউ যাইতে পারে না। গেলে মাইয়ারা ধইয়া ভেড়া বানাইয়া দেয়।
গুল দেয়। বলে রাজা—সব মিথ্যা কথা। এই তো আমি তোর সামনে বসে আছি। বললাম না অনেকবার আসাম গেছি, তা আমি কি ভেড়া হয়েছি? দেখাচ্ছে আমাকে ভেড়ার মতো?
মোনে কয় ওরা তোমারে দেখতে পায় নাই।
বলিস কি। আমার এত বড় শরীরটা দেখতে পায়নি। দেখা কি রে, কত জনার সাথে কথাও বলছি। এক জনের হাত ধরেছি।
সেই হাত ধরার পুরাতন স্মৃতি মনের দরজায় ধাক্কা মারায় কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে যায় রাজা। তারপরে বলে ওই দেশের মেয়েগুলোকে কে জানে ভগবান কি দিয়ে তৈরি করেছে, যদি একবার ছুঁয়ে দেয়, সারা শরীর অবশ হয়ে যাবে। জাদু যদি বলিস, তবে তা ওদের আছে। যদি কোন বাঙালীর ভাগ্যে ও রকম একটা মেয়ে জুটে যায়, ভেড়া কি রে! একেবারে পায়ের জুতো হয়ে যাবে।
মেয়ে বিষয়ক গল্প বেশিদূর এগোয় না। একা রাজা কতক্ষণ বা বলবে! জীবন এখনো এতটা সাবলীল হয়ে ওঠেনি। মেয়ে দেখতে তার ভালোই লাগে, তবে তা আড়চোখে। সরাসরি কারও চোখে চোখ পড়লে কেন কে জানে পা থেকে মাথা অবধি কেঁপে ওঠে। একে শিহরণ বলে।
কিছুক্ষণ পরে জীবনের কাছে জানতে চায়–বিড়ি খাবি?
মুই বিড়ি খাইনা। বলে জীবন।
অবাক হয় রাজা। এ কী করে সম্ভব! স্টেশনবাসি এই বয়সের সব ছেলেরাই মদ, গাঁজা কত কী নেশা করে। আর এই ছেলেটা নিরীহ বিড়িতেই বিমুখ? এত নিরামিষভাবে স্টেশনে টিকে আছে কেমন করে!
তাহলে তুই কি খাস? কীসের নেশা তোর!
আমি ভাত খাই। আমার একটাই নেশা। ভাত। ভাত ছাড়া আর কোনো নেশা নাই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে রাজা–আগে আমারও ওই নেশা ছিল। একমুঠো ভাত সারা দিনে একবার না হলে চলতো না। এখন আর সে নেশা নেই। পেলে খাই না পেলেও কোন দুঃখ করি না। দুঃখ করেই বা কি করবো। না খেয়ে আছি বলে কেউ তো আর ভাতের থালা সামনে এগিয়ে দেবে না।
জীবনকে প্রশ্ন করে রাজা–আচ্ছা কতদিন তুই কিছু না খেয়ে থাকতে পারিস?
একদিনও পারি না। বলে জীবন–না খাইয়া থাকলে হাত পা কাপে, চক্ষু ঘোলা হইয়া যায়। কথা কান দিয়া বাইরায়।
বলে রাজা, না খেয়ে থাকা কোন ব্যাপারই না, শিখলে সব পারা যায়। বেঞ্চির পিছন দিকে শরীর হেলিয়ে দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে ফের বলে সে–বলতো উট কতদিন জল না খেয়ে থাকতে পারে? এক মাস। মরুভূমি কত গরম জানিস? সেখানে এক মাস জল না খেয়ে থাকা কি সোজা কথা! কেউ পারবে?
মাথা নাড়ে জীবন–পারবে না।
আচ্ছা বলতো সাপ কতদিন না খেয়ে থাকতে পারে?
জানি না।
পাক্কা তিনমাস। শীত পড়া শুরু করলে একবার খেয়ে সেই যে গর্তে ঢোকে পুরো শীতকাল আর বের হয় না, কিছু খায়ও না। তাহলে বল ওরা যদি এসব পারে মানুষ কেন পারবে না।
ফের বলে রাজা—আমার এক মামা আছে তারে আমি কোনদিন ভাত রুটি কিছু খেতে দেখিনি। রোজ সকালে একমগ লাল চা দুটো নেড়ো বিস্কুট, বিকালেও তাই। কিন্তু কোনদিন কোন বিয়ে বাড়ি, যদি খাবার টাবার বেঁচে যায় আর মামাকে ডেকে নিয়ে যায় তখন দেখা যায় খাওয়া কাকে বলে। সেই মামার কাছে থেকে আমি না খেয়ে থাকার কায়দা জেনে নিয়েছি।
কী কায়দা?
একদম খিদের কথা মনে না করা। চেষ্টা করে দেখ, তুইও পারবি। সব সময় মনে করবি–এইমাত্র খেয়ে উঠেছি, পেট ভরা আছে। দেখবি মোটেই খিদে লাগবে না।
মানুষকে পাণ্ডিত্যপূর্ণ কথা বলার জন্য পণ্ডিত হতে হবে এ নিয়ম সর্বদা খাটে না। কখনো কোন মূর্খ নির্বোধ নিরক্ষর মানুষের মুখ থেকে বের হয়ে যেতে পারে এমন কোন শব্দ যা সর্বকালের পণ্ডিতদেরও জ্ঞানের অতীত। সেই কবে কত সহস্র বছর আগে একজন মানুষ যে সূর্য পৃথিবীর চেয়ে বড় না ছোট, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, না পৃথিবী, তা জানত না। জানত না গাছ থেকে আপেল মাটিতে কেন পড়ে, আকাশে কেন উড়ে যায় না। সেই আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলো ওখানে ঈশ্বর থাকেন। তারই কথা হাজার হাজার পণ্ডিত হাজার হাজার বছর বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
রাজা নামের ছেলেটা জানে না সে আজ নিজের অজান্তে অষ্টম মার্গের শেষ এবং পরম মার্গের শেষ কথা বলে ফেলেছে। বহু সাধক মুনিতপস্বী যার নাম দিয়েছে নিবৃত্তিমার্গ। এই মার্গের পথিকের বিষয় সম্পদ ভোগ বিলাস কোন কিছুতে আসক্তি থাকে না। তারা বলে গেছেন–আসক্তি অর্থাৎ কামনা বাসনাই হচ্ছে সর্বপ্রকার দুঃখের মূল কারণ। মন থেকে যদি আসক্তিকে উৎপাটন করে ফেলে তাকে জড় নির্জীব নির্বিকার করে দেওয়া যায় সেটাই হবে মোক্ষ। এই মোক্ষ প্রাপ্তি ঘটে গেলে তখন আর জীবের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আনন্দ বেদনা প্রেম বিরহ কোন কিছুই অবশেষ থাকে না। সব কিছুর অবসান ঘটে যায় এবং বন্ধন দশা থেকে চিরমুক্তি পায় জীব। তখন আর তার সৎ আর শঠে পুরুষ আর নারীতে পায়েস আর পান্তায় কোন প্রভেদ থাকে না। তখন সেই মুক্ত পুরুষ নেংটি পরে খালি পেটে গাছতলায় শুয়ে মিলিয়ন ডলারের মালিকের চেয়ে নিজেকে বড় ভাবতে পারে।
হাজার বছর ধরে হাজার মহাপুরুষ মানব সমাজকে সেই মোক্ষের পথে নিয়ে যাবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। কোরাণ পুরাণ বেদ বাইবেল, মঠ মন্দির মসজিদ গির্জার সমবেত প্রচেষ্টায় আংশিক সফলতা এসে গেছে।কিছুমানুষকেবোঝানো গেছে। বাকি মানুষটাকে বোঝাতে পারলেই ধরণীর ধূলিতে আকাশের স্বর্গ নেমে আসবে। দ্বেষ কলুষতা হিংসা ঈর্ষামুক্ত হয়ে মানুষ মহাসুখে বসবাস করবে।
অনেকক্ষণ পরে বলে জীবন, একটা কথা কমু? তোমাগো লগে তোমরা আমারে আসাম নিয়ে যাবা?
তুই যাবি আমার সাথে!
নিয়া গেলে যাইতাম।
নিয়া যাবো কিরে, তুই কি বাচ্চা নাকি যে কোলে করে নেবো। তুই যাবি তোর পায়ে হেঁটে। তুই যদি যাস আমি আর বন্ধুর জন্য দেরি করব না। তাহলে আজই রওনা দিই কি বল?
একটু বিমর্ষ হয়ে বলে জীবন–আমার কাছেও তো টাকা পয়সা নেই।
যাবো তো ট্রেনে, বিনা টিকিটে। টাকা কি হবে?
ভাড়া না লাগুক কিন্তু পথে খাওয়া দাওয়া–
খাওয়া দাওয়ার নামে খেপে ওঠে রাজা। এই হচ্ছে তোদের দোষ। এই জন্য তোদের কোন উন্নতি হবে না। এখানে দিব্যি দিনের পর দিন না খেয়ে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিচ্ছিস, তখন খিদের নাম মুখে আসে না। যেই এক জায়গায় যাবার কথা হল অমনি খাই খাই জুড়ে দিলি। আচ্ছা ঠিক আছে, কথা দিলাম পথে তোকে একবার গরম ভাত খাইয়ে তবেই আসাম নিয়ে যাবো। এবার আর আপত্তি নেই তো?
মানে। আমতা আমতা করে বলে জীবন—তোমার কাছে তো কইলা টাকা নাই, তয় কেমুন কইরা খাওয়াইবা। ভাত খাইতে তো টাকা লাগে।
আমার লাগে না।
কেমনে?
কেমনে? আরে মাথা মোটা পথে কি একবারও চেকারে ধরবেন না? যদি না ধরে নিজেরা গিয়ে ধরা দেবো। জেলে নিয়ে গেলে খাওয়ার কি ভাবনা। দু-দশদিন খেয়ে দেয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা করে নিয়ে ফের রওনা দেবো।
বাল্যের সেই জেল ভীতি উঁকি দেয় জীবনের মনে। ওর বাবাকে ধরে জেলের বদলে কুড়ি পঁচিশ মাইল দুরে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এবারেও যদি সে রকম কিছু হয়? যদি চেকাররা কুড়ি পঁচিশ স্টেশন সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়? তখন এই না খাওয়া দুর্বল দেহ নিয়ে কি করবে জীবন। মরে যাবে যে। জীবনের আশংকা এক ফুয়ে উড়িয়ে দেয় রাজা। পঁচিশ স্টেশন আগে নিয়ে যাবে? যাক না। যতদূরই নিয়ে নামাক আসামের ওপারে তো নিয়ে যেতে পারবে না। রেল লাইনই নেই। তাছাড়া আসাম বর্ডার পার হলেই তো অন্য দেশ।
না, আর কোনো দ্বিধা সংকোচ ভয় ভীতি নয়, যা হবার তা হবে। মনঃস্থির করে বলে জীবন, তাইলে চলো।
মাঝ পথে গিয়ে কাদাকাটি জুড়বি না তো? মা’র জন্য মন কেমন করছে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আয়। তাহলে আমি কিন্তু তোকে ফেলেই চলে যাবো। তখন কিন্তু বলতে পারবি না রাজাটা বেইমান। ভেবে দেখ। যাবি?
যাবো।
বেশ তবে চল।
.
তখন বিকেল হয়ে গেছে। শুরু হল দুই আধ পাগলের এক অবিশ্বাস্য যাত্রা। যাত্রা না বলে একে অভিযান বলাই বোধ হয় বেশি যুক্তিযুক্ত। কাছে কারও একটা পয়সা নেই সেই অবস্থায় রওনা দিয়েছে আসাম। সে দেশে কেউ চেনা নেই জানা নেই কোথায় থাকবে কি বিপদে পড়বে সবটাই অজানা। তবু শুধু মাত্র আশার ছলনে ভুলি পরবাসের পথে হাঁটা দিয়েছে দুই উন্মাদ বালক।
তখনো ফারাক্কায় ব্রিজ নির্মাণ হয়নি। হাওড়া থেকে ট্রেন এসে থামাতো এক বড় নদীর কিনারে ফারাক্কায়। তারপর লঞ্চ ধরে আসতে হত এই পারে। খেজুরিয়া ঘাটে। সেই স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে আসতে হবে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে পাওয়া যাবে গৌহাটি মেল। পথে কোন বিঘ্ন না ঘটলে এটা পঞ্চাশ ষাট ঘণ্টার যাত্রা পথ। যা সমাপ্ত করতে হবে একেবারে নিখরচায়। এটা এ্যাডভেঞ্চারের চেয়ে কোনও অংশে কম রোমাঞ্চক, কষ্টকর, সাহসিকতাপূর্ণ তো নয়ই, বলা চলে কিছু বেশিই।
শিয়ালদহ স্টেশনের গেটে কোন গেট কীপার ছিলো না। ওরা সহজেই গেট পার হয়ে বাইরে এসে হাঁটা দিলো হাওড়ার দিকে। তখন হাওড়া থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত ট্রামের ভাড়া মাত্র আট নয়া পয়সা। সেইটুকুও কারও কাছে নেই। ধীর কিন্তু দৃঢ় পায়ে ওরা হাঁটা দেয় ওদের সামনের দিকে যা দিকের বিচারে পশ্চিম। যেদিক থেকে সূর্য ওঠে না, ডুবে যায়। যখন ওরা হাওড়ায় পৌঁছায় তার আগে সূর্য ডুবে গেছে।
রাজা জানে কোন প্লাটফর্ম থেকে ফরাক্কার ট্রেন ছাড়বে। যার সময়ও খুব একটা বাকি নেই। কিন্তু সমস্যা বিনা টিকিটে কেমন করে ভিতরে ঢোকে! এখানে শিয়ালদহের মত গেট ফাঁকা নেই। সব গেটে দু’তিন জন গেট কীপার। তার উপর গেটের সামনে একটা চাকার মত অবরোধক। যা একজন একজন করে ঠেলে ঠেলে যেতে হয়।
অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর চোখে পড়ে রাজার একটা গেটে কোন গেট কীপার নেই। অবরোধক চক্রে তালা দিয়ে সে কোথায় যেন গেছে। সাথে সাথে তার সামনে শুয়ে পড়ে রাজা। তারপর যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন ভাবে সৈনিকেরা বুকে হেঁটে আগায় সেই ভাবে চাকার নিচে থেকে ঢুকে যায় প্লাটফর্মের ভিতরে। ডাকে, চলে আয় জীবন, শিগগির। ওই একইভাবে জীবনও ঢুকে পড়ে। তারপর ছোটে ট্রেনের দিকে। তখন গার্ড সাহেব তার হাতের নীল আলো দুলিয়ে ট্রেন ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছে। ওরা ছুটে গিয়ে উঠে পড়ে সেই ট্রেনের এক কামরায়।
এ কামরায় বিশেষ একটা ভিড় নেই। যাত্রীরা বেশ আরামে বসে যেতে পারছে। সিট দু’চারটে খালি ছিল ইচ্ছা করলে ওরাও বসতে পারত কিন্তু তা করল না। একে টিকিট নেই তার ওপর সিট দখল, সেটা টিকিট চেকার এবং বৈধযাত্রী দুজনের কাছে গর্হিত অপরাধ। ওরা গিয়ে বসলো উল্টো দিকের দরজায়, দুপাশে দুজন। সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে। এদিকে প্লাটফর্ম পড়বে না। বেশ হাওয়া খেতে খেতে বাইরেটা দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। সামান্য কিছু সময়ের মধ্যে আলোয় আলোয় উজ্জ্বল শহর পার হয়ে ট্রেনখানা প্রবেশ করল রাত্রির নিকষ অন্ধকার গর্ভের ভিতর। যত সে চলে ধীরে ধীরে দূরে সরে যায় হাওড়া ব্রিজের বাতিস্তম্ভ।
জীবন কলকাতা ছেড়ে এর আগে এতদুর যাত্রায় কখনো যায় নি। ট্রেন যত সামনে আগায় যত একটু একটু করে দুরে সরে যায় কলকাতা শহর, তত তার বুকটা কি এক বেদনায় যেন ভরে ওঠে। অনেকগুলো দিন কেটে গেছে এইশহরের পথে পথে। অনেক অপমান অন্যায় অত্যাচার দিয়েছে। এই শহর দিনের পর দিন অনাহারেও রেখেছে। তবু আজ কেন কে জানে ছেড়ে যেতে বড় মায়া হচ্ছে। এই শহরের এক কোণে ঝুড়ি কোদাল নিয়ে কাজের আশায় হা পিত্যেশ করে বসে থাকত তার অসময়ে বুড়ো হয়ে যাওয়া বাপ। বাপের ফেরবার পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত তার অনাহারী ভাই, বোন। ভাই বোনের কাতর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে অসহায় মা। এ শহর তাদের কোন কষ্ট বোঝেনি। তাই তারা কোনদিন পেট ভরে দুটো ভাত খেতে পায়নি। অসুখে বিসুখে পায় নি একটু ওষুধ। বর্ষা নামলে ভাঙা ঘরের খড়পচা জল ভিজিয়ে দিতে চার ছয় জন অভাগা মানুষের শীর্ণ শরীর। শীতকাল এলে তারা শীতের কামড়ে কুই কুই করে কঁপে আর কাঁদে। মায়াটা কি ওই অসহায় মানুষগুলোর জন্য না এই নির্দয় শহরের জন্য, সেটা এখন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না জীবন। কিন্তু তার চোখে জল ভরে আসে। মনে মনে বলে–মা মাগো, আমি তোমার এক অধম সন্তান। ক্ষমা করো। আমি আমার দায়িত্ব কর্তব্য কিছুই পালন করতে পারি নি। তাই তোমাকে ফেলে চোরের মত পালিয়ে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি তা জানি না। কী পাবো সেখানে গিয়ে তাও আমার অজানা। তবু যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি তা আর কেউ না জানুক না বুঝুক তুমি নিশ্চয় জানো বোঝো। যদি কোন অন্যায় করে থাকি ক্ষমা কোরো।
রাতের ট্রেনের চলার ছন্দে এক অদ্ভুত মাদকতার মিশ্রণ আছে। এক মনে অনেকক্ষণ ধরে কান পেতে ছুটে চলা বেগবান ট্রেনের চাকার সাথে লাইনের ঘর্ষণের যে শব্দ, ইঞ্জিনের ফোঁস ফোঁস গর্জন, সব মিলে যে মধুর বাদ্যধ্বনি তা শুনে যেন নেশায় চোখ বুজে আসে। তারপরে বহু সময়ের একই ধরনের যন্ত্রসঙ্গীতের পর, কোন এক স্টেশনে যখন ট্রেন থামে, হকারদের সম্মিলিত কলতান, কুলিদের হাঁকাহাকি ছোটাছুটি সব মিলিয়ে যেন কোন মৃত নগরীর হঠাৎ কোন যাদুকাঠির ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরে পেয়ে জেগে ওঠার উল্লাস উৎসব আর আনন্দ আমেজ ফুটে ওঠে।
জীবন এখন সান্ধ্য শোক বিস্মৃত হয়ে রাত্রি গভীরের অনির্বচনীয় মাদক আমেজে ডুবে যায়। রাত যত বেড়ে চলে তত তার নেশা গাঢ়তর হয়। তখন চা অলার দ্বিমাত্রিক বাঁশচেড়া গলার গর্জনে, পাকোড়া ফল্লিদানা বিক্রেতার আনুনাসিক শব্দে, তার সাথে মিলে মিশে আসা আরও নানাবিধ জটিল এলোমেলো ধ্বনি তরঙ্গের মধ্যে একটা কাব্যিক সুষমা খুঁজে পায়। খুঁজে পায় নিশুতি রাতের শরীরময় এক আবহ সঙ্গীতের বর্ণময় রেশ।
জীবন নামক এক বালকের জীবনে এমন রাত আগে আর আসেনি। এ যেন জীবনকে সমৃদ্ধ করা নতুন রাগে রূপে উপস্থাপিত অন্যতর এক রাত। ফলে তার সারা শরীর মনে বহে যায় অদ্ভুত এক শিহরণ। এক ভালো লাগা ঢেউ। অনাস্বাদিত রোমাঞ্চের অগুনতি সেই ঢেউ দোলায় দুলে যায় প্রাণের ছোট তরণীখানি।
বেলা আট কি সাড়ে আটটার সময় ট্রেন পৌঁছে গেল ফরাক্কা স্টেশনে। এ স্টেশন হাওড়া শিয়ালদহের মত রেলিং গেট শেড দিয়ে অত ঘেরা ঘোরা নয়। চারদিকে অত পথঘাট যান বাহন বড় ছোট গাড়ির মিছিলও নেই। নেই উঁচু উঁচু বাড়ি গিজগিজে লোকের ভিড়। এখান থেকে এক দেড় মাইল দুরে ফেরীঘাট। ট্রেন থেকে নামা সব যাত্রীর পা সেই দিকে সচল। সবার পিছু পিছু রাজা আর জীবনও হাটা দেয় সেই পথ বেয়ে।
ফেরীঘাটে এসে দেখতে পায় সেখানে দাঁড়িয়ে আছে জলে গা ভাসিয়ে দু-তিনখানা স্টীমার। যারা অকারণে অথবা যাত্রী ডাকার জন্য মাঝে মাঝে ভেঁপু বাজাচ্ছে। আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় বেশ কিছু পণ্যবাহী নৌকা। যাতে মাল ওঠা নামা চলছে। রয়েছে কতগুলো মাছ ধরা ছোট নৌকাও। মালকোচা মারা খালি গায়ের কালো কালো কিছু মৎস্যজীবী ঝুড়ি ভরে ভরে নামাচ্ছে নানা জাতের নদীর মাছ। এই ফেরী ঘাট ঘিরে অসংখ্য হোটেল রেস্টুরেন্ট। সবই দরমা টিনের। সেগুলোয় এখন উপছে পড়া ভিড়।
যে স্টীমারটা প্রথম ছেড়ে যাবে তাতে যাত্রী বোঝাই করা হচ্ছে। কাঠের একটা পাটাতন বেয়ে মালপত্র নিয়ে ধীরে ধীরে তাতে চড়ছে মানুষ। পাটাতনের শেষ মাথায় স্টীমারের দরজায় রোগা কালো লুঙ্গি পড়া দুতিন জন চেকার যাত্রীদের টিকিট চেক করে তবেই ভিতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে। রাজা জীবনের টিকিট নেই। তাদের পক্ষে এই স্টীমারে চড়া অসম্ভব। সে কথা বুঝে রাজার দিকে তাকিয়ে বলে জীবন, কী হবে রাজা। আমরা ও পারে যামু কেমনে?
জীবনের কাতরতাকে কোন আমল দেয় না রাজা। দৃপ্ত গলায় বলে, আমরা ওপারে যাবো আর স্টীমারেই যাবো। একটু ধৈর্য্য ধরে দেখ।
স্টীমার তো ছাড়ে ছাড়ে।
ছাড়ুক না। এটাই কী শেষ নাকি! এরপর আরো কত আছে, আধ ঘণ্টা পরপর। একটা না একটায় চান্স পাবো।
আর একবার স্টীমার ভোঁ বাজালো। এটাই শেষ ভো। এর আগে দুবার বাজানো হয়ে গেছে। যারা যাবার সব উঠে পড়েছে। এবার লুঙ্গি পড়া চেকার ক’জন মুখের বিড়ি জলে ছুঁড়ে ফেলে প্রস্তুত হল পাটাতন সরিয়ে দেবার জন্য। ঠিক সেই সময় এক মহিলা মাথায় একটা বড় মোট আর এক দঙ্গল ছেলে পুলে নিয়ে ছুটে এল স্টীমারের দিকে। এখানকার অধিকাংশ দোকানদার স্টীমার লঞ্চের কর্মচারী সম্ভবতঃ সবাই ভালোমত তাকে চেনে। কারণ তাকে দেখেই হেসে নানা দোকান থেকে নানা মন্তব্য ছুটে আসতে লাগল। মহিলা তাদের অকথ্য ভাষায় গাল দিতে দিতে গাদা গুচ্ছের বাচ্চা নিয়ে পাটাতন বেয়ে স্টীমারে উঠার মুখে বোধ হয় কোন নতুন কর্মচারী তার কাছে টিকিট দেখতে চেয়ে থাকবে। সাথে সাথে সে জুড়ে দিল চিল চিৎকার কান্না ঝগড়া গালাগালি–টিকিট! কেন–ঘরে তোর মা নেই, বোন নেই! তার টিকিট দেখতে পারিস না। টিকিট দেখবি তো চল আমার সাথে, চল তোকে দেখাবো টিকিট! মহিলার কথ্য ভাষার সাথে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি দেখে সে গোবেচারা চেকার ভয়ে এক পাশে সরে দাঁড়ায় আর মহিলা সদলবলে প্রবিষ্ট হল জলযানের অন্দর মহলে। প্রায় সাথে সাথে পিছন পিছন দৌড়ে যায় রাজা, বিড়ি ফোঁকা বোকা বোকা চেকারের সামনে দুটো হাত জোড় করে তুলে ধরে বলে বাবু, রাগ করবেন না বাবু। মা-টার আমার মাথার ঠিক নেই তো। একে বাবু শব্দ, তার উপর জোড় হাত–এই দুই ধাক্কায় চেকার কাত। তারা ধাতস্ত হবার আগেই জীবনের হাত টেনে ধরে স্টীমারের গিজ গিজ ভিড়ের মধ্যে রাজা উধাও।
বলে রাজা–যা বাবা চড়া তো হলো। এবার যা পারে হোক। রাজার স্বস্তিতে জীবন স্বস্তি পায় না। বলে–এখন যদি ওরা এসে আমাদের ধরে?
ধরলে ধরবে। বলে রাজা–ধরে আর কি করবে। হয় এপারে নয় ওপারে এক পারে তো নামাবে। ধাক্কা মেরে জলে তো ফেলে দিতে পারবে না।
ওরা ওঠবার প্রায় সাথে সাথে চলতে শুরু করে দিয়েছে সেই জলযান। জলের রঙ ঘোলা লাল মাটির মতো। যার উপর খেলছে ছোট ছোট ঢেউ। কিছুক্ষণ সেটা চলার পর ডানদিকে দূরে দেখা যায় একটা ছোট গ্রামের আম, জাম, নারকেল সুপারির সবুজ বাগান। ঠিক তারই সামনে জলে মাছ ধরছে কিছু নৌকা চড়া মৎস্যজীবী মানুষ।
আধঘণ্টা চলবার পর এপার খেজুরিয়া ঘাটে এসে থামল জলযানখানা। এখানে গেটে কোন পাহারাদার নেই। নিরাপদে ওরা নামল দুজন। বালির উপর রেল লাইন পেতে নদীর একেবারে কাছাকাছি এনে বানানো হয়েছে এই স্টেশন। যে কেউ দেখে এক নিমেষে বুঝে যাবে এ স্টেশন স্থায়ী নির্মাণ নয়।নদীর জল বাড়লেই একে তুলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে পিছনে। দোকানগুলোও তাই। সবই অস্থায়ী। হোগলা দরমার ঘেরা বেড়া দিয়ে বালির উপর বানানো হয়েছে চা দোকান হোটেল। একখানা ট্রেন তখন দাঁড়িয়ে রয়েছে লাইনের উপর। বগিগুলো টেনে নেওয়া ইঞ্জিনটা যেন ঘুমাচ্ছে। দৌড় শুরু করার আগে তার যে ফোঁস ফোঁস তেজ গর্জন নরম নিশ্বাস তা এখন নেই। গাড়ি টানা আলসে গরু যেরকম গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে জাবর কাটে আর ঘন ঘন মূত্র ত্যাগ করে ইঞ্জিনটা তাই করছে।
বলে রাজা, গাড়ি ছাড়তে এখনো অনেক দেরি আছে বলে মনে হচ্ছে। চল দেখি কোথা থেকে কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
ট্রেনের সামনে সোজা লম্বা হয়ে বসেছে বাজার। গ্রামের সাধারণ চাষীবাসী মানুষ নানারকম ক্ষেতের ফসল, যার মধ্যে পাকা আমই সব চেয়ে বেশি, তা নিয়ে এসে বিক্রি করছে বাজারে। চার কি পাঁচটায় এক কিলো হবে এমন আমের দাম একটা এক আনা। এক টাকার কিনলে ষোলটার বদলে আঠারো কেউ কেউ কুড়িটাও দিচ্ছে। রাজা এক বুড়ো মত চাষীর ঝুড়ির সামনে গিয়ে জানতে চায়–আম মিষ্টি হবে তো? নাকি টক? বুড়ো লোকটা কথার জবাব দেয় হাত দিয়ে–একটা কাটা আমের ফালি এগিয়ে ধরে। এক কামড় রাজা খেয়ে বাকিটা জীবনের দিকে এগিয়ে দেয়। দেখ তো।
এভাবে একে একে সারা বাজারের সব আমের ঝুড়ির কাটা টুকরো চাখা হয়ে যায় দুজনার। এ সেই ঝাটি ফুলের মধু চোষা, ধান ক্ষেতের কচি ধানের শীষ ছিঁড়ে দাঁতে চেপে দুধ বের করে খাওয়ার মতো ব্যাপার। খিতে এতে মিটবে না শুধু মনকে প্রবোধ দেবার কাজ চলবে।
বলে রাজা–এবার আমের ফলন খুব একটা ভালো হয় নি মনে হচ্ছে। না হলে আরো লোক আম নিয়ে আসত। আমাদের পেট ভরে যেত। যা একেবারে না হবার চেয়ে কিছু তো হল। সারা দিনে আর না পেলেও চলে যাবে কি বল!
দশটা কি সাড়ে দশটা নাগাদ নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল সেই ট্রেন। সব কামরাই এখন কঁকা ফাঁকা। কোনটায় পাঁচ কোনটায় দশজন এইরকম যাত্রী নিয়ে বালির উপর পাতা লাইনের উপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ট্রেন। রাজা জীবন দুজনে সেই প্রিয় পুরাতন স্থান একটা দরজার দুপাশ দখল করে বসে পড়ে। চোখ বিছিয়ে রাখে রোদ্দুর ধোয়া মাঠ ধান ক্ষেত জলাশয় ফলফলাদির বাগান মাঠে চড়তে থাকা গরু দূরের ছুটন্ত গ্রাম, গ্রামের মানুষের উপরে।
এইসব কি নতুন কিছু! আগে কখনো দেখেনি! দেখেছে খুব দেখেছে। কিন্তু এই রকম পরিবেশ পরিস্থিতি এই রকম মানসিক অবস্থায় একবারও আর দেখা হয়ে ওঠেনি।
ট্রেন এক এক স্টেশন করে পিছনে ফেলে আর একটু একটু করে যাত্রীর সংখ্যা বাড়ে। তবে সারা দিনে কখনো তেমন ভিড় হল না যাকে চামকাটাকাটি ভিড় বলে। পুরো দিন অবিরাম চলার পর সন্ধ্যে বেলায় নির্বিঘ্নে সে ট্রেন পৌঁছে গেল নিউ জলপাইগুড়ি। আজ আর আসামে যাবার মতো কোন ট্রেন নেই। সে পাওয়া যাবে কাল সকালে।
এখন জীবনের খিদের চোটে মুখে ফেনা উঠে গেছে। হাত পা সব তির তির করে কাঁপছে। কথা বলতে গেলে তা বের হচ্ছে কান দিয়ে। পেটের নাড়ি ভুড়িগুলো মনে হচ্ছে কেউ দু-হাতে টেনে ছিঁড়ে নিতে চাইছে। বুকের খাঁচায় পোষা প্রাণ পাখি আর বাঁচার মধ্যে বদ্ধ থাকতে চাইছে না। যেন এক্ষুণি খাঁচা ফেলে উড়ে যাবে কোন দিকে।
খিদে রাজারও লেগেছ। তবে তা জীবনের মত কষ্টে নয়, বদলে গেল রাগে। ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে বলে সে, শালাদের কাণ্ডটা দেখলি জীবন। কোন মানে হয়। সেই কলকাতা থেকে হাজার মাইল পথ এলাম। এক শালা চেকারকে দেখতে পেলি। ডাং ডাং করে বিনা টিকিটে দুদুটো লোক যাচ্ছে যেন তাদের বাপের ট্রেন। ধরার কেউ নেই। সব বাঞ্চোৎ অকস্মা। শালারা মাইনে নেয় আর ঘরে গিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমায়। বলতো এখন আমরা কি করি।
চেকারের উপর এক বিনা টিকিটের যাত্রীর কেন এত দ্বগ স্ত্রী এখন জীবন ঠিক ঠাক বুঝে উঠতে পারে না। খিদেয় তার বোধ বুদ্ধি লুপ্ত হয়ে গেছে। তখন তাকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বোঝায় রাজা–আরে যদি চেকার থাকত আর যদি আমাদের ধরে জেলে পাঠাত কটা দিন আরামে খেয়ে দেয়ে শরীরটা একটু চাঙ্গা বানিয়ে আনতে পারতাম। আমার নিজের জন্য বলছি না। তোর কথা ভেবেই বলছি। মুখ টুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। খিয়ে পেয়েছে না?
এ্যাঃ। কি কইলা?
ঠিক পেয়েছে। নিশ্চয় কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। সেই জন্য কথা শুনতে পাচ্ছিস না। চল দেখি তোর জন্য কোথা থেকে কিছু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।
তখন সন্ধ্যা বেশ ঘন হয়ে এসে গেছে। যদিও চারদিকে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে লাইট পোস্টে লাগানো বৈদ্যুতিক আলোগুলো তবু সে আলোয় তত জোর নেই যা গা ছমছম করা অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দেয়। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে দূর পর্বত চূড়ায় অবস্থিত শৈল শহর দার্জিলিংকে। সেখানকার পথ ঘাট ঘর বাড়ি দোকান বাজারে সদ্য জ্বলে ওঠা আলোগুলোকে দেখাচ্ছে আকাশ থেকে খসে পড়া চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়া একরাশ তারার মতো। মনে হচ্ছে কোন ঘন সবুজ বনের বৃক্ষ। বৃক্ষের ডালে ডালে আটকা পড়া তারারা জ্বল জ্বল করে জ্বলছে নিভছে আর জ্বলছে।
রেল স্টেশন থেকে বাইরে বের হয়ে ওরা সেই দিকে মুখ করে হাটে।
এখানে একটু শীত শীত ভাব আছে এ সময়ের আবহাওয়ায়। পথে কোন লোকজন নেই। একদম ফাঁকা। যারা ট্রেন থেকে নেমেছিল তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। কুড়ি পঁচিশজন হবে হয়ত। এতক্ষণে তারা চলে গেছে যে যার গন্তব্যে। কলকাতার আলো লোকজন গাড়ি ঘোড়া দেখা চোখে এখানকার নির্জনতা, পাহাড়, জঙ্গল, পুরো পরিবেশটাই এখন বড় ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে। সেই ভয় থেকেই জীবন বাঁহাত দিয়ে রাজার ডানহাত চেপে ধরে। বিদেশ বিভুয়ে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে বন্ধু হয়ে ওঠা একটা হাতের স্পর্শ মানুষকে যে কতখানি নিরাপত্তা কতখানি সাহস জোগাতে পারে তা জীবন জীবন থেকে অনুভব করে।
প্রায় পনেরো কুড়ি মিনিট হাটবার সামনে পড়ল একটা তেমাথার মোড়। সেখানে একটা বটগাছ। গাছের গোড়াটা গোল করে বাঁধানো। ডানদিকের রাস্তায় পর পর কয়েকটা দোকান। প্রথমটা মিষ্টির পরেরটা হোটেল। একটার মালিক বাঙালী। অন্যটার নেপালি।
বলে রাজা–চল তো দোকানগুলোর দিকে।
পয়সা নাই খাবার দোকানে কি কাম।
চারদিক দেখে নিয়ে বলে রাজা–দুটো পথ আছে, যা মন চায় পেট ভরে খেয়ে দেয়ে দৌড় মেরে পালানো। পারবি?
ধরা পড়লে খুব মারবে।
খুব মারবে না। দু-চারটে চড় ঘুষি মারতে পারে।
আমি মাইর খাইতে পারি না, ব্যথা লাগে।
তাহলে আর একটা উপায় আছে। গিয়ে বলা আমরা কাজ করব। যদি কাজ দেয় খেতেও দেবে। করবি কাজ? দু-চারদিন কাজ করে খেয়ে দেয়ে জিড়িয়ে যেতর আসামের দিকে রওনা দেবো।
এইটা ঠিক হইবে।
রাজা মিষ্টির দোকানের সামনে গিয়ে সহজ সপ্রতিভ গলায় দোকান মালিককে বলে, দেখুন, আমরা দুজন কলকাতায় থাকি। আপনাদের এখানটা ঘুরে দেখতে এসেছি। কটা দিন এখানে থাকার ইচ্ছা। আপনার দোকানে কোন কাজ টাজ পাওয়া যাবে? একটু বিড়ির নেশা আছে আমার। দু’একটা দিলে ভালো না দিলেও কোন কথা নেই। বাঙালী দোকান মালিক তার পাশের নেপালি মালিককে ডেকে আনে। দু’জনে প্রাণভরে খানিকক্ষণ হেসে সোৎসাহে বলে–নিশ্চয় কাজ পাবে। কাজের লোকের জন্য আমরা কবে থেকে পথ চেয়ে বসে আছি। কাজের লোকের অভাবে কত কাজ পড়ে আছে। এসো এসো তোমরা। যতদিন মন চায় থাকো, খাও দাও, দেশ দেখো।
রাজা নেপালির হোটেলে আর জীবন বাঙালীর মিষ্টির দোকানে তৎক্ষণাৎ বহাল হয়ে গেল। দুই দোকানের গোপন গুদাম থেকে এবার বের হল বিশাল বিশাল কড়াই গামলা বাথটব হাতা খুন্তি আরও কত কী। তারা সেই ছোট খাটো পাহাড় দেখিয়ে বলল–আজকে তোমরা ক্লান্ত, অনেক দূর থেকে এসেছো বলে এর বেশি আর কিছু দিলাম না। ভালো করে এগুলো মেজে ধুয়ে চকচকে করে ফ্যালো তো দেখি। মালিক দুজন মুখ নয়। তারা বুঝে গেছে এরা আজ আছে কালকে কোথায় তা কে জানে। প্রথম দিন আজ যখন তারা একবার এদের খাপে পেয়ে গেছে যতটা পারে খাঁটিয়ে নেবে সেটায় তার আশ্চর্য কি!
দুই দোকানের মাঝে একটা বাঁশের বেড়া। এপারের কলতলায় জীবন ওপারের কলতলায় রাজা। দুজনার সামনে বাসনের পাহাড়। যা মনে হয় বহু বছর ধরে মাজা ধোয়া হয়নি। ছাই দেওয়া হয়েছে সোড়া দেওয়া হয়েছে আর বলে দেওয়া হয়েছে—কাজ শেষ হবার পরই খেতে দেওয়া হবে গরম গরম ভাত। ভাতের লোভে দুই ক্ষুধার্ত বালকের শুরু হল বাসনের সাথে দুই তিন ঘণ্টার কঠিন কুস্তি। শেষে গামলা কড়াই মেজে ধুয়ে নিয়ে চলে যাবার আগে জীবনকে বলে যায় রাজা সকালেই কিন্তু পালাবো। সাতটার সময় আসাম যাবার ট্রেন, মনে থাকে যেন। না পালালে শালারা আমাদের খাঁটিয়ে খাঁটিয়ে মেরে ফেলবে।
যেমন কথা তেমন কাজ। সকাল বেলা রাজা চলে গেল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। সে যে যাবে তা জানা ছিল জীবনের। যাবার কথা ছিল তারও। কিন্তু কথা থাকলেই কি সব কাজ সময় মত করে ওঠা যায়? রাতের খাওয়া দাওয়ার পর রাজাকে শুতে দেওয়া হয়েছিল বাইরে হোটেলের বারান্দায়। যেখান থেকে সটকে পড়া সহজ। আর জীবন ছিলো কাঠের দোতলার তালাবদ্ধ এক ঘরে। যার তালা বাইরে থেকে না খুলে দিলে বের হওয়া অসম্ভব। তাছাড়া বিগত চব্বিশ ঘন্টার পথ ক্লেশ তাকে সঠিক সময়ে জেগেও উঠতে দেয়নি। যখন তার ঘুম ভাঙল বাইরে তখন নেপালি ভাষায় চিৎকার গালি গালাজ–চোর শালে, চোরিসে ভাগ গিয়া।
চোরিসে ভাগ গিয়া, আর চোরি করকে ভাগ গিয়া দুটো কথার মধ্যে ব্যবধান আকাশ পাতালের। কিন্তু সে ব্যবধান স্থান কাল পাত্র অনুসারে বিবেচিত হয়। এক দুর্বল দরিদ্র দূর দেশের বাচ্চার জন্য কে কবে এত বিচার বিবেচনার ধারে কাছে গেছে। জীবনকে চুলের মুঠি ধরে দোকানের বাইরে বের করে আনলো একজন। ঠাস করে চড় হাঁকাল গালে। যাঃ শালা চোর। ভাগ।
এই বিদেশ বিভুয়ে বান্ধবহীন জীবন এখন কোথায় যাবে। চড়ের ব্যথায় নয়, কেঁদে ফেলল নিজের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে। সে যেন এখন হাত পা বাঁধা কুয়োয় পড়া মানুষ। যার আর রক্ষা নেই। নিশ্চিত মৃত্যু এসে যেন শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে পড়েছে। চিলের মত ছোঁ মেরে এখনই তুলে নেবে ধারালো নখে।
দোকানের সামনে থেকে সরে এসে তেমাথার মোড়ে বাঁধানো বটের গোড়ায় বসে পড়ল জীবন। সামনে পিছনে ডানে বাঁয়ে চারদিকে তাকাল। তেমন কাউকে চোখ পড়ল না যার সামনে গিয়ে অঞ্জলি পেতে দাঁড়িয়ে বলা যায় আমি বড় বিপদগ্রস্থ। আমাকে বাঁচান।
কত সময় সেই নির্বান্ধব গাছতলায় একা একা বসেছিল জীবন তা সে নিজেও জানে না। কখন চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে তা টেরও পায়নি। তখন জীবন মন শক্ত লক্ষ্যস্থির করে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে হাঁটা দেয় সামনে। কয়েক পা হাঁটবার পর মনে হয়, হ্যাঁ পারব। কারও কোন সহায়তা ছাড়াই সে একা হেঁটে যেতে পারবে।
.
পথ কোন আঁকা বাঁকা নেই, একেবারে ধনুকের ছিলার মত সোজা। সেই সোজা পথ ধরে হেঁটে জীবন পৌঁছে গেল রেল স্টেশনে। কাল যে স্টেশন থেকে রাজার হাত ধরে হেঁটে গিয়েছিল। এখন স্টেশন কালকের মত অত ফাঁকা নেই। কিছু লোকজন আছে। সেই কিছু লোকজনের মধ্যে একা একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে পড়ে জীবন।
সকাল সাতটার যে ট্রেন তা সকাল সাতটাতেই ছেড়ে গেছে। সেই ট্রেন ধরে চলে গেছে রাজা। এরপর আসাম ট্রেন আবার আছে বেলা বারোটায়। ফের বিকেল চারটেয়। সময় এখন দশটার বেশি নয়। দু’ঘণ্টা কি করে কাটায় জীবন। কিছুক্ষণ বসার পর সে স্টেশন দেখতে বের হল। এক নাম্বার প্লাটফর্ম ঘুরে গিয়ে উঠল দু’নাম্বার প্লাটফর্মে। কিন্তু তার চোখ প্লাটফর্মের সেই চেনা চিহ্ন কিছুতেই খুঁজে পেল না। এখানে সেই উনুন নেই যা ঘিরে বসে থাকে ভিখারি মায়ের হাড় গিলগিলে সন্তানরা। রেলিংয়ের গায়ে ছেঁড়া ময়লা কথা শুকোতে দেওয়া নেই। কেউ মাতলামো করছে না। তাসের জুয়া খেলছে না রেলের কুলিরা দল বেঁধে। ঝগড়া মারামারি করছে না কেউ। বড় শান্ত বড়ই নিরুপদ্রব পরিবেশ এখানে।
এই সব দেখে অথবা কিছুই না দেখে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিল জীবন। এক সময় ঘড়িতে বারোটা বাজলো। কারশেড থেকে এবার একখানা ট্রেন এসে ঢুকল প্লাটফর্মে। যারা যাবার ছিলো সব ধীরে সুস্থে উঠে পড়ল কামরায়। জীবনকেও যেতে হবে। সে বা বসে থাকে কেন? ট্রেনে উঠে দরজার কাছে সেই পুরাতন ভঙ্গিতে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল সে।
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে এক সময় ট্রেন এসে পৌঁছাল শিলিগুড়ি স্টেশন। ট্রেনে ওঠার জন্য এখানে বড় বড় বেডিং ট্র্যাঙ্ক স্যুটকেশ নিয়ে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার যাত্রী। ট্রেন থামা মাত্র হুড়মুড় করে তারা সব উঠে পড়তে লাগল কামরায়। চিৎকার চেঁচামেচি হৈ হট্টগোলে সমস্ত স্টেশন এক মুহূর্তে যেন রণভূমি হয়ে গেল। কে কার পা মাড়িয়ে কে কার বুকে কনুইয়ের গুঁতো মেরে কে কাকে ঠেলে ফেলে আগে গিয়ে পছন্দের সিট দখল করবে তারই প্রতিযোগিতা শুরু হল। সে সব থামলে যাকে গত কয়েকদিন তপস্যা করেও দর্শন মেলেনি সেই অপ্রত্যাশিত অবয়ব আচমকা সামনে এসে দাঁড়াল। তিনি কালো কোর্ট পড়া বিশালদেহী এক চেকার। টিকিট! মাথা এবং হাত দুটো এক সাথে নেড়ে জানাল জীবন–নেই। চেকারের আর কিছু শোনবার দরকার ছিল না। বাজপাখি যেমন ছোঁ মেরে ইঁদুর ছানা তুলে নেয় সে তার বিশাল থাবায় ঠিক সেই ভাবে ধরে ফেলল জীবনকে। তারপর যেমনভাবে ঘোড়ায় বেঁধে যুদ্ধবন্দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় সেইভাবে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল স্টেশন থেকে বাইরে যাবার গেটের কাছে। শেষে সজোর এক ধাক্কা যাঃ–!
জীবনের পরিধানে একটা হাফ প্যান্ট গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি জড়ানো গামছা আর খালি পা দেখে চেকার বুঝে গেছে এরকম লোকের ফাইন দেবার ক্ষমতা, ঘুষ দেবার যোগ্যতা থাকে না। বিনা টিকিটে চড়া এমন কোন গর্হিত কাজ নয়। গর্হিত ওই দুটোর কোন একটা না থাকা। তেমন লোক ধাক্কা খাবারই যোগ্য। জীবনের সর্বক্ষেত্রে পদে পদে এরা ধাক্কাই খায়। সেটাই দিয়েছে সে।
গেটের এপারে টিকিট কাউন্টার। তার পাশে একটা ফাঁকা কাঠের বেঞ্চি। সেটায় বসে ফের ভালো করে স্টেশন আর আসামগামী ট্রেনটার দিকে তাকায় জীবন। ট্রেন ঘিরে স্টেশনের চারদিকে থিকথিক করছে কালো কোর্ট আর খাকি জামা। এত পুলিশ এত চেকার হাওড়া শিয়ালদায়ও দেখা যায় নি। এত চোখ ফাঁকি দিয়ে কী করে ট্রেনে চড়া যায় সে জীবন জানে না। যে জানত সে রাজা আর নেই।
কী করা যায় এখন। ট্রেনে চড়া যাবে না, তাহলে কী একা এই পরদেশে ভয়ে ভাবনায় ক্ষুধা তৃষ্ণায় মরে পড়ে থাকবে। মরতেই যদি হয় তবে এতদূর দেশে আসতে গেল কেন! কলকাতায় কি মৃত্যুর কোন অভাব ছিল। এসেছে বাঁচতে। সে এখনও বেঁচে থাকতে চায়। সবাইকে বাঁচাবার জন্যই তার বাঁচাটা দরকারী। সবাইকে বাঁচাতে হলে আসাম যাওয়াও দরকার। যার পথে পথে পড়ে থাকে টাকা। যে টাকায় কেনা যায় বেঁচে থাকার উপকরণ।
আসাম যেতে হবে। না গিয়ে কোনও উপায় নেই। ঝিমুনি ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় জীবন। টিকিট কাউন্টারের সামনে একটা বড় স্টল। শো কেসে সাজানো নানা রকম খাবার। উনুনে ভাজা হচ্ছে কচুরি সিঙ্গারা আরও কত কী! বানানো হচ্ছে দুধের ঘন চা। দোকানের সামনে গিয়ে রাজার মত গলায় বলে সে, আপনেগো দোকানে কামে লোক লাগবে নাকি? আমি কাজের তালাশে কইলকাতা থিকা আইছি।
দোকানের মালিকের মাথায় লম্বা চুল দাড়িগোঁফ সব কামানো একেবারে সখি সখি চেহারা। গলায় বৈষ্ণব পদাবলীর মধুর সুর এনে বলে সে–দেশ কোথায় ছিল?
আইজ্ঞা পূর্ব পাকিস্থানের বরিশাল জেলায়।
আমরা ঢাকা জেলার লোক। বলে না বিদ্যা বুদ্ধি টাকা সব হচ্ছে ঢাকা। সেই ঢাকার। কি নাম তোর?
জীবন। আইজ্ঞা জীবন কৃষ্ণ দত্ত।
বড় ভালো নাম, কায়স্থ। হ্যাঁ, লোক তো আমার লাগবে।
মাইনা কত দিবেন।
মাইনে! হাসেন তিনি, আগে কাজে তো লাগ। এক দুমাস কাজ কর। সব কাজ শেখ তবে তো মাইনের কথা। কেমন কাজ করিস না করিস কিছু দেখলাম না, শুনলাম না–আগেই মাইনের কথা কি করে বলবো! এক দেশের লোক তুই, এক জাতের। আমরা সাহা। তোকে কি আর আমি ঠকাবো?
না, তবু আপনে কিছু এক্ট কন। আমার খুউব টাকার দরকার। আমি গেলাস ধুইতে, চা বানাইতে পারি।
ঠিক আছে। বলছিস যখন, প্রথম মাসের পর থেকে মাসে চল্লিশ করে নিস।
মাত্র ষাট দিন পরে পাওয়া যাবে চল্লিশ টাকা। মাত্র ষাটটা দিন। তারপরই জোগাড় হয়ে যাবে ট্রেন ভাড়া। এই কটা দিন পরে জীবন পেয়ে যাবে সেই জাদু নগরীর গেট পাশ। যেখানে পৌঁছাতে পারা মাত্র জীবনের নাগালে এসে যাবে কাঙ্খিত সুখ।
জীবন যখন তাড়া খাওয়া কুকুরের মত এখানে সেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল ঠিক সেই সময় তারা অজান্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা পালাবদল ঘটে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকে যে দল পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় অটল বসেছিল তারা টলে গেল। তাদের দলের এক প্রভাবশালী নেতা অজয় মুখার্জী তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে ডিগবাজী খাওয়ায় কংগ্রেস দল শাসন ক্ষমতা হারাল। পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় বসল চৌদ্দ দলের জোট যুক্তফ্রন্ট। অজয় মুখার্জী হল সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আর উপমুখ্যমন্ত্রী হল সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু। পুলিশ বিভাগ রইল তাঁরই হাতে। এর ফলে গ্রাম বাংলার শ্রমিক কৃষক খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে একটা আশার সঞ্চার হল। শ্রমিকরা ভাবল শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির নেতার হাতে যখন পুলিশ বিভাগ তখন সেই পুলিশ দিয়ে মালিক শ্রেণি আর শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার আন্দোলন দমন করতে পারবে না। আর কৃষক, যারা এতকাল শুনে এসেছে লাঙল যার জমির প্রকৃত মালিকই সেই। মাটিতে যাদের ঠেকেনা চরণ মাটির মালিক তাহারাই হন–সেই পুরানো অন্যায় আইন এবার বদলে যাবে। এই আশায় টগবগ করে ফুটতে লাগল।
সেটা উনিশশো সাতষট্টি সাল। হেমন্তকাল গিয়ে শীতকাল এল বীর বিক্রমে। বস্ত্রহীন মানুষের হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের শীষে সোনার রঙ ধরল। সে এক সময় বিল্টুদায় নিল। এসে গেল বসন্তকাল। বসন্তকালকে বলা হয় প্রেমের ঋতু। কিন্তু এবার সমগ্র উত্তরবঙ্গের জন্য তা নিয়েএল এক বিদ্রোহী বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ।
স্টেশনের এক চা দোকান, যেখানে নানা জায়গার লোক আসে তাদের মুখের টুকরো টুকরো কথায় জীবনও বুঝে যায় এই বসন্ত এই শহরের সুখী শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে কোন শুভবার্তা নিয়ে আসেনি। সর্বত্র কি যেন এক গুঞ্জন ত্রস্তভাব। সব যেন ভয়ের জ্বরে কাঁপছে। কয়েকদিন পরে দেখতে পেল জীবন, স্টেশন বাজার শহর সারা শিলিগুড়ি যেন খাকি রঙে ঢেকে গেল। জেলা পুলিশের সদর দপ্তর এখানেই। ট্রাক ভ্যান জীপ ভরে রাইফেল স্টেনগান এস, এল, আর নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ সেখানে এল, এরা সব সি.আর.পি। আবার ঝাঁকে ঝাঁকে তারা গাড়ি ছুটিয়ে চলে গেল। এদের আসা যাওয়ায় ফুটে উঠলএকটা রণংদেহী ভাব। যা দেখে মনে হল এরা যেন সেই বাষট্টি সালে চিনের হাতে জুতো খাওয়ার বদলা নিতে যাচ্ছে আজ।
ইচ্ছা করে জীবনের কোথায় সেই নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি একবার গিয়ে দেখে আসতে। সাওতাল গরিব চাষী ক্ষেতমজুর কেমন করে লড়ছে এক সাহসিক লড়াই। ওদের নেতার নাম জঙ্গল সাওতাল। তারই নেতৃত্বে শোষণ বঞ্চনা অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে কৃষক জনতা। এলড়াই মনে হয় যেন তারও লড়াই। হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছে জীবন। সে দাঙ্গার ছিটেফোঁটা রক্ত তার হাতেও লেগে আছে। যে রক্তের ঘ্রাণ এখনো তাকে বিচলিত করে দেয়। সে লড়াইকে কখনো সঠিক লড়াই, নিজের লড়াই বলে মনে হয় নি। কিন্তু এই লড়াই যেন তার নিজেরই লড়াই এমনই মনে হয়।
কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও তার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সে রয়ে যায় সেই চা দোকানের এঁঠো থালা গেলাস প্লেট কাপের ডাই করা স্তূপের পাশে। এ ভাবেই কেটে যায় আট দশ মাস। কথা ছিল সাহাবাবু প্রথম মাসের মাইনে দেবেন না। পরের মাস থেকে দেবেন। সে মাস শেষ হতেই জীবন হাত পেতে দাঁড়ায় মালিকের সামনে—বাবু মোর মোর মাইনা দ্যান।
তেল চকচকে বকনা বাছুরের মত চেহারার সখি মুখে সাহাবাবু জীবনের কথা শুনে একটু নিরীহ হাসি দিলেন–মাইনে? কেন দেব না। নিশ্চয় দেব, একশো বার দেব। তবে এখন তো নেই। সামনের মাসে নিয়ে নিস।
মাইনে না পাওয়ায় মনটা একটু খারাপ হলেও সেটা সামলে নেয় জীবন। দুমাস তো গেছে আর একটা মাস গেলে বা কি হয়েছে। তাতে বরং ভালোই হবে। কিছু বেশি টাকা হাতে থাকবে। আসাম গিয়ে দু পাঁচদিন খেয়ে দেয়ে ঘুরে বেড়িয়ে একটা মনের মত কাজ খোঁজা যাবে। কিন্তু হায় হতভাগা! পরের মাসে সে যেই মাইনে চাইল বিনোদ সাহার অতি বিনীত জবাব নেই রে। পরের মাসে নিস। এভাবে পরের মাস পরের মাস করে ছয় সাত মাস কেটে গেল।
একদিন একটু ক্ষোভ রাগ গলায় এনে বলে জীবন পেত্যেক বার আপনে কন সামনের মাসে দিমু। ছয় সাত মাস হইয়া গেছে একটাও পয়সা দ্যান নাই। এইবার আমার মাইনা দ্যান। দ্যাখেন আমার গামছা গেঞ্জিও ছিইড়া গেছে। নতুন কেনা লাগবো।
বলিস কি! এর মধ্যে ছয় মাস হয়ে গেল! ঠিক গুনেছিস?
আপনে গুইন্যা দেখেন। কার্তিক মাসে কামে লাগছি, এইডা বৈশাখ।
বাব্বা একেবারে ক্যালেন্ডার। তো ঠিক আছে, ছয় মাসইতে হয়েছে, ছয় বছর তো আর হয় নি। চার ছয় চব্বিশ, দুশো চব্বিশ টাকা আছে আমার কাছে তোর পাওনা। থাক না আরো ছয় মাস। একেবারে সব হিসেব করে দিয়ে দেব। একবারে টাকাটা পেলে তোরও কাজে লাগবে।
এবার বড় কাতর হয়ে পড়ে জীবন। কান্না এসে জমা হয় তার গলায়। বলে, বাবু মোরা বড় গরিব। বাড়িতে ছোড ছোড় ভাই বইন। অরা খাইতে পায় না। মোর বাপের প্যাডে ব্যথা। অষুধ পায় না। সেই লইগ্যা কামে বাইরাইছি। মোর টাকা কয়ডা মোরে দিয়া দ্যান বাবু। বাড়িতে পাড়াইয়া দিই।
সাহাবাবু বিষম বিরক্ত–তুই তো দেখছি কাবুলিওয়ালারও বাপ। বলছি এখন নেই তবু প্যানর প্যানর করছিস। এই রকম করবি জানলে কোনদিন তোকে কাজে রাখতাম না। দেখে মায়া হয়েছিল বলে রেখেছিলাম। কথায় বলে না উপকারীকে বাঘে খায়। আমার এখন সেই দশা। বড় ভুল করে ফেলেছি। বলছি পরের মাসে দিয়ে দেব। আরে ভগবান আমাকে অনেক দিয়েছে, অনেক দেবে। তোর ওই কটা টাকা মেরে আমার কি হবে।
বলে জীবন, বাবুমুই অনেকদিন ঘর ছাড়া। মার লইগ্যা মোন কেমন কেমন করে। তারা বাঁইচা আছে না বেবাকে মইরা গেছে তা কে জানে। সামনের মাসে মোর টাকা মিটাইয়া দিবেন। মুই বাড়ি যামু।
দরাজ গলায় বলেন সাহাবাবু–নিশ্চয় দেবো। দু’দশটাকা বেশিই দেবো। যা এখন মন দিয়ে কাজ কর।
পরের মাসেও বিনোদ সাহার সেই এক গৎ–নেই রে। হাতে একদম টাকা পয়সা নেই। ঠিক আছে, এতদিন যখন গেছে আর একটা মাস যাক। সামনের মাসে ঠিক দিয়ে দেব। কথা দিলাম। পরের মাসেও টাকা দেয় না বিনোদ সাহা, কথা দেয়। পাকা কথা পরের মাসে।
ত্রিকোণ পার্কে একটা বাড়িতে কাজ করত বিহারের একটা ছেলে। সে এক রাতে বাড়ির মালিকের গলা কেটে দিয়ে সোনাদানা টাকা পয়সা সব নিয়ে পালিয়ে চলে যায়। জীবনের মনের মধ্যে এখন একটা সেই ইচ্ছা দাপাদাপি করে। কিন্তু কিছুই পারে না সে, গোপনে চোখের জল ফেলা ছাড়া। সে কান্নায় একটা গাছের পাতা খসে পড়ে না। কে যেন কবে বলেছিল–মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। বিশ্বাস করতে করতে দশ মাস কেটে গেল। শেষে আর বিশ্বাস রইল না মানুষের ওপর। এবার জীবনের নিজের উপর, দেশ সমাজ মানুষের উপর রাগ হতে থাকে। একদিন বিনোদ সাহাকে বলে সে–আপনি আমারে খালি দিনই দিবেন। টাকা আর দিবেন না। আমি আপনেরে বুইঝা ফালাইছি। আমি আর কাম করমু না।
মিষ্টি করে হেসে, একটুও না রেগে বলেন তিনি কাজ করা না করা সবটা তোর ইচ্ছা। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক তার উপর তো জোর খাটানো চলবে না। পারি, ইচ্ছা করলে তোকে যতক্ষণ আর একজন লোক না পাই আটকে রাখতে পারি। সে আমি করব না। তবে আমার ওই এক কথা–সামনের মাসে।
সামনের মাসে আমি কইলকাতা থিকা টাকা নিতে কেমনে আমু?
আসতে হবে না। ঠিকানা রেখে দিয়ে যা, মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দেব। জীবনে কারও এক পয়সা মারি নাই, তোরও মারবো না।
জীবন আর কোন কথা বলতে পারে না। কেন কে জানে চোখ ফেটে জল গড়িয়ে নামে। চোখের জল, যা এ সময়ের সব চেয়ে সস্তা সব চেয়ে ফালতু একটা জিনিস। নীরব ঝাঁপশা চোখে সে সামনে আগায়। নির্বান্ধব এক ছোট শহর শিলিগুড়ির পথে পথে খালি পায়ে ঘুরে খালি পেটে ঘুমিয়ে এক নিঃস্ব কিশোরের কেটে গেল কয়েকটা দিন কয়েকটা রাত। প্রথমে সে ভেবেছিল কলকাতার দিকে ফিরে যাবে। শিলিগুড়ি থেকে ট্রেনে যদিনা চাপা যায় রেল লাইন ধরে হেঁটে এক স্টেশন পেছনে পিছিয়ে আসবে, কিন্তু তখনই তার চোখে পড়েছিল নিজের দুটো নিঃস্ব হাত। অনবরত কাপ প্লেট ধোবার ফলে জলে ভিজে হাজা মজা পচা সে হাতে মা বাবা ভাই বোনকে দেবার মতো কোন সঞ্চয় ছিল না। ছিল নিঃসীম শূন্যতার বিপ। সে হাত যেন বলে উঠেছিল হেরো হেরো। তুই এক হেরে যাওয়া ব্যর্থ মানুষ। তোর মা বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর মত মুখ আর নেই। তখনই জীবনের ছোট্ট বুকটায় তোলপাড় হয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে জনমদুঃখী জননীর আশাহত ছলো ছলো মুখটা। সে যেন বলছে, জীবন রে কি আনলি তোর না খাওয়া ছোট ছোট ভাই বোনদের জন্য? এতদিনে একসের চালও জোগাড় করতে পারলি না!
তখনই এক অসহায় জীবন কাঁদে। মাকে তার বলতে ইচ্ছা করে, মা-মাগো, আমাদের বড় অভিশাপময় জীবন। নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে আমাদের জন্য কোথাও আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আমাদের জন্মের বহু আগেই জগতের যত কিছু সম্পদ, যা কিছু ভালো যা কিছু বেঁচে থাকার জন্য জরুরি, সব–সব দখল হয়ে গেছে। যারা তা দখল করে বসে আছে তা থেকে তিলপরিমাণও আর আমাদের জন্য ছেড়ে দিতে রাজি নয়। এরা বুক থেকে উঠে আসা গরম নিশ্বাস চোখ থেকে ঝরে পড়া নোনা জলের মূল্য দেয় না। শরীর থেকে বেয়ে পড়া ঘামকে কত কম দামে কিনতে পারে তারই কৌশল করে। দয়া ধর্ম ন্যায় এসব এদের কাছে অর্থহীন মূল্যহীন অবজ্ঞার বিষয়। কত পথ পার হলাম, কোথায় না কোথায় ঘুরলাম, কত মানুষ দেখে এলাম–সর্বত্র, সবার কাছে আমরা সমান উপেক্ষিত। এক উদ্বৃত্ত জীব মাত্র। যার দাম এই সমাজে কুকুর ছাগলের চেয়েও কম।
একদিন জীবনের আবার মনে পড়ে গেল আসামের কথা। মনে পড়ে গেল রাজার কথা। রাজা আসামের অনেক গল্প করেছিল। একবারও তার মুখ থেকে আসামের কোন নিন্দা বের হয় নি। যা বলেছে তার সবটা প্রশংসা। তাহলে এটা তো প্রমাণিত যে আসাম অন্য সব জায়গা থেকে আলাদা। সেখানকার মানুষ এখানকার মত অমানুষ দয়া মায়া শূন্য নয়।
তখনই জীবনের মাথায় আসে, এক স্টেশন পিছিয়ে গিয়ে যদি কলকাতামুখি ট্রেনে চাপা যায় তাহলে এক স্টেশন এগিয়ে গিয়ে আসাম ট্রেনে ওঠাও তো কঠিন নয়। এখন মনে হল তার, ছিঃ ছিঃ এই সহজ কথাটা এত দিন কেন মনে আসে নি। যতদিন শিলিগুড়ির পথে পথে ঘুরছি। ঘুরে ঘুরে মরছি, রেল লাইন ধরে হাঁটতে থাকলে হয়ত আসামেই পৌঁছে যেতাম। সে আর কাল বিলম্ব করে না। হাটা দেয় রেল লাইন ধরে।
সময় এখন সকাল সাত কি সাড়ে সাতটা। যত দূরই হোক বেলা বারোটা নাগাদ কি সামনের স্টেশনে পৌঁছে যেতে পারবে না। নিশ্চয়ই পারবে। এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশন কত দুরে দুরে হয় সে তো তার জানা। তবে আর চিন্তা কীসের! শহর পার হয়ে আসবার পর সামনে পড়ল একটা কুয়ো। কিছু মহিলা সেখানে বালতি কলসিতে জল ভরছে। এক জনের কাছ থেকে চেয়ে অঞ্জলি ভরে খানিকটা জল খেয়ে নেয়। পথে আর কোন পানীয় জল পাওয়া যাবে কিনা তা কে জানে। খালি পেটে জল পড়ায়, পেটটা কন কন করে ওঠে। হাটার সময় খল খল করে। কিন্তু এত তুচ্ছ ব্যাপারে এখন জীবনের নজর দেবার সময় নেই। সে হাঁটতে থাকে।
দু’তিন কিলোমিটার চলার পর দেখে রেল লাইন দুদিকে বেঁকে গেছে। একটা বা দিকে অন্যটা ডানে। বা দিকে লাইনটা সরু। ওই লাইনে যে ট্রেন চলে তা ট্রামের চেয়ে সামান্য বড়। এর নাম ন্যারোগেজ। এ ট্রেন যায় দার্জিলিং। জীবন ডান দিকের বড় রেললাইন ধরে। এটাই আসাম যাবার পথ।
আরো কিছুক্ষণ হাঁটবার পর ঘর বাড়ি দোর দালান গাড়ি ঘোড়া লোক জন সব চিহ্ন মুছে যায়। শুরু হয় ঘন গভীর বন। রেল লাইনের পাশেই একবুক উঁচু জংলা আগাছা আর পিছনে আকাশ ছোঁয়া উঁচু উঁচু বৃক্ষ। যে বৃক্ষের ডালে ডালে দোল খাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে শাখামৃগ। প্রচুর নানাবর্ণের পাখিও দেখা যাচ্ছে। সব কিচির মিচির করছে। ডালে ডালে দোল খাওয়া বানরগুলো বিস্ময় মাখা চোখে জীবনকে দেখছে আর মুখ দিয়ে বিচিত্র সব শব্দ করছে। বাঁকুড়ার জঙ্গল দেখেছে জীবন। একা একা সে জঙ্গলে অনেক ঘুরেছে। কিন্তু সে জঙ্গলের সাথে এ জঙ্গলের কোন মিল নেই। তাই কেমন যেন একটু ভয় ভয় করে জীবনের। প্রতিটা জঙ্গলের একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। সেই গন্ধের মধ্যে গোপন থাকে তার চরিত্র। সে জানে যারা অভিজ্ঞ। জীবন এ জঙ্গলের স্বভাব চরিত্র জানে না। তাই একা এই পথে হেঁটে যেতে পারছে। জানলে কোনদিন পারত না। এ জঙ্গলে বাঘ আছে, তার চেয়ে মারাত্মক পাহাড়ি চিতা। আকারে কিছু ছোট অসম্ভব ক্ষিপ্র এই জীবেরা ক’দিন আগে এখানেই একটা গরু মেরেছে।
দু’আড়াই ঘণ্টা হাটবার পর অবশেষে জীবন পৌঁছে গেল সেই কাঙ্খিত স্টেশনে। কিন্তু এ কী! ঘন জঙ্গলের মধ্যে সে স্টেশনে একজনও লোক নেই। এমনকি যাদের না হলে ট্রেন চলে না সেই স্টেশন মাস্টার পোর্টার সিগন্যাল ম্যান কারো কোনো কোনো আত্তা পাতা নেই। স্টেশনটাকে দেখে মনে হয় বন জঙ্গলের মধ্যে বহু বছর আগে একে পরিত্যাগ করে চলে গেছে কেউ। সেই থেকে যেন অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। আর এখানে ঝক মক ধাতব শব্দ তুলে কোন ট্রেন এসে পৌঁছায় না। হৈ চৈ সোরগোল তুলে মানুষ ট্রেনে ওঠা নামা করে না। তাই স্টেশনের ঘুম ভাঙে না চেতনা ফেরে না। স্টেশন স্থাপনের প্রয়োজনে যেটুকু জঙ্গল সাফ করা হয়েছে তার ওপাশে গাছ পালা ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে কোনও গ্রাম নগর লোকালয় আছে কিনা কিছু বোঝা যায় না। তবে যেটুকু চোখে পড়ছে বৈশাখের প্রখর রোদে জ্বলা সেই সীমার মধ্যে কোন জীবিত প্রাণী আছে তেমন বিশ্বাস হয় না।
মনে মনে বুঝে যায় জীবন এ স্টেশনে অন্য ট্রেন যদি বা থামে মেল ট্রেন কিছুতে থামবে না। মেল ট্রেন থামার জন্য যত বড় স্টেশন চাই, এটা তা নয়। গৌহাটি মেল আসবে বারোটায়। হাতে এখনো তিনঘণ্টা সময়। ইচ্ছা করলে এই সময়ের মধ্যে সামনের স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া কঠিন হবে না। আর তা করতেই হবে আসাম যেতে হলে। সে আবার সামনে হাটা দেয়। এবার জঙ্গল আরো ঘন আরো গভীর। আরো ভীতিকারক। গত কয়েক দিনের উপোস আর গত কয়েক ঘন্টার অনবরত হাটায় কিছুটা ঘায়েল তবু মনের জোরে এগিয়ে চলে। কে যেন কবে কোন পর্বতের গুহায় বসে বহু সাধনার জ্ঞান ব্যক্ত করেছিলেন–চরৈবেতি চরৈবেতি চরৈবেতি। এগিয়ে চলো এগিয়ে চলো। বিশ্ব চরাচর জল স্থল অন্তরীক্ষে, সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে এই এক নাদ ধ্বনি, চলো চলো–চলার নামই জীবন। যে সচল একমাত্র সেই জীবিত। যার চলা থেমে গেছে তার মৃত্যু ঘটে গেছে। জীবন এখন অন্তরাত্মার মধ্যে সেই মহান বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করে। এই জঙ্গলের মধ্যে না চলে বসে পড়লে দুচার দিন যাও বাঁচা যেত তাও যাবে না। ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত অক্ষম অসমর্থ দেহ রাত নামার সাথে সাথে কোন বন্যপ্রাণী মেরে খেয়ে নেবে।
কে জানে, জীবনের চলার গতি কমে গেছে, নাকি পরবর্তী স্টেশনের দুরত্ব অনেক বেশি অথবা ঘড়ির কাটা জোরে ছুটছে বলে সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে। চুলের সিঁথির মত জঙ্গলের মধ্যের রেলপথের উপর দারুণ আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রোদ। জীবনের শরীর জ্বলছে। পায়ের পাতা পুড়ে যাচ্ছে গরমে। জল তেষ্টাও পাচ্ছে খুব। কিন্তু ঘাম নেই শরীরে।
স্টেশনে তখনো পৌঁছাতে পারে নি জীবন, তা রয়েছে এখনো বেশ কয়েক কিলোমিটার দুরে। ঠিক সেই সময় শিলিগুড়ির দিক থেকে ছুটে এল সেই বেলা বারোটার গৌহাটি মেল। শব্দ শুনে পিছন ফিরে ট্রেনকে দেখে পাশের বুক সমান ঘাস জঙ্গলের মধ্যে নেমে দাঁড়ালো সে। মাটি কাঁপয়ে জঙ্গল কাঁপিয়ে শুকনো পাতা উড়িয়ে পাখিদের ভয় ধরিয়ে যেন জীবনের বুকের উপর দিয়ে সে ট্রেন ছুটে গেল আসামের দিকে। কি আর করে জীবন, ফের রেল লাইনের উপর উঠে কিছুক্ষণ হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। কিন্তু কতক্ষণ দাঁড়াবে! দাঁড়িয়ে তো কোন সুরাহা হবে না, বোঝে সে, স্টেশনে তো পৌঁছাতেই হবে। এর কোন বিকল্পই যে নেই।
সে আবার হাঁটা দেয়। দুর্বল পায়ের উপর যে অক্ষম শরীর তার উপর ঝিম ঝিম করা বোধহীন যে ফালতু মাথা সে সব টেনে টেনে যেন সামনে আগায়। আরো দেড় দু ঘন্টা চলার পর পৌঁছায়। আর এক স্টেশনে। সে স্টেশনে পৌঁছে জীবন অবাক। মনের ভুলে যেখানে লাইন থেকে নিচে নেমেছিল সেখান থেকে উল্টো দিকে হেঁটে চলে যায় নি তো। না হলে এখানেও সেই জনশুন্য মৃত নগরীর পুনরাবৃত্তি হল কেন? সেই রোদে জ্বলা খাঃ আঃ করা স্টেশন। যেখানে মানুষ তো বহুদূর, একটা কাক কুকুরও নেই।
এবার কি করবে জীবন? করার আর কিছু নেই চলা ছাড়া। যে করে হোক এখন একটা রেল স্টেশনে পৌঁছাতেই হবে যেখানে লোক জন আছে। যেখানে মেল ট্রেন যাত্রী তোলা নামানোর জন্য থামে। যেখানে ঘর বাড়ি দোকান পাট লোক জন কিছুই নেই সেখানে অপেক্ষা করা চরম মুখামি। তাই চালাকের মতো জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সোজা এগিয়ে যাওয়া রেল লাইন ধরে ধুঁকতে ধুঁকতে হাঁটে। হাটুর মালাইচাকি কন কন করছে, বুকে দাপাচ্ছে তৃষ্ণা, পেটে জ্বলছে আগুন, শরীর জ্বলছে রোদে, সব কিছু অস্বীকার করে সে উন্মাদের মত হেঁটে চলে। জঙ্গলের বানরগুলো অবাক হয়ে ওকে দেখে নিজেদের মধ্যে যেন কি বলাবলি করে। সে ভাষা অনুবাদ করতে পারলে জীবন হয়ত মানুষ সম্বন্ধে ওদের ধারণা জেনে মরমে মরে যেত।
সে যাই হোক শরীর তখন আর চলছে না। নিজের শরীর নিজের কাছে একটা বোঝা হয়ে গেছে। সেই বোঝা টেনে পরের স্টেশন গুলমায় পৌঁছাতে পারল, তখন ওর সামনে থেকে তির বেগে বের হয়ে গেল সেই চারটের আসাম মেল। সে ট্রেনও ওই স্টেশনকে যোগ্য বলে মনে করে নি এক মিনিট থেমে যাবার উপযুক্ত ভেবে।
ট্রেন চলে যাবার পর এই প্রথম একজন লোকের সাক্ষাৎ পেল জীবন। সে দু হাতে দুটো পতাকা যার একটা লাল একটা নীল, নিয়ে প্লাটফর্মে ধরে হেঁটে এসে জীবনের সামনে দাঁড়াল। ডানদিকে রেলের অফিস, সেদিকেই যাবে সে। ওদিকে গিয়েছিল ট্রেন পাশ করাতে। পতাকা নাড়িয়ে ট্রেনকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেওয়া তার কাজ।
জীনকে দেখে তার চোখে মুখে সারা শরীরে ঘনিয়ে উঠল চরম বিস্ময়। ঘন ঘোর জঙ্গল কুঁড়ে যে আসছে সে কে!
বলে সে–এ বাচ্চা, কাহা যায়েগা?
জীবন সরল গলায় জবাব দেয়–হাম আসাম যায়েগা।
তো পয়দল কিউ?
বলে জীবন–আমার কাছে তো গাড়ি ভাড়া নেই। তাই–
পতাকাবাহী লোকটার বিস্ময় আর সীমার মধ্যে থাকে না। একি পাগল নাকি। বারো, চোদ্দ ঘন্টার ট্রেন পথ আসাম। সেই আসামে যাচ্ছে পায়ে হেঁটে। পরের স্টেশনে পৌঁছাবার আগেই পথে রাত নামবে। জঙ্গল থেকে বের হবে শিকার সন্ধানী জন্তু জানোয়ার। তাদের সামনে পড়লে আর কি বাঁচবে?
বলে সে–আভি শিলিগুড়ি নেবালা ট্রেন হ্যায়। উসমে বইঠকে বাপস চলা যা। মরে গা কেয়া? আসাম বহুত দূর হ্যায় কেইসে যায়েগা পয়দল? আর বেশি কথা না বাড়িয়ে সে নিজের কক্ষে গিয়ে ঢোকে।
না, আর চলার ক্ষমতা নেই জীবনের। আজ আর আসাম যাবার কোন ট্রেনও নেই। এ স্টেশনের এখনই যা ভয়াবহ অবস্থা রাত নামলে কেমন হবে তার অনুমান করতে পেরে জীবন ভয়ে মুষড়ে পড়ে। এখন ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
ফিরে গেলে শিলিগুড়িতে আবার চেকারে ধরতে পারে। এক আধটা ধাক্কা কি চড় চাপড় দিতে পারে। জেলেও নিয়ে যেতে পারে। সে যা হয় তোক। এই ভেবে স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে এসে বসে সে।
ট্রেন এল সন্ধ্যে ঘোর করে। জীবন তখন আগপাছ না ভেবে উঠে পড়ল সেই ফিরতি ট্রেনে। সবকটা স্টেশনে থেমে থেমে সে ট্রেন পৌঁছাল শিলিগুড়ি। জীবন ট্রেন থেকে নেমে অগুনতি চেকার, পুলিশের সামনে থেকে হেঁটে ওভার ব্রিজের উপর গিয়ে ওঠে। এখন তার দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে জীবনের। সে বসে পড়ে ব্রিজের উপর। তারপর গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে এবং এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ তাকে বিরক্ত করে না। নিরুপদ্রবে রাতটা কেটে যায়। ব্রিজের উপর চিৎ শোয়া জীবন ঘুম ভেঙে চোখ মুছে প্রথমে আকাশ দেখতে পেল। একখানা কালো মেঘ উড়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কোথায় গিয়ে মাটির টানে নিজেকে ঢেলে রৌদ্র তাপে ফুটিফাটা মাটিকে নরম কোমল করে দেবে তা কে জানে। এ বছর এখনো বৃষ্টি হয় নি। তবে হবে। মেঘে মেঘে তারই বজ্রগর্ভ সঞ্চার। জল পেয়ে জমিতে জাগবেশস্যের সম্ভাবনা।শস্য জাগাবে মানুষের আশা আকাঙ্খ আর বেঁচে থাকার সম্ভাব্য প্রতিশ্রুতি। মানুষ বাঁচলে বাঁচবে মানুষের সমাজ সভ্যতা আর মানুষের যা কিছু নির্মাণ শিল্প সৃজন।
কিন্তু সময়ের গতি প্রবাহ ধারা সব এখন উল্টো দিকে ছুটছে। প্রাকৃতিক নিয়মকে বদলে দিয়েছে মানুষ। মানুষ তার চতুর কৌশলে খরা বন্যা মহামারী মন্বন্তর বানাতে পারে। পারে কৃত্রিম অভাব বানিয়ে মানুষের জীবনকে কষ্টকর মরণ যন্ত্রণার আকর বানিয়ে দিতে, জীবন নামক এক কিশোরের জীবন এখন সেই পাহাড় সমান যন্ত্রণার নিচে চাপা পড়ে ছটফট করছে।
চিৎ থেকে কাত হয়ে দেখতে পায় সে স্টেশনের উপরে যে মিষ্টির দোকান তার ঘাড়ে গর্দানে মালিক একঝুড়ি গতকালের অবিক্রিত সিঙ্গারা, নিমকি, কচুরি প্ল্যাটফর্মের বাইরে একটা একটা করে ছুঁড়ছে, আর মুখে আঃ আঃ করে কাক ডাকছে। তা দেখে জীবনের পেটের খিদে গন গন করে। কষ্ট পায়, কান্না আসে। সে জানে ওরা মানুষ না খেয়ে মরে গেলেও তাকে খাবারগুলো দেবে না। কাক কুকুরকে এইজন্য দেবে, কারণ, তারা মানুষ নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নাকি এই রকমই। এই ব্যবস্থায় মানুষের প্রতি মানুষের নাকি দয়া, মায়া, স্নেহ, প্রেম–এসব আবেগ প্রকাশের বিশেষ কোন ভূমিকা নেই। যা আছে তা লেনদেনের হিসেবী সম্পর্ক। কিছু দেবার আগে সেই অংক দিয়ে হিসেব নিকেশ করে দেখে নেবে। যা দেওয়া হবে তা লাভজনক হয়ে ফিরে আসবে কিনা।
এই গণিতের কারণে জীবন এখন একটা ফালতু মানুষ। তাকে কেন কেউ কিছু দেবে! তাই জীবনকে, তার মত হাজার হাজার মানুষকে, না খেয়ে থাকতে হবে।
জীবন এখন শোয়া থেকে উঠে বসে। উঠে বসতে বাধ্য হয়। এক থেমে যাওয়া ট্রেনের এক ব্যস্তযাত্রীর পায়ের বুটে তার হাতের আঙুল চেপে যাবার জন্য। তাকিয়ে দেখে সূর্য মাটি ছেড়ে আট দশ ফুট উপরে উঠে গেছে। যা এক বড় গাছের আড়ালে আছে বলে ব্রিজের উপর বিশেষ রোদ ফেলতে পারে নি। তখনই জীবন এক জনের কাছে জানতে চায়–ওইটা কোন গাড়ি? যাইবো কই? চলে যেতে যেতে বলে যায় সে, গৌহাটি মেল।
গৌহাটি মেল! থেমে থাকা ওই ট্রেনখানা সেই ট্রেন যে আসাম যাচ্ছে! জীবন ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে চারিদিকে তাকায়। আছে, একটা সুযোগ আছে। ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে দৌড়ে সামনের ওই ফাঁকা কামরায় উঠে পড়ায় কোন অসুবিধা হবেনা। চেকার পুলিশ সব প্লাটফর্মের উপর। একবার চলন্ত ট্রেনে উঠে গেলে ওরা আর কি করবে? যেই মত ভাবা, সেই মতো কাজ। একটু পরেই গার্ড সাহেব তার হাতের নীল পতাকা উড়িয়ে মুখের বাঁশি বাজিয়ে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল গাড়ি ছাড়ার। ড্রাইভার ইঞ্জিনের হুইসেল বাজিয়ে হুকুম মতো গাড়িকে চালাবার প্রস্তুতি নিল। জীবন ছুটে গিয়ে উঠে পড়ল একটা কামরায়। গাড়ির চলা শুরু হল। তখন সে তার সেই নিজস্ব স্থান উল্টোদিকের দরজায় গিয়ে বসে পড়ল। এ ট্রেন বড় অহংকারী। ছোটখাটো স্টেশনে থামে না। প্রায় আধঘন্টা চলার পর যেখানে থামে, সেসব জমজমাট স্টেশন, জংশন।
এভাবে প্রায় দুই তিন ঘন্টা চলবার পরে পৌঁছাল এক জংশনে। এখানে ইঞ্জিন জল ভরছে বা ইঞ্জিন বদল হচ্ছে সেই কারণে ট্রেন ছাড়তে বৈশ বিলম্ব হচ্ছে। বেলা এখন দশটা কি সাড়ে দশটা। এটা লোকেদের টিফিনের সময়। জীবন উল্টো দিকের দরজায় বাইরের দিকে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল। হঠাৎ তার চোখ গেল সামনের জানলার দিকে। জানলা থেকে একটা মোটা লোমশ হাত বাইরে বের হল। সে হাতে শাল পাতার একটা ঠোঙা। হাতটা বড় অবহেলায় সেই ঠোঙাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ওপাশের রেল লাইনের উপর। সেটা উঁচু থেকে নিচে পড়ার সাথে সাথে খুলে গেল। তখন দেখতে পেল জীবন, ওর মধ্যে রয়েছে মোটা মোেটা দেড়খানা আটার লালরুটি, সাথে কিছু ভাজাভুজি।
রুটি দেখেই মনে পড়ল জীবনের সে অনেকদিন কিছু খায়নি। এবং যেগুলো কেউ অবহেলায় বিসর্জন দিয়েছে, তা একটা খাদ্য। সেই মুহূর্তে জীবন তার আত্মা পরমাত্মাকে গলা টিপে হত্যা করে দিল। আর সে যা কোনদিন করেনি কোনও দিন করতে হবে বলে ভাবে নি তাই করে বসল। তড়াক করে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল রেল লাইনের উপর। তারপর ছুটে গিয়ে সেই ঠোঙাটা যেন কোনও বহুমুল্য ধন, এমনভাবে তুলেনিল। রুটি দেখে কটা ছাল ওঠা নেড়ি কুত্তাও সেটা অধিকার করবার আশায় ছুটে এসেছিলো। ওরা এই স্টেশনে থাকে, তাই জানে পৃথিবীতে এখনও এমন বহু মানুষ আছে যাদের কাছে ছুঁড়ে ফেলার মত প্রচুর ভাত রুটি থাকে। এখানে ট্রেন থামলেই তারা কিছু না কিছু ফেলে দিয়ে যায়। কুকুরেরা তাই ট্রেন এলেই লাইন ধরে হেঁটে হেঁটে বেড়ায়। ট্রেনের দরজায় জানালায় তাকায় কুঁই কুঁই করে। তারা এতদিন জানত যে মানুষ আর যাইহোক কুকুরের মতো হবে না কোন দিন। কিন্তু এখন দেখতে পেল মানুষের সমাজে মানুষের ছদ্মবেশে তাদের মত একজন কেউ লুকিয়ে আছে যে তাদের মুখের খাবার কেড়ে নিচ্ছে। মানুষ থেকে কুকুর হয়ে কুকুরদের বঞ্চিত করছে তাদের কুকুরিক অধিকার থেকে।
জীবনের এমন অমানবিক অন্যায় ব্যবহার দেখে এক যোগে ঘেউ ঘেউ করে প্রতিবাদ জানাল তারা। তেড়ে এল রুটির ঠোঙা কেড়ে নেবার জন্য। জীবন একা ওরা অনেক। জীবন নিরীহ নিরস্ত্র ক্ষুধার্ত কিন্তু ওরা আক্রমণে অভ্যস্ত। দাঁতে অনেক ধার আছে ওদের। সে পিছন ফিরে ছুট মেরে পালায়। পালিয়ে কিছু দুরে গিয়ে আর এক কামরায় উঠে পড়ে। বসে পড়ে আবার দরজায় পা ঝুলিয়ে। তারপর আস্ত মোটা লাল গমের রুটিখানা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে গন্ধ সোকে। মনে হচ্ছে যেন ঘিয়ে ভাজা। তবে আজকের নয় কাল কিংবা পরশুর। ভাজাভুজিও অতটাই পুরানো। তাই ইটের মত শক্ত আর পুরাতন ভাজাভুজি থেকে মিলে মিশে পাওয়া যাচ্ছে কেমন একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ। সে ঘ্রাণে যেন মানুষকে মানুষ থেকে কুকুরের পর্যায়ে নামিয়ে এনে অন্ততঃ একটা দিন কঠোর জঠর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার প্রলোভন আছে। সেই প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ করে জীবন।
রুটি খেয়ে পেট ভরে জল খাবার পর তখন আসে সেই আত্মগ্লানী যা আগে আসে নি। কে যেন তখন বুকের ভিতর কেঁদে ওঠে। ছিঃ ছিঃ করে, ধিক্কার দেয়। শেষকালে তোর এত অধঃ পতন। কুকুরের মুখের খাবার কেড়ে খেলি! নিজেকে আর কত নিচে নামাবি জীবন? কিন্তু অসহায় জীবন এখন এ কথার কি জবাব দেবে? দেবার মতো জবাব কি তার এখন আছে? সে কোন জবাব দিতে পারে না। হয়ত এ দেশের হাজার হাজার মানুষ এই যন্ত্রণায় ডাস্টবিন ঘেঁটে খাবার খোঁজে।
যে কামরায় উঠেছে জীবন সেটা বেশ ফাঁকাই। যার হারাবার মত কোন সম্পদ নেই কোনকিছু পাবার আশা, পথ, সম্ভাবনা নেই, জীবনের সব চাওয়া পাওয়া যার ফুরিয়ে গেছে, কোন রকম শোক, দুঃখ ব্যথা বেদনা যাকে আর বিচলিত করে না, সে ঈশ্বরের পায়ে ভবিষ্যতের হাতে নিজেকে সমর্পন করে, যা হবার তা হোক বলে বসে আছে, সেই সাধক তপস্বী বা নিরাশ হতাশ মানুষের মত জীবন দরজায় হেলান দিয়ে বসে থাকে। ট্রেন চলা শুরু করলে গায়ে এসে লাগে গ্রাম বাংলার মাঠ মাটি জলাভূমি জঙ্গলের ফুরফুরে হাওয়া।
জীবনের এখন ঘুম পায়। সে দরজার ডান দিকে গামছা পেতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ থাকায় জীবন এখন দেখতে পাচ্ছে না এখানকার প্রকৃতি পরিবেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অকৃত্রিম সৌন্দর্য্য। সামনে কিছু পাতলা গাছ গাছালির ওপারে দাঁড়িয়ে আছে যুগযুগান্তরের ঘুমন্ত পাহাড়। যার ন্যাড়া মাথায় সূর্যের আলো পড়ে আয়নার মত ঠিকরে যাচ্ছে। সেই পাহাড়কে যেন কেউ কোন অদৃশ্য নদীর উপর বসিয়ে দিয়েছে। যে নদীতাকে ভাটার টানে ছোট নৌকার মতো মোহনার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ট্রেন যত সামনে আগায় সে তত পিছনে ছোটে।
ট্রেনখানা কিছুক্ষণ চলার পর শুরু হয় আরো ঘন আরো গভীর বন। এক আদিম অনাবিল সবুজ অন্ধকার ঢেকে ফেলল এই অতিকায় যন্ত্রনখানাকে। শুধু জঙ্গলই নয় এরই সাথে রয়েছে ছোট খাটো পাহাড়। পাহাড় কেটে কোথাও কোথাও বানানো হয়েছে রেল যাত্রার লৌহ পথ। সেই পথে ঝমঝম বাজনা বাজিয়ে ছুটতে থাকে গৌহাটি মেল। আর জীবন চিন্তারহিত এক নির্বিকল্প সমাধিতে সমর্পিত হয়ে দরজার কাছে টানটান হয়ে শুয়ে থাকে। ঘুম নয় ওর যা আসে তা ঝিমুনি, তা যেন চোখ বুজে কোন পরিণতির জন্য প্রতীক্ষা।
যখন ওর ঝিমুনি কেটে গেল তখন বেলা একটু হেলে গেছে। দু’তিন ঘন্টা আগে পেটের এক সমুদ্র খিদের মধ্যে যে দেড়খানা রুটি পড়েছিল, তা কখন যেন গলে জল হয়ে গেছে। এখন আবার সেই পেট মোচড়ান শুরু হয়ে গেছে। আবার সেই চোখ কেমন ঘোলাটে হচ্ছে আর কান ঝা ঝাঁ করা ধরেছে। মানুষ তো অভ্যাসের দাস। আগে না খেতে খেতে সেটাই অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখন সে অভ্যাস নিজের দোষে নষ্ট করে ফেলেছে জীবন। জিভের এখন লোভ বেড়ে গেছে। সে আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারছে না।
হঠাৎ যেন জীবনের মনোকষ্টের কথা বুঝতে পেরে তার সামনে ঈশ্বরের প্রেরিত কোন মহান মানবের মত এসে দাঁড়াল একজন লোক। লোকটা মাঝবয়সী মাথায় কাঁচা পাকা চুল। মুখে মৃদু হাসি। দুটো চোখে যেন উপছে পড়ছে স্বর্গীয় মমত্ব। যা মানুষের সমাজে আজকে বড় দুর্লভ। গলায় তার গভীর আদর স্নেহ দরদ, এই বাচ্চা তুই কোথায় যাবি রে বাবা?
গ্রাম দেশের পাঠশালার মাষ্টার মশাইয়ের মত চেহারার এই লোকটার কথা শুনে, চোখ তুলে তাকাল জীবন। গলায় জোর ছিল না তার। রোগীর কাতরানোর মত জবাব দিল সে, এই টেরেন যেইখান যাবে, সেইখানে যামু আমি।
কোথায় যাবে এই ট্রেন তা জানিস?
মাথা নেড়ে জানায় জীবন, সে জানে। তারপর বলে আমি কামের তালাশে বাইর হইছি। যাইতে আছি আসাম। দেখি হেইখানে গিয়া যদি কোন কাম কাজ পাই।
কোথায় তোর বাড়ি?
বাড়ি নাই আমাগো। বাপ মা ক্যাম্পে থাকে।
ঘনিষ্ট হয়ে দয়াবান লোকটা জীবনের কাছ থেকে একে একে তার সব কথা জেনে নেয়। গাঠের পয়সা খরচ করে জীবনকে চা পাউরুটি মিশন খাওয়ায়।
মানুষ জীবন তার ছোট জীবনে অনেক দেখছে। কিন্তু এমন মানবিক ব্যবহার আর দেখে নি। কেউ তার সাথে এত দরদ ভরা আত্মীয় ভাষায় কথা বলে নি। তার নোংরা পোষাক অপরিচর্চা অনাকর্ষক চেহারা, তার দুরবস্থা সর্বদাই মানুষের ঘৃণা কখনো কখনো নামমাত্র অনুকম্পা জুটিয়েছে। কিন্তু এই গ্রাম্য শিক্ষক গোছের লোকটা যেন একটু অন্য ধরনের। সে যেন জীবনকে, তার অসহনিয় অবস্থাকে সম্যক উপলব্ধি করে সেই কর্তব্য করছেন যা প্রকৃত পক্ষে একজন দরদী মানুষই করতে পারে। তাই জীবন কৃতার্থ বোধ করে।
লোকটা কি এক বেদনায় কিছুক্ষণ মৌন হয়ে থাকেন। শেষে আবার বলেন–কাল থেকে কিছু খাসনি। আহারে! সামনের স্টেশনে আমি নামব। চল তুই আমার বাড়ি। কটা দিন আমার বাড়ি থেকে খেয়ে তারপর যদি আসাম যেতে চাস তো যাস। পথ খরচার কটা টাকা সে না হয় বাবার মত আমার কাছ থেকে নিয়ে নিবি। লোকটার কথায় প্রলোভন ছিল, সম্মোহন ছিল, দরদ ছিল যা এড়াতে পারে না জীবন। পরে স্টেশনে ট্রেন থামলে সে তার পিছন পিছন হেঁটে যায়। হেঁটে যায় জীবন আর এক অভিজ্ঞার দিকে। জীবন তো নিত্য নতুন এক যাত্রার মধ্য দিয়ে বিশ্ব জগতটাকে চিনে নেবার আর এক নাম। হোঁচট ঠোকরে ক্ষত বিক্ষত হয়ে পথে পথে রক্ত ছড়িয়ে যাবার নাম।
স্টেশনটা খুব বড় নয়, তবে একেবারে ছোটও বলা যাবে না। প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমে দক্ষিণমুখো ইট বিছানো রাস্তা। রাস্তার পাশে বেশ কিছু গাছ গাছালিতে ঘেরা ছায়াদার পরিবেশ। সেখানে বৈকালিন বাজারের আয়োজন। স্থানীয় চাষীরা তাদের ক্ষেত্রের নানাবিধ ফসল নিয়ে এসেছে বেচতে। সে সব ছাড়িয়ে সামনে আগালে কিছু জামা কাপড় শাড়ি সায়ার দোকান। দরিদ্র অঞ্চলের দরিদ্র দোকান। দোকানদারও তত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জাত ব্যবসায়ী শ্রেণির নয়।
দোকানে ঢুকে লোকটা দোকানদারকে বলে, ভাল দেখে শাড়ি দেখাও তো দুটো নেবো। আর আমার এই ছেলেটার জন্য একটা প্যান্ট একটা জামা। দামী জামা প্যান্ট জীবনের অঙ্গে কখনো ওঠেনি। জামা প্যান্টের রঙ দেখে দাম শুনে সে আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওঠে। কিন্তু হাতে নেবার আগেই বলে লোকটা, তুই এক কাজ কর, আগে চুলটা কেটে নে। আমি ততক্ষণে তোর মায়ের জন্য শাড়ি দেখি।
সেলুন রাস্তার ও পাশে। জীবনকে সেখানে বসিয়ে দিয়ে এসে ফের শাড়ি বাছাই করে লোকটা। দাম নিয়ে তার কোন মাথা ব্যথা নেই। ভালো জিনিসের তো ভাল দাম হবেই। চিন্তা একটাই, বউয়ের পছন্দ হবে কিনা। অনেক বেছে অনেক ভেবে শেষে বলে সে–এক কাজ করো ভাই, যদি কোন অসুবিধা না হয় গোটা চার পাঁচ শাড়ি আমাকে দিয়ে দাও। এই তো পাশেই আমার বাড়ি, যেতে পাঁচ মিনিট আসতে পাঁচ মিনিট। দু-তিনটে যা বউ পছন্দ করবে রেখে দেব। ছেলেটার চুল কাটা হয়ে গেলে এখানে বসতে বোলো।
দোকানদার সরল সোজা মানুষ। অনেক কটা শাড়ি বিক্রির লোভে সে আহ্লাদিত। তা ছাড়া যার ছেলে এখানে থাকছে তাকে অবিশ্বাস কীসের। সে লোকটাকে যেতে দেয়।
এ সব কথা জীবন সেলুনে থাকার জন্য শুনতে পায় নি। তাকে শোনাবার জন্য তো বলা হয়নি। শুনলে স্রেফ শব্দ, বাক্য থেকে নিহিত মর্মার্থকী বুঝতে পারত। যে বয়স মানব চরিত্রের এই অনাবিষ্কৃত রহস্য অনুধাবন করায় সে ক্ষমতা তার কি তখনো হয়েছে। সে বুঝতে অল্প কিছু সময় বাকি ছিলো। জীবন সেলুন থেকে বের হবার পর কাপড় দোকানদার ডাকে–এই ছেলে এখানে এসো বসো। তোমার বাবা এক্ষুণি আসবে। সেলুন অলাকেও বলে দেয় সে–একটু পরে এর বাবা এসে পয়সা দেবে। তার এই
জীবনের আর কি করার আছে অপেক্ষা করা ছাড়া? এক ঘন্টা দু’ঘন্টা করে সময় কেটে যায়। বিকেল ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধ্যা ঘনায়। সে আর আসে না। সে ফেরেনা বলে দোকানদারও জীবনকে দোকান ছেড়ে নড়তে চড়তে দেয় না। বলে তোর বাপ না এলে তোকে ছাড়ব না। কোথায় কত দুরে বাড়ি তোদের? বাজারের চারদিকে খবর ছড়ায়। বহুলোক ভিড় করে জীবনকে ঘিরে। চলে জিজ্ঞাসাবাদ চলে চড় চাপড়। চোর চিটিংবাজের যা সাজা। এক প্রস্ত সাধারণ মারের পর তাকে চালান করা হয় বাজার কমিটির দপ্তরে। শুরু হয় অসাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ। সে যত বলে আমি লোকটাকে চিনি না, ট্রেনে আলাপ, কেউ সে কথা বিশ্বাস করে না। যত বিশ্বাস করে না তত “সত্য” জানবার চেষ্টায় নির্দয় হয়ে ওঠে কমিটির মানুষ। কার যেন একটা জোরালো ঘুষি এসে পড়ে জীবনের বুকে, বল তোর দলের লোক কোথায় গেছে? অনাহারে দুর্বল ক্লান্ত জীবনের ছোট্ট শরীর সে সজোর ঘুষির ধকল সহ্য করতে পারে না। মাটিতে আছড়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। জীবন তার এই অল্প পরিধির জীবনে অনেকবার মার খেয়েছে কিন্তু অজ্ঞান কখনো হয় নি। অজ্ঞান হবার একটা মস্ত সুবিধা যে তারপর মারলে আর কষ্ট হয় না।
যখন তার জ্ঞান ফেরে দেখে মাথা মুখ সব ভেজা।এ সব জ্ঞান ফেরাবার জন্য সাধারণ জনতার সাধারণ উপাচার। জীবন অজ্ঞান হবার পর শালা নাটক করছে ভেবে আর দু এক ঘা দেবার পরও যখন সে নড়ে না, তখন তারা চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়েছে। মরে ফরে গেলে মহা হ্যাপা হবে ভেবে দোকানদার জীবনের জ্ঞান ফেরার পর তাকে গরম দুধ খাইয়ে, নিজের অদৃষ্টকে যথেচ্ছা গালাগালি দিয়ে, যা ক্ষতি হয়েছে মেনে নিয়ে, আর না ক্ষতি হোক সেই কারণে ওকে স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে তুলে দেয়। সে ট্রেন গৌহাটি যাবে। যে ট্রেন বিকেল চারটেয় নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ছেড়ে রাত দশটায় এখানে পৌঁছেছে। মার খেয়ে যতটা কষ্ট হয়েছিল তার খানিকটা কমে গেল আসাম যাবার ট্রেনের কামরায় উঠে। ওরা বলাবলি করছিল পুলিশে দিয়ে দেবে, জেল খাটাবে। তা যখন করে নি সেটাকে জীবন নিজের পরম ভাগ্য বলে মন করল এখন। এই রাত আঁধারে ওরা মেরে রেল লাইনে শুইয়ে দিলেই বা তার কি করার ছিলো। তাও বলে ছিল ওরা। তোর দলের আর একজন কোথায় থাকে বলে দে। না হলে মেরে লাইনে শুইয়ে দেবো।
রাত দশটায় ট্রেনে উঠেছিল জীবন। একরাশ দুশ্চিন্তা আর এক পাহাড় শারীরিক কষ্ট নিয়ে সে এখন পায়খানা বাথরুমে যাবার গলির মধ্যে থুতু ধুলো বিড়ির টুকরো বাদাম খোলা লেবুর খোসা শাল পাতা, ছেঁড়া কাগজের টুকরো ইত্যাকার আবর্জনার মধ্যে শুয়ে পড়ে। যা ভাগ্যে আছে এর বাইরে সে আর কিছু ভাবতে পারে না। ভাবতে চায় ও না।
… ঝমঝম করে চলছে রাতের ট্রেন। এখন ট্রেনে সেই দিনের মত চেঁচামেচি নেই। এক আধঘন্টা নাগাড়ে চলবার পর কোথাও গিয়ে ট্রেন থামে। তখন একদল নেমে যায় আর একদল ওঠে। তাদের ছেড়ে যাওয়া স্থান দখল করে। জীবনের সে সব দিকে কোন খেয়াল দেবার দরকার পড়ে না। সে শুয়ে থাকে সেই অনারোগ্য রোগের রোগীর মত যাকে ডাক্তার বলে দিয়েছে কোন আশা নেই। ভগবানকে ডাকো, যা কিছু করার সেই করতে পারে। সবটা এখন তারই হাতে।
নিজের জন্য জীবনের যা যা করার ছিল সবটা সাধ্যমত করেছে। এর মধ্যে কোন ফাঁকি চালাকি নেই। আর তার করার মত কিছু নেই। এবার যা হবার তা হোক। তার আর কোন ভয় ভাবনা চঞ্চলতা উত্তেজনা কিছুই থাকে না। চুপচাপ কুকুর কুণ্ডলি পাকিয়ে মরার মতো পড়ে থাকে। লোকেরা তাকে ডিঙিয়ে পায়খানা বাথরুমে আসা যাওয়া করে। রাত বাড়ে।
টিকিট।
চোখ কচলে তাকায় জীবন শব্দ লক্ষ্য করে। সামনের আলো আঁধারিতে দণ্ডায়মান কালো কোট পড়া গুফো ষণ্ডা চেহারার এক চেকার। শুয়ে শুয়ে হাত নাড়ে জীবন–নেই।
উতার যা!
কোথায় কোন এক অন্ধকার স্টেশনে দাঁড়িয়েছে ট্রেন। বাধ্য ছেলের মত সেখানে নেমে পড়ে জীবন। দু’চার বগি পার হয়ে গিয়ে ফের একটা কামরায় উঠে আবার সেই একই ভাবে একই জায়গায় গিয়ে শয্যা নেয়। কিছুক্ষণ ট্রেন চলার পর আবার এক অন্য চেকারে তাকে নামিয়ে দেয়। যথারীতি জীবনও আর এক কামরায় গিয়ে ওঠে। এভাবেই সকাল হয়।
বেলা দশ কী এগারোটায় ট্রেন এসে পৌঁছাল সেই কাঙ্খিত ধাম। আসাম এর এক শহর গৌহাটিতে। এসময়ে প্লাটফর্ম বেশ কঁকাই। সামান্য কিছু লোক এদিক সেদিক ঘুরছে, জটলা করছে। স্টেশনের স্টলগুলোয় তেমন একটা খদ্দরের ভিড় নেই। সব যেন জাবর কাটছে এমন অলসতা ছেয়ে আছে। সেগুলোকে বৃত্ত করে একজন নীল প্যান্ট নীল জামা পড়া বুড়ো ঝাড়ুদার লাঠির ডগায় বাধা ঝাটা দিয়ে প্লাটফর্ম ঝাট দিচ্ছে। স্টেশনটা বেশ সাফসুতরো। পাগল মাতাল জুয়াড়ি ভিখারি দেখা যাচ্ছেনা এখানে। জীবন মন্থর পায়ে প্লাটফর্ম থেকে বাইরে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ায়। রোদ এখন বেশ কড়া হয়ে নামছে। সে রোদে যেন খা খা করছে চারদিক। দূরে দেখা যাচ্ছে আকাশের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সার সার ছোট বড় পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে সবুজ পত্রসার বৃক্ষ। কিন্তু এখন প্রকৃতির এসব দৃশ্যপট মুগ্ধ হয়ে দেখবার সময় নয়। এখন মাথার উপর যেমন সুর্য জ্বলছে পেটে জ্বলছে ক্ষুধার আগুন। জঠরাগ্নি নির্বাপণের জন্য এখন একটু খাদ্য দরকার। কিন্তু সে তো কেউ এমনি এমনি দেবে না। রাজা বলেছিলো, এখানে নাকি পথে ঘাটে পয়সার ছড়াছড়ি। স্টেশনের বাইরের জগতটা দেখে তার কথার উপর কেন কে জানে ভরসা থাকে না জীবনের।মনে কুডাক ডেকে ওঠে। এস্থানও কলকাতা নিউ জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ির চেয়ে আলাদা কিছু নয়। পথ ঘাট ঘর বাড়ি দোকানপসার মানুষ জন সবই তো সেই এক রকম। মনে হয় জীবনের যে আশায় বুক বেঁধে সে বহু ক্লেশ সয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে সে আশা আশাই রয়ে যাবে। কোন সার্থকতার সংবাদ বহন করে আনবে এখনো তেমন প্রত্যয় হয় না।
সে যা হোক এখন জীবনের এক মুঠো খাদ্য দরকার। বাদবাকি ভাবনা তার পরে। এখনই শরীর ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছে। আজকেও কিছু খেতে না পেলে কাল আরো দুর্বল হয়ে যাবে। পরশু নিজেকে আর দুপায়ের উপর দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না। তারপরের দিন শুয়ে পড়তে হবে। এ সব জীবন জানে, তাই এখনই শরীর আরো বেশি অক্ষম হয়ে যাবার আগে যে করে হোক একটু কিছু খাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
এখানে তার সহজ পথ কি? পথ একটাই কোন হোটেলে রেস্টুরেন্টে চা দোকানে যা সে পারে সেই থালাগেলাস ধোবার কাজে লেগে পড়া। মোট কথা এখন একটা কাজ চাই। যা হোক আর যেমন হোক দুটো খেতে পেলেই চলবে। যদি মাইনে ফাইনে না পাওয়া যায় সে আর কি করা যাবে। সে সেই আশায় বড় রাস্তা ধরে হেঁটে সামনে আগায়।
আপনে গো কামের লোক লাগবে?
রাস্তার বা পাশে এক পাঞ্জাবির বড় দোকান। চা মিষ্টি নোনতা শো কেসে সাজানো রকমারি খাবার। খদ্দের যেন উপছে পড়ছে। পাঁচ ছয় জন কর্মচারী ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। সেই দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দোকানদার ওকে ভিখারি ভেবে কুকুর খেদা দেয়, যা! ভাগ। নেহী তো বদনপে গরম পানী ডাল দেগা। তখন বলে জীবন, মুই ভিখারি না, কামের তলাশে আইছি। আগে এক মিষ্টির দোকানে কাম করেছি। বেবাক কাম জানি।
হিন্দিতে জানতে চায় মাথায় পাগড়ি মুখে দাড়ি হাতে বালা পড়া মধ্যম বয়সি দোকানদার–কোথায় কাজ করেছিস?
শিলিগুড়ি।
শিলিগুড়ি থেকে সোজা আসাম!
চব্বিশ ঘণ্টার ট্রেন যাত্রা করে এতপথ পাড়ি দিয়ে মিষ্টির দোকানে কাজ করতে আসায় দোকানদার বিস্মিত–শিলিগুড়িতে আর দোকান নেই?
ফালতু কথায় নষ্ট করবার মতো সময় আমার হাতে নাই। আপনে কাম দিলে কন। মাইনা ফাইনা লাগবে না, শুধু খাওয়া। নইলে আমি যাই।
এখানে তোক কে চেনে?
ক্যামনে চেনবে আইজই তো আইছি।
তাহলে কাজ হবে না। চুরি ফুরি করে পালালে তখন কি করব। যাও রাস্তা মাগো, আগে বাড়ো।
সময়টা সেই সময় যখন আসামের ভাগ্যাকাশে দেখা দিয়েছে একখণ্ড কালো মেঘ। যা অচিরেই বঙ্গাল খেদাও নামক এক সুপার সাইক্লোন হয়ে আছড়ে পড়বে আসামের সর্বত্র। ডিগবয় ডিব্ৰুগড় তিনসুকিয়া জোড়হাট গৌহাটি জুড়ে এক বিধ্বংসী তাণ্ডব চলবে প্রায় এক দশক ধরে। ঘর বাড়ি পুড়বে, দোকান লুঠপাট হবে, মানুষ মরবে। ইতিমধ্যেই তার কিছু কিছু লক্ষণ প্রকাশ হতে শুরু করেছে। কদিন আগে এখানে অহমিয়া আর বঙ্গালে তুমুল এক সংঘর্ষ হয়ে গেছে। পথে পথে এখনো পড়ে আছে ইটের টুকরো সোডার বোতলের ভাঙা কাঁচ। সেই পথ মাড়িয়ে বেঁচে থাকার এক আদিম অভীপ্সায় সামনে আগায় এক অনাহারী বালক।
কাজ একটা চাই। আসামে যখন পৌঁছানো গেছে কটা দিন এখানে থাকার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। তারপর খুঁজতে হবে কামরূপ কামাক্ষার সেই মন্দির। যার চারদিকে নাকি ঘিরে আছে ফণীমনসার দুর্ভেদ্য জঙ্গল। যে জঙ্গল পার হওয়া মানুষের পক্ষে অতীব কঠিন। সেই মন্দিরকে নাকি পাহারা দেয় সুন্দরী সুসজ্জিত প্রমিলা বাহিনী। যারা যাদু মন্ত্র জানে। তারা নাকি নাগালের মধ্যে কোন পুরুষ লোককে পেলেই মন্ত্র শক্তিতে ভেড়া বানিয়ে রাখে। এত বাধা বিপত্তি ঠেলে যদি কোন সাহসী মানুষ সেখানে পৌঁছে যেতে পারে আর কোনভাবে শিখে নিতে পারে কিছু মন্ত্র, তখন সারা পৃথিবী তার হাতের মুঠোয় চলে আসে। এ সব গল্প ছোট বেলা থেকে বহুবার শুনেছে জীবন। এই জীবনের আর কি দাম? কুকুরের মুখ থেকে খাবার কেড়ে খেয়ে কুকুর গোত্র তো হয়েই গেছে। এখন যদি তাকে কেউ ভেড়া বানিয়ে দেয় তো দিক না। ভেড়া এমন কী খারাপ জীব। ভেড়ারা আর যাই হোক না খেয়ে তো থাকে না।
রাস্তা ধরে এই সব ভাবে আর সামনের দিকে হাঁটে এবং কোন হোটেল রেস্টুরেন্ট মিষ্টির দোকান দেখলে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। জানতে চায়, আপনের দোকানে কামে লোক লাগবে?
আমি বড় দুঃখী গো বাবু। বড় গরিব। কেউ আমাকে রাখো না কোনও কাজে। আমার বাবা এক বস্তা ধান একা মাথায় তুলে দুক্রোশ পথ বয়ে নিয়ে যেতে পারত। সেই বাপের ছেলে আমি। খুব খাটতে পারি। আগে যেখানে কাজ করেছি আমার পরিশ্রম দেখে সবাই ধন্য ধন্য করেছে। নেবে আমাকে কেউ?
কে নেবে। কেন নেবে? সময় বড় সংক্রামক বড় সন্দেহজনক। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। কে জানে যদি সুযোগ পেলে সব কিছু ফাঁকা করে পালিয়ে যায়। যারা সৎ যারা সাবধানী তারা অচেনা অজানা লোক বিষয়ে বড় ভীত। জানতে চায়, কে তোমাকে চেনে! কে গ্যারান্টি নেবে তোমার সতোর!
নেই তেমন কেউ জীবনের জন্য সারা আসামে, শুধু আসাম কেন সারা ভারতে সারা পৃথিবীতে নেই। কেউ বলবে না, একে আমি পরিপূর্ণভাবে চিনি, কেবল চিনি না, এর সততা সম্বন্ধে একশো ভাগ নিঃসন্দেহ।
তাই সৎ সাবধান ভীত লোকেরা এমন উটকো লোককে কাজে রাখবে না। তবু হাল ছাড়তে পারে না জীবন। হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বিদেশের পথে বসে পড়ায় সমস্যার কোন সমাধান হবে না। সেটুকু বোঝে সে। তাই স্রেফ আশা আঁকড়ে আবার সামনে আগায়।
সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর। তার শরীর গলে গলে যেন আগুন হয়ে নিচে নামছে। সে আগুনে জীবনের সারা দেহ জ্বলে যাচ্ছে। আগুন তো জীবনের পেটেও। নাড়ি ভুড়িগুলো যেন আগুনে পোড়া অজগরের মত মোচরাচ্ছে। আর যেন দেহটা দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। যেন এখনই গোড়া কাটা গাছের মতো লুটিয়ে পড়বে। সেই শরীরটাকে শামুকের খোলের মতো টেনে এনে দাঁড় করায় ভাঙা চোরা একটা দোকানের সামনে। এটা এক বিহারির চা দোকান।
এখানে চা হয় বটে তবে তার আসল ব্যবসা দুধের। জাতে যাদব। লোকটা দোকান দোকানে দিয়ে অবশিষ্ট যা দুধ থাকে তা দিয়ে দুই পাতে। দইয়ে লস্যি হয়। এই দোকানে বলা মাত্র কাজ পেয়ে যায় জীবন। হ্যাঁ হ্যাঁ কামমে তো আমি চাহিয়ে।
লোকটার উৎসাহ দেখে জীবন বলে–মাইনা দিবেন?
জরুর জরুর কিউ নেহি দেগা!
কত দিবেন?
কিতনা লেগা?
না, আপনে কন কত দিবেন?
দোটাইম খানা এক টাইম নাস্তা আউর মহিনামে বিশ দেনে সে চলেগা?
চলেগা কি দৌড়েগা। মনে মনে ভাবে জীবন-কাজ যা হোক আর যেমনই হোক মাইনেটা মাসে মাসে পেলে আর কোন কথাই নেই। যদি কেউ তাকে ঠকাতে চায় এক মাসের বেশি ঠকাতে পারবে না তাহলে। আর কাউকে বিশ্বাস করতে মন চায় না। বিশ্বাস কথাটা যেন মরে পচে ফালতু হয়ে গেছে ওর অভিধানে। কুকুর তুল্য জীবন ওকে শিক্ষা দিয়েছে মানুষের সমাজে তার মত মানুষের জন্য কোন সমবেদনা সহানুভূতি দায় দরদ আর অবশিষ্ট নেই। সে এই সময় সমাজের কাছে অবাঞ্ছিত অনভিপ্রেত একজীব। তাকে যে যতটুকু পারবে সুযোগ পেলে ঠকাতেই থাকবে। তাই এখন সময়টা একটু অনুকূল বিবেচনায় সে নিজের দুর্বলতা গোপন রেখে শর্ত চাপায়-মাহিনা কিন্তু মাসে মাসে নিমু।
দরাজ গলায় গ্রাম দেশের যাত্রা দলের শকুনি মামার মত চেহারার রোগা ছুঁচলো কাঁচা পাকা মোটা গোঁফের মালিক লুঙ্গি ফতুয়া পড়া বিহারি দোকানদার বলে–লে লেনা মাহিনা মাহিনামে। ইসমে মেরাহি আচ্ছা হ্যায়। জাদা বোঝ নেহী পড়ে গা।
কাজে নিযুক্ত হল জীবন। কাজ বলতে দুধের ড্রাম মাথায় করে লোকটার পিছন পিছন হাঁটা। আড়াই মোন ধানের বস্তা বওয়া বাপের ছেলে কুড়ি কিলো ওজনে ঘায়েল হয় না। কিন্তু ঘায়েল হয়ে যায় দুপুরে রাতে খাবার পাতে বসে। গোয়ালা লোকটার দেশে বউ মেয়ে সব আছে। এখানে সে থাকে তার দুই ছেলেকে নিয়ে। ছেলে দুটো মোষ চড়াতে মোষ দুইতেই ওস্তাদ নয়, লাঠি চালানো কুস্তি এসবেও সমান দক্ষ। সারা শরাবভাট্টি অঞ্চলে তাদের সমকক্ষ পালোয়ান আর একজনও নেই। রোজ সকালে তারা নিয়ম করে বুকডন ডনবৈঠক মারে। আর বিকালে যায় কুস্তির আখরায়। ধোবিপাট খেয়ে থোবিপাট দিয়ে তারা যখন ঘরে ফিরে খেতে বসে প্রায় দিনই ভুলে যায় যে খাবার লোক একজন বেড়ে গেছে। যার জন্য কিছু ফেলে রাখার দরকার আছে। বিহারিরা বাঙালীদের মতো ভাতের ভক্ত নয়, ছাতু রুটি তাদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু জীবনের ভাতের জন্য বড় প্রাণ আনচান করে। সে কষ্ট যদি বা ভোলা যায়, না খাওয়ার কষ্ট ভোলে কি করে! বিশেষতঃ যখন দুটাইম খেতে দেবার কড়ারে তাকে দিয়ে শহরময় বোঝা বওয়ানো হয়।
আরো একটা কারণে সে বড় কাতর হয়, সেটা কামাখ্যা দেবীর মন্দিরদর্শন করে ফেরত আসা তীর্থযাত্রীদের কথপোকথনে। কোথায় জাদু মন্তর বাপ! কোন কালে তা থাকলেও থাকতে পারে। এখন ওসব কিছু আর নেই টেই।
একটু একটু করে জীবনের কিশোর চৈতন্য বাস্তবতার কঠোর আঘাতে অলীক উড়ান থেকে যথার্থতার ধরাতলে নেমে আসে। চারদিকে তাকায়। স্টেশন থেকে এই শরাবভাট্টির চৌমাথা পর্যন্ত। চারপাশে অসংখ্য অনাহার অভাবজনিত নত নজ মানুষ। তথাকথিত জাদুর দেশে বাস করেও যাদের আজো সেই জাদুকাঠির সন্ধান জানা হয় নি, যা জানলে জীবন সুন্দর হয় সম্পন্ন হয়। পেট পিঠের সাথে সেঁটে যাওয়া, বুকের হাড় দাঁত বের করে ভেংচি কাটা সেইসব মানুষের স্বপ্নহারা দুচোখ জুড়ে শুধু অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কালো ছায়ার নাচন। মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা কথা বলেছে রাজা। কোথায় এখানে পথে পথে পড়ে থাকা সেই তামার টুকরো, যাকে পয়সা বলে! যা দিয়ে পেটের ভাত পরনের ন্যাতা পাওয়া যায়? নেই, এখানেও ওসব নেই। নেই বলেই এখানেও মানুষ অভাবে আছে। অনাহারে আছে।
তবে আর আসামে থেকে কি হবে! চিনির বলদ যেমন সারা জন্ম চিনির বোঝা বয় কিন্তু এক দানা চিনি খেতে পায় না। বড় দুধের ড্রাম মাথায় করে বওয়া জীবন জানেনা দুধের স্বাদ কেমন। যে মানুষ কিলো কিলো দুধের যোগানদার সে নিজেই এক ফোঁটা দুধ মুখে তোলেনা, আর জীবন তো সাধারণ এক চাকর মাত্র। কেন তার পেছনে হিসেবি মালিক অপচয় করবে সেই দ্রব্য যা দামে বিক্রি হবে।
মানুষের সমাজে এক বিচিত্র নিয়ম আছে। যে ময়রা মিষ্টান্ন তৈয়ারি করে সেমিষ্টি খায় না।সে ছোটে তেল মশলা ঝাল কোন খাবারের দিকে। যে দোকানদার তেলেভাজা ভাজে, সে বড় আয়েশ করে মুড়কি বাদাম ছাপা খায়, তেলেভাজা মুখে তুলতে রাজি হয় না। সেই নিয়মে কিনা কে জানে। এই দুধওলা কোনদিন দুধ খায় না। সে সন্ধ্যে হলে ছোটে দেশী মদের দোকানে। আর মদ খেয়ে একটু নেশা হয়ে গেলে সে কবে কোন কালে একবার কলকাতা গিয়ে কিছু কাল ছিল তখন বাঙালিরা তার সাথে কি দুর্ব্যবহার করেছে সেই কথা তার মনে পড়ে যায়। আর তখন অকারণেই জীবনকে স্রেফ বাঙালী হবার অপরাধে যাচ্ছেতাই গালাগাল দেয়। বাঙালী নামক এই জাতটার যে এতদোষ তা আগে জীবন জানত না। এই জাতটার মেয়েদের সতীত্ব বলে কোন জিনিস নেই। তাগড়া পুরুষ পেলেই নাকি তার কাছে শুয়ে পড়ে। খাদ্যাখাদ্য বিষয়ে কোন বাছ বিচার নেই। মাছ তা সে যে কয়মাসের পচা হোক, খেয়ে নেয়। এমনিতে দুর্বল, কিন্তু ঝগড়া কোন্দল পেলে নাওয়া খাওয়া ভুলে তাতে মেতে থাকে। আর মিথ্যা ছাড়া সত্যি কোন দিন বলে না। যার খায় তার দেয় না। এমন যে দুধ, তার দাম পর্যন্ত মেরে দেয়। প্রায় রোজই এত বাঙলী নিন্দা শুনতে শুনতে কান যেন ঝালাপালা হয়ে যায় জীবনের।
অন্য কেউ হলে হয়তো কবে পালিয়ে যেত। কিন্তু জীবন পালাই পালাই মন নিয়েও পাঁচ মাস টিকে যায়। কারণ একটাই। লোকটা মাসের দশবারো তারিখ হলেই জীবনকে তার মাস মাইনের টাকা ধরিয়ে দিত। যক্ষের ধনের মত জীবন তার সেই কষ্টার্জিত টাকা শোবার বালিশের মধ্যে লুকিয়ে রাখত। মা বাবার কাছে পোস্টাপিস মারফত টাকা পাঠাবার কায়দা তখন তার জানা ছিল না। ভয় করত টাকাটা হয়ত পৌঁছাবে না ঠিকানা পর্যন্ত। পথেই মার পড়ে যাবে। তাই ভাবনায় ছিল আর সামান্য কিছু জমে গেলে বাসায় গিয়ে মায়ের হাতে দিয়ে আসবে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হল না। যত সাবধানে গোপনে টাকাটা সে লুকিয়ে রাখুক, তা আসলে গোপন ছিল না। যাদের সঙ্গে তার সারাদিন কাটে তারা জানতো। কিছু টাকা জীবন এটা সেটা কিনে, খেয়ে খরচ করে ফেলেছিল। রাখা ছিল নীল রঙের একটা একশো টাকার নোট। এক সকালে দুধ বওয়ার কাজ শেষ করে দোকানে ফিরে এসে দেখে বালিশের মধ্যে থেকে টাকা উধাও হয়ে গেছে। তখন দোকানে ছিল দোকানদারের ছোট ছেলে। এত কষ্টের ধন চুরি চলে যাওয়ায় জীবনের আর মাথার ঠিক ছিল না। সে সরাসরি ছোট ছেলের দিকে আঙুল তুললো–তুমি নেছো। আর কেউ না, তুমি। যাওনের আগে আমি দেইখ্যা গেছি, হেয়ার পর ঘরে আর কেউ ছেলে না। আমার টাকা ফেরত দাও।
চুরি ততটা লজ্জার নয়, যতটা চোর বদনামে। মাথা গরম হয়ে গেল আখড়ায় কুস্তি লড়া ছোট পহেলবানের। “শালা হামারা খাতা হ্যায় হামারা পিতা হ্যায় আউর হামিকো চোরবোলতা হ্যায়।” জীবনকে সে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাস্তায়-যা শালে কুত্তা, ভাগ, নেহি তো মারকে তবিয়ত বিগাড় দেগা। ভেবেছিল জীবন, আশে পাশের মানুষ, বিশেষ করে দুপাঁচজন বাঙালী যারা আছে তারা ওর পাশে এসে দাঁড়াবে। কেউ অন্ততঃ বলবে, এটা অন্যায়। গরিব বেচারার টাকাটা দিয়ে দাও। কিন্তু তেমনটা ঘটলো না। দূরে দাঁড়িয়ে অনেকে জীবনের কান্না দেখে মজা করল। কেউ কষ্টও পেতে পারে। তবে সামনে এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করল না। আবার আর একবার পাঁচ ছয় মাসের নিষ্ফল প্রচেষ্টার পর কপর্দকশূন্য অবস্থায় পথে পড়ল জীবন।
এখন বেলা প্রায় তিনটে বাজে। পথঘাট একেবারে ফাঁকা। এমনিতে এ অঞ্চলের জনবসতি ততটা ঘিঞ্জি নয়। শহর কলকাতার ভিড় দেখা চোখে এখানকার ভিড় শিশু। ভগ্ন মনে একরাশ শূন্যতা নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে স্টেশনে আসে জীবন। কোথায় যাবে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। এমন একটা মানুষের মুখ চোখে পড়ে না, যার কাছে গিয়ে কেঁদে পড়া যায়। বলা যায় নিজের দুঃখের সাতকাহন। আশা করা যায়, সে এমন একটা কাজ কথা উপদেশ দেবে যাতে জীবনের এই হাল ভাঙা পাল ছেঁড়া তরণীখানি একটু কুল ছোঁয়। একটু মাটি পায়। যে মাটিতে শিকড় চারিয়ে বেঁচে থাকে ছোট বনস্পতি।
পৃথিবীর কাছে জীবনের আর কোন আশা নেই, দাবি নেই। শুধু দুবেলা দুমুঠো অন্ন, এক টুকরো মোটা কাপড়, মাথার উপর একটু ছাউনি–সেটুকুই যে কৃপণ পৃথিবীর কাছে অনেক বড় দান। কিছুতেই সে মুঠি আলগা করতে রাজি নয়। বাবা বলত ক্ষুধা দিয়েছেন যিনি আহার জোগাবেন তিনি। কাঠের মধ্যে ঘুন পোকা থাকে ঈশ্বর তাকেও অভুক্ত রাখেন না। তাকে বলেছিল তার বাবা। তোতা রটনের মতো দুখ কষ্ট অভাব অনটনের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে, বিনা অসুখে পেটের ব্যথায় কাটা ছাগলের মত ছটফট করতে করতে, অনাহারে মরে যাওয়া শিশু কন্যার মৃতদেহের সামনে বসে চোখের জল ফেলতে ফেলতে, নিবস্ত্র স্ত্রীর লজ্জা নিবারণের জন্য এক খণ্ড ন্যাকড়া জোগাড় করবার অক্ষমতায় হাহুতাশ করতে করতে, কোন বিশ্বাসে নিজের কাছে এসব বলেছিল তা এক জব্বর ধাঁধাঁ। জীবন যে ধাঁধার অর্থ আজো জানে না। কোথা সেই মঙ্গলময়ের মঙ্গল বাসনা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। সে কোনদিন কারো কাছে বলতে পারবে না, ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করে থাকেন।
কিছুক্ষণ গৌহাটি স্টেশন বসে কিছু সময় কাটিয়ে শেষে যে ট্রেনখানা তখন ছাড়ছে সেটায় উঠে বসে। কেন উঠে বসে কোথায় যাবে কেন যাবে তার কোন উত্তর জীবনের কাছে নেই।
এ ট্রেনে অসম্ভব ভিড়! কামরার মধ্যে গাদাগাদি মেরে গেছে যাত্রীতে। এত ভিড় ট্রেনে চেকার ওঠে না। কত ধাক্কা সহ্য করবে! একদিন দুদিন তো নয় রোজকার কর্ম। জীবন কোথাও বসার জায়গা পায় না। দরজার সামনে অনেকের সাথে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে। যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের পোষাক আষাক দেখে বোঝা যায় এরা মজুরশ্রেণীর লোক। কোথায় যেন কাজে চলেছে। হায় হতভাগা! জীবন যে আসামে এসেছিল এক বুক আশা নিয়ে, সেই আসাম থেকে একদল মানুষ চলেছে আলিপুর দুয়ার নামক এক স্থানে কাজের সন্ধানে।
এক সময় জীবন একটু বসার জায়গা পায়। সেখানেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে সে। দুতিন ঘণ্টা ট্রেন চলার পর ভিড় একটু কমলে শুয়েও পড়তে পারে। ধীরে ধীরে ঘুম এসে যায় তার। ভোর চারটেয় ট্রেন এসে থামে শিলিগুড়ি। কি ভেবে কে জানে, সেখানে নেমে পড়ে জীবন। অনেকগুলো মাস এখানে কেটেছে। সেই প্রাণের টানেই কি? কিন্তু তা বা কি করে হয়। শিলিগুড়ি তাকে যা দিয়েছে সে তো বিশ্বাসঘাতকতা। আস্থা হনন। তবু এখানে নামে। জীবনের বহু অকারণ অবিবেচক সিদ্ধান্তের এটা আর একটা।
রাত শেষ হতে খুব বেশি বাকি ছিল না। সব রাতের শেষ আছে। এটা প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম। শুধু সেই রাত সেই অন্ধকার শেষ হয় না যা মানুষের নিজের প্রয়োজনে সৃষ্টি করে, পরিপুষ্ট করে। যেসব অন্ধকার মানুষ বুকের মধ্যে লালন করে। নিজের সৃষ্টি করা লালন করা অন্ধকারে বাস করতে করতে সেই মানুষই নিজে একদিন কালো কুৎসিত প্রেতাত্মার মতো অবয়ব শূন্য আদর্শ শূন্য এমন এক প্রাণী হয়ে যায়, যার আরাধ্য উপাস্য পূজ্য শুধু অন্ধকার অন্ধকার অন্ধকার। সেই অন্ধকারের জঠর থেকে জন্ম নেয় আরো অন্ধকারে। যা অনন্ত অসীম …।
প্রকৃতির অন্ধকার এখন একটা পাতলা চাদরের মতো বিছানো রয়েছে দিগন্ত জুড়ে। সেই চাদর সরিয়ে পুর্বাকাশে দেখা দিচ্ছে হালকা একটা বেগুনি রেখা। গাছ গাছালির ডালে ডালে খড় কুটোর বাসায় আড়মোড়া ভাঙছে পাখ পাখালির ঝক। কিচির মিচির শোনা যাচ্ছে তাদের গলায়। কত সুখী ওরা! ছোট্ট দুটো ডানা আছে। সেই ক্ষুদ্র কিন্তু স্বাধীন ডানায় সারা আকাশ দখল করে নেয়। যতদিন জীব জন্তু পাখিদের জীবনের দিকে লোভি মানুষের কালো হাতের ছায়া না পড়ে ওরা বড় সুখেই থাকে।
জীবন আনমনে রেল লাইন ধরে হাঁটে। কেন হাঁটে, চঞ্চল পা কিসের সন্ধানে ব্যাকুল, তা কি সে জানে? স্টেশনের আলোকিত অঞ্চলের বাইরে যে বিশাল অঞ্চল তার চোখে এখনও প্রভাতি ঘুমের আঠা লেগে আছে। রাতের আঁধার যত ফিকে হয়ে যাচ্ছে তত পরিদৃশ্য হচ্ছে হালকা ধোয়ার মতো সামান্য কুয়াশা। যা দুরের গাছপালা, পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে আছে। কি ভেবে যেন কিছুক্ষণ জনহীন সেই মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে জীবন। নিজেকে এখন তার জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলা সেই রাখাল বালকের মতো মনে হয়। যার সামনে কোনও পথের নিশানা নেই। মনে হয় চোরাবালিতে পা বসে যাওয়া সেই হরিণ শাবকের মত, যে একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে এরপর কি ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু পরিত্রাণের কোন পথই নেই।
বেলা তখন মাটি ছেড়ে এক হাত উপরে উঠেছে। সকাল বেলার সেই সোনালি রঙ ঝেড়ে ফেলে রোদ এখন রক্তচক্ষু। উবর খাবর মাটি মাঠ পাথর টিলা পাহাড় গাছ পালার ফাঁক থেকে তার তিরের ফলার মতো দৃষ্টি এসে বিদ্ধ করছে জীবনের চারপাশ। সেই সময় দেখতে পায় জীবন তার সামনের রেল লাইনের উপর এসে দাঁড়ায় ট্রেনের চেয়ে ছোট ট্রামের চেয়ে বড় তিন চার বগির একখানা অদ্ভুত যান। ইঞ্জিনখানাও সেইরকম ছোট। কিছু পরে দেখে জীবন সেই যানখানা যার নাম ন্যাড়ো গেজ, তাতে এসে চড়তে থাকে একদল সুবেশ সুন্দর বড় বড় মানুষ। লোকের কথোপকথন থেকে শুনে নেয় সে এই যানখানা যাবে দার্জিলিং।
সকাল বেলায় ঝকঝকে রোদে এখান থেকে পাহাড়ের মাথায় আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই শহরে দেশলাই বাক্সের মতো দালান কোঠা ঘর বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে। যেন এক সবুজ নিথর সমুদ্রের মধ্যে নোঙর ফেলা ছোট ছোট খেলনা রাংতার নৌকা। যা রোদের আলোয় ঝিকমিক ঝিকমিক করছে।
সকাল দেখলে বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। এটা পুরাতন প্রবাদ। জীবনও তা জানে। আজকের দিনটাও যে তার জন্য কোন শুভবার্তা নিয়ে আসেনি, তার আভাস পাওয়া হয়ে গেছে। সেই এক বুক নিরাশা বঞ্চনা এক পেট বুভুক্ষা নিয়ে পথে পথে ঘোরা। এর যখন কোন ব্যাত্যয় নেই তখন ঘুরতে ঘুরতে দার্জিলিং চলে গেলে ক্ষতি কি! কে যেন দার্জিলিংকে অলকাপুরী বলেছে। অলকাপুরী মানে ধন দেবতা কুবেরের পুরী। যে রাস্তায় ছাইয়ের ট্রাক, বালি, চালের ট্রাক যায়, উড়ে ঝরে একটু আধটু রাস্তায় পড়ে। ক্ষুদ্র মানুষ জীবন তার চাহিদাও ক্ষুদ্র। কুবেরের নগর থেকে কুড়িয়ে খুটে কিছু কি এমন পেতে পারে না যে সেই ছোট্ট চাহিদাটুকু মিটে যায়? সেটা পরখ করতে হলে সেই নগরে না গিয়ে উপায় নেই।
যাবে জীবন! ভালো কিছু হবার আশা যখন নেই সব চেয়ে খারাপ যা হতে পারে তা যখন জানা, শিলিগুড়িতে পড়ে মরার চেয়ে দার্জিলিং গিয়ে মরায় কি এমন ক্ষতি! তাতে অন্ততঃ মরার আগে মনে সান্ত্বনা থাকবে, আঙুর ফল টক জেনেও লাফালাফি করেছিলাম, নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকিনি।
সামনে ইঞ্জিন, তার পরের কামরা মালপত্রের, তার পরে ফার্স্ট ক্লাস, তার পিছনে সেকেন্ড ক্লাস এবং সবার পিছনে গার্ড সাহেবের কামরা। ছোট্ট ট্রেন এবং লোকজনের ভিড়ও খুব কম। যারা শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যায় বেশির ভাগ লোক ট্রেনের চেয়ে জিপ বেশি পছন্দ করে। বিশেষ করে জিপের সামনের সিট। পিছন থেকে তার ভাড়াও কিছু বেশি। জিপ ট্রেনের চেয়ে সময় নেয় কম আর দেয় নৈসর্গকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবার রোমাঞ্চ। কিন্তু জিপে বিনা ভাড়ায় যাওয়া যাবে না। ট্রেনে তা যায়। শুধু যে তিন চারজন চেকার ট্রেন ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ওদের চোখ এড়িয়ে কামরায় চড়তে পারলেই হল।
জীবনের কাছে কোন পয়সা কড়ি নেই। কিন্তু ট্রেনে তো চাপতেই হবে। সেইঞ্জিনের সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কখন ট্রেন ছাড়বে। এই ট্রেন ধীরে ধীরে চলে। চলন্ত ট্রেনে ওর পক্ষে উঠে পড়া খুব কঠিন কাজ নয়। চেকার পিছনে ফেলে ট্রেন সামান্য সামনে এগিয়ে এলে সেই কাজটা সম্পন্ন করবে। সেটা করতে পারলেই দার্জিলিং যাত্রার প্রথম ধাপ পার হওয়া যাবে।
ট্রেন যেখানে দণ্ডায়মান সেখানে কোনও প্লাটফর্ম নেই। চারদিক খোলা মাঠ। মাথার উপর সুনীল আকাশ। আকাশে ডানা মেলা এক ঝাক পরিযায়ী পাখি। হিমালয় পার হয়ে কোথায় কোন দূর দেশ থেকে ওরা উড়ে আসছে। তিন চার মাস এখানে কাটিয়ে ফেব্রুয়ারীর দিকে ওরা আবার ফিরে যাবে। এটা অক্টোবর, আর কয়েকদিন পরে হিন্দুধর্মের শাস্ত্রমতে দেবী দুর্গা এই হিমালয় থেকে পুত্র কন্যাসহ সমতলে পূজা নিতে আসবে। এখনই বাতাসে খুব সামান্য শীত শীত ভাব। যেন সেই ভাবের সাথে মিশে আছে পূজো পূজো গন্ধ। তাতে অবশ্য জীবনের কিছু যায় আসে না। ওর তো পেট বোঝাই আগুন, দহন। সে আগুনে দহনে সব উৎসব ছাই হয়ে গিয়ে যা পড়ে আছে। তার রূপ বড়ই কদাকার। সেখানে কোন প্রফুল্লতা স্থায়ী হয় না।
এতক্ষণ ইঞ্জিন থেকে গর্ভবতী রমণীর মতো আলস্যময়, একটা মন্থর ধোঁয়া চিমনি বেয়ে আকাশের দিকে উঠছিল। এবার তার আলস্য কেটে গেল। বয়লারের কয়লা মারার ফলে ভলকে ভলকে সাদা ধোয়া উঠে আকাশ ঢেকে দিল। দুবার কুকু করে সিটি বাজাল। বোঝা গেল দৌড় শুরু হবার জন্য সে প্রস্তুত হয়েছে।
জীবনও প্রস্তুত। স্টার্ট হলো ইঞ্জিন। সো সো ছ্যাক ছ্যাক করে সে তার চাকা গড়ানো লিভারের উপর বাষ্পের চাপ দিয়ে শুরু করল সামনের দিকে যাত্রা। এক দুই তিন চার। চার পাক চাকা ঘোরার পর কালো কোর্ট পড়া চার চেকার পিছনে ফিরল। ওরা স্টেশনের কেবিনে যাবে। আর অপেক্ষার দরকার নেই। জীবন ছুটল ট্রেনের দিকে। ট্রেন তখন একটু বেগবান হয়ে গেছে। সে তুলনায় জীবনের শরীর একটু বেসামাল, পা একটু নড়বড়ে, হাত শক্তিহীন। তবু কোন মতে ধরে ফেলল দরজার হাতল। যাত্রীরা ওর রকম সকম দেখে আঁতকে উঠল। বিপদাশঙ্কায় কেঁপে চোখ বন্ধ করল কেউ কেউ। গেল, গেল বুঝি। কিন্তু গেল না। না প্রাণ, না হাত পা। সে উঠে পড়ল সাধারণ কামরায়। দাঁড়িয়ে পড়ল দরজার সামনে। দু’এক জন যাত্রী যাদের আশঙ্কা হচ্ছিল কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ট্রেন থেমে যাবে। যাত্রায় বিলম্ব ঘটবে। তারা ওকে দুচারটে সাধারণ খিচুনি দেবার পর মনোনিবেশ করল প্রকৃতির দৃশ্যপট দেখার দিকে।
শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন ছেড়ে প্রথমে যে স্টেশনে এসে থামল তার নাম সুকনা। এখান থেকেই ট্রেন পাহাড়ে চড়া শুরু করল। পাহাড়ের গায়ে নানা ধরনের বৃক্ষের ঘনগভীর জঙ্গল। তবে সে সব একটু দুর দুরে। এই সময় থেকে একটু শীত শীত করতে শুরু করল জীবনের। ট্রেনের যাত্রীদের দেখা গেল গায়ে শাল সোয়েটার কোর্ট চাপাচ্ছে। জীবনের কাছে গামছা গেঞ্জি ছাড়া আর কিছু নেই। সেগুলোই সে গায়ে জড়িয়ে নেয়।
এরপর ট্রেন যত সামনে আগায় শীত বেড়ে চলে। কিন্তু তখন শীতের কামড়ে জীবন ততটা কাতর হয় না। সে অবাক হয়ে প্রকৃতির অনুপম সৃষ্টি ছোট বড় মাঝারি পর্বতশ্রেণীর শৈলচূড়া দেখতে থাকে। যেন কেউ একখানা ঢেউ খেলানো বিশাল সবুজ চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে সব কিছু। সে চাদরের উপর নানা রকম ফুলের কেয়ারি করা। দুরে দেখা যাচ্ছে একপাল ভেড়া চড়ছে। সবুজের উপর ঘিয়ে রঙের জীবনগুলো ফুটে আছে আর এক সৌন্দৰ্য্য হয়ে।
পাহাড়ি রাস্তায় ট্রেন সোজা চলতে পারে না। তাকে পাহাড়ের গায়ে পাক খেয়ে খেয়ে উপরে উঠতে হয়। কত কঠিন পরিশ্রমে বিশ্বকর্মার বরপুত্ররা এ পথের নির্মাণ করেছে ভেবে অবাক হয় জীবন। চেষ্টা করলে মানুষ কত কি না করতে পারে। যারা পাহাড় ফাটিয়ে ছেনি হাতুড়ি চালিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এমন অনবদ্য শিল্প সৃষ্টি করেছে, কে তাদের কথা জানে? কে জানে
তারাও সব একদিন এক বস্তা ধান মাথায় একা তোলা গরিব দাসের দশা প্রাপ্ত হয়েছে কিনা!
অতিকায় এক কেন্নোর মত টিকিস টিকিস করে ট্রেনখানা যে পাহাড়ের গা বেয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠছে তার একদিকে গভীর খাঁই। সেদিকে একবার ট্রেন হেলে গেলে গড়িয়ে কোথায় গিয়ে পড়বে তা কে জানে! অন্য দিকে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে একেবারে ট্রেনের প্রায় গা ঘেসে। সেই পাহাড়ের গায়ে ফুটে আছে লাল সাদা হলুদ নীল নানারঙের অজস্র জংলা ফুল। যা দেখে মনে হয় কেউ যেন সেসব সুন্দর ভাবে লাগিয়ে রেখে গেছে। কোন এক স্টেশন থেকে যেন পাঁচ ছয়জন জীবনের বয়েসী নেপালি ছেলে উঠেছে ট্রেনে। তারাও সব ভিড় করে রয়েছে দরজার কাছে। প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর সেই সব তরুণরা হাত বাড়িয়ে গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে নিচ্ছে। তারপর পথ চলা কোন তরুণী যুবতী দেখলে ছুঁড়ে দিচ্ছে তার দিকে। যাদের দিকে ছুঁড়ছে তারাও সব হাত নেড়ে হেসে ছুঁড়ে দিচ্ছে ভালোবাসার প্রত্যুত্তর। যে একটু বেশি সাহসী সে ছুঁড়ছে উড়ন্ত চুম্বন।
যে পথে রেল চলেছে তারই সাথে সাথে পাশে পাশে কখনো বা শঙ্খ লাগা সাপের মত জড়িয়ে পেঁচিয়ে চলেছে একটা পিচ ঢালা পথ। যে পথে যাত্রী নিয়ে আসা যাওয়া করছে প্রচুর জিপ গাড়ি। খুশির জোয়ারে গা ভাসিয়ে জিপের আরোহীরাও মেতে উঠেছে সীমিত উশৃঙ্খলতায়। স্থান কালের কারণে বৈসাদৃশ্য লাগছে না কারোরই। ট্রেনের প্রায় সব যাত্রী আনন্দে হাসছে হা হা করে। মনে হয় সারা পৃথিবীতে একমাত্র হাসি এবং কান্নার যে ভাষা তা বিনা অনুবাদে সবাই বুঝে নিতে সক্ষম। জন থেকে জনে জনে সংক্রামিত হয়ে যাচ্ছে সেইহাসিখুশি আনন্দ আহাদের মলয় মদিরতা। এই আনন্দে মূর্তিমান নিরানন্দ একমাত্র জীবন নামের এক না কিশোর না যুবক না জীবিত না মৃত মানুষ। সে তার ছোট্ট গামছায় শরীর ঢেকে শীত বাতাসের ছোবল খেয়ে একপাশে সরে থেকে সুখী মানুষ দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
ট্রেন চলছে আর চলছে। কখনো ইঞ্জিন সামনে টানে কখনো পিছনের দিকে ঠেলে পাহাড় চড়ছে। কখনো দেখা যায় রেল লাইন মাথার উপরে কখনো সোজা পায়ের নিচে। এই ঘুরপাক খাওয়া পথের নাম লুপ। সুকনা থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত নাকি আঠারোটা লুপ আছে। দুরন্ত দামাল নেপালি ছেলেগুলোর এই পথের বাঁক মোচর সব নখ দর্পণে। ওরা এক একটা বাঁকে এসে চলন্ত ট্রেন থেকেজিপচলা পথের উপর নেমে পড়ে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে চা জল খেয়ে গোছাখানেক ফুল ছিঁড়ে পাহাড়ি চড়াই বেয়ে হেঁটে এসে আর এক বাঁকে বসে থাকে। যেখানে মানুষ পৌঁছে যাবার বিশ মিনিট বাদে পৌঁছাচ্ছে ট্রেন। আবার ওরা ট্রেনে উঠে শুরু করে দেয় হুল্লোড়। যার নাম যৌবন জল তরঙ্গ। কয়েক ঘণ্টা ওরা এসব করার পর কোন এক স্টেশনে যেন নেমে যায়। কে একজন বলে এ স্টেশনের নাম ঘুম। সেখানে ট্রেনের ক্রশিং হল। যে ট্রেন দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি যাচ্ছে ওরা সব সেই ট্রেনে গিয়ে উঠল। এবার ওরা হুল্লোড় করতে করতে নিচে নামবে।
এখন মনে হয় বেলা একটা হবে। ইঞ্জিনে এখানে জল ভরা হল। যাত্রীদের সুযোগ দেওয়া হল দুপুরের ভোজন সেরে নেবার। তারপর মন্থর পায়ে আবার রওনা দিল ট্রেন। এখন শীত আগের চেয়ে ঢের বেড়ে গেছে। জীবনের ছোট্ট গামছা গেঞ্জিতে সে শীত বাধা মানতে চাইছে না। এ ট্রেনে ওর মতো উদোম যাত্রী আর কেউ নেই। সব প্যান্ট কোর্ট টুপি মাফলারে ঢাকা। কিছু যাত্রী এমন আছে দেখে বোঝা যায় তারা গরিব কেননা তাদের প্যান্ট কোট মলিন ছেঁড়াকোরা। কিন্তু সে যেমনই হোক শীত তো মানছে। জীবনের তো তাও নেই।
এরপর বেশ কয়েকঘণ্টা ট্রেন চলে অনেকগুলো স্টেশনে পিছনে ফেলে ট্রেন পৌঁছাল কার্শিয়াং। তখন ঘড়ির কাঁটায় সময় মনে হয় পাঁচটা হবে। উঁচু একটা পাহাড়ের মাথায় জোরালো সার্চলাইটের মতো জ্বলছে বিল্টুদায়ী সূর্য। আর পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যে সে পাহাড়ের আড়ালে চলে যাবে। সমতলের ঢের আগে এখানে দিবাবসান ঘটবে।
ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী এখানে নেমে গেছে। কামরায় আর সাত আট জন অবশিষ্ট মাত্র। সেই নিয়ে আবার চলা শুরু করল ট্রেন। জীবন এখন একটা বসার জায়গা পেয়ে হাঁটু মুড়ে ছোট হয়ে বসে পড়ে। এখানে হাওয়া একটু কম তাই শীতও কম। কিছুক্ষণ পরে উঁচু নিচু পৰ্বত শ্রেণীর মাথায় মাথায় যেখানে যেখানে লোকালয় আছে জ্বলে ওঠা আলোকমালা দেখতে পায়। পাহাড়ি নৈঃশব্দতার মধ্য দিয়ে ছুটে চলা ট্রেনখানাকে তখন মনে হয় যেন নক্ষত্র রাজ্যের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা কোন মহাকাশ যান। জীবন বসেছে ট্রেনের ডানদিকে। ওর ডানদিকে গভীর গিরি খাদ, মাথা উঁচু পাইন দেবদারুর বন। তার ও পাশে আকাশের গায়ে ঘুমন্ত পাহাড় পর্বত গিরিশৃঙ্গ।
এখন জীবনের এসব দৃশ্যে মুগ্ধ হবার সময় নেই। সে ভাবছে আর কতক্ষণ পরে ট্রেন দার্জিলিং পৌঁছাবে। সেখানে এরপর কি ঘটবে। কি বিস্ময় বিপদ ঘটনা দুর্ঘটনা অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে। এখনই শীতকামড়ে শরীর কাতর। রাত যত বাড়বে শীতও বাড়বে। কোথাও একটু মাথা গোঁজার গরম জায়গা না পেলে তখন কি হবে! এখন আবার মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। এ সেই সমতলের আষাঢ়স্য ধারা নয়। এ উড়ে চলা পরিব্রাজক মেঘ। যা উড়তে উড়তে কোথাও থেমে গিয়ে ঝির ঝির করে খানিকক্ষণ ঝরে যায়। তাই এই বোদ তো এই বৃষ্টি। পাহাড় জুড়ে এমন লুকোচুরি খেলা চলতেই থাকে এই সময়টায়। জলের ছিটে গায়ে পড়তে মনে হল যেন সুচের মত লোমকুপ থেকে চামড়া ভেদ করে হাড়ে গিয়ে বিধছে। এত ঠাণ্ডা। সরাসরি পর্বতের মাথায় জমে থাকা বরফ জল হয়ে নামছে বোধ হয়।
রাত তখন আটটা কি সাড়ে আটটা ঝিরি ঝিরি বরফ জলে ভিজতে ভিজতে ট্রেন এসে পৌঁছাল দার্জিলিং স্টেশনে। একেবারে সুনসান চারধার। এক গণ্ডা পৌষ মাঘ যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে এখানকার সব তাপ উত্তাপ প্রাণের স্পন্দন ঠাণ্ডা করে দিচ্ছে। চারদিকে ছেয়ে আছে কেমন একটা গা ছমছমে অচেনা অন্ধকার। যে কজন যাত্রী ট্রেন থেকে নেমেছে সবাই কুলির মাথায়, না, কুলিরা এখানে মাথায় মাল বয় না, বয় দড়ির ঝোলায়, পিঠে। সেভাবে মালপত্র নিয়ে চলে যায় ভিজতে ভিজতে যে যার গন্তব্যে। জীবন ট্রেন থেকে নিচে নেমে চারপাশ দেখে বড় মুষড়ে পড়ে। কেমন যেন বুকের মধ্যে একটা ভয়ের অস্তিত্ব টের পায়। মনে হয় তার কোথায় কি যেন একটা হিসেবে ভুল হয়ে গেছে।
বাঁকুড়ায় থাকতে একবার জীবন একা হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলো বিষ্ণুপুর। লালবাঁধ আর রাণীবাঁধ নামে ওখানে দুটো বিশাল দিঘি আছে। প্রজাদের জল কষ্ট নিবারণের জন্য মল্লরাজারা এ দিঘির খনন করিয়েছিলেন। এখন পরিচর্যার অভাবে যার জল পানের অযোগ্য হয়ে গেছে। লাল বাঁধের তীরে পৌঁছে দেখেছিল জীবন দিঘির মাঝখানে প্রচুর শাপলা ফুল ফুটে আছে। শাপলা এমন এক জলজ উদ্ভিদ যা সেদ্ধ করে খেলে খিদে মেটে। খিদের কারণে আগপাছ বিচার না করেই সেই ভরদুপুরে দিঘির পাড়ে প্যান্ট খুলে রেখে নেমে পড়েছিল জলে। সেদিন কোন বিশ্বাসে কোন সাহসে জনহীন মনুষ্যহীন লালবাঁধের জলে একা নেমে পড়েছিল জীবন কে জানে। সাঁতরে মাঝখানে চলেও গিয়েছিল। বেশ কিছু শাপলা তুলেও ফেলেছিল। কিন্তু শাপলা নিয়ে ফেরবার সময় বুঝতে পারল এভাবে একা একা আসাটা একদম ঠিক হয়নি। যেভাবে তোক সে এসে তো পড়েছে কিন্তু ফেরার পথে জলজ উদ্ভিদেরা বিছিয়ে দিয়েছে অজস্র লতা পাতার বাধা। সাঁতার কাটতে গেলে যা পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। কোনভাবে যদি এক সাথে দু পা লতায় পেঁচিয়ে যায় আর বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। এমনিতে দিঘির গভীরতা খুব বেশি নয়। তবে এত কমও নয় যে একটা বাচ্চাকে ডুবিয়ে মারতে পারবে না।
যখন সাঁতার কাটতে কাটতে হাত পা খিল ধরে আসছিল মনের মধ্যে মাথা চাড়া দিচ্ছিল ডুবে মরার নিদারুণ ভয়, তখনই কার যেন গলা শুনেছিল, যে গলা বিপদে আপদের সময় বারবার শুনেছে–সাহস হারাস না জীবন। মরার ভয়ে যেন মরে বসিস না। আশে পাশে কেউ কোথাও নেই, কারও কোনও সহায়তা পাবার আশা কোরো না। কেউ তোমাকে এই মাঠের মাঝখানে, দিঘির জলে বাঁচাতে আসবে না। বাঁচতে হলে নিজের চেষ্টায় বাঁচতে হবে। সেই চেষ্টা কর। কথায় বলে, ডুবন্ত মানুষ হাতের কাছে খড়কুটো যা পায় আঁকড়ে ধরে। জীবনের সামনে খড়কুটো ছিল না। থাকার মধ্যে ছিল এক আঁটি শাপলা। যা সে জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। তখন সেই শাপলা ধরে জলের উপর শরীর ভাসিয়ে কিছুক্ষণ দম নেয় সে। তারপর আবার সাঁতরায় আবার দম নেয়। এভাবেই সেই লতাগুল্মর জঙ্গল থেকে এক সময় পাড়ে এসে পৌঁছায়। সেদিন সে মনে শপথ নিয়েছিল, এমন ভুল আর কোনদিন করবে না।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই একই ভুল আর একবার হয়ে গেছে। অন্ধকার এক দিক দিশা কুলহীন সমুদ্রের বরফ জল পড়ে গেছে সে। এখানে কেউ তার বন্ধু আপনজন বিপদতারণ নেই।
স্টেশনের উপর একজন লোক একটা কালো কম্বল জড়িয়ে সামনে একটা কয়লার উনুন নিয়ে বসে বসে আগুন সেঁকছে। তার কাছে গিয়ে জানতে চায় জীবন–এইখানে রাইতটা একটু কোথাও কাটানো যায় কিনা কন দেখি।
লোকটা মনে হয় স্টেশনস্থ খাবার দোকানের কর্মী। সে যে চোখে জীবনের দিকে তাকায় তাতে কোন কৌতূহল বিস্ময় বাৎসল্য আতিশয্য নেই। আছে বিরক্তি, ফালতু বাক্যালাপের অনিচ্ছুকতা।
বলে সে–কই হোটেল মে চলা যাও।
আমার কাছে তো টাকা নেই। আচ্ছা এইখানে কি ইস্টাশনে থাকা যায় না?
আগের চেয়েও বেশি বিরক্তি ঝরে লোকটার গলা থেকে–ইহা তো টেসনমে পুলিশ মচ্ছর তক রহনে নেহি দেতা, কেইসে রহো গে।
জীবন তার ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া হাত দুটো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু উনুনে সেঁকে নেয়। তখন আবার বলে লোকটা–কাহা রহতা হ্যায়?
বেশি দূর বলা ঠিক হবে না ভেবে নিকটস্থ স্থানের নাম নেয় জীবন। শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ির বর্ধমান রোড, সেইখানে আমাগো বাড়ি।
তো ইহা ক্যা করনে আয়া?
কামের তালাশে আইছি।
কাম! লোকটা ঠোঁট ওল্টায়। এ কাম কাঁহা। এহাকে লোক কাম কী তালাশমে নিচে যাতা হ্যায় আউর তুম নিচেসে উপর আয়া!
লোকটার কথায় জীবনের মনের মধ্যে কল্পনায় গড়ে তোলা কুবের মহলের স্বর্ণসৌধটা চুর চুর হয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যায়। পাহাড়কে লোগ খুদ ভুখ পিয়াস গরিবীমে মর রহা। দূর সে পাহাড়কো বহুত সুন্দর দিখতা হ্যায়। নজদিক আনেসে মালুম পড়তা হ্যায় কিতনা খাই গড়া হ্যায়।
হতাশায় বলে জীবন–তাইলে হাম এখন কি করো?
ক্যা করেগা?মর। মরনেকে লিয়ে তো আয়া। কথা তার শেষ। লোকটা উনুন নিয়ে সামনের দোকানে ঢুকে দরজা বন্ধ করে নেয়। কে কোথাকার একটা উটকো লোক তার জন্য সে কেন মাথা ব্যথা করবে। বর্তমান সময় বড়ই আত্মকেন্দ্রিক। এত সময় কার আছে যে, এক অচেনা আপদের বিষয়ে দুর্ভাবনায় ডুববে। কিন্তু জীবন এখন কি করবে? কী করবে জীবন? যেমন বলল লোকটা, মরে যাবে?
মরে তো যাবেই। সে চাক বা না চাক। শীত যেরকম হামলে পড়েছে সারারাত যদি সে শরীর ছোবলায় প্রাণ দেহ ছেড়ে পালাবে। কোনভাবে তাকে আটকে রাখা যাবে না দেহের চোর কুঠরির মধ্যে। ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে জীবন যখন অনাগত ভব্যিতের জন্য একরকম প্রায় প্রস্তুত তখনই ট্রেনের হুইসেল তীক্ষ্ণভাবে বৃষ্টি ভেজা রাতের বাতাস কাঁপিয়ে বেজে উঠল। কি ব্যাপার? ট্রেনের চাকাও যে পিছন দিকে গড়াতে শুরু করেছে একটু একটু করে। কেউ বলেনি তবু বুঝতে পারল, ট্রেন এবার ফিরে যাবে। এ সময়ে জীবনের বোধ বুদ্ধিতে যা এল তাই করল সে। আবার উঠে পড়ল ট্রেনে।ফিরে যাবে। ফিরেই যাবে জীবন। না ফিরে গিয়ে আর তার কি বা করার আছে। অলকাপুরী তার জন্য কোন শুভ সংবাদ নিয়ে অপেক্ষা করে নি।
বলতে গেলে প্রায় ফাঁকা ট্রেন ঘণ্টা দেড়েক চলার পর পৌঁছে গেল কার্শিয়াং। যাবার বেলা এর ডবল সময় লেগেছিল। সেটা চড়াই, এটা উতরাই। জগতের সব জিনিসের ক্ষেত্রে এটাই নিয়ম। উঠতে লাগে বহু সময় বহু কষ্ট বহু দৃঢ়তা কিন্তু নামতে হলে কোন প্রয়াসই লাগে না। একটা অপপ্রয়াসই যথেষ্ট।
রাত তখন দশ কি সাড়ে দশটা। শীতার্ত রাতের পাহাড়ি স্টেশন কার্শিয়াংয়ে এসে সেই যে ট্রেন থামল, একেবারেই থেমেই গেল। নট নড়ন চড়ন। কামরাগুলো প্লাটফর্মে ফেলে ড্রাইভার গার্ড উধাও হল। আজকের মত তাদের ডিউটি শেষ। ট্রেন চলার ইতি আজকের মত। আবার চলবে কাল। সকাল সাতটায়। কার্শিয়াং দার্জিলিংয়ের চেয়ে উঁচুতে। ফলে সেখানে শীতও বেশি বৃষ্টিও বেশি। জীবনের ক্ষেত্রে এ যেন গরম কড়াই থেকে রক্ষা পেতে আগুনে ঝাপানোর সামিল হল। কি আর করে জীবন, ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নেমে চারদিকে কাতর চোখে তাকায় সে। যদি কোথাও কোন আশার আলোর সন্ধান মেলে, যদি পাওয়া যায় প্রাণ বাঁচানো প্রাণের উত্তাপ নেই। চারদিকে অন্ধকার। লোডশেডিং নয়। এমনিতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে তবে সে আলোয় এত উজ্জ্বলতা নেই যাতে জীবন আলোকিত হয়। মনে হয় পরিবেশ বিরূপ নয়, ভয়ংকর বিরূপ।
প্লাটফর্ম একদম ফাঁকা। এটা অফ সিজন। এ সময়ে ভ্রমণার্থী মানুষেরা এখানে আসা তেমন একটা পছন্দ করে না। তাছাড়া আজ বৃষ্টিটা একটু বেশি হচ্ছে। সবটা মিলিয়ে সঠিক সময়ের অনেক আগে, বলা চলে প্রায় সূর্য ডোবার সাথে সাথে মানুষজন, যারা পথে ছিল সবকে সব ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এক পা দু-পা করে হেঁটে জীবন একটু সামনের দিকে যেখানে জিপ স্ট্যান্ড সেদিকে চলে গিয়েছিল। গোটা কয়েক জিপ যেখানে দাঁড় করানো যার উপর বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির করে। কিন্তু কোনও লোকজন দেখা গেল না। আছে হয়তো জিপের ড্রাইভাররা জিপের মধ্যে বসে শুয়ে। অকারণে কেন বৃষ্টিতে ভিজবে!
সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ট্রেনের দিকে তাকাতেই বুকটা কেঁপে যায় জীবনের। একজন রেলের কর্মচারী রেল কেবিন থেকে বেড়িয়ে এসে ট্রেনের প্রতিটা কামরায় লক লাগিয়ে দিচ্ছে। চাবি তার কাছে থাকছে। যা ঘুরিয়ে সে কাল দরজা খুলে দিলে যাত্রীরা উঠতে নামতে পারবে। কিন্তু জীবন এখন কী করবে! কোথায় বসে কাটাবে হিম তুহিন ভয়াবহ রাত! ট্রেনের কামরায় স্থান পেলে তবু একটা কথা ছিল। খোলা প্লাটফর্মে থাকতে হলে যা ঘটবে, সে কথা ভেবে বুকের কি দোষ সেতো কেঁপে যাবেই। কোন মানুষের এমন বুকের পাটা, যে মৃত্যু ভয়ে কাঁপে না।
আর কি! হয়ে গেল হিসেব নিকেশ। এই রাত জীবনের শেষ রাত। জমে বরফ হয়ে মরে পড়ে থাকার রাত। তার আর এমন কি বিলম্ব। এক ঘণ্টা দু-ঘণ্টা তিন-ঘন্টা। নশ্বর এই কায়াটা কতক্ষণ সইতে পারবে এমন বাঘের মত হাড় কাঁপানো শীতের কামড়!
বৃষ্টি ঝরা রাত, সাথে সাথে হাড় হিম করা কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। কোথাও কোন মাথা গোঁজার ঠাই নেই। এই অবস্থায় বাঁচবার কোন পথ কি থাকে! মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি, ফাঁসির দড়ি গলায় চেপে বসার পরেও একবার প্রাণপণে শেষ নিঃশ্বাস টানে। যদি এক সেকেন্ডও বেঁচে থাকা যায়। বেঁচে থাকার এই আকুতি, অদম্য অভীপ্সা, মরণান্তিক প্রয়াস–এর নাম জীবন সংগ্রাম। হার জিত বড় কথা নয়, বড় কথা মরার আগে না মরা। শেষ নিঃশ্বাস পড়ার আগের নিঃশ্বাস পড়া পর্যন্ত লড়ে যাওয়া, ভীষণ ভাবে বেঁচে থাকা।
কান পাতে জীবন, যেন অন্ধকার সমুদ্রের ওপার আকাশ ছোঁয়া দুর্গম পর্বতের কোন এক গুহা থেকে মেঘে ঢাকা নভোমণ্ডলের ওপাশের কোনও নাম না জানা নক্ষত্র থেকে ভেসে আসে সেই মৃত্যুঞ্জয় মহামন্ত্র, চরৈবেতি চরৈবেতি চরৈবেতি। জীবন এগিয়ে চল। এগিয়ে চল জীবন। মরার আগে মরে বসিস না। ডোবার আগে হাল ছাড়িস না। বড় পরিচিত, প্রিয় এই কণ্ঠস্বর। এ রব নাদ শব্দ ধ্বনি জীবনের বড়ই চেনা।
এগিয়ে যায় জীবন। প্ল্যাটফর্ম থেকে নিচে নেমে ট্রেনের অপর পার্শ্বে গিয়ে চারদিক দেখে নেয়। চোখে একেবারে তার আজ রাতচারা শিকারী জন্তুর চাউনি। না কেউ তাকে দেখছে না। এসময়ে যে কোনও দুষ্কর্ম করা যায়। সে ট্রেনের কাছে গিয়ে একটা দরজার গায়ে ধাক্কা দেয়। যা ভেবেছে ঠিক তাই, খুলে যায় দরজা। রেলের কর্মচারী, সব সরকারি কর্মচারীর যা স্বভাব ধর্ম তার বাইরে যেতে পারেনি। প্ল্যাটফর্মের দিকের ট্রেনের দরজা কটায় লক করে পিছনেরগুলো খোলা রেখে অর্ধেক শ্রম বাঁচিয়ে নিয়েছে।
জীবন খোলা দরজা দিয়ে কামরার মধ্যে উঠে বুকের সঙ্গে হাঁটু ঠেকিয়ে গোল হয়ে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ে। বাইরে থেকে এখানে বেশ ঠাণ্ডা বেশ খানিকটা খুব স্বাভাবিক কারণেই কম। মনে হয় জীবনের, কষ্ট হবে, তবে এভাবে এই রাতটা কাটিয়ে দেওয়া কঠিন হবে না। অন্ততঃ মরণকে ফাঁকি দিয়ে এ যাত্রা বেঁচে থাকা গেল।
রাত তখন কত হবে তা কে জানে, সারা পাহাড় জুড়ে ছেয়ে গিয়েছিল কোন মায়াবী জাদুকরের জাদুকাঠির নির্দেশে নেমে আসা মায়া ঘুমে। পাহাড়, গাছপালা, ঘর-বাড়ি, পথ-ঘাট, যানবাহন সব ডুবে গিয়েছিল সুপ্তির অতল গহ্বরে। কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া ছিল না। শুধু দমকা বাতাস আর বৃষ্টির জল ঝরার মৃদু আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না কোথাও। লাইট পোস্ট আর প্ল্যাটফর্মের শেডে ঝোলানো আলোগুলো জ্বলছিল কোনও ক্লান্ত দৈত্যের সহস্র লোচনের মত ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে। কিছু আলো চুঁইয়ে রেল কামরার জালিকাটা জানালা দিয়ে জীবনের চারপাশেও এসে পড়েছিল। তবে তাতে কামরার অন্ধকার দূর হয়নি। কিছু পাতলা হয়ে গিয়েছিল মাত্র। একসময় কামরার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক শব্দ হল। একটু ঘুম ঘুম এসেছিল জীবনের। সেই শব্দে চোখ খুলে গেল তার। টের পেল সারা কামরাটা চোলাই মদের কটু গন্ধে ভরে গেছে। চোখে পড়ল, আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে কান মাথা মুখ ঢাকা হাঁটু পর্যন্ত কোট পড়া একজন মাতাল মানুষ। তার পা টলছে আর গলা দিয়ে বার হচ্ছে গর গর ইঁদুর ধরার আগে বিড়ালের স্বর।
কি করে সে টের পেয়েছে যে, এই দুর্যোগময় রাতে ট্রেনের কামরায় একটি অরক্ষিত অভিভাবকহীন দুঃস্থ বালক আছে তা কে জানে! সে তার টলোমলো পায়ে এগিয়ে এল জীবনের দিকে। গামছা সরিয়ে মুখ দেখল, একে নেশা তায় কামরায় অপ্রতুল আলোয় দাড়ি গোঁফ শূন্য জীবনের কিশোর মুখটা কোন যুবতীর বলে ভ্রম হল। এই আততায়ী অন্ধকারে যাকে ধর্ষণ করলে রক্ষা করার কেউ নেই। সে তার মাতাল মানসিকতায় টালমাটাল পায়ে এগিয়ে এসে জীবনের প্যান্টের বোতামে হাত দেয়। তর সয় না তার, বোম খোলায় দেরি হলে টেনে ছিঁড়েই ফেলবে।
এমন আকস্মিক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না জীবন। ভয়ে, আত্মরক্ষার তাড়নায়, ঘৃণায় ক্রোধে তার ডান পাটা ছুটে গেল। সেটা যেখানে গিয়ে লাগল দুর্ভাগ্যবশতঃ সেখানেই লোকটার অণ্ডকোষ ঝুলছিল। পুরুষশরীরের এটা এমন এক দুর্বলতম স্থান যেখানে লাথি তো অনেক বড়ো জিনিস, সামান্য টোকা পড়লেও অতিবড় পালোয়ান বাপ বলে শুয়ে পড়ে। ছিটকে পড়ল লোকটা। তার গলা থেকে তখন যে আওয়াজ বের হল তাকে কাতরানো, আর্তনাদ গোঙানী যা হোক একটার সাথে তুলনা করা যায়। সেই আওয়াজ না জীবনের ভারাক্রান্ত কান্না কে জানে, কি শুনে যেন প্লাটফর্মের পাশের জিপ স্ট্যান্ডে থেকে দুজন লোক ছুটে এল। কোন পাশের দরজা খোলা থাকে তা তারা মনে হয় জানে। সেই দরজা দিয়ে সোজা ট্রেনের কামরায় ঢুকে পড়ল। মাতাল লোকটা ওদের হয়তো চেনে, পরিচয় জানে। সে চেনা হয়তো সুখদায়ক কোন ঘটনার মধ্য দিয়ে হয়নি। সে-ক্যা শালে! ফির সে? মাত্র এইটুকু শুনে শরীরের কষ্ট শরীরে বয়ে ছুটে পালাল।
এরা সব জিপ গাড়ির চালক। যে পালিয়েছে এবং যারা দাঁড়িয়ে আছে তিনজনই হিন্দিভাষী। নাক ছোট চোখ গোল চেহারাও নেপালিদের মতো ফর্সা নয়। একজন জীবনের দিকে তাকিয়ে পালিশহীন গলায় বলে, কৌন হ্যায় রে তু?
জীবন এখনো যথেষ্ট ভীত। সেই ভীতি জড়ানো, ক্ষুধায় আধবোজা গলায় সে তার এখানে আসার কার্যকারণ সংক্ষেপে বলে দেয়। দুজনার মধ্যে যার চেহারা একটু লম্বা, বয়েস ত্রিশ বত্রিশ সে খসখসে গলায় যেন আদেশ করে, চল।
কোথায়?
মেরে সাথ।
কেন?
নেহী তো জার মে মর জায়েগা।
জিপ চালক লোকটা জীবনকে নিয়ে গিয়ে তার জিপের পিছনের সিটে শুইয়ে দেয়। গায়ে দেবার জন্য দেয় একটা ছেঁড়া কোট। বলে, সুবে হোতে হি বাপস চলা যা। এহা কুছ নেহী মিলনে বালা। একদম ফালতু আয়া। তারপর সামনের সিটে শুয়ে পড়ে। পাহাড় অঞ্চলে বাস করা মানুষ। এখন তো শীত এমন কিছু নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ভোস ভেঁস করে নাক ডাকা শুরু হল। কিন্তু জীবনের ঘুম আসে না। অজানা পরিবেশের অনিশ্চিত অবস্থা। পেটের খিদে, তার উপর হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার মনের উপর চাপ, ওকে ঘুমাতে দেয় না। এপাশ ওপাশ করে রাত কেটে যায়।
তখন সূর্য উঠেছে উঁচু পাহাড়টার মাথায়। বৃষ্টি ধোয়া সবুজ চা বাগানে দেবদারু পাইন সেগুণ গাছের ডালে পাতায় প্রভাতী রোদ হাসছে কিশোরী মেয়ের মত। মানুষজন অল্প স্বল্প ইতিমধ্যে বেড়িয়ে পড়েছে পথে। দোকান বাজার খুলে গেছে। দিনশুরু হয়ে গেছে ছোট্ট পার্বত্য শহর কার্শিয়াংয়ে। জিপ চালক ঘুম থেকে উঠে জীবনকে নিয়ে যায় এক দোকানে। পনেরো পয়সায় এক কাপ চা দশ পয়সায় দুই স্লাইজ রুটি কিনে দেয়। বলে খা লে–আউর আভি টেরেন ছুটনে বালা হ্যায়। উসমে বইঠকে বাপস চলা যা। ফির কোভি নেহি আনা।
এক গলা কৃতজ্ঞতায় ডুবে যায় জীবন জিপ চালকের বদান্যতায়। এই প্রথম, এর আগে আর কেউ কোনওদিন প্রতিদানের আশা না রেখে তার জন্য এক পয়সাও খরচ করেনি। বলে সে–যো আপনে বলা ওহি করে গা। ফিরত যায়ে গা!
বেলা তখন দুটো আড়াইটে। যে ট্রেনখানা কাল এখান থেকে চলে গিয়েছিল, আজ এখন ফিরে এসেছে। সেই ট্রেনে চেপে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে এক ব্যর্থ বিষণ্ণ পরাভূত মানব সন্তান। যার নাম জীবন। ফিরে এল দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়িতে। পাহাড় থেকে সমতলে, আকাশ ছোঁয়া উচ্চতা থেকে, কল্পনায় গড়ে তোলা স্বর্ণপুরী থেকে, বাস্তবতার কঠিন ধরাতলে। সেই চেনা আকাশ মাটি মানুষের মাঝে। এখানকার আবহাওয়া এখনো শরীরের পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠবার সময় কালের ঋতুচক্রে আবর্তিত হয় নি। বাতাসের সেই সূঁচ ফোঁটানো তীক্ষ্ণ কামড় অনুপস্থিত। রাতও এখানকার কম অন্ধকার কম ভীতিকারক। ফলে, দশ বারো ঘণ্টা এখানে আরো বিনা কারণে কাটিয়ে দিতে জীবনের কোন অসুবিধা হল না। কোন আশায় এখানে পড়েছিল, মনের অতলে আঁতিপাতি করে তার বিশ্বাসযোগ্য, বাস্তবতাসম্মত, যুক্তিগ্রাহ্য কোন উত্তর খুঁজে কোনওদিন পাবে না। এর একটাই কারণ ছিল তা হচ্ছে মনঃস্থির করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না জীবন। এইসময় তার পক্ষে যা করার ছিল সবচেয়ে সহজ পথ তা হল আর একটা কোনও দোকানের সামনে গিয়ে কাজে রাখার আবেদন জানানো। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে মনের মধ্যে কাটার মত খচ খচ বিঁধছিল একটা ভয় সন্দেহ অবিশ্বাস। সেও যদি গাধার মতো খাঁটিয়ে নিয়ে মজুরি না দেয়। মজুরির যে খুব দরকার। সেই কারণে কোন মনঃস্থির করতে না পেরে স্টেশনের আশে পাশে পাক খেতে খেতে কেটে যায় সারাদিন এবং প্রায় সারা রাত।
রাত যখন প্রায় শেষতখনই শিলিগুড়ি স্টেশনে এসে ঢুকল লক্ষ্ণৌ মেল। এসেছে সেই জীবনের ফেলে আসা জাদু নগরী আসামের গৌহাটি থেকে। তখন মনে মনে ভাবে জীবন, লক্ষ্ণৌ মানে উত্তরপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ মানে দিল্লী, ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লী। দেশের মাথা মাথা লোকের বাস সেখানে। একবার সেখানে গিয়ে দেখলে খুব একটা খারাপ হয় না। খারাপ হবার মতো তার আর আছে বা কি! চরম-চরমতম খারাপ যাকে ঘিরে আছে তার আর নতুন খারাপ থেকে ভয় পাবার কিছু নাই। তবে যদি কোন অঘটন ঘটে, যদি তিলার্ধ পরিমাণ কোন ভালো শুভ মঙ্গল বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো তার ভাগ্যে জুটে যায়। এতকালের গতানুগতিক নিরস নির্মম জীবনযাত্রায় একটা কিছু পরিবর্তন এলেও আসতে পারে। অন্ততঃ তেমন একটা আশা করে এক দান জুয়া খেলায় অন্যায় বা ভুল কিছু হবে না।
ঘোলাদোলতলায় থাকতে একবার জীবন একটা ভাঙা ছাতার শিক কুড়িয়ে পেয়ে তাকে পাথরে ঘষে ধার দিয়ে একটা বাঁশের লাঠির মাথায় বেঁধে মাছ মারা কোচ বানিয়েছিল। এর আগে সে কোনদিন কোচ বানায়নি, মাছও মারে নি। সে বিষয়ে বলতে গেলে কোন অভিজ্ঞতাই ছিলো না। শুধু তার এক দু’বার দেখাছিল কেমন করে লোকে ওটা বানায় ও মাছ মারে। সে শিক্ষা অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে সাইকেল চালাতে দেখা বা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে সাঁতার শেখার মতো শিক্ষা। তাই কোচ নিয়ে সারা দিন খালপাড় ধানক্ষেত ঘুরে বেড়িয়েও কোন ফল হল না। একটা মাছও গেঁথে তুলতে পারল না কোচে। মনের দুঃখ মনে চেপে ঘরে ফেরার সময় এ কোচ দিয়ে আর কি হবে’ ভেবে রাগে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ধান ক্ষেতের দিকে। কিন্তু তখনই ঘটে গিয়েছিল এই আশ্চর্য ঘটনা। শত চেষ্টায় যা সে পারেনি, বিনা চেষ্টায় তাই ঘটেছিল। একটা শোল মাছের বাচ্চার পিঠে গেঁথে গিয়েছিল কোচের চোখা সিক। সে মাছের বাচ্চার বয়স চার পাঁচ দিনের বেশি নয়, লম্বা ইঞ্চি দেড়েক মাত্র। মনে হয় ঈশ্বর তার ভাগ্যে ওই রকমই মুক্তি নির্ধারিত করে রেখেছিল বলেই ওভাবে মারা পড়ল নাহলে তার মৃত্যুর আর কোনও ব্যাখ্যা হয় না।
.
আকাশের দিকে মুখ করে তীর ছুঁড়লে তা শিকারের গায়ে গিয়ে বেঁধে, অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়লে তা সঠিক স্থানে গিয়ে পড়ে, সে সব কখন? যখন কপাল ভালো থাকে। সবার নয় কারো কারো এভাবে কপাল ফিরেছে। জীবন এসব গভীর ভাবে ভেবে বুঝে অথবা কিছুই না ভেবে না বুঝে উঠে পড়ে লক্ষ্ণৌ মেলের তৃতীয় শ্রেণীর চামকাটা ভিড় কামরায়। শুরু হয় জীবনের খালি পেটে শুন্য ট্যাকে আড়াইদিন ব্যাপী আপাতঃ দৃষ্টিতে অনর্থক উদ্দেশ্যহীন আশা আশ্বাস ছাড়া এক দীর্ঘ রেল যাত্রা। চান নেই খাওয়া নেই ঘুম নেই শুধু চলা আর চলা। দিনের বেলা ট্রেনে তেমন একটা ভিড় থাকে না। রাত যত বাড়তে থাকে তত ভিড় গাদা মেরে যায়। কোন এক স্টেশনে যেন ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মে জল খেতে গিয়ে ভিড়ের কারণে কামরায় আর উঠতে পারল না। জীবন একা নয় তার মত অনেকেই পা রাখার জায়গা পায়নি কোথাও। তখন সবাই মিলে প্রাণ হাতে করে গিয়ে বসেছিল দুটো কামরাকে পরস্পরের সাথে জুড়ে রাখা লোহার শিকলের উপর। কয়লাচালিত ইঞ্জিন থেকে ভকভক ধোঁয়ার সাথে গরম কয়লার কুচি, আগুনের ফুলকি উড়ে উড়ে এসে পড়ছিল মুখে মাথায় চুলে। ধুলো মাখা জট বাধা চুলে সে কুচি আটকে যাচ্ছিল। পোড়াচ্ছিল চামড়া! উপায় ছিল না পোড়া থেকে নিস্তারের। হাত দিয়ে আগুন আটকাতে গেলে সার্কাসের তারের মত শিকল থেকে নিচের রেল লাইনের উপর পড়ে যাবার ভয় ছিল।
এই দীর্ঘ যাত্রা পথে একবার টিকিট চেকারের সামনে পড়ে জীবন। বেলা তখন নয় কী দশটা। দাড়িওলা বৃদ্ধ এক চেকার কোথায় কোন স্টেশন থেকে যেন উঠে পড়ে ট্রেনের কামরায়। একদিক থেকে টিকিট পরীক্ষা করতে করতে এসে যায় জীবনের সামনে। তারপর হাত বাড়ায়–টিকিট। এই প্রশ্নের একটাই জবাব জানা আছে জীবনের–নেই। তখন চেকার লোকটি নরম গলায় জানতে যায়–কাহা যায়ে গা?
জীবন যেখানে যাবে বলে ট্রেনে চেপেছে সে নামটা তো জানে। কিন্তু এখন সে নাম না বলে শুধু বলে–যায়েগা বহুতদূর। বৃদ্ধ চেকার কানে একটু কম শোনে। ট্রেনের আওয়াজ তা ছাড়া জীবনের না খাওয়া গলায় ফ্যাঁস ফ্যাসে আওয়াজে অন্য কিছু শোনে–ক্যা বোলা? কাহা যায়ে গা? গোরক্ষপুর? গোরক্ষপুর বহুদূর।
লোকটাকে দেখে মনে হয় জীবনের এর একটু দয়া মায়া থাকলেও থাকতে পারে। নিজের কষ্টের কথা একে বলে একটু সাহায্য ভিক্ষা করা যেতে পারে। অনেকগুলো দিন পেটে কিছু পড়েনি। খিদেয় শরীর কাহিল। একে বললে এ নিশ্চয় তাকে দিন কয়েকের জন্য জেলে নিয়ে যেতে পারবে। বলে গেছে রাজা জেলখানায় খাবার পাওয়া যায়। কিছু খেতে হলে এখন জেলে যাওয়াটা জরুরি। লক্ষ্ণৌ এখনো কত পথ তা কে জানে। আর গেলেই যে কেউ খাবারের থালা এগিয়ে দেবে তাও তো নয়। যদি এখানে খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায় দু’চারদিন বিশ্রাম নিয়ে ফের যাত্রা শুরু করায় খুব একটা ক্ষতির কিছু নেই।
সে একটু এগিয়ে যাওয়া চেকারের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে–আমার টিকিট নাই। মানে হাম বেটিকিট।
ঘাড় ঘুরিয়ে জীবনকে দেখে বলে চেকার–ও তো পহেলে বোল দিয়া ক্যা! ফির ক্যা?
হাম এহি বোলতা হ্যায় যে আপনি কী আমাকে ধরে নিয়ে যাইতে পারতা হ্যায়।
কিউ?
এতক্ষণের বৃদ্ধ নরম চেহারার চেকার লোকটার চোখ লাল চেহারা রাগী রাগী হয়ে ওঠে। সেই রাগ গলায় ঢেলে বলে সে–যাঃ ওই কোণায় গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। ধরে নিয়ে যাব! শালা যাদের ক্ষমতা আছে টিকিট কাটার তারাই কাটে না। তাদের ধরতে পারি না, একা কী করব। সাথ ফোর্স দিক। তা তত দেবে না। মরব নাকি ডিউটি করতে গিয়ে? তুই তো বেচারা গরিব। দেখলেই বোঝা যায়, খাওয়া জোটে না। তোকে ধরে কি হবে। ধরব না! যা বস গিয়ে ওদিকে।
জীবনের সবিনয় নিবেদনে নরম লোকটা রেগে তো গেছে কিন্তু এমন রাগ নয় যাতে জীবনের লাভ হয়। পরের স্টেশনে চেকার নেমে যাবার আগে জীবনকে আশ্বস্ত করে যায়–মেরা ডিউটি গোরক্ষপুর তক। যা বেটা কোই ডর নেহী।
সেদিন সারা দিন সারা রাত আর কোন চেকার পুলিশ কারো সাথেই তার দেখা সাক্ষাৎ হলো না। নিঝঞ্ঝাটে অবশেষ শেষ হলে বাংলা থেকে বিহারের মধ্যে দিয়ে উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত পৌঁছাবার নিখরচার দীর্ঘ যাত্রা। ট্রেন এসে থামল লক্ষ্ণৌয়ের চার বাগ স্টেশনে। সময় তখন সকাল সাতটা। বাতাসে একটু শীত শীত ভাব। ট্রেন থেকে নেমে শতশত যাত্রীর সাথে মিশে যেন মিছিল করে গেটের দিকে আগাল জীবন। গেট পার হতে পারলেই পাওয়া যাবে স্বাধীনতা, ভয় থেকে মুক্তি। গেটের ও পারেই আছে উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌ শহরের মাটি, পথ মানুষ। লক্ষ্ণৌ সেই অতীত কালের নবাব বাদশা গজল ঠুংরি বাইজি নর্তকী প্রসাদ ইমারতের শহর। শরীরের অবস্থা বিশেষ সুবিধার নয়। একে আর দানাপানী না দিয়ে বেশি দূর টেনে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাই কটা দিন এখানে থাকতে হবে জীবনের। কিছু খাবারের জোগাড় করতে হবে। তারপর আবার যাত্রা শুরু করবে।
গেটের দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে কালো কোট পড়া দুজন চেকার। তারা একে একে যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করে যেতে দিচ্ছে গেটের বাইরে। জীবনের টিকিট নেই। কিন্তু সে নিয়ে কোন ভাবনাও নাই তার। কি করবে চেকার! কী করারই ক্ষমতা আছে তার? হয় সে ধরবে নয় ধরবে না। ধরলে হয় জেলে দেবে নয় ছেড়ে দেবে। এদের যেটাই করার জীবনের তাতে লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। সে সহজ পায়ে সামনের দিকে আগায়।
কিন্তু সেদিকে আর যেতে পারল না। গেট তখনো কুড়ি পঁচিশ ফুট দুর। কর্কশ গম্ভীর এক গলার আওয়াজে পা থেমে গেল–এই রোখ, চেকার নয় তাকে ধরে ফেলেছে জি.আর.পিবিভাগের এক হাবিলদার। মাঝবয়েসী, মোটা গোঁফ মোটা শরীর চোখে কালো চশমা হাতে বেতের লাঠি খাকি হাফ প্যান্ট পায়ে বুট। তবে গায়ে সাদা জামা। লোকটাকে দেখে জীবনের বুনো শুয়োর উপমাটা মনে পড়ে যায়। পথ আগলে দাঁড়িয়ে ঘোঁত ঘোত করে বলে সে–কাহা যায়েগা?
বড় লালের দোকানে অনেক দিন থাকার কারণে হিন্দিটা বুঝতে ওর বিশেষ অসুবিধা হয় না। অসুবিধা হয় বলার বেলায়। জীবন তার বাঙাল টান যুক্ত হিন্দিতে হাবিলদারের কথার জবাবে বলে–ওই দিক যায়েগা। গেটের বাইরের দিক।
কাহা সে আয়া?
কলকাতা, অতদূর বলাটা কি ঠিক হবে! অতদুর থেকে বিনা টিকিটে এসেছে তা নিজেই স্বীকার করে নিলে জেল জরিমানাও তো সেই রকম হবে। তার চেয়ে একটু কম বলা যাক। দিন ছয় সাত যাতে জেল হয়। বলে জীবন, গোরখপুর থিকা আয়া।
গোরখপুর মানে লক্ষ্ণৌ থেকে কুড়ি বাইশ ঘণ্টার পথ। তাই শুনে হাবিলদার চমকে যায়। এ কাহা আয়া মালুম হ্যায়?
হাঁ হয়, এ লক্ষ্ণৌ।
কিউ আয়া?
কিউ মানে কেন। কেন জীবন গোরক্ষপুর থেকে লক্ষৌ এসেছে তা জানতে চায় হাবিলদার। বুঝতে চায় কোনও অপকর্ম করে পালিয়েছে কিনা। কিন্তু এখন জীবন কি বলে। কি বলে পুলিশ লোকটাকে বিশ্বাস করাবে সে সত্য বলেছে। সদা সত্য কথা বলিবে। সতমেব জয়তে। এ সব কথা বলতে বা শুনতে যতটা মধুর হোক আসলে তা মোটেই মধুর নয়। বাস্তব সত্য এই যে, সব সময় সত্য কথা চলে না। সময় বিশেষে সত্যটাই চরম মিথ্যা হয়ে যায়। সেটা জীবন এই ছোট্টবয়েসে হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছ। যদি সে বিনোদ সাহাকে কলকাতার কথা না বলে নিউ জলপাইগুড়ি বা আশেপাশের কোন ঠিকানা বলতে পারতো তবে কী ওরকম নির্ভয়ে টাকাগুলো মেরে দেবার সাহস পেতো?
তবে সে যা হোক, এখন এই চরম সন্ধিক্ষণে হাবিলদারকে যদি বলে জীবন–আমি খুব গরিব তাই বিশ্বের বৃহত্তমের তালিকায় নাম থাকা শহর কলকাতা থেকে লক্ষ্ণৌ শহরের এক দোকানে কাজ করতে এসেছি–সেটা আর যার কাছে হোক বা না হোক দিন রাত চোর ছ্যাচোর ধরা এক পুলিশের কাছে সত্য হবে না। তাই বাধ্য হয়ে জীবন এখন একটা সত্যকে বিনির্মাণ করে। সব কিছুর মতো সত্যকেও নির্মাণ ও প্রাণ দান করা যায়। রবারের মতো বিস্তার সংকোচনও করা চলে। সেই জন্যই তো একজন পুরুলেছেন–রায়ে জন্মভূমি অযযাধ্যার চেয়ে কবির মনোভূমি অনেক বড়।কবি হোক বা কথকতার উপস্থাপনাটাই হচ্ছে আসল জিনিস। তার রচনাকৃত কৌশলে মিথ্যাটা সত্যি সত্যিটা মহা সত্যি হয়ে যায়।
চোখে এক ফোঁটা জল এনে বলে জীবন, “হামলোক রিফুজি। পূর্ব পাকিস্তানে যে রায়ট হইলো তাই তে আমরা ঘরবাড়ি, জমি জাগা গোলা ভরা ধান পুকুর ভরা মাছ বেবাক ফালাইয়া এই পারে পরাণ লইয়া পালাইয়া আইছি। সরকার আমাগো থাকতে দিছিলো ক্যাম্পে। সেইখান থিকা টেরেনে কইরা নিয়া যাইতে আছিলো দণ্ডকারণ্য। বাপ মায় ভাই বইন তাগো লগে আমিও যাইতে আছিলাম। পথে এক ইস্টাশনে টেরেন থামলে মায় আমারে কয়, খোকা এটু খাবার জল নিয়া আয়। মার কথায় আমি গেছি জল আনতে। এদিকে টেরেন ছাইড়া দেছে। আমি আর উঠতে পারলাম না। মায় বাপ ভাই বোন সব হারাইয়া গেল।”
হাতের চেটোয় চোখ মুছে বলে জীবন–”হাম তো নেহি জানতে হ্যায় দণ্ডাকারণ্য কোন দিকে। একজন বলা হ্যায়, সেটা নাকি লক্ষৌয়ের কাছে। সেই শুইনা মায় বাপরে খোঁজতে হাম হিয়াপর আয়া। আপনি কি কইতে পারেন দণ্ডকারণ্য কোথায়?”
মাথা নাড়ে হাবিলদার। সে জানে না। দুশ্চিন্তায় কালো হয় জীবনের কাঁদো কাঁদো মুখ, “আপনি জানেন না কেউ জানেনা, তাইলে আমি তাগো কেমন খুইজা পামু। এখন আমি বিদ্যাশ বিভুয়ে কি করমু। কি খাইয়া বাচমু! আচ্ছা আপনেরে দেইখ্যা তো ভালো মানুষ বইল্যা মোনে হয়। আমার এটা উপকার কইরা দিবেন। কোনো জাগায় আমারে এটা কামে লাগাইয়া দিবেন। আমি খুব কাম করতে পারি।
খানা বানানে আতা হ্যায়?
আতা হ্যায়। বলে জীবন, আমি সব রান্না পারি।
চল মেরা সাথ।
যার ক্যানসার রোগ হয় তার অন্যরোগ হবার দরকার নেই। যাকে পুলিশে ধরে ফেলেছে, চেকারে কি করবে! গেট ছেড়ে সরে দাঁড়ায় গেট কীপার দু’জন। জীবনের হাত শক্ত করে ধরে তাকে নিয়ে একটা রিকশায় তোলে হাবিলদার। পঞ্চাশ পয়সা ভাড়া পথ পার হয়ে মিনিট কুড়ি বাদেশহরের শেষ সীমায়–যার ও পাশে মাঠ রেল লাইন সেখানে এক রেল কোয়াটারের সামনে এসে রিকশা থামে। হাবিলদার রিকশা থেকে নেমে পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খোলে। কোয়াটারে আর অন্য কোনও লোক থাকে কিনা তার কোন চিহ্ন নেই। আসবাব পত্র তেমন কিছু নেই ঘরে। দুঘরে দুটো দড়ির খাঁটিয়া। টাঙানো দড়িতে গামছা লুঙ্গি আর দু’তিনটে পুলিশের পোষাক। একটা টিনে কিছু আটা। মেঝেয় গড়াচ্ছে কটা আলু পেঁয়াজ। একটা শিশিতে সরসের তেল, কিছু মশলা। ঘরের এক কোণে কটা থালা। দুটো বালতি। আর বারান্দায় একটা কয়লার উনুন, যার সামনে কিছু কাঠ কুঁচো কয়লা। একটা বড় ড্রাম।
বলে হাবিলদার, “চুল্লা জ্বালানে আঁতা?”
“আঁতা।” বলে জীবন।
“তো চুল্লা জ্বালাকে আটা সান।”
হাবিলদার জামা প্যান্ট খুলে আণ্ডার ওয়ার পরা অবস্থায় একটা দড়ির খাঁটিয়ায় বসে পড়ে। হাত পা বুক সব লোমশ। বুকের এক পাশে উল্কিতে হনুমান আঁকা। গায়ে ঘাম। যা থেকে ছড়াচ্ছে। একটা বোটকা গন্ধ। যেমন গন্ধ বুড়ো পাঠার গায়ে থাকে। তাই
জীবন রান্না করতে জানে। গৌহাটিতে খুব বানিয়েছে। সে আটা মেখে রুটি বানায়। আলু চচ্চড়ি, আর রসুন ফোড়ন দিয়ে অড়হর ডাল রাঁধে।কটা রুটি কতটা ডাল রান্না হবে তা মেপে দেয় হাবিলদার। রান্না শেষ হবার পর জীবনকে বলে সে, “কাটোরামে থোরা তেল লে আ এবং সে বারান্দার এক পাশে হাত পা ছড়িয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে। তেল নিয়ে যাবার পর জীবনকে বলে–চল আব মালিশ লাগা।”
পেটে এক সমুদ্র খিদে। নাকে এসে ধাক্কা মারছে রসুন ডালের হত্যাকারী গন্ধ। পেটের শুকনো সমুদ্রে সাইক্লোন উঠছে উত্তাল হয়ে। এ বড় ভয়ংকর সময়। এ সময়ে অবাধ্য হওয়া চলে না। জীবন মালিশ শুরু করে দেয়। প্রথমে হাত তার পর পা তারপর পিঠ তারপর মাথা তারপর আর যা যা বাকি থাকে, সব হায়া বর্জন করে সর্বত্র ছোঁড়া হাতের নরম মালিশ গ্রহণ করে হাবিলদার। আ হা কি আরাম, কি আনন্দ। নরম আঙুল স্পর্শে শরীর যেন শিউরে উঠছিল। প্রায় দেড় দু’ঘন্টা ধরে প্রায় পঞ্চাশ গ্রাম তেল দিয়ে সারা শরীর মালিশ করানোয় এখন শরীরটা বেশ ঝরঝরে হয়ে গেছে হাবিলদারের। এবার চান করতে হবে। তাই জীবনকে এর পরের কাজটা বলে।
“রাস্তামে নিকালকে সোজা বায়ে তরফ যানা। সামনে কুঁয়া মিলেগা। উহাসে পানী লা।” কুয়া থেকে বালতি ভরে জল এনে একটা ড্রামে ভরে জীবন। তিনবারে আনা ছয় বালতি জলে ড্রাম ভর্তি হয়ে যায়। তখন সেই জলে অনেকক্ষণ ধরে চান করে চুল আঁচড়ে খেতে বসে হাবিলদার। আটা সে মেপে দিয়েছিল। কটা রুটি হয়েছে তা তার জানা। চারটে নিজে খেয়ে দুটো জীবনের জন্য রেখে মুখ হাত ধুয়ে খাঁটিয়ায় গিয়ে বসে খইনি ডলে। খইনি মুখে রেখে থুতু ফেলে বলে জীবনকে–যা নাহাকে রুটি খালে। জলদি কর।
জল কিছুটা ড্রামে ছিলো। সেটুকু গায়ে ঢেলে রুটি ডাল আলু চচ্চড়ি যতটুকু তারজন্য রাখা হয়েছিল খেয়ে বাসন পত্র সব মেজে ধুয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দেয় জীবন। তখন বড় দুটো পেতলের তালা দরজায় লাগিয়ে পোষাক পড়ে ডিউটিতে চলে যায় হাবিলদার। বলে যায়–বারান্দায় বসে থাকিস। আমি আটটার মধ্যে এসে পড়ব।
বেশ কয়েকদিন চান খাওয়া ঘুম কিছুই ছিল না। আজ চান করে যা হোক একটু পেটে দেওয়ার শরীর এলিয়ে আসে জীবনের। বারান্দায় ঝাট দিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সে এমন ঘুম কোথা দিয়ে যে সারা দিন কেটে যায় টেরই পায় না। ঘুম ভাঙে সন্ধেবেলায় বাচ্চাদের কিচির মিচির শব্দে। এই জায়গাটা রেলের। তার কর্মচারীদের থাকার জন্য পঞ্চাশ ষাটটা কোয়াটার বানিয়ে রেখেছে রেল কোম্পানী। একটা ছোট মাঠের চারপাশ ঘিরে এ সব কোয়াটার। যার সামনে ছয় সাত ফুট উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের গেটে লোহার দরজা। এখন সব কোয়াটারের সব লোহার দরজা খুলে মাঠে নেমে এসেছে বাচ্চারা। ঘুম থেকে উঠে হাবিলদারের দরজার সামনে বসে বাচ্চাদের হাসি খেলা হুল্লোড় দেখে মনটা ভরে ওঠে জীবনের। ভরে ওঠে বেদনার অশ্রু জলে। তারও একটা বাল্যকাল ছিল। কথা ছিল তারও এমনি খেলায় মেতে ওঠার, হেসে ওঠার। কিন্তু তা পারেনি। তার হাসি আনন্দ খেলা কাদের যেন চক্রান্তে চুরি হয়ে গিয়েছিল। এই সব শিশুদের বাপ দাদা কেউ না কেউ সরকারি কর্মচারী। সরকার দায়িত্ব নিয়েছে তাদের অন্নবস্ত্র সুখসুবিধার।তাই তাদের সন্তানরা হেসে খেলে খেয়ে মেখে বড় হচ্ছে। সরকারি কর্মচারী মানে সরকারের পোষ্য পুত্র। বেতন পাবে ঘুষও খাবে, ইচ্ছা না হলে কাজও করার দরকার নেই। বড় সুখের চাকরি, বড় সুখের জীবন। তাদের শিশুরাও সুখের রোজগারে সুখে মানুষ হচ্ছে। ওরা হাসবে না তো কারা হাসবে।
বাচ্চাদের খেলা শেষ হয়। দূরের এক মসজিদ থেকে মাইক মারফত ভেসে আসে আজানের সুর। সেই পবিত্র প্রদোষকালের পিছন পিছন এসে যায় অমাবস্যার আলকাতরা কালো ভয়ানক নিশিতপ্রিয় পিশাচরাত।
রাত আটটাতেই ফিরে এসেছে হাবিলদার। জীবনকে দেখে একটু হাসি খেলে যায় তার মুখে আছিস! তালা খুলে ঘর থেকে আবার আটা ডাল আলু বের করে দেয় সে, খানা বানা। ও বেলার মত এ বেলাও রুটি ডাল আলু চচ্চরি বানায় জীবন। হাবিলদার নিজে হাতে খাবার নিয়ে যায়। যা সে রেখে দেয়, খায় জীবন। ততক্ষণে দশটা সাড়ে দশটা বেজে গেছে। একটা হাবিলদারের দেওয়া চাদর পেতে বারান্দায় শুয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যে শুয়ে পড়ে হাবিলদার। শুয়ে পড়ে কিন্তু তার ঘুম আসে না। তারই ঘরের বারান্দায় তারই কবজায় এই রাত আঁধারে শুয়ে আছে একটা ষোল সতের বছরের তরতাজা ‘লোণ্ডা’। তাহলে কেমন করে তার ঘুম আসবে। বেশ কিছুক্ষণ উস পাশ করে দরজা খুলে বারান্দায় আসে। কোথায় কোন গাছের ডালে বাধা পাখির বাসায় ঘুমন্ত পাখি ছানার উপর ছোঃ মেরেছে আর কোন এক রাতচরা শিকারী পাখি। ভয়ে দুঃখে পাখি মা ডানা ঝাঁপটাচ্ছে, কর্কশ চিৎকারে কাঁদছে। রাত্রির নৈশব্দতা ছিঁড়ে তার কান্না কাতর আর্তনাদ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারধারে।
সে রাত বড় বিভৎস কালো কদাকার রাত। পৃথিবী মনে হয় তার আবর্তন গতি পথ বদলে ফেলেছিল। বিবর্তন হাটা দিয়ে ছিল উল্টো মুখো। প্রকৃতির সব নিয়ম নীতি, বহু কষ্টে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মানব সভ্যতা, কৃষ্টি সংস্কৃতি সব বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। মানুষ হয়ে ওঠার গর্ব করা এক জানোয়ার পৌঁছে গিয়েছিল সেই ভূমিকায় যা দেখে জানোয়ারও ঘৃণায় থুতু ফেলে।
হাবিলদার জীবনকে দেখে। তাকে ঘিরে আছে ঘন অন্ধকার। অন্ধকার যা আলোর বিপরীতে অবস্থান করে। আলো মানে দীপ্তি প্রভা জ্যোতি কিরণ। আলো মানে সূর্য আলো মানে সত্য। আর অন্ধকারের অর্থ শুধু অন্ধকার। ঘন কালো নিস্তব্ধ। সে অন্ধকারের গর্ভগৃহে বাস করে পাপ অন্যায় অবিচার ব্যাভিচার অত্যাচার। যে অন্ধকার ঢেকে রাখতে পারে শয়তানদের আসল অবয়ব। বড়ই সুবর্ণ সুযোগ এখন। হাবিলদার এক ক্ষুধার্ত হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে নধর হরিণ শাবক তুল্য নিরাশ্রয় নিঃসহায় জীবনের উপর। সে বাধা দিতে পারে না, শরীরে তত শক্তি নেই। চিৎকার করতে পারে না, কারণ গলার উপর একটা সবল হাত। সাথে ধমক, মাত চিল্লানা। নেহী তো গলা ঘোট দুঙ্গা। বাধ্য হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মাটি কামড়ে পড়ে থেকে হাবিলদারের গলগল করে ঢেলে দেওয়া আঠালো অপমান অনাচার অত্যাচার মাখে শরীর ময়। শিবপুরের মেসে, কার্শিয়াংয়ের ট্রেনের কামরায় নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল জীবন। কিন্তু এখন যাদের হাতে দেশের আইন শৃঙ্খলা নাগরিক নিরাপত্তা রক্ষার ভার, সেই রক্ষকের তমঃপ্রবৃত্তি থেকে সে নিজেকে বাঁচাতে পারল না। মানব ধর্ম থেকে, পুরুষ ধর্ম থেকে, পুলিশ ধর্ম থেকে বিচ্যুত এক পাষণ্ড ধর্ষণ করল তাকে। তার আত্মা স্বাভিমান অস্মিতাকে।
কতক্ষণ চলে ছিল পায়ুদেশে সেই রবার পিষ্টকের ওঠা নামা। কত কষ্ট হয়েছিল জীবনের। ক ফোঁটা রক্ত ঝরে ছিল শরীর থেকে। সারা জীবন যত কষ্ট যত অপমান সয়েছে জীবন সে তুলনায় এ আর কতটুকু। কিন্তু মনে হয় জীবনের আজকের এই ঘটনা, এই গ্লানি অসম্মান, এর চেয়ে বড় আগে আর কিছু ঘটে নি। পরেও ঘটবে না। এই ঘটনা, যদি সে বেঁচে থাকে, সারা জীবন মনন চিন্তনকে প্রভাবিত করে দেবে। মানুষ আর তার মানসিকতা সম্বন্ধে অন্য কিছু ভাবতে শেখাবে।
ধর্ষণ এমন একটা বিভৎস ক্রিয়া যা শোনা মাত্র যে কোন সাধারণ মানুষ বিচলিত হয়ে ওঠে। ধর্ষণ এমন একটা পাশবিক ঘটনা, যা যার উপর তা ঘটে যায়, নিজের কাছে সমাজের কাছে তার মান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। জীবন তখন মৃত্যুর চেয়ে ভারী, কষ্টদায়ক হয়ে যায়। প্রচলিত ধারণায় ধর্ষণ ব্যাপারটা সব সময় সংঘটিত হয় কামুক পুরুষ দ্বারা কোন দুর্বল অসুরক্ষিত মহিলার উপর।কিন্তু মহিলা দ্বারা পুরুষ, মহিলা দ্বারা মহিলা, পুরুষ দ্বারা পুরুষ ধর্ষণের ঘটনা সাধারণের ধারণায় তত পরিষ্কার উদ্বেগ উদ্রেককারী কোন বিরাট বিষয় নয়। এ সব বিশ্বাস করে নিতেও তাদের কষ্ট হবে। কিন্তু সত্য ঘটনা হচ্ছে সমকামী বিকৃতকামী দ্বারা সমাজে এসব ঘটনা অনবরত ঘটে চলেছে। মানুষ তো তুচ্ছ, মানুষ কুকুর গরুকেও রেহাই দেয় না।
মনে আছে জীবনের এমন একটা ঘটনার কথা। যা সংঘটিত হয়েছিল শিবপুর পুলিশ লাইনে। ফুটবল খেলা, প্যারেড করা ফাঁকা মাঠে রাত আটটা নটার সময়ে এক যুবতী কুকুর দেখে কাম মোহিত হয়ে একজন তাকে ধর্ষণ করে দিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা গোপন থাকে নি। কেউ একজন দেখে সেটা প্রকাশ করে দেয়। সেটা বহুদিন মানুষের কাছে একটা আলোচনার বিষয় হয়েছিল মাত্র তার বেশি আর কিছু নয়।
যদি কোন পুরুষ দ্বারা কোন মহিলা ধর্ষিত হয় ধর্ষকের প্রতি মানুষ ফেটে পড়ে ক্রোধে, আর ধর্ষিতার প্রতি সহানুভূতিতে। কিন্তু যদি কোন বালক বা কিশোর ধর্ষিত হয়, তার ভাগ্যে জোটে সামাজিক উপহাস। কেউ উপহাসের পাত্র হতে চায় না। তাই অধিকাংশ ঘটনা থেকে যায় অপ্রকাশিত গোপন গুপ্ত। জীবনও আশা করছে না কারও কোন সাহায্য সহানুভূতি পাবার। এ বড় বিপন্ন সময়। এ সময়ে কে কার? কে যাবে এক ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা আজব এক জীবের জন্য পুলিশ হাবিলদারের বিরুদ্ধে পুলিশ বিভাগে নালিশ জানিয়ে পুলিশের ক্রোধের কারণ হতে? কেন যাবে?
এক সময় সকাল হয়। হাবিলদারের কোয়াটার পশ্চিম মুখো। তার উঠোনে রোদ একটু বিলম্বে আসে। ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল জীবন। ঘুম থেকে উঠে দেখে হাবিলদার নেই। সে তার রোজকার রুটিন মর্নিং ওয়াকে গেছে। যে ওয়াক সারবার সময়ে জীবন তার সামনে পড়ে যায়।
জীবনের এখন নিজেকে ভীষণ ঘৃণা হয়। কান্না পায় তার। নিজেকে যেন অশুচি অপবিত্র নোংরা নদৰ্মার মতো মনে হয়। যে নর্দমায় লোকে প্রস্রাব করে। মনে হয় যেন তার সারা শরীর বেয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা পোকা। জ্যান্ত জীবনকে কুরে কুরে খাচ্ছে। যেমন ভাবে লাশ গাদায় পড়ে থাকা বেওয়ারিশ লাশ খায়। মনে হয় যেন পাঁচিলের ও পারের সব মানুষ জেনে গেছে তার চূড়ান্ত হেনস্তার কথা। গেট খুলে বাইরে গেলেই সব চোখ কুঁচকে মুখ বাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হেসে উঠবে–পোদু, ওই দ্যাখ যাচ্ছে, শালা একটা পোদু। হাবিলদার ওর পোদ মেরেছে।
শরীর জ্বলে যায় জীবনের। মনের মধ্যে মাথা নাড়ায় পোষ না মানা একটা বুনো মোষ। চোখা সিং দিয়ে গেঁথে দিতে চায় হারামী হাবিলদারটাকে। রক্তের লোহিত কণিকায় সেই পার্ক সার্কাস রাতের তুফান টের পায়। হাতটা নিস পিস করে তার। যে হাত শুঁকলে এখনো রক্তের ঘ্রাণ পায়। মানুষের রক্তের ঘ্রাণ।
ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। কিন্তু জীবন এত অন্ধ হয় নি যে তার বর্তমান অবস্থা অবস্থান বিস্মৃত হয়ে যায়। পরিণতি দেখতে না পায়।
আশি পঁচাশি কিলো ওজনের, ছয় ফুটের চেয়ে কিছু বেশি, মারপিট শেখা শরীর চর্চা করা সরকারি চাকুরে, যার সামনে পিছনে পাহাড়ের মত ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহাশক্তিধর ভারত রাষ্ট্রের তাবত আইন কানুন বিচার ব্যবস্থা। সব তাকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করবে। অন্য দিকে জন্ম জনিত কারণে অপরাধী দুঃস্থ দুর্বল এক সহায়হীন কিশোর। কি তার ক্ষমতা রাষ্ট্রীক এবং সামাজিক সুরক্ষা বর্ম ভেদ করে অপরাধীর কাছে পর্যন্ত পৌঁছায় এবং তার অপরাধের যোগ্য শাস্তি দেয়?
ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড নামে, একখানা পুস্তকে লেখা আছে, যদি কোন পুরুষ দ্বারা কোন নারী ধর্ষিত হয়, ধর্ষণ প্রমাণিত হলে ধর্ষকের সর্বোচ্চ সাত বছর কারাবাস হতে পারে। আর যদি কোন পুরুষ কোন বালক বা কিশোরকে ধর্ষণ করে তার সাজা যাবজ্জীবন জেল। এ দেশে প্রতি চুয়ান্ন মিনিটে এক জন নারী ধর্ষিত হয়। অত না হলেও বালক কিশোর ধর্ষণের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। নারী ধর্ষকদের কালে ভদ্রে এক আধজনার সাজার কথা শোনা গেলেও বালক কিশোর এমন কি পশু ধর্ষক এক জনেরও কোন সাজা হয়েছে এমন কোন উদাহরণ নেই।
তাই এখন জীবন যতই মাথা খুড়ুক তার কোন ন্যায় বিচার হবে না। কে করবে সেই বিচার? যার গরু ধান খায় তার কাছে ক্ষেতের মালিক ন্যায় কি করে পাবে? কেউ কি পেয়েছে?
একটাই কাজ পারে জীবন। সেটা নিজের প্রতি ঘটা অপরাধের নিজে বিচার করে তার সাজা দেওয়া। রাতে হাবিলদার ঘুমিয়ে পড়লে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে অন্ধকারে পালিয়ে যাওয়া। খড়ের গাদায় সঁচ খুঁজলে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু বিশাল এই দেশের কোটি কোটি জনগণের মধ্যে থেকে নাম পরিচয় হীন এক বালককে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। মনে যে আগুন এখন জ্বলছে জীবনের, তাতে হাবিলদারকে পুড়িয়ে মারা তার পক্ষে কোন কঠিন কাজ নয়। তবে কঠিন সেটা করার জন্য দশ বিশ লিটার পেট্রোল বা কেরোসিন সংগ্রহ করা। এটা খড়ের ঘরতো নয় যে ফুলকিতে জতুগৃহ হয়ে যাবে।
তাহলে কি করা হবে। ছেড়ে দেওয়া হবে বদমাইশটাকে। এতবড় অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে? ভাবতে ভাবতে একটা পথ পেয়ে যায় জীবন। সেটা সস্তা নির্ভরযোগ্য এবং মোক্ষম। বারান্দার এক দিকে একটা তাক। যার উপর রাখা একটা ছোট আয়না যার পাশে একটা রেজার গোটা কয়েক নতুন ব্লেড। খুবই সাধারণ উপকরণ। এখানে হাবিলদার চান করে, মাথা আঁচড়ায়। দাড়ি কামায়। এখানকার একটা ধারালো ব্লেড জীবনের কাজে লাগতে পারে। মাত্র একটা পোঁচ পুরুষাঙ্গের গোড়ায়। একটা মাত্র পোঁচ।
জীবন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। কাল রাতের ঘটনা যা মনের উপর এতক্ষণ জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল তা নেমে যায়। যেন কিছু ঘটে নি। যা ঘটেছে তা এমন কিছু নয়। একটা আগাম প্রস্তুতির অভাব জনিত ভুল বোঝাবুঝি মাত্র। কিছুক্ষণ পরে হাবিলদার ফিরে আসে। সহজভাবে জীবন যা কাল করেছে সেই সব কাজ সম্পন্ন করে। উনুন ধরায় আটা মাখে রুটি বানায় চানের জল বয়ে আনে তেল মালিশ করে হাবিলদারের সারা অঙ্গে। কাল তেল মাখা হাত যেখানে যেতে থমকে যাচ্ছিল আজ অবলীলায় পৌঁছে যায়। হাবিলদার তৃপ্ত হয়। এই তো চাই। লৌণ্ডা ঠিক লাইনে এসে গেছে। লৌণ্ডা হিন্দিতে বহুল প্রচলিত একটা শব্দ। যার বাংলা অর্থ পোE। যার কাজ পায়ু মৈথুন করানো।
খুশি মনে হাবিলদার খেয়ে দেয়ে চলে যায়। আর জীবন একটা ব্লেড নিয়ে প্রতিক্ষায় বসে থাকে মধ্যরাতের।
ডান আর বা, সঠিক আর বেঠিক বলে কোন কিছু হয় না। যদি কেউ পর পর দুবার বা দিকে ঘোরে নিজের অজান্তে তার একটা ডান দিকের যাত্রা হয়ে যায়। ভাগ্য ভালো ছিল তাই সেদিন হাবিলদারের একটা সঠিক যাত্রা হয়ে গেল। স্টেশনস্থ জি.আর.পি. অফিসে গ্রামের বাড়ি থেকে খবর এসে পৌঁছাল, জলদি ঘর আ যা বেটা। সে ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা ছিল না হাবিলদারের। কারণ তার ছোট ভাই মেরে তার বাবার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। পুলিশের লোক, মারপিট খুন দাঙ্গায় খুব একটা বিচলিত হয় না। তবে এখানে ব্যাপারটা পারিবারিক বলে একটু যা কষ্টদায়ক হয়ে গেছে। তখুনি সে গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে যায়। তবে যাবার আগে জীবনকে রেলের ইঞ্জিন মেরামতির কারখানায় একটা কাজে লাগিয়ে রেখে যায়।
হাবিলদারের কোয়াটার থেকে স্টেশনের দিকে আসবার পথের ডান দিকে এই লোকো ওয়ার্কশপ। এই ঠিকেদারের অধীনে আরো কুড়ি পঁচিশজন মজুরের সাথে মিলে রেল লাইন থেকে ছাই সরিয়ে নিয়ে গাদায় গিয়ে ফেলা এই হচ্ছে কাজ। মাইনে তার মাসে পঞ্চাশ টাকা। যেদিন বাজে না যাবে মাইনে কাটা। নো ওয়ার্ক, নো পে। মাসে পঞ্চাশ অর্থাৎ দিনে এক টাকা দশ আনা। এত কম মজুরিতে কাজের লোক পাবার কথা নয়। পেয়ে যায় কারণ কাজের শেষে সব মজুর এক ঝুড়ি করে পোড়া কয়লা নিয়ে যেতে পারে। দয়া পরবশ হয়ে হাবিলদার তার জন্য উনুন চাটু তাওয়া বারান্দায় রেখে গেছে। বলে গেছে ঠিকেদারকে, দু একটাকা চাইলে যেন দেয়। হাবিলদার এক সপ্তাহের জন্য গ্রামে চলে গেল। অক্ষত রয়ে গেল তার পুরুষাঙ্গটি।
সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে ছটা অবধি কাজ। একজন বেলচায় করে ছাই দিয়ে ঝুড়ি ভরে তুলে দেয় জীবনের মাথায়। সে নিয়ে গিয়ে দূরে ফেলে আসে। সন্ধ্যায় কয়লার ঝুড়ি পাড়ার দিকে নিয়ে যায়। কয়লা কেনার লোক প্রচুর। কয়লা বেচে পয়সা নিয়ে বাজার করে। নিজে রান্না করে। নিজে খায়। জীবনে পেট ভরে খাবার, আনন্দে থাকার সুযোগ খুব কম আসে। ভবিষ্যৎ কোন রূপ নিয়ে আসছে তা কে জানে। সাতটা দিন যখন পাওয়া গেল তাকে উপভোগ করে নেওয়া যাক। এমনই ভাবে জীবন।
সাত নয়, দশ দিন পরে পারিবারিক সমস্যা মিটিয়ে ফিরে এল হাবিলদার। তবে একা নয় এবার সাথে এসেছে তার বউ, মেয়ে। তারা এখানেই থাকবে এখন থেকে।
কে যেন বলেছে জীবনটা একটা নাটক পৃথিবীটা একটা রঙ্গমঞ্চ। হাবিলদার এখন পশুত্বকে লুকিয়ে রেখে ভাজা মাছ উল্টে খেতে না জানা পরম নিষ্ঠাবান পতিধর্ম নির্বাহ শুরু করল। তবে জীবনের জীবন যাত্রার কোন পরিবর্তন ঘটল না। নিজের বাজার নিজে করে নিজে খাওয়া চালু থাকল। হাবিলদার ঘরনির রাতের রান্না শেষ হলে সেই উনুনে কয়লা ঢেলে নিজের দুবেলার রান্না সেরে নেয় জীবন। তারপর রাতটুকুর জন্য পড়ে থাকে বারান্দার এক কোণে।
একদিক ভোলা ছোট্ট বারান্দা। উত্তর প্রদেশ হিমালয়ের কাছে বলে শীত এখানে বাংলার চেয়ে আগে আসে। একটু একটু শীত পড়া শুরু হয়ে গেছে। ভোরের দিকে হাত পা কালা হয়ে যায়। সে যা হোক আর যেমন হোক তবু একটা আস্তানা তো। নিয়মমত তার একটা ভাড়া নিশ্চয় হয়। জীবনের ভাড়া দেবার ক্ষমতা নেই। তাই হাবিলদারের হিসেবি স্ত্রী ভাড়ার বদলে বাসন মাজানো রান্না চানের জল বওয়ালে কাপ ছোপানো এসব ঘরের কাজ বিনা দ্বিধায় করিয়ে নেয়।
এইভাবে কেটে যায় এক মাস। এসে যায় বেতন পাবার দিন। মজুরদের সবার মনে উল্লাস। জীবনও ভাসছে আনন্দের জোয়ারে। আর কিছুক্ষণ পরে হাতে পাবে নগদ পঞ্চাশ টাকা। এতটাকা। সে, এমন কি তার বাপ ও এক সাথে কোনদিন হাতে ধরে দেখে নি। গামছাটা ছিঁড়ে ফর্দাফাই হয়ে গেছে। একটা নতুন গামছা কিনবে। অনেক দিন ভাত খায় নি। ভাত রান্নার কোন হাড়ি নেই। হোটেলে গিয়ে আজ ভাত খাবে। চারবাগের স্টেশনের কাছে একটা বাঙালী হোটেল আছে। বড় আশা বুকে নিয়ে বসে থাকে জীবন।
ঠিক চারটের সময় মাইনে দেওয়া শুরু হয়। একে একে সবার ডাক আসে। সবাই টাকা পেয়ে যায়। শুধু একা জীবনের ডাক আসে না। বিস্মিত জীবন ঠিকাদারকে বলে–কই সায়েব আমাকে তো টাকা দিলেন না।
ফরসা গোল মুখ মুসলমান ঠিকাদার। দেখে মনে হয় নবাব বাদশার রক্ত শরীরে আছে। শহরের মাঝখানে বিশাল বাড়ি। দু তিনটে বউ, সর্ব কনিষ্ঠ বউটার বয়েস নাকি বাইশ। বছর খানেক আগে বিয়ে করেছে।
বলে সে–তোমার টাকা তো তোমার হাতে দেওয়া যাবে না। হাবিলদার বারণ করে দিয়ে গেছে। তুমি তার বাসায় থাকো খাও। তোমার সাথে তার কি কথাবার্তা হিসাব নিকাশ আমি তো কিছুই জানি না। সে তোমাকে কাজে লাগিয়ে গেছে। বলতে গেলে তুমি তারই কাজ করছে। যা বলার তাকে বোলো।
বলে জীবন–তার বাসায় খাই সে খাবার আমি নিজে কিনে আনি, থাকি একটু তার জন্য বাসার সব কাজ করিয়ে নেয়। আপনারা যে কয়লা দ্যান মাঝে মাঝে তারও এক দু ঝুড়ি দিয়ে দিই।
সে তো আমি বলতে পারব না। তোমার আর তার ব্যাপার। আমি কোন ঝামেলায় জড়াতে চাইনা।
ইঁদুর কলে পড়ে গেছে জীবন। তাকে বিনাশ করার জন্য যেন বিশ্বজোড়া ফঁদ পাতা রয়েছে, অদৃশ্য সেই মাকড়শার জাল কেটে কোনভাবে বের হতে পারছে না। কেউ তাকে ত্রাণ দিতে অবতার হয়ে আসবে না। এখন কি করে সে? কি করে জীবন নামের এক হতভাগ্য?
বোঝে সে, এখানে কাজ করতে হলে থাকার জন্য হাবিলদারের বাসায় না গিয়ে কোন উপায় নেই। আর গেলেই তার মালিশ জল ভোলা বাসন মাজা, সব কাজ সিন্ধবাদের বোঝার মত ঘাড়ে চেপে বসবে। তার পর মাস গেলে নিজের মেহনতের মজুরিও হাতে পাবে না। হাবিলদারের মত নরাধমের কাছে কোন দয়া কৃপা পাবার আশা করা মানে মুখের স্বর্গে বাস। দেখে মনে হয় এই সব পাষণ্ডতে পৃথিবীটা ভরে গেছে। যারা গলা টিপে ধরে আছে জীবনদের মতো জীবনের।
বলে ঠিকেদার, আমি বুঝি না তেমন নয়। তুমি গরিব ঘরের ছেলে। দুটো পয়সার জন্য খাটতে এসেছ। কিন্তু আমার কিছু করার উপায় নেই। হাত পা বাধা। জলে বাস করে কি কুমীরের সাথে বিবাদ করে পারা যায়। তুমি তো জানো কাজের মজুরি বাবদ মজুররা কিছু পোড়া কয়লা নিয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কি, সেটা আইনসম্মত নয়। আইন হচ্ছে ওয়ার্কসপের ধুলোও নাইরে যাবে না। যদি আমি হাবিলদারের কথা না মানি, সে রেগে যাবে। আর তখন কয়লা নিয়ে যেতে দেবে না। সব বাজেয়াপ্ত করে নেবে। আগে কয়েকবার এমন হয়েছে। তাহলে মজুররা সব না খেয়ে মরবে। কাজ বন্ধ হয়ে গেলে আমার কি হবে বলো।
বিদায় নবাব বাদশা বাইজি নর্তকী আমীর ওমরাহ গলজ ঠুংরির স্বনামধন্য শহর লক্ষ্ণৌ। কত ইতিহাস ইতিকথা কত গল্প গাথা কিংবদন্তী ছড়িয়ে আছে তোমার পথে পথে ধুলিকণায়। ক্ষুধার্ত এক কিশোরের তার কিছুই শোনা হল না। দেখা হল না। চলে যেতে হবে এবার এখান থেকে।
মনের মধ্যে যখন বিল্টুদায়ের ঘন্টা বাজতে শুরু করেছে তখন সেই ঘন্টায় একটা নাড়া দিয়ে দেয় ঠিকেদার, তোমার অবস্থা বুঝে, সবদিক ভেবে দেখে বলছি, তোমার এখান থেকে চলে যাওয়াই উচিৎ হবে। তবে হ্যাঁ, যদি কানপুরে যাও, ওখানেও আমার ঠিকা নেওয়া আছে। সেখানে কাজে লাগিয়ে দিতে পারি। তাহলে আর তোমার পয়সা হাবিলদার নিয়ে নিতে পারবে না। যাবে?
রাতটা ঠিকেদারের বাড়ির নিচের তলায় একটা ঘরে কাটিয়ে সূর্য ওঠার আগেই রওনা দিল কানপুর। কানপুরের কাজ দেখা শোনা করা মুনশি এসেছিল পেমেন্ট নিয়ে যাবার জন্য। সকাল আটটার আগে পৌঁছে তাকে মজুর কাজে লাগাতে হবে। তাই তাড়াহুড়ো।
কানপুর লক্ষ্ণৌ থেকে খুব একটা দুর নয়। দেড় দুঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া গেল লোকো শেডে। এটা খুবই ছোট কারখানা। কাজও কম মজুরও কম। কিন্তু সেখানেও কি টিকতে পারল জীবন। এতো সেই জীবন যার পায়ের তলের ভূমি পিচ্ছল। অনবরত পিছলে পিছলে যায়। সে ভূমিতে স্থির দাঁড়াবে কি করে?
এখানে রান্না করে খাবার কোনো সুবিধা নেই। খেতে হবে হোটেলে। পঞ্চাশ টাকা মাস মাইনের লোক সারা মাস হোটেলে খেলে হাতে আর পয়সা থাকে কই? দু বেলা, মাত্র দু বেলা তাও কি পেট ভরে খাওয়া যায়? চারটে রুটি যার দাম আট আনা সাথে দু আনার ডাল, রাতটা তো দশ আনায় চলে যায় কিন্তু দুপুর এক টাকায় চলে না। কম পক্ষে আটটা রুটি চার আনার তরকারি দরকার।
ইঞ্জিন থেকে যে ছাই ঢালা হয় তাতে আগুন থাকে। আগুন নেভাবার জন্য ঢালা হয় জল। সেই জলে ভেজা ছাই এক ঝুড়ির ওজন চল্লিশ পঞ্চাশ কিলোর কম নয়। সারা দিন ধরে সেই ঝুড়ি মাথায় করে বয়ে পেটে যেন আগুন জ্বলে। সেই আগুনে পাতলা আটটা দশটা রুটি দহন হতে কতক্ষণ। লক্ষ্ণৌয়ে যে পোড়া কলার উপরি রোজগার ছিল এখানে তা নেই। অন্য মজুরদের বাড়ির লোকরা তা আগে ভাগে বেছে নিয়ে চলে যায়। ঝুড়ি বওয়া থেকে ফুরসত মিললে তবে তো জীবন তা বাছাই করবে। তার আগেই তো সব হাওয়া।
লক্ষ্ণৌয়ের সহকর্মীরা বাচ্চা বলে জীবনকে কিছু রাহত দিত। কিন্তু কানপুরের সঙ্গীরা তেমন নয়। তারা উড়ে এসে জুড়ে বসা জীবনকে ঠিকেদারের চামচা ভেবে ঝুড়িতে যথেচ্ছো বোঝ চাপিয়ে তুলে দেয় তার মাথায়। ছাইয়ে ঢালা জল বেলচা করে তুলে দেয় ঝুড়িতে। সে জল চুঁইয়ে গায়ে মাথায় পড়ে জীবনের। ভিজে ভূত হয়ে যায়। কতদিন সে এই অত্যাচার সয়ে টিকতে পারে? যেন সেই পরীক্ষায় মেতে ওঠে সাত সহকর্মী মজুর ভাই।
এক মাস টেকে জীবন। তবে তার জন্য সহকর্মীদের ব্যবহারই একমাত্র দায়ী নয়। শীতও বেশ কিছু দায়ী। প্রকৃতির নিয়মানুসারে সে তখন বেশ জাঁকিয়ে নেমেছে। উত্তর প্রদেশকে ভালোমত কাঁপিয়ে প্রতিবছরের মত শীতেদুদশজনকে মেরে বাংলার দিকে যাবে। লক্ষ্ণৌয়ের মত কানপুরে জীবনের থাকার কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই। তেমন কোন বিষয় ঠিকেদারের হাজার রকম চিন্তা করা মাথায় আসে নি। বড় মানুষের বড় ভাবনা থাকে। সেখানে এত তুচ্ছ জিনিস স্থান পায় না। প্রথম প্রথম দিন কয়েক কারখানায় একটা চালায় রাত কাটাতে খুব একটা অসুবিধা হয় নি। শীত বাড়ার সাথে সাথে অসুবিধা ঘটল। চারদিক ভোলা সে স্থান আর শীতের দাপটে বাসের উপযুক্ত রইল না।
তাই কাজ ছেড়ে আবার হাঁটা দেয় জীবন। তবে এবার আর তার আর্থিক ক্ষতি বিশেষ একটা হয়নি। পারিশ্রমিকের সবটা পেয়ে গিয়েছিলো। এবং তা খরচও হয়ে গিয়েছিলো সবটা।
***
০৩. পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বাইরে বাইরে
মা বাবা ভাইবোন আত্মীয় পরিজন সবাইকে ছেড়ে এসেছি প্রায় পাঁচ বছর। পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ালাম যার মধ্যে দুবছর। দিনের পর দিন কিছু খাওয়া জোটেনি, চান হয়নি, ঘুম হয়নি। কখনও বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের অপরাধে চেকারে ধরে নিয়ে গেছে, কখনও রেল পুলিশ চোর বলে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে দিয়েছে। এক দুবার দুর্ঘটনায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একদিন একটা পাউরুটি চুরি করে নিয়েছিলাম এক দোকান থেকে। প্রখর রোদের তাপে ঝলসে গেছে শরীর, বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে কোথাও কোন ছাউনি না পেয়ে। শীতের কামড়ে কেঁপেছি আর কেঁদেছিসারারাত। এভাবেই চিনেছিহৃদয়হীন পৃথিবীটাকে। কে যেন বলে গেছেন পৃথিবীটা গোল। এর যেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যাক অনবরত চলতে থাকলে একদিন সেইখানে এসে যাত্রা শেষ হবে যেখান থেকে একদিন শুরু করা হয়েছিল। আমিও তো এই নিয়মের অধীন। তাই একদিন স্পর্শ পেলাম পায়ের পাতায়–চেনা মাটির। গায়ে এসে লাগল সেই চেনা ফুরফুরে হাওয়া। কানে এসে বাজল আমরি বাংলা ভাষা।
.
আমি যেদিন কলকাতায় ফিরে এলাম সেটা ছিল ১৯৬৯ সালের গ্রীষ্মকালের সকাল। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে শিয়ালদহ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে এই পথটুকুর ট্রামভাড়া ছিল আট নয়া পয়সা, বাসভাড়া দশ নয়া পয়সা। পাঁচ বছরের চেষ্টার পরেও আমার পকেটে ওইটুকু পয়সাও ছিল না। যেদিন গিয়েছিলাম তখনও ছিল খালি হাত, যখন ফিরলাম তখনও তাই।
শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে চেপেছিলাম ঘোলা দোতলায় যাব বলে, ট্রেনের মধ্যেই দেখা হয়ে গেল একজন চেনা লোকের সাথে। সে ঘোলা দোতলার ক্যাম্পেই থাকে। তার মুখে খবর পেলাম আমার বাবা আর সেখানে থাকেন না। তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে যাদবপুরে এসে উঠেছেন। যাদবপুর কোন ছোট জায়গা নয়। বিশাল এই জনারণ্যে কোথায় আছে তারা, কী করে খুঁজে পাবো তাদের! তবু আশায় আশায় নেমে পড়ি ট্রেন থেকে যাদবপুর স্টেশনে। এখানে না নেমে আর যাবই বা কোথায়!
অনেকদিন এই শহরে বৃষ্টিপাত হয়নি। সারা শহর যেন সূর্যের দারুণ দহনে জ্বলে যাচ্ছে। সেই নিদারুণ প্রকৃতির রোষের সাথে পাল্লা দিয়ে সমান তালে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপও। পায়ে পায়ে সাতের দশক যে এগিয়ে আসছে। এই দশকেই তো তাজা বুকের গরম রক্ত দিয়ে লেখা হবে রাজনৈতিক ইতিহাসের সেই অধ্যায়। যা আগে মানুষ কখনও দেখেনি, আগে কখনও শোনেনি, আগে কখনও জানেনি।
আমি সেই ১৯৬৭ সালে শিলিগুড়িতে বসেই শুনেছিলাম নকশালবাড়ির নাম। যেখানে চিরকালের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে আদিবাসী, কৃষক, ক্ষেত মজুররা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, তারা জমিদার জোতদারদের ধানের গোলা দখল করে নিচ্ছে, দখল করে নিচ্ছে চাষের জমি, ক্ষেতের ফসল। তাদের এক কথা, লাঙল যার জমি তার। যে জমিতে কৃষকদের শ্রমে ঘামে ফসল ফলে, অথচ উৎপাদিত ফসলে কোন অধিকার থাকে না, সে আইন তারা মানবে না। কিন্তু শোষক শ্রেণি যাদের লেজুরবৃত্তিকারী রঙবেরঙের শাসক দল, পুলিশ মিলিটারি–তারা মানুষের এই দাবি মেনে নেবে কেন! তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরস্ত্র জনতার উপর। শিশু বৃদ্ধা মহিলা কাউকে রেয়াত করছেনা। ক্রমে বড় হচ্ছে লাশের পাহাড়। আর মানুষ সেই পাহাড় অতিক্রম করে সামিল হচ্ছে প্রতিরোধ আন্দোলনে।
সেই নকশালবাড়ির লাল আগুন এখন সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে। তরাইয়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যে বেজে ওঠা “বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ” এখন শোনা যাচ্ছে নানান দিকে, ক্ষেতে খামারে পাহাড়ে জঙ্গলে। কলকাতায় এসে দেখি, সারা শহর দখল করে নিয়েছে ওই নাম–নকশালবাড়ি।
.
খোঁজার মত খুঁজলে নাকি খড়ের গাদায় হারিয়ে যাওয়া সঁচও খুঁজে পাওয়া যায়। তবে তার জন্য কত দিন মাস বছর লাগে তার কোন হিসাব কেউ বলে যায়নি। আমি এই মহানগরে কোথায় আর খুঁজবো আমার প্রিয়জনদের। চিনি শুধু বাঘাযতীন মোড়, যেখানে আমার বাবা ঝুড়ি কোদাল নিয়ে বসে থাকতেন সেখানে গিয়ে দাঁড়াই। যদি বাবার দেখা মেলে। কিন্তু দেখা মেলে না। তিনি আর ওখানে যান না। যখন যাদবপুরে নেমে ছিলাম এই শহরে আশ্রয় পাবার মতো আমার কোন স্থান ছিল না। সেদিন আমার আশ্রয় হয়েছিল এই রেল স্টেশন। আজও আমার আবাস আশ্রয় ঠিকানা হল সে-ই। আর কোন চা দোকান হোটেলে গিয়ে কাজ নেবার মত মনের ইচ্ছা ছিল না। বড়ও তো হয়ে গেছি একটু। এখন আমি প্রাপ্ত বয়স্ক-যুবক। এখন আমি স্টেশনে মোট বই। ভারী মোট। আর রাত হলে ওভার ব্রিজের সিঁড়ির উপর শুয়ে ঘুমাই।
একদিন ভোর বেলায় ক্যানিং ট্রেনের যাত্রী এক মাছ ব্যাপারীর মাছের চাকন পাল বাজারে পৌঁছে দিয়ে পঞ্চাশ পয়সা মজুরি নিয়ে ফেরবার সময় লেভেল ক্রশিংয়ের কাছে দেখা হয়ে গেল আমার দিদিমার সাথে। শুনলাম তিনি এক বাড়িতে কাজ করেন। রান্না, বাসন মাজা, ঘর মোছা, কাপড় কাঁচা। এর জন্য দু বেলা খাওয়া আর মাসে বারোটা টাকা বেতন মেলে। দিদিমার কাছে খবর পাই, পরিবারের সবাই এখন কোথায় থাকে। আমার মা দুই বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করেন। দু বাড়ির মাইনে মিলিয়ে ষোলটাকা হয়। মেজভাই চিত্ত এক চা দোকানে গেলাস ধোয় সে পায় মাসে দশটাকা। বাবার শরীরটা এখন আগের তুলনায় একটু ভাল। তিনি কার কাছ থেকে যেন জেনে নিয়েছেন খাবার সোডা খেলে পেট ব্যথা কমে যায়। এখন পেট চিনচিন করে উঠলেই একমুঠো সোড়া জল দিয়ে গিলে নেন। সাথে সাথে উপশম। তিনি এখন সেই আগের মত জনমজুর খাটতে পারছেন। যদিও খাটবার ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তবে এখন আর বাঘাযতীন মোড়ে যেতে হয় না। যেখানে থাকেন, সেখানকার পাড়াতেই কাজ পেয়ে যান।
কোথায় থাকেন। থাকেন শ্যামা কলোনিতে। এখন যেখানে সুকান্ত সেতু তখন সেখানে একটা খাল ছিল। ঠিক তার উল্টোদিকে। শ্যামা কলোনিতে ঢোকবার মুখে বা দিকে যে বিশাল বিল্ডিং, এখানে তখন বিল্ডিং ছিল না। ছিল একটা ফাঁকা মাঠ। আর জায়গাটি দখল করে রাখার প্রমাণ স্বরূপ মাঠের এককোণে একখানা ছোট দরমার ঘর। না পায়খানা বাথরুম, না জলের কল শুধু মাত্র একখানা ঘর। এই প্লটখানা যিনি দখল করে রেখেছেন, অন্য এক কলোনিতেও তার প্লট দখল করা আছে। ফলে এখানেথাকতে পারল ন্য। থাকেন সেখানে। দাম বাড়লে, পরে তিনি এই প্লটখানা বিক্রি করে দেবেন। শ্যামা কলোনির উল্টোদিকে রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, যেখানে কুলদা কর্মকার নামে এক ভদ্রলোক থাকেন। তিনি বাবাকে এই ঘরে থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
এই প্লটের পূর্বদিকে যে প্লট, যেটায় এখন একটা ব্যাঙ্ক সেই প্লটে তখন বাড়িটার থেমে থেমে নির্মাণ কার্য চলছিল। বাবার কাজ ছিল এই প্লটে থেকে সেই প্লটের ইট, বালি পাথর সিমেন্ট বাঁশকাঠ সব পাহারা দিয়ে রাখা। এর জন্য তাকে মাসে পনের টাকা দেওয়া হতো।
আমি যখন আসামে গিয়েছিলাম সেটা ১৯৬৮ সাল। তখনই সেখানে “বাঙাল খেদাও” আন্দোলনের অঙ্কুরোদগম হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝেই নানাস্থানে বিক্ষিপ্তভাবে আসামবাসী ও বাংলাভাষীদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছিল। যা থেকে অনুমান করা কঠিন ছিল না যে একটা রক্তক্ষয়ী লড়াই আসন্ন। তখন, আর বোধ হয় আসামে থাকা যাবে না, এই আশঙ্কা করে আসামের জোরহাট নিবাসী এক বিত্তবান বাঙালী ভদ্রলোক কলকাতায় বাড়ি বানিয়ে চলে আসার কথা ভাবেন।
আগেই বলা হয়েছে যে, সেই সময়ে এখানে বহুলোকই একাধিক কলোনিতে একাধিক প্লট দখল করে রেখেছিল। তারা তাদের পছন্দ মতো একদুটো নিজের দখলে রেখে বাকিগুলো উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দিতে থাকে। আসামবাসী ভদ্রলোক দালাল মারফত যোগাযোগ করে ওই প্লটখানা কিনে নিয়ে এই বাড়িটার নির্মাণ করাচ্ছিলেন। পরে অবশ্য আসামের গণ্ডগোল থেমে যাওয়ায় আর তিনি আসাম ছেড়ে এই বাড়িতে বাস করতে আসেননি। ব্যাঙ্ককে ভাড়ায় দিয়ে দেন।
যেদিন আমি সেই বাসায় গেলাম তখন দুপুর বেলায় রান্না করছিলেন আমার মা। একটা হঁটের উনুনে বাঁশের টুকরো কাঠের কুচির জালে একটা কালো হাড়িতে ফুটছিল আটাগোলা। আটা জ্বাল হয়ে গেলে নুন দিয়ে বার্লির মত চুমুক দিয়ে খাবে বলে মায়ের কাছে বসেছিল আমার ভাই নিরু আর বোন অঞ্জু। বাবা তখন বাসায় ছিলেন না। পাশের রেশন দোকানের একটা চালের বস্তা নিয়ে নারকেল বাগান কলোনিতে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন পঞ্চাশ পয়সা মজুরির বিনিময়ে। যেদিন বাবার মজুরের কাজ হয়না ওই দোকানে গিয়ে বসে থাকেন। এতে এক আধটাকা হয়ে যায়। আমার ভাইবোন অধীর আগ্রহেইটের পাঁজা হেলান দিয়ে মায়ের রান্নাকরা দেখছিল। আটার মধ্যে ভেসে ভেসে উঠছিল ওদের কুড়িয়ে আনা কিছু সজির টুকরো। মা ভাইবোন সবারই চোখে মুখে বুকে পেটে শরীরের সর্বত্র জেগেছিল যেন যুগ যুগান্তের প্রবল ক্ষুধা।
আমাকে দেখে ভাইবোন প্রথমে চিনতে পারেনি। চিনেছিল মা। আর ভাইবোন যখন চিনল চক্ করে উঠল তাদের ছোট ঘোট দুজোড়া চোখ। বোনটা এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে–দাদা এ্যাতোদিন আসোস নাই ক্যান! কই আছিলি? আমাগো জইন্য কী আনছোস?
জন্ম মুহূর্তের এক অভিশাপ জর্জরিত মানুষ আমি, দুহাত ভরে শূন্যতা ছাড়া আর কী আনতে পারি! মাথা নাড়ি আমি কিছুই আনতে পারিনি। এই দেশ, সময়, মানুষ, খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে। সবাই ঠকিয়েছে যার যেমন সাধ্য। মা কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করে-এতগুলান বছর কই আছিলি? কোথায় যে ছিলাম মাকে তা কী করে বোঝাই! ছিলাম তোনরকে, নরক যন্ত্রণা ভোগ করার জন্যে। এই পৃথিবীর মধ্যে যে বজ্রকন্টকশাল্মলী নরক রয়েছে যেখানে কৃমিকীটের মত মানুষ মানুষকে খুবলে খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়, আমি সেই নরকের বাসিন্দা হয়েছিলাম। সেই কষ্টের কথা মাকে কী করে বলি! বলে হবেই বা কী? তাই কিছুই বলতে পারি না আমি। একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। গ্রীষ্মের রাগীবোদ আমার শরীর জুড়ে ছোবল মারতে থাকে। দরদর ঘামে গায়ের গেঞ্জি ভিজে ওঠে। ভিজে ওঠে আমার চোখের পাতাও।
এ সময়ে বাবা ফিরে আসেন, পাঁচ বছরে তার বয়স যেন পনের বছর বেড়ে গেছে, হাতের ছেঁড়া ময়লা গামছাটা দিয়ে মুখ চোখ মুছে যেন ভূত দেখছেন এমনভাবে আমাকে দ্যাখেন। তারপর গর্জে ওঠেন–”কী করতে আইলি! আমরা মরছি কীনা দ্যাখতে আইলি বুঝি? মরি নাই। আমরা। মরলে তহন আইস্যা পোড়াইয়া যাইস”। আমার মৌনতায় তিনি আরও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন–”পোলা জন্মাইলে বাপের বুকে হাতির বল হয়। ভাবে, পোলায় বড় হইলে আর আমার কষ্ট দুঃখ এত থাকবো না। পোলায় সে বোঝা কিছু হাল্কা করবো। কিন্তু পোড়া কপাল আমাগো। পোলায় যেই বড় হইছে, পাখনা গজাইয়া গেল তার। যেদিক মোন লয়, ওড়তে আছে। আমরা আছি না গেছি হেতে তার কিছু যায় আসে না।”
বাবার বাক্যের প্রতিটা শব্দের মধ্য দিয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে তার জীবন যন্ত্রণার তীব্র গরল। যা সে পান করেছে সারাটা জীবন। যা তাকে দিয়েছে এই সমাজ সে তা-ই দিচ্ছে সন্তানকে। যার সঞ্চয়ে যা আছে সে তো তাই দিতে পারে, যা নেই তা দেবে কী করে? বাবার কথাগুলো যেন আমার বুকের পাঁজরে দাগ কেটে বসে যাচ্ছে। বাবার কী দোষ! গ্রামবাংলার সরলসোজা মানুষ। সে জানেনা ওই দেশকালে তার ছোট্ট ছেলেটা কতখানি অক্ষম–অসহায়। তার দুর্বল বাহুতে নিজের ন্যায্য পাওনাটুকু আদায় করে নেবার মত শক্তি সামর্থ এখনও আসেনি। তাই প্রতি দরজা থেকে ধাক্কা খেয়ে বঞ্চনা কুড়িয়ে ফিরে আসতে হয়।
যেভাবে মাথা নিচু করে ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, মাথা নিচু করে আবার ফিরে চললাম পথের দিকে। একদিন আমি সেচ্ছায় ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, আজ ঘর আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে। এখন মাথার উপরে মহাশূন্য ছাড়া আমার আর কিছুই নেই।
.
একদিন আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম সেই বাঘাযতীন মোড়ে। যেখানে আমার অকালে বুড়ো হয়ে যাওয়া বাপ কাজ পাবার আশায় এসে বসে থাকতেন। এখন সেখানে সমস্ত তীর্থস্থানে যেমন ভিক্ষা পাবার আশায় ভিখিরিরা বসে থাকে, সামনে ঝুড়ি কোদাল নিয়ে বসে আছে শতশত মজুর শ্রেণির মানুষ। সবাই কাজ চায়। কাজের শেষে চায় মজুরী। তাদের পুত্রকন্যা খিদেয় কাঁদছে। তাদের জন্য চাল কিনে বাসায় ফিরতে হবে।
মোড়ের মাথায় গিজগিজ করছে কর্মপ্রত্যাশী মানুষ। মিস্তিরিরা আসছে বাবু লোকেরা আসছে, গরুর বাজারে যেমনভাবে লোক গরুর শিং দাঁত লেজ নাড়িয়ে দেখে গরু কেনে, সেইভাবে তারা এখান থেকে বাছাই করে মজুর কাজে নিয়ে যাচ্ছে। আমি এখানে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম এই মানুষ কেনাবেচা। এ-ও যেন সেই প্রাচীনকালের বাঁদিবান্দা বেচাকেনার বাজার। তফাত শুধু এই, সারা জীবনের জন্য নয়, এখানে মানুষটাকে কেনা হচ্ছে একদিনের জন্য। ক্রীতদাস পোর চাইতে এতে খরচ অনেক কম পড়ে।
।আমি এখানে কাজ পাবার জন্য আসিনি। আমি তো স্টেশনে মোট বই। এসেছিলাম বাঘাযতীন বাজারে মাছের ঝুড়ি নিয়ে। কিছু ছোট ব্যাপারী খরচা কম পড়ে বলে রিকশায় মাল না চাপিয়ে আমাদের দিয়ে বওয়ায়। ঝুড়ি ফেলে যাওয়ার সময় কী মনে করে যেন দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। তখনই হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল একজন লোক। মাথায় সরসের তেল চপচপে লম্বা চুল, খালি পা, গায়ে হাতওয়ালা সাদা গেঞ্জি, গলায় পৈতা। আমাকে বলে সে “এ্যাই কামে যাবি”? কাজ! কী কাজ? জানায় সে “বিয়া বাড়ির কাম।” জল ভরতে হবে, মশলা করতে হবে, পাতা গেলাস ধুতে হবে, এটো পাতা ফেলতে হবে। এর জন্য মজুরি পাওয়া যাবে সাড়ে তিন টাকা, আর তার সাথে বিয়ে বাড়ির উপাদেয় খাবার একপেট ঠেসে যতটা ধরে।
আমি সেই জনগোষ্ঠীর মানুষ যারা উপাদেয় তো দুরের কথা, পেট ভরেই খেতে পায় না। স্টেশনের কিছু গরিব গুরবো দীন দুঃখী মানুষ বিয়ের সিজনে ডাস্টবিনে ফেলা এটোপাতা–খুঁজে খাদ্য নিয়ে আসে। ওদের মুখে শুনি সেই সব খাদ্যদ্রব্যের নাম। যা আমার বাপ ঠাকুরদাও কোনদিন শোনেনি, চোখে দেখেনি। আমি কাজে গেলে তা চোখে দেখতে পারব। রাজি হয়ে যাই। যামু কামে।
আমি বর্ণব্যবস্থার সর্বনিম্ন ধাপে অবস্থানকারীনমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ। জল-অচল, অচ্ছুত, অস্পৃশ্য। উঁচু জাতের হেঁসেলে গিয়ে ঢুকলে সেটা অপরাধ। যে আমাকে কাজে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে, তার নাম মেঘা দাস, জাতিতে জেলে। অনেক খুঁজে মেঘা এক গুরুদেবকে পেয়েছে যার শিষ্য হলে পৈতা পাওয়া যায়। মেঘা তার শিষ্য হয়ে উপবীত পেয়ে পেশাগত দিকে কিছু নির্ভরতা পেয়েছে। গলায় পৈতে থাকায় আর কেউ জাত জানতে চায় না।
বলে সে–কী নাম তোর? নাম শোনার পর বলে, কেউ জিগাইলে ওই নাম কবি না। জাইত কবি কাইস্থ, কাম কইরা পয়সা নিয়া চইল্যা তাইলে জাইত যাউক সোগা মারাইতে।
এই জগতের এ এক বিচ্ছিরি নিয়ম এক জনের খারাপ না হলে আর একজনের ভালো হয়না। এই জন্যে বলে কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষমাস। জামাই এসেছে শ্বশুরবাড়ি, শাশুড়ির সে কী আনন্দ। ওদিকে প্রাণ গেল কঁচি পাঠাটার। লাখ খানেক ডিম পেটে নিয়ে মারা পড়ল বেচারা ইলিশ মাছ।
আমরা যে বাড়ি রান্নার কাজে গিয়েছিলাম আয়োজন ছিল চারশো জনের। রান্নাবান্না যখন শেষ হঠাৎই শহর কাঁপিয়ে নেমেছিল কালবৈশাখির ঝড়-জল। বড় বড় গাছের ডাল ভেঙে পড়েছিল মড়মড় করে রাস্তার ওপরে। বিকট শব্দে বাজ পড়ছিল চারধারে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিল বিদ্যুৎ ও পরিবহণ ব্যবস্থা। অবশ্য ঘন্টা দেড়েক পরে সেই ঝড় জল থেমেও গিয়েছিল। কিন্তু তখনকার বিক্রমগড়ের পথঘাট এমন ঝা চকচকে তো ছিল না। ইট বিছানো সে রাস্তায় ছিল বড় বড় গর্ত। আর এ রাস্তায় তখন একমাত্র রিকশা ছাড়া অন্য কোন বাহনও ঢুকত না। এখন সেই সব গর্তে জল জমে গেছে। অন্ধকারে চোখ চলে না। চাকা ভাঙার ভয়ে বেশি ভাড়া দিলেও রিকশা আসতে চাইছে না। এই অবস্থায় নিমন্ত্রিত আত্মীয় স্বজন যারা দূরে থাকে–আসে কী করে। তা ছাড়া এই অঞ্চলে এখন রাত নামলেই বোমা গুলি চলা শুরু হয়ে যায়। রাত গম্ভীর হয়ে গেলে তারা ফিরে যাবে কী করে। ফলে চারশো নিমন্ত্রিতের মধ্যে মাত্র দুই আড়াই শ এসেছে। এখন বেঁচে যাওয়া এত খাবার দাবারের কী উপায় হবে?
অন্যান্য মজুরের তুলনায় রান্নার কাজের মজুরদের দ্বিগুণ সময় বেশি খাটতে হয়। সকাল থেকে রাত দুপুর। কিন্তু এর জন্যে মজুরি মেলে না। তার বদলে মেলে দুবেলা খাবার। এরা দুপুরের খাবারটা খেয়ে নেয়। রাতের খাবার না খেয়ে পোটলা বেধে বাসায় নিয়ে যায়। গরিব পরিবারের মানুষ এরফলে একটু সুস্বাদু খাদ্যের স্বাদ পায়। সেদিন নিয়মমত সবাই যখন গামছার উপর কলাপাতা পেতে যে যার মজুরির খাদ্যে নেবে বলে প্রস্তুত, দুঃখী গৃহকর্তা একটা হাতা ঠকাস করে আমাদের সামনে ফেলে দিলেন–কী আর দেব, যার যা লাগে নিয়ে যাও? এসব আর কী হবে, সব তত ফেলা যাবে। যা পারো নিয়ে কমাও।
আমরা পাঁচ ছয়জন ছিলাম। যার গামছায় যতটা ধরে বেধে নিয়েছিলাম মাংস আর ভাত। শুধু আমাদের যে মাথা সেই নরেশ ঠাকুর কোন খাবার নেয়নি। খেয়েছিল দই আর মিষ্টি।
সেদিন রাত দুপুরে বাসায় ফিরে এসেছিলাম আমি। ঘুমন্ত মা বাবা ভাইবোন সবাইকে ডেকে তুলে বসিয়ে ছিলাম সরুচালের ভাত আর পাঠার মাংসের সামনে। বড় তৃপ্তি করে সেদিন খেয়েছিল সবাই আমার জীবনের প্রথম রোজগারের অন্ন।…..আমাদের দেশ মুনি ঋষিদের দেশ, তারা বলে গেছেন লোভ লালসাকে পরিত্যাগ করতে, কারণ লোভে পাপ হয়, পাপ করলে নরক গমন ঘটে, নরকে অশেষ যন্ত্রণা অপমান। কিন্তু মানুষ কবে আর মহাপুরুষদের কথা মেনে চলেছে। আমিও তো মানুষই। আমার লোভ হয়ে গেল, সুস্বাদু খাদ্যের লোভ। নেশা হয়ে গেল, রান্নার কাজে যাবার নেশা। যে আমাদের আসল রাধুনি ছিল তার নাম নরেশ ঠাকুর। সে বাল্যকালে মায়ের সাথে বর্ধমান থেকে কলকাতায় এসেছিল। তারপর আর কোনদিন বর্ধমানে যায়নি। লোকে তার মায়ের নামে সেখানে নাকি যাতা বলে। সে সব কথা শুনতে চায়নি।
নরেশ ঠাকুরের মাসি কিভাবে কেমন করে যেন পৌঁছে গিয়েছিল শেঠ বাগান লেনে। এখানে এক “হাইকোর্টের উকিল” তার ‘বাধাবাবু” হয়ে যায়। উকিল সাহেবের বউ বাচ্চা ছিল না। সে তার সমস্ত রোজগার দিয়ে মাসির নামে বেশ বড় একটা বাড়ি কিনে দেয়। তিনতলা এই বাড়িটায় নিজেদের ব্যবহারের জন্য দু তিনখানা কামরা রেখে বাকি ঘরগুলো দিনচুক্তিতে ভাড়া চলত। মাসির নিজের কোন সন্তান ছিল না। তাই তিনি তার ছোটবোন এবং তার দুই শিশু পুত্রকে এখানে এনে রাখেন। এসব গল্প নরেশ ঠাকুর নিজে আমাকে বলেছিল। আমাকে খুব ভালোবাসত বিশ্বাস করত। তবে তার মা এই পেশা গ্রহণ করেছিল কিনা তা কোনদিন বলেনি। সে নিজে থেকে যা বলেছে তার বাইরে অন্যকিছু আমার জানবার আগ্রহও ছিল না।
মেশো আগেই মারা গিয়েছিলেন, মাসি মারা যাবার সময়ে নরেশ ঠাকুর এবং তার দাদার নামে উইল করে বাড়িটা লিখে দিয়ে যান। এই বাড়িতে কমপক্ষে কুড়ি বাইশটি মেয়ে থাকে। তারা যে ভাড়া দেয়, একটু হিসেব করে চললে পুলিশ এবং পাড়ার মাস্তান, রাজনেতা সবাইকে দিয়েথুয়ে দুভাইয়ের সংসার চলে যাবার কথা। কিন্তু নরেশ ঠাকুরের দাদার খরচ ছিল হিসেব ছাড়া। মদ জুয়া বাইরের মেয়ে মানুষ সব নেশাই ছিল ষোল আনা। সে নিয়ে দুই ভাইয়ে ঝগড়া বচসা। এরপর শুরু হল দু ভাইয়ে পুরো বাড়িটা একা দখল নেবার চেষ্টা। চলল মামলা মোকদ্দমা। মামলার খরচা যোগাড় করা হোত সুদে টাকা ধার করে। শেষে একদিন বাড়িটাই চলে গেল দেনাদারের গর্ভে। দুই ভাই সপরিবারে নেমে এল পথে।
নরেশ ঠাকুরের তখন স্ত্রী মারা গেছে দুই ছেলে দুই মেয়ে রেখে। এরপর আর কী–এখানে দু দিন ওখানে দু মাস এইভাবে পথে পথে, ভাড়া বাসায়, ফুটপাতে দিন কাটানো। লেখাপড়া বিশেষ জানে না, কোন হাতের কাজও শেখেনি, শরীরও কোন শ্রমদায়ক কাজের উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার অবকাশ পায়নি। এখন বাঁচবে কীভাবে। কিছুদিন পরে একে একে ছেলেমেয়ে সবাই তাকে ফেলে চলে যায়।
যখন আমার সঙ্গে নরেশ ঠাকুরের পরিচয় হয়, তখন খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তার বড় ছেলে গনেশটকির কাছে এক প্লাস্টিক কারখানার কাজ করে। বিয়ে করেছে। দুটো বাচ্চা সহ পাতি পুকুরে ঘর ভাড়ায় থাকে। বড় মেয়ে যে ব্যাগের কারখানায় কাজ করত সেই কারখানার সুপার ভাইজারই তাকে বিয়ে করেছে। তারও দুটো বাচ্চা, মা মাসির অতীতে তাকে ধাওয়া করেনি। সে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে আছে। ছোট মেয়ে মা মাসির পদানুসরণ করে পৌঁছে গেছে রাইচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের এক কক্ষে। সেখানেই কামায় ও খায়। আর ছোট ছেলে এসে গেছে সেই শেঠ বাগান লেনে। সে এখন এই গলির এক গুণ্ডা। তোলা তোলে, মদ খায়, মারপিট করে, জেলে যায়।
নরেশ ঠাকুরের সাথে আমি তার ছেলেমেয়ের কাছে অনেকবার গেছি। ছোট ছেলে–যার ডাক নাম বুড়ো সে আমার বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। বুড়োর সাথে গিয়ে পতিতা পল্লীতে মুখে রং মেখে পথের দিকে তাকিয়ে থাকা দুঃখী মেয়েদের যেসব জীবন কাহিনী জানতে পেরেছিলাম তারপর তাদের আর অনেকের মত ঘৃণা করতে পারিনি।
নরেশ ঠাকুর আমাকে ছেলের মতো ভালবাসত। বিশ্বাস করত, তার একলা জীবনের বিপদ বিঘ্নে আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াব। কিন্তু সে আমি পারিনি। আমি তখন নিজের বিপন্ন জীবন নিয়ে কোথায় না কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। সেই সময় সে কী এক রোগে বিনা চিকিৎসায় রামকৃষ্ণ পল্লী মঙ্গল সমিতির বারান্দায় শুয়ে মরে যায় ও নিক্ষিপ্ত হয় বেওয়ারিস লাশ গাদায়।
সে অনেক পরের কথা। এখন আগের কথা বলি। আমার তখন রান্নার কাজে যাওয়ার ছয় সাত মাস হয়ে গেছে। সবদিন তো আর এ কাজ হয় না–মাসে দু চারবার। তবে যখনই কাজে যাই কড়াইয়ের আশেপাশে থাকি আর মন দিয়ে কাজটা শিখি। এ আমার দায়। একটা কিছু করে তো সারা জীবন খেতে হবে। দায়ে পড়ে নরেশ ঠাকুরও এইকাজ শিখেছে। তাইবেঁচে আছে। আমাকেও বাঁচতে হবে।
একদিন উত্তর চব্বিশ পরগণার এক জায়গা থেকে অন্নপ্রাশনের একটা কাজ এল। তিনশো লোকের আয়োজন। কাজটা ধরে নিল নরেশ ঠাকুর। কিছু অগ্রিম পেয়ে গেল। এর নাম বায়না। এসব কাজের এই নিয়ম। এতে দু পক্ষ দুপক্ষের কাছে বাধাপড়া থাকে।
তখনকার দিনে আজকালের মত এত ক্যাটারিং ব্যবসার রমরমা ছিল না। তখন গৃহকর্তা নিজে বাজার হাট করে, রান্নার লোক দিয়ে রাধিয়ে, নিজের আস্থাভাজন লোক দ্বারা পরিবেশন করিয়ে অতিথি অভ্যাগতদের ভুরিভোজন করাতেন।
আমি যে বাড়ির কথা বলতে যাচ্ছি সেই গৃহকর্তার বড় মেয়ের বিবাহ হয়েছে এই যাদবপুরে। মেয়ের বৌভাতে এসে নরেশ ঠাকুরের হাতের রান্না খেয়ে সেইদিনই তিনি মনঃস্থির করে বসেন, নাতির অন্নপ্রাশনে কলকাতার এই ঠাকুরকে দিয়ে রান্না করিয়ে সবাইকে খাইয়ে তাক লাগিয়ে দেবেন। তাই এই বায়না। পারিশ্রমিক বেশ ভালো রকম পাবার লোভে নরেশ ঠাকুর তখন কাজটা তো নিয়ে বসেছিল, কদিন পরে যে ওই একই তারিখে তার একটা বড় কাজ এসে যাবে তা কে জানত। সেটা অন্য অপর কেউ নয়, যে ডেকরেটর্স থেকে বারোমাস কাজ মেলে সেই ডেকরেটর্স মালিকের বাড়ির কাজ। বলে দিয়েছেন মালিক, আমার বাড়ির কাজ তোমাকেই করতে হবে নরেশ। আজেবাজে দুচারটে লোক পাঠিয়ে দেবে, তারা পাতে দেওয়া যায় না এমন রান্না করবে সে কিন্তু হবে না। তাহলে তোমার আমার সব সম্পর্ক শেষ, এই বলে দিলাম।
এখন কী হবে? অগত্যা আমার উপর দায়িত্ব দেওয়া হল উত্তর চব্বিশ পরগনার সেই কাজ সুসম্পন্ন করে আসবার। ভরসা ছিল নরেশ ঠাকুরের–আমি পারব। আমার সাথে যোগাড়ে হয়ে গেল বেতবেড়িয়া গ্রামের দুঃখে। বলে দিল নরেশ ঠাকুর, গিয়ে পার্টিকে বলবি আমার শরীর খুব খারাপ। হঠাৎকরে জ্বর এসে গেছে তাই যেতে পারিনি। কাজ শেষ করে আসার সময় চল্লিশ টাকা চেয়ে নিবি। দশ টাকা বায়না দিয়ে গেছে। এই মোট পঞ্চাশ।
আজ যাব বিকেলে, কাজ কাল, ফিরব পরশু সকালে। দুদিন হাফ একদিন ফুল, আমি ঠাকুর তাই মজুরি পাব ষোল টাকা। এবার আমি পনের টাকায় মাকে একখানা কাপড় কিনে দেব। মা সেই মশারির টুকরো জড়িয়ে কতদিন কাটিয়েছেন অন্ধকার ঘরের কোণে তা আমি জানি না। তাকে দিনের আলোয় আনবার জন্য কর্মকারের বউ একখানা বাতিল কাপড় বাবার হাত দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তখন কর্মকার বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। বাবা মজুরের কাজ করছিলেন। এখন সেখানাও ন্যাকড়া।
তখন বিকেল শেষ হয়ে সবে সন্ধ্যে নেমেছে। আমরা দুজন পৌঁছে গেছি সেই ঠিকানায়। সে সময়ে বাড়িটা সাজানো চলছে। গেটের সামনে কয়েকজন মজুর বাঁশের খুটি পুতছে। কাল এতে ফুলের গোছা বাঁধা হবে। একজন চার পাঁচ খানা হ্যাঁজাকে তেল ভরছে, ম্যান্টেল বাধছে। এ অঞ্চলে এখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছয়নি। আর বাড়ির গোবরলেপা পরিষ্কার উঠোনে এক আমগাছের তলে ইজিচেয়ার পেতে বসে আছেন এই গৃহের বড়কর্তা। তার পরনে ভাঁজ করে লুঙ্গির মতো পরা একখানা দামি ধুতি। গায়ে কিছু নেই এবং হাতে একখানা তালপাতার পাখা। গলায় ধবধবে একগাছা পৈতা। তার সামনে মাটিতে শীতলপাটি বিছানো যার উপরে শায়িত সেই শিশু। যার কাল মুখেভাত। হাজার হাজার টাকা ব্যয়। সোনার বরণ সে শিশুর সারা শরীর সোনায় মোড়া। গলা হাত বাহু কোমর কোথাও খালি নেই। বড়ই ভাগ্যবান এই শিশু জন্ম নিয়েই দশভরি সোনার মালিক।
আমরা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াতেই আমাদের হাতে হাতা খুন্তি দেখে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি-নরেশ আসেনি? বলি আমি–তার শরীরটা। তিনি আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলেন–খুব খারাপ তাইনা? হঠাৎ করে আজ জ্বর এসে গেছে এই বলবি তো? একটু সময় চুপ করে থেকে জানতে চান তিনি-তোদের দুজনের মধ্যে ঠাকুর কে? আমি আঙুল তুলে দুঃখেকে দেখাই। সে দেখায় আমাকে। হুকুম দেন গৃহকর্তা-~ও দিকে তাকা। তাকাই সেই দিকে। একজন মজুর কুড়ুল দিয়ে কাঠ “চেলা” করছে। এই “চেলায়” কাল রান্না হবে। উনি সেই “চেলা” দেখিয়ে বলেন–কে রান্না করবি আমার জানার দরকার নেই। যদি রান্না খারাপ হয় ওর একখানা পিঠে পড়বে মনে থাকে যেন।
সন্ধ্যে গড়িয়ে গিয়ে রাত নামল। সে বড় ভয়ের রাত। চারিদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। মাঠের ঘাসের মধ্যে ঝিঁঝি পোকারা তান ধরেছে। সামনের পাটক্ষেতের মধ্যে সাপে ব্যাঙ ধরেছে। বড়ই করুণ স্বরে কো কো করে কাতরাচ্ছে মৃত্যুপথযাত্রী ছোট্ট জীবটা। যেখানে কাল রান্না হবে সেখানে আমরা দুটো উনুন বানিয়েছি। তারপরে এদের দেওয়া খাবার খেয়ে পাকশালেই শুয়ে পড়েছি। কিন্তু ঘুম আসছে না। আমার নিজের উপর আস্থা আছে। জানি, রান্না আমি ভালোই করব। এমন কিছু ঘটবে না। যে পিঠে চেলা কাঠ পড়ে। কিন্তু দুঃখের বুক কাঁপছে ভয়ে। সে আমার উপর ঠিক ভরসা রাখতে পারছেনা। রাত আর একটু ঘন আর একটু শুনশান, নিস্তব্ধ হয়ে যাবার পর আমাকে চুপিচুপি বলে সে–”চল এ্যাখোন আমরা পেলিয়ে চলে যাই।” আন্না বান্নার কথা কিছু বলা যায় নে। এই ভালো তো এই খারাপ। এরা লোক ভালো নয়। যেদি আন্নায় কোন দোষঘাট হয় বড় ঠ্যাঙাবে। আমি এটা জানি যে এখন পালিয়ে চলে যাওয়া খুবই খারাপ কাজ হবে। তখন এরা যাদবপুরে গিয়েও পিটিয়ে আসতে পারে। জন সমর্থন পাবে। বলা যায় না আমরা চলে গেলে রেগেমেগে আমাদের নামে একটা চুরির কেসও চাপিয়ে দিতে পারে সে কথাই বলি দুঃখেকে। সাহস দিই–ভয় পাইসনা দুঃখে দা, দেখবি আমি ভালোই রানমু।
আমার কথা সত্যি হয়েছিল। নিমন্ত্রিত লোকজন খেয়ে রান্নার খুব প্রশংসাও করেছিল। কিন্তু আমাদের সগুণ দোষে পরিণত হয়ে গেল যখন জাতি পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ল।
এই বাড়ির সেই জামাই যে যাদবপুরে থাকে, সে কোন সাধারণ লোক নয়। নামকরা এক মাস্তান। সে এতক্ষণ পাশের কলাবাগানে বসে পাঠার মেটুলি দিয়ে “বাংলা” খাচ্ছিল। একা নয়, সাথে শ্যালক ছিল। পানপর্ব শেষ করে এসে সে দুঃখেকে দেখেই চিনে ফেললো। এ্যাই, তুই সেদিন আমাদের পাড়ায় পানাপুকুর সাফ করেছিলি না? নরেশ তোকে পাঠিয়েছে রান্না করতে।
এটা তো সত্যি যে রান্নার কাজ সবদিন হবার নয়। কিন্তু পেটের খিদে যে সবদিনের। তাই দুঃখে অন্য কাজ যখন যা পায় করে। তা না করলে সংসার চলে না। আমিও তো স্টেশনে মোট বই। তাই দুঃখে একদিন করেছিল কোন এক পানা পুকুরের পানা তোলার কাজ। সেটাই দেখেছিল মাস্তান জামাই এবং তার মুখটা মনে করে রেখেছিল।
এবার সেই জামাই আর তার শ্যালক দুজনে চেপে ধরল আমাদের। বল তোদের কী নাম, কী জাত। জেরায় প্রকাশ হয়ে গেল–একজন দক্ষিণবঙ্গের কাওড়া আর একজন পূর্ববঙ্গের নমঃশুদ্র। দুটোই জল অচল–অচ্ছুত। এরপর দুই মদ্যপজাত লুকিয়ে বামুনের হেঁসেলে ঢোকার অপরাধে আমাদের ধরে নিয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে, কলা বাগানের মধ্যে। কান ধরে ওঠবস নাকে খত এই সব করালো আমাদের দিয়ে। এটা ওদের কাছে ছিল হয়ত একটা মজা পাবার বিষয়। কিন্তু আমাদের কাছে ছিল চরম অবমাননাকর একটা ঘটনা। যা কোনদিন ভুলে যাবার মত নয়।
পরের দিন সকালে কাউকে কিছু না বলে দিনের আলো ফোটবার আগে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে চলে এসেছিলাম আমরা। এক হীনমন্যতা গ্রাস করে নিয়েছিল আমাদের। সাহস করে যে পারিশ্রমিকের টাকাটা চেয়ে নেব, তাও পারিনি।
.
রামকৃষ্ণ উপনিবেশ কলোনিতে থাকে একজন ছেলেধরা। এই লোকটার নাম প্রণব চক্রবর্তী। এক পার্টির আঞ্চলিক নেতা। ফরসা লম্বা ভদ্রশিক্ষিত এই লোকটি সবসময় খুঁজে বেড়ায় কাকে ধরবে। উঠতি বয়সের ছেলে তার ভারী পছন্দ। আমাকেও ধরবে বলে তাক করে আছে। মাঝে মাঝে সে ডেকে আমাকে চায়ের দোকানে নিয়ে বসায়। নিজের পয়সায় বড় চা নিয়ে দুভাগ করে।
তিনি একদিন বলেছিলেন–”এই পৃথিবীর যা কিছু মহান যা কিছু শ্রেষ্ঠ যত কিছু সম্পদ সবকিছুর সৃষ্টি হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের দ্বারা। তাই পৃথিবীর সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ সবচেয়ে মহান মানুষ হচ্ছে মেহনতি মানুষ, শ্রমিক ও কৃষক।”
আমার কিন্তু শ্রম জীবনের প্রতি কোন আকর্ষণ কোন মোহশ্রদ্ধা আর অবশিষ্ট নেই। কোথাও কোন কাজে যেতে মনের সায় পাইনা। রান্নার কাজে যাবার কথা বললে রাগে সারা শরীর যেন জ্বলতে থাকে। তাই কাজ কর্ম ছেড়ে চুপচাপ ঘরে বসে থাকি।
.
আমার মেজভাই চিত্তর পায়ের উপর গরম জলের কেটলি উল্টে পড়ে গেছে। তাই বাসায় চলে এসেছে সে। পায়ের ফোস্কা সেরে যাবার পর সে একটা অন্য কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। যে মালিক এমন বিপদের সময় শুধুমাত্র ফোস্কার উপর বার্নল লাগিয়ে দায় মুক্ত হয়ে যায়, কোন খোঁজ নেয় না তার কাছে কাজ করার ইচ্ছা নেই আমার ভাই চিত্তর। সে তাই তখন বাসায় বসেছিল।
আমরা শ্যামাকলোনি নামের যে পাড়ায় থাকি, রাজা সুবোধ মল্লিক রোড় পার হয়ে তার এপাশের কলোনির নাম রামকৃষ্ণ উপনিবেশ। সেখানে থাকে অনিল, বিলু আর বাসক-নামগুলো আসল নয় একটু বদলে দিলাম। এরাতিনবন্ধু। অনিলেরা চারপাঁচ ভাই। তাদের যাদবপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে বড়কাপড়ের দোকান।বিলু আর বাসক সুলেখা কালির কারখানার কর্মী। এবং এক রাজনৈতিক দলের সদস্য। পূর্বদিকে রামকৃষ্ণ উপনিবেশ, পশ্চিমদিকে টিবি হাসপাতাল। এর মাঝখান থেকে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সোজা চলে গেছে যে বড় জল নিকাশি নালা, বাসকের মা এই নালায় জমা জলে ডজন খানেক হাঁস পোষে। একদিন ওরা তিনবন্ধু এসে ধরে নিয়ে গেল আমার ভাই চিত্তকে। তাদের অভিযোগ যে সে নাকি হাঁস চুরি করেছে। আমার ভাই চুরি করেছে সেটা কেউ দেখেনি। তবে কে একজন তাকে ওই নোংরা জল নিকাশি নালার কাছে সন্ধ্যে বেলায় ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে। তারপরই হাঁস নিখোঁজ। এতেই প্রমাণিত সে ছাড়া আর কেউ নেয়নি নিখোঁজ হয়ে যাওয়া হাঁসটা।
আমরা যে বাসায় থাকি তাতে কোন পায়খানা নেই। ফলে পায়খানা পেলে আমাদের ওই নালার পাশের ঢোলকমলির জঙ্গলেই যেতে হয়। সাপ আছে জোক আছে বিছে আছে জেনেও আমরা নিরুপায়। এবং আমাদের সবচেয়ে পছন্দের সময় সন্ধ্যার সূর্য ডোবার পরে আর সকালে সূর্য ওঠার আগে। সন্ধ্যার সময় আমার ভাই সেখানে হয়ত গিয়েছিল। তাই শুধু মাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তারা ওকে ধরে নিয়ে গেল। এখানে আমাদের আপনজন কেউ নেই। আমরা এখানকার লোকও নই। এখানে থাকি একজনের অনুগ্রহ আর একজনের বাসায়। আমরা শিক্ষাদীক্ষাহীন–গরিব মানুষ। জাতিতেও নিচু। আমাদের হয়ে এখানে কে কথা বলবে। কেন বলবে? বললে একমাত্র বলতে পারতেন প্রণব চক্রবর্তী, আমার প্রণব দা। কেন কে জানে তিনি ধারে কাছে আসেননি। সেটা কী অনিল তারই সংগঠনের ছেলে বলে? আমি জানি না!
যারা আমার ভাইকে নিয়ে গেছে তাদের যুক্তি অতি চমৎকার–এত বছরে এখানে কারও কোনও কিছু চুরি যায়নি। আমরা আসার পরই হাঁস গেল। এর মানে একটাই–আমরাই চোর। এবং সেই সঙ্গে তাদের ভবিষ্যৎকাল নিয়েও উৎকণ্ঠা, আজ হাঁস চুরি করেছে কাল কার দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে সব মাল হাতিয়ে নেবে তার কি ঠিক। অতএব আজই এমন শিক্ষা দিতে হবে, যেন চুরির নাম ভুলে যায়। সেই শিক্ষা দেবার জন্য শুরু হয়ে গেল বেধরক মার।
আমার বাবা তখনও কাজ থেকে ফেরেননি। সারাদিনের কঠিন পরিশ্রমের পর বাসায় ফিরে ক্রন্দনরতা মায়ের মুখে সবকথা শুনে আর বিশ্রাম নিতে পারলেন না, পাগলের মত ছুটে গেলেন তিনি। হাত জোর করে কেঁদে ফেললেন বাবুদের দয়ার দরজায় “–বাবুগো অরে আপনেরা আর মাইরেন না। পোলায় আমার সারাদিন কিছু খায় নাই। আর মারলে মইরা যাইব।” বাবার স্বীকারোক্তির মধ্যেই তারা মারবার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি খুঁজে পেয়ে গেল। মানুষ চুরি করে কেন? করে স্বভাবে আর না হয় অভাবে। সারাদিন খায়নি, একেবারে সোজা অংক–সেই জন্যই হাঁস চুরি করেছে। হয় ওটা বিক্রি করে চালটাল কিনে আনবে বা এনেছে, নয় কেটে খেয়ে নিয়েছে বা খাবে। ঠিক কী করেছে সেটা যতক্ষণ না বলছে মার চলছে মার চলবে।
বাপের সামনে ছেলেকে মারা হলে কোন বাপের পক্ষেই তা সহ্য করা কঠিন। আর একপ্রস্থ মার শুরু হতেই বাবা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার ভাইয়ের বুকের উপর। দুর্বল শরীরের আড়াল দিয়ে রক্ষা করতে চেষ্টা করলেন সারাদিনের অভুক্ত পুত্রকে বিভৎস অত্যাচার থেকে। তার তখন ঠোঁট কেটে নাক ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। সারা শরীর পথের ধুলোয় লতপত। এই মারকুটে ছেলেদের প্রধান অনিল সাহা। সে বাবাকে টেনে তুলল চিত্তর বুকের উপর থেকে। পল্লীমঙ্গল সমিতির ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম করা বলশালী হাতে বাবাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল পাকা রাস্তার উপর–যাও সরে যাও এখান থেকে নাহলে তোমাকেও বানানো হবে। সব চোর কাহাকা।
আছড়ে পড়া বাবার শরীরে যে আঘাত লেগেছিল, মনে লেগেছিল তার বহুগুণ বেশি। সারা জীবন তার মনে একটা ধারণা ছিল সে সৎ মানুষ, কঠোর পরিশ্রমী, কখনও কারও অনিষ্ট করেন না। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে। এই সব সদগুণের কারণে শ্যামাকলোনি ও রামকৃষ্ণ উপনিবেশের মানুষ তাকে ভালবাসে। এইখানে যে তাকে এত অপমানিত হতে হবে সে তার দুরতম কল্পনাতেও ছিল না। এই অপমানিত জীবন রেখে আর কী হবে? মাটি থেকে উঠে বাবা ছুট দিল রেল লাইনের দিকে। আত্মহত্যা করে তিনি সব অপমানের জ্বালা থেকে চিরমুক্তি নেবেন।
আমি তখন যাদবপুর বাসস্ট্যান্ডে গিয়েছিলাম। রাত তখন প্রায় নটা, বাসায় ফেরবার সময় দেখতে পাই কাঁদতে কাঁদতে টালমাটাল পায়ে আমার বাবা সামনের দিকে ছুটে আসছেন। তাকে ধরে ফেলে থামিয়ে সব শুনলাম। আর তখন সেই অবমাননাময় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে–চিরমঙ্গলময় ঈশ্বরকে অস্বীকার করলাম আমি। হে ঈশ্বর তুমি যখন তোমার এক অন্ধভক্তকে বিপদের দিনে বাঁচাতে এলে না–তোমাকে আমার আর কোন দরকার নেই। আজ থেকে আমার উপাস্য তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী–শয়তান। মনে মনে ডাকলাম হে শয়তান, আমাকে সাহস দাও শক্তি দাও। যে হাত দিয়ে অনিল আমার বাবাকে মেরেছে সেই হাতটা কাধ করে নামিয়ে দেব–সেই সাধনায় সিদ্ধি দাও।
সন্ধ্যের মুখে ওরা আমার ভাইকে নিয়ে গিয়েছিল, আর ছেড়েছিল রাত প্রায় সাড়ে নটায়। এত দীর্ঘ সময়-আশেপাশের মানুষ তামাশা দেখেছে। কিন্তু এক জনের মনেও শুভবুদ্ধির উদয় হল না। কেউ গিয়ে বলল না, কেন, তোমরা ছেলেটাকে এভাবে মারছো।ও যে চুরি করেছে তার প্রমাণ কী?
সেদিন যা জেনেছিলাম, বুঝেছিলাম আমার সেই জানাবোঝার এত বছর পরেও এতটুকু টোল পড়েনি। দীন দুর্বল অসহায় মানুষের উপর অত্যাচার করতে সবল শক্তিমানের কোন প্রমাণ দরকার পড়ে না। তার ইচ্ছাই যথেষ্ট। এখানে আর একটা কথা বলে রাখি-আমি অনিলের হাত কেটে ফেলতে পারিনি। সেটা আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ। কারণ যতদিনে আমি নিজেকে সেই পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হই, ততদিনে সে তার নব বিবাহিত বধূকে রেখে ব্রেন টিউমারে মরে যায়।
আর একটা কথা, শেষ পর্যন্ত সেই হাঁসটা পাওয়া গিয়েছিল। কেন কে জানে সে ড্রেনের পাশের ঢোলকলমির জঙ্গলে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসেছিল। অনেক রাতে ভয় পেয়ে প্যাক প্যাক করে ডেকে উঠলে বাসকের ভাই গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে আসে।
.
আমার ছোট ভাইয়ের নাম নিরঞ্জন। তাকে আমরা ডাকি নিরু বলে। মাথাটা ছোট পেটটা বড়, মায়ের মত মুখ মায়ের মত গায়ের রঙ। এই ভাইটাকে আমি খুবই ভালোবাসি। ছোটবেলায় আমার কোন খেলবার উপকরণ ছিল না। বাবার সে ক্ষমতা ছিল না যে খেলনা কিনে দেবেন। আমি আমার সেই বাল্যের অতৃপ্তি তৃপ্ত করতে চাইতাম নিরুর মধ্যে দিয়ে। আমার কোন ঘুড়ি লাটাই লাট্টু কাঁচের গুলি ছিল না। কিন্তু নিরুর ছিল। আমি তাকে সেসব কিনে দিয়েছিলাম।ও খেলত আর আমি বসে বসে দেখতাম। যেখানে আমরা থাকতাম আমাদের চারপাশের সবাই ছিল স্বচ্ছল শিক্ষিত ভদ্রলোকের দল। যারা কায়িক শ্রমে জীবননির্বাহকারী মানুষকে ইতর ছোটলোক বলে মনে করে। ফলে ওরা আমাদের সাথে মিশত না। খুব দরকার না পড়লে কথা বলত না। আমাদের দারিদ্র্য এবং জাতিগত ভিন্নতা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল আঞ্চলিক সমাজ জীবন থেকে।
আমরা যে ভবনটির নির্মাণ সামগ্রীর পাহারাদার নিযুক্ত হয়েছিলাম সেটির নির্মাণ তখন বেশ কিছুদিন বন্ধ পড়েছিল। তখন আর ইট বালি এসব না আসায় আমাদের ঘরের সামনের মাঠটুকু ফাঁকা পড়েছিল। আমার ছোটভাই নিরু ছোটবোন অঞ্জু ওই জায়গাটুকুর মধ্যে সারাদিন ঘোরাঘুরি করত, খেলত। এই জায়গায় কোন কোনদিন এ পাড়ার বাচ্চারাও খেলতে আসত। তখন ওরা আমার ভাইবোনকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দিত। নোংরা আর ছেঁড়া জামা কাপড় কালো কালো চেহারা তেলহীন রুক্ষ মাথার চুল, খড়িওঠা গা–গতর এসব দেখেই সেইসব বাচ্চারা বুঝে গিয়েছিল, আমরা ওদের মত “ভদ্রলোক” নই। তাই তাদের আমাদের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরে থাকাই প্রচলিত নিয়ম।
সেটা সম্ভবতঃ ১৯৮১-৮২ সালের কথা। আমি তখন রিকশা চালাই। এইট বি বাসস্ট্যান্ড থেকে স্কুল ফেরতা দুটি বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম নর্থরোডে। সাত আট বছরের ফুলের মত সুন্দর বাচ্চা দুটি নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল হাসছিল। সেই পবিত্র নির্মল প্রাণখোলা হাসিতে আমার মনটাও হাসছিল “গাধা ঘোড়া গরু” তুল্য জীবনের কষ্ট অপমান ভুলে। রিকশা চালাতে চালাতে তাদের সাথে আলাপ জমাতে চেষ্টা করছিলাম আমি, কি নাম তোমার খুকুমণি। কোন ইস্কুলে পড়ো…। আর নর্থরোডে পৌঁছে সুদৃশ্য বাড়ির দরজায় রিকশা থামিয়ে বিগলিত আত্মীয় ভাবনায় বলে বসেছিলাম, খুকুমণি আমাগো বাড়ি যাইবা? আর তখন সেই ফুলের মত শিশুর চোখে মুখে সেদিন যে ঘৃণার চালচিত্র ফুটে উঠেছিল তা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না। ছোট্ট ঠোঁট বাঁকিয়ে সেই শিশু চরম তাচ্ছিল্যের শব্দে বলেছিল–”তোমাদের বাড়ি কেউ যাবে না। তোমরা রিকশা চালাও।”
ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায়–বঙ্গভূমির বাঙালী মননে, বিশেষ করে কলকাতা মহানগরীর মধ্যবিত্ত ভাবনায়, ছোটজাত, ছোটলোক, কায়িকশ্রম এই তিনটি শব্দ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যারা ছোটজাত তারাই ছোটলোক। তারাই রিকশা চালায় মজুর খাটে, ঠেলা চালায়, বাসন মাজে এবং নানারকম কায়িকশ্রমে পেটের খাবার সংগ্রহ করে। আর যারা ভদ্রলোক তারা ভালো খায়, ভালোবাড়িতে থাকে, ভালো চাকরি করে যাতে কোন ঘাম ঝরে না শ্রম লাগে না। এই ভাবাশ্রয়ী পরাবৃত্তের মধ্যেই তাদের সব অভিগমন। যার দ্বারা পারিবারিক পরিবেশগত কারণে শিশুরাও সংক্রামিত হয়ে পড়ে শিশু বয়েসেই।ওদেরও কচি মনে দাগ কেটে বসে যায় ওরা আমরা এই শ্রেণি বিভাজন। দুয়ের কোন বিন্দুতে সম্মিলন সম্ভব নয়। এই ভাবনা উঁচু থেকে নিচুতে, গাছের মগডাল থেকে শেকড়ে চারিয়ে গেছে। কোন গরিব আর নিজেকে ভদ্রলোক বলে ভাবতে পারে না। ভয় পায়, লজ্জাও পায়।
একবার আমি বাইপাশ পার হয়ে রাধা হাউসিংয়ের কাছে একজন লোককে খুঁজতে গেছি। তিনি বলেছিলেন, হাউসিংয়ের পিছনেই ওনার বাড়ি। তিনি ভ্যান রিকশা চালান। দুপুর বেলা সেখানে গিয়ে দেখি ছোট ছোট অনেকগুলো ঘর। এর ঠিক কোনটায় তিনি থাকেন বুঝতে পারি না। শেষে এক ঘরের সামনে একটি মেয়েকে দাঁড়ানো দেখে জিজ্ঞাসা করি–আচ্ছা বলতে পারেন এখানে এক ভদ্রলোক থাকেন, ভ্যান রিকশা চালান। তার বাড়িটা কোথায়? আমার কথা শুনে মেয়েটা বড় ভাবনায় পড়ে গিয়ে বলে–এখানে যারা ভদ্রলোক সব তো হাউসিংয়ে থাকে। তারা সব চাকরি করে। কেউ ভ্যান চালায় না। ভ্যান রিকশা চালায় আমার বাবা কিন্তু সে ত… মেয়েটির বয়স বছর চব্বিশ। অল্প লেখাপড়াও জানে। দেবী শেঠির হাসপাতালে কাজ করে। পুরাতন অভ্যাসে সেও অন্যদের মত তার ভ্যান রিকশা চালক বাবাকে ভদ্রলোক বলে ভাবতে পারছে না। তার ভাবনাকেও বিকৃত করে দিয়েছে এই দুষিতকরণ প্রক্রিয়া।
সেদিনে আমাদের ঘরের সামনের মাঠে ’পাঁচ-ছটা’ ভদ্রলোকের সন্তান ব্যাটবল নিয়ে ক্রিকেট খেলতে এল। এটা সত্যি যে এ পাড়ায় বাচ্চাদের খেলবার মতো কোন ফাঁকা জায়গা নেই। তারা এসে আমার ভাইবোনকে তাড়িয়ে দিয়ে জায়গাটার দখল নিল। মা বাবা দুজনে কাজে গেছেন। মেজ ভাইও ঘরে নেই। আমি কি এক দরকারে যেন কোথায় গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি আমার ভাই নিরু কাঁদছে। কাঁদছে কেননা ও পাড়ার বাচ্চারা তার কাঁচের গুলি সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। যার দুটো সে খুঁজে পাচ্ছে না।
মাথাটা ধাঁ করে উঠল আমার। আমরা এখানে থাকি। আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। যতদিন আমরা আছি আমাদের অধিকার সবার আগে। আমার ভাইয়ের গুলি ফেলে দেয় এত স্পর্ধা কার! আমি ছুটে গিয়ে ওদের উইকেট তুলে ফেলে দিই–যা! এখানে কোন খেলা ফেলা হবে না। তারা গিয়ে তাদের দাদাদের সে কথা জানাল। খেলতে দিচ্ছে না। উইকেট তুলে ফেলে দিয়েছে। এরপর দাদারা দৌড়ে এল। এক দাদা যে আমার চেয়ে বছর সাত আট বড় দশ-বারো ইঞ্চি বেশি লম্বা সে ঠাস করে এক চড় হাঁকাল আমার বাঁ গালে। বাঞ্চোৎ, এত সাহস তোর! আমাদের পাড়ায় থাকিস আবার আমাদের উপর মস্তানি দেখাস! আন, এনে যেখানের উইকেট সেখানে পুতে দে!
আগে আমি এদের হাতে অনেকবার মার খেয়েছি। এই দাদাও একবার মেরেছিল। কিন্তু এখন আমি অন্য মানুষ। যার একমাত্র উপাস্য শয়তান। যে আমাকে শিখিয়েছে কোন ভয়ভীতির সামনে নত না হতে। মানুষ একবারই মরে, কাপুরুষ মরে বারবার। যে মানুষ মরতে ভয় পায়, তাকে সবাই ভয় করে। আমিও চড়ের বদলে এক চড় বসিয়ে দিলাম তার ডান গালে। ওই চড় যেন মৌচাকে ঢিল মেরে দিয়েছে। পাঁচ-সাত জন একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। কিল চড় লাথি ঘুসি-মুহূর্তে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল আমার শরীরের উপর দিয়ে। তারা যখন ক্লান্ত হয়ে থামল তখন আমার নাকমুখ থেকে গলগল করে রক্তের ঢল নেমে বুকপেট সব ভাসিয়ে দিচ্ছে।
কলকাতা শহরে এসে এ আমার এক নতুন অভিজ্ঞতা। আমাদের ক্যাম্পে দেখেছি দুজনে ঝগড়া মারামারি হলে দশজনে এগিয়ে এসে তাদের থামিয়ে দেয়। এখানে একজনের উপর দশজন মিলে হামলে পড়লে অন্য সবাই দূরে দাঁড়িয়ে দেখে। এক বিভৎস আনন্দে অবগাহন করে। কেউ কাছে আসে না। এখানকার নীতি যে আক্রান্ত সে যদি পারে আত্মরক্ষা করুক, না পারলে মরুক।
“জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা।” মানব মনোবৃত্তি সম্বন্ধে এই যে জ্ঞান তা আমারও একদিন কাজে লাগবে। যেদিন আমিও মারতে শিখে যাব। কিন্তু আমি এখন কী করব।ওরা অনেক আমি একা, তাবলে মার খেয়ে মাটিতে পড়ে থাকব। ওরা যখন আমাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ফিরে যাবার পথ ধরেছে ধুলো ঝেড়ে উঠে বঁছালাম। আমার আরাধ্য দেবতা শয়তানের শরণাপন্ন হলাম আমি। হে দেবতা আমাকে সাহস দাও শক্তি দাও। সারা জীবনে অনেক মার খেয়েছি। অনেক রকমভাবে মেরেছে মানুষ। হয় আমাকে ভয় জয় করে উঠে দাঁড়িয়ে মারতে শেখাও, নয় তো মৃত্যু দাও।
ঘরে আমাদের একখানা ছোট কুড়ুল ছিল। বাবা এই কুড়ুলের সাহসে একা চলে যেতেন কাঠ কাটতে গভীর জঙ্গলে। সেই কুড়ুলখানা আজ আমার হাতে। এ যেন সেই পরশুরামের কুঠার। যা দুর্বিনীত অহংকারী অত্যাচারী ক্ষত্রিয়কুলকে একুশবার ধ্বংস করেছিল। সেই কুড়ুলখানা তুলে ধাওয়া করলাম ওদের। তখন, ওরা অনেক আমি একা, ওরা বলবান আমি বলহীন, ওরা উচ্চবর্ণ আমি নিঃস্ব, এদেশের আইন ধনবানের রক্ষক, ধনহীনের ভক্ষক, এ সব কোন কিছু আর মনে রইলনা। মনের মধ্যে তখন জেগে উঠেছে এক এতকালের ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি। মার কা বদলা মার চাই। খুন কা বদলা খুন।
ওরা আমার দিক থেকে প্রত্যাঘাত আশা করেনি। কাঁদব, নালিশ করব, কপাল চাপড়াব, আমাদের জাত গোত্র শ্রেণির মানুষ চিরকাল যা করে থাকে। সেই চিরকালের বিধান নিয়ম উল্টে দিয়ে নিজেই বিচারকের আসনে বসে বিচার করে নিজের হাতে অপরাধীর শাস্তি দেব সেটা ছিল তাদের কল্পনারও অতীত। তাদের একজনের ঘাড়ে কুড়ুল পড়তেই বাকি সবাই প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে যে যেদিকে পারে ছুট মারল। সেদিন সেই সময় অন্ততঃপক্ষে দশ পনের মিনিট আমার চারপাশে কোন মানুষ হিম্মত করে এসে দাঁড়াতে পারেনি। পাড়ার গলিতে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলাম একা আমি। যাকে এই কিছুক্ষণ আগে মনে হয়েছিল একটা চক্রব্যুহ, ভোতা এক কুড়ুলের দাপটে তা পরিণত হয়ে গিয়েছিল একটা মুক্তাঞ্চলে।
এর কিছুক্ষণ পরে পাড়ার মাতব্বর গোছের মানুষরা বের হয়ে এসেছিলেন। তাদেরই একজন আমার হাত থেকে কুড়ুল ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। পথে যেতে যেতে যে পুলিশ ভ্যানখানা দাঁড়িয়ে পড়েছিল গণ্ডগোল দেখে, তুলে দিয়েছিলেন সেই ভ্যানে। তবে কেন কে জানে তারা আমাকে থানায় নিয়ে কোন কেস না দিয়ে একদিন এক রাত আটকে রেখে দু চার ঘা মেরেই ছেড়ে দিয়েছিল।
আমি শয়তানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। বিনিময়ে শয়তান কী আমাকে রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে দিল? না তা দিল না। দিল এক অদ্ভুত মানসিক আরাম দিল সেই সুমহান আত্মশক্তি, যা প্রবল ঝড় ঝঞ্জার মধ্যে এক শিশুবৃক্ষকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে শেখায়।
আমরা যেখানে থাকি তার পাশের কলোনি আনন্দপল্লীর দুই উঠতি মাস্তান কাজল আর পনু, এরাই আমার কাছেশয়তানের অবতার। আমার কথা তাদের কানে পৌঁছেগিয়েছিল। বুঝে ফেলেছিল তারা, আমার মধ্যে উপাদান আছে। কাঠে আগুন আছে পাথরে আগুন আছে। সে আগুন বের হয় তখন, যখন দুটো কাঠকে ঘর্ষণ করা হয়, দুটো পাথরকে ঠোকা হয়। আমাকে সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে ঠেলে দিলে আমিও আগুন হয়ে উঠব। ওরা আমাকে তাদের সঙ্গী করে নিল। আগে আমি ছিলাম এক আমার পিছনে দুই আসায় বারো হয়ে গেলাম। ওরা আমাকে শিখিয়ে দিল কেমন করে বোমা বানাতে হয়, কেমন করে তা ছুঁড়তে হয়। এবার আবার আমি পুলিশের দৃষ্টিপথে এসে গেলাম। এখন আর আমাকে ধরলে কেস না দিয়ে ছেড়ে দেবে না। আচ্ছামত “বায়নট” করে চালান দেবে।
রামকৃষ্ণ উপনিবেশের মাঝখানে একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি। বাড়ির চার দিকে উঁচু দেওয়াল। এই বাড়ির মালিকদের লাইসেন্স বন্দুক এবং দেশে প্রচুর জমি জায়গা। এরা কি করে এক জবরদখল কলোনির প্লট পায় সে এক রহস্য। এরা তো পূর্ববঙ্গের লোকই নয়। সব সেই প্লট কেনাবেচার রহস্যময় মোড়কে লুকানো।
স্বনামধন্য সাহিত্যিক “যাযাবর” লিখেছেন তার “দৃষ্টিপাত” উপন্যাসে–বাঙালী যেখানে যায় সবার আগে গড়ে একটা কালীমন্দির। সেই নিয়মে ভাদুড়ি বাড়ির ডানপাশে–টিবি হাসপাতালের পচাখাল ঘেসে এ কলোনির লোক একটা কালীমন্দির বানিয়েছে। সেখানকার ভগ্নমন্দিরে এক গরিব কালীর পূজা হয়। একদিন সেই কালীমন্দিরের পিছনে বসে রামকৃষ্ণ উপনিবেশের “আলু স্বপনের” সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন সারা দেশে নকশাল বাড়ির লাল আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। সে আগুন থেকে যাদবপুরও রক্ষা পায়নি। ফলে আমাদের কথপোকথনে বারবার উঠে আসছিল ওই নাম। আমি শিলিগুড়ি গিয়েছিলাম, তাই নকশাল, কানু সান্যাল জঙ্গল সাওতাল তাদের বিষয়ে বক্তা ছিলাম আমি, স্বপন শ্রোতা।
এক সময়ে আমাদের আড্ডা শেষ হল। আমি যখন ঘরের পথে পা দিয়েছি স্বপন হঠাৎ কি মনে করে কে জানে কালীমন্দিরের সামনে পড়ে থাকা হোমের একখানা পোড়াকয়লার টুকরো তুলে এগিয়ে গেল ভাদুড়িদের দেওয়ালের সামনে। চুনকাম করা সাদা দেওয়াল, যার এককোণে লেখা ইংরাজি বর্ণমালার তিনটি অক্ষর–সি.পি.এম। স্বপন তার পাশে অহেতুক একটা ‘এল’ অক্ষর বসিয়ে দিল। এই দেওয়াল দখল ছিল সি.পি.এম দলের। দখলচ্যুত হয়ে তা সি.পি.এম.এল–অর্থাৎ নকশালদের হয়ে গেল। তখন সেই পথে হেঁটে যাচ্ছিল সুলেখা কারখানার কর্মী সিটু ইউনিয়নের নেতা দেবদাস। সে এইশিল্পকর্ম এবং শিল্পীদের প্রত্যক্ষ করে গেল। তারপর দলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর যা কাজ–সে খবরটা লোকাল পার্টি অফিসে পৌঁছে দিল।
সেদিন সি.পি.এম. পার্টির যুব সংগঠন ডি.ওয়াই.এফয়ের একটা মিছিল ছিল। সে মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জঙ্গি নেতা পিন্টু সেন। নানা পথ ঘুরে লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই শ্লোগান দিয়ে সে মিছিল এসে শেষ হয় “মেজদার” চা দোকানের সামনে। যেখানে আমি বসেছিলাম। ওরা ধরে নিয়ে গেল আমাকে।
সুন্দরবন নয় এটা, তবু এমন একটা অঞ্চল যেখানে বাঘেরা বাস করে। যে বাঘের নাম সি.পি.এম. এখানকার আশেপাশের কোন কলোনিতে অন্যকোন পার্টির নামগন্ধ নেই। সব বাঘেরা খেয়ে নিয়েছে। সেই বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! সি.পি.এম পার্টির বড় শত্রু নকশাল অনুপ্রবেশ! এর এখনই একটা প্রতিষেধক ব্যবস্থা না নিলেই নয়।
পিন্টু সেনবাবু একজন বিচক্ষণ নেতা। তিনি মন দিয়ে “কি করিতে হইবে” সেই বইখানা পড়েছিলেন। “আলু” স্বপন এই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। সে ভালো ফুটবল খেলে, যে কারণে যুবজনের প্রিয়। এ ছাড়া তারা চার পাঁচ ভাই। বাপের পাইকারি আলুর কারবার। জাতিতে কায়স্থ। ওকে কিছু করলে এলাকায় তার একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ওর সাথে থাকা অন্য যে ছেলেটা কি যেন নাম, ওর বাপ মজুর ঘাটে মা করে ঝিগিরি। ওরা এই অঞ্চলের কেউ নয়। জাতিতেও নিচু। এছাড়া তার নামের পিছনে কিছুটা বদনামও আছে, ওকে ধরে মারায় কোন ঝামেলাই নেই।
সর্বহারা পার্টির নেতা সেনবাবুর এক সর্বহারাকে ঝাড় দিতে মনটা একটু কাতর হয়েছিল, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার উপায় ছিল না। এটা একটা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। ঝিকে মেরে বউকে বোঝাও এটা আমাদের প্রাচীন পদ্ধতি। এই জন্য ওকে একটা দৃষ্টান্তমূলক মার দিতে হবে। সেই মার দেখে যেন অঞ্চলের যুবজনের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে যায়। দেখ নকশাল করলে তার কী হাল হয়। ভয়ে যেন কেউ নকশাল নাম পর্যন্ত মুখে না আনে।
আমাকে নিয়ে গিয়ে উপনিবেশের সি ব্লকের পার্টি অফিসের সামনের লাইট পোস্টে বাঁধা হল। লড়াই লড়াই লড়াই চাই, শ্লোগানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ গরান কাঠের যে ঝান্ডাবাঁধা ডাণ্ডা তা দিয়ে খুব মেপে আমার হাটুতে হিট করলেন সেনবাবু–বল তোদের বোমা পাইপগান কোথায় আছে? কতজনকে খুন করেছিস? তোদের দলে আর কে আছে? কতদিন ধরে নকশাল করিস? একটা করে প্রশ্ন একবার করে হিট। ওরা জানে আমার কাছে এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। আমিও জানি উত্তর নেই, তাই শুধু বাবাগো মাগো করি। জবাব দেবার মত প্রশ্ন আসে একটা, বল দেওয়ালে কেন লিখেছিস? বলি, মুই লেহি নাই। মুই তো ল্যাখতে জানি না। সে কথা কোন ঘাস জল খায় না। মার চলতে থাকে।
ঘন্টা দুয়েক ধরে আমাকে দুরমুশ, থেঁতো, গুড়ো করার পর শেষে একটা রিকশা ডেকে তুলে দেওয়া হল তার পাদানিতে। যা এটাকে শ্যামাকলোনির মোড়ে ফেলে রেখে আয়।
সেদিন সারারাত গাঠের যন্ত্রণায় কাতরেছিলাম আমি। জ্বর এসে গিয়েছিল। তখন ভীষণ ভয়ও করছিল আমার, আর বোধহয় কোনদিন পায়ের উপর উঠে দাঁড়াতে পারব না। পঙ্গু হয়ে যাব। এখন আমার দরকার চিকিৎসার। চিকিৎসা করাতে যে টাকা লাগে, সে আমরা কোথায় পাব! তাইবিনা চিকিৎসায় পড়েছিলাম আট-দশদিন।কাজল পনু যাদের উপর আমার ভরসা ছিল তারাও এ সময়ে কেউ আমার কোন খোঁজ নিল না। ওরা টের পেয়ে গেছে, সময় বদলে যাচ্ছে। এখন মস্তানি গুন্ডামি চালিয়ে যেতে হলে পার্টির ছত্রছায়া ছাড়া গতি নেই। ওরা শক্তিমান, আমাকে দেখতে এসে তাদের বিষ নজরে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। খবর পেলাম “আলু স্বপন” তার বাবাকে সাথে নিয়ে সেনবাবুর কাছে সারেন্ডার করে এসেছে, যা করেছি ভুল করেছি। এখন থেকে আপনি যা বলবেন তাই করব।
সেনবাবু আমাকে মেরে অবশ্যই কিছু লাভবান হয়েছিলেন। তবে সব ক্রিয়ার একটা সমানুপাতিক প্রতিক্রিয়া থাকে, নিউটনের সেই সূত্র অনুসারে আমারও কিছু লাভ হয়েছিল। চারিদিকে আমার খ্যাতি ছড়িয়ে গিয়েছিল।
একদিন সকালে যখন আমি কিছুটা সুস্থ সচল হয়েছি, আমাদের ঘরের সামনে মেজদার চা দোকানে গিয়ে একটু বসেছি। তখন সেখানে চা খেতে এল সেলিমপুর রেল কলোনির টিউবওয়েল মিস্ত্রি নকুল আর গোষ্ট। চা দোকানদার মেজদাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল ওদের সাথে। আর তখন মুখ নিচু করে চাপা গলায় বলে গোষ্ট, আমরা তোর খোঁজে এসেছি। আশুদা তোকে দেখা করতে বলেছে।
আশুদা মানে নকশাল নেতা আশু মজুমদার। তখনকার যাদবপুরে এক মহা সংগ্রামের মহানায়ক হিসাবে এই মানুষটি প্রতিষ্ঠিত। তিনি আমাকে দেখা করতে বলেছেন। নিজের অবস্থানে আমার পক্ষে অটল থাকা আর সম্ভব হল না। ওদের পিছু পিছু হাঁটা দিলাম আমি। যেন আমাকে আমার অদেখা ভবিতব্য হটিয়ে নিয়ে গেল গরফায়।
সারা শহর–শুধু শহর কেন পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম নগর সব, কেউ কেউ তো এমনও বলে যে সমস্ত ভারতবর্ষ এখন স্পষ্ট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক ভাগে আছে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজিপতিশ্রেণি ও তাদের দালালরা। যাদের পিছনে রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ. এই ভাগে রয়েছে ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণি এবং রাষ্ট্রের আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত বিশাল পুলিশ ও মিলিটারি বাহিনী। আছে মুখে দরিদ্র জনগণের কথা বলা রঙবেরঙের পতাকাধারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। যাদের পিছনে টাকার থলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধনিক শ্রেণি।
অপরদিকে রয়েছে আদর্শের প্রতি নিবেদিত প্রাণ ছাত্র যুব শ্রমিক কৃষক। এক কথায় বিপ্লবী জনগণ। এই কঠিন সময়ে কেউ নিরপেক্ষ নয়। যে নিরপেক্ষ সে আসলে শোষক শ্রেণির শোষণ দমন পীড়নেরই মৌন সমর্থক হয়ে রয়েছে অজ্ঞাতসারে। এই সময় আমাকে ডাক দিয়েছে আমার মানবিক, সামাজিক দায়িত্ব পালন করবার জন্য। আশু মজুমদার কোন এক ব্যক্তি নয়, এই সময়ের মুখপাত্র। সময়ের দাবি মেনে নিয়ে অবশ্যই আমাকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে কোন এক পক্ষে। কোন পক্ষে যাব আমি?
যদি যেতে হয় আমাকে সেই পক্ষে যেতে হবে যেখানে আমার মত সর্বহারা মানুষরা রয়েছে। যেখানে আশু মজুমদার রয়েছে। আশু মজুমদারের মতো নিঃস্বার্থতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আর কে বা আছে? ভোট চায়না গদি চায়না সুখভোগ বিলাসব্যাসন কিছুই চায়না তারা। চায় একটা শোষণমুক্ত শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণ করতে। যে সমাজে সব মানুষ সমান সব মানুষ সমান সম্মানীয়। সবার জন্য থাকবে খাদ্যবস্ত্র শিক্ষা বাসস্থান চিকিৎসা।
এই অবস্থা এমনি এমনি আসবে না। একে স্থাপন করতে হলে হাজার বছরের পচা পুরাতন জীর্ণ এই সমাজ কাঠামো, রাষ্ট্র ব্যবস্থাটা ভেঙে চুরে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। এই ধ্বংসের পরে যে নব নির্মাণ তারই নাম বিপ্লব। বিপ্লব এক উগ্র বলপ্রয়োগ দ্বারাই সফল হয়। কারণ কোথাও কোন শাসক স্বেচ্ছায় ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে সরে দাঁড়ায় না। উগ্র বলপ্রয়োগ দ্বারা তাকে উৎপাটন করতে হয়। এর জন্য প্রচুর প্রাণহানি প্রাণ বলিদান আত্মত্যাগ করতে হয়। আশু মজুমদারের দল সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।বিপ্লবী যুবারা বুকের গরম তাজা রক্ত ঢালছে। নির্ভয়ে বুক পেতে বুলেট নিয়ে আত্মত্যাগের এক সুমহান ইতিহাস রচনা করছে। যে জল বিন্দু একা থাকে রোদ তাকে শুকিয়ে দেয়, মাটি তাকে শুষে নেয়। সে যদি কোনভাবে সাগরে গিয়ে পৌঁছাতে পারে সাগর হয়ে যায়। আমি সাগরে পৌঁছে গেছি। আমি ইতিহাসের পাতার উপর পা রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছি। সেই স্পার্টাকাস থেকে শুরু করে সিধু কানু বীরসা বীর নারায়ণ তিলকা মাঝি আর এই নকশাল আন্দোলনের বীর শহীদ বাবুলাল বিশ্বকর্মা এদের বুক থেকে ঝরে পরা রক্তের মহাসাগর, আমি সেইরক্ত স্রোতের উত্তরসুরি। আমি এইমাত্র আমাকে চিনেছি। তাই আর ফিরে যাওয়া হল না।
আমি গরফায় যেদিন আসি তার ঘন্টা দুয়েক পরে এখানে পুলিশ এসেছিল। এটা তাদের রুটিন কাজ। কখনও পুলিশ কখনও সিপিএম মাঝে মাঝে নকশালদের এই ঘাটিটার ওপরে হামলা চালাত। ওদের সম্মিলিত প্রয়াস ছিল যেভাবেই পারে এই ঘাটিটাকে চূর্ণ করে দেবে। এই দুপক্ষের স্বার্থের সামনে হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এই ঘাটির কিছু অকুতোভয় যুবা। তাই এই আক্রমণ। তো সেদিন আমি আমার অক্ষম অচল শরীর নিয়ে ঘটনাক্রমে সেই অসমযুদ্ধের শরিক হয়ে গিয়েছিলাম। একদিকে মারাত্মক মারণাস্ত্র সজ্জিত একদল হায়নাতুল্য হিংস্র পুলিশ আর একদিকে আদর্শের বলে বলীয়ান একদল আগুনখোর যুবক। যাদের কাছে গোটা কয়েক হাত বোমা আর রেল লাইনের খোয়া ছাড়া অন্যকোন অস্ত্র ছিল না। তবু সেই দৃঢ় প্রতিরোধের সামনে থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল বিশাল পুলিশ বাহিনী ভয়, সেদিন নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এটা যখন একটা যুদ্ধ, ক্ষয়ক্ষতি যে দুপক্ষেরই হবে সেটা তো স্বাভাবিক। ওপক্ষের কতটা কী হয়েছিল তা আমি জানি না। তবে এ পক্ষের কাতু নামের মধ্যবিত্ত ঘরের একটা ছেলের হাত উড়ে গিয়েছিল। পাল বাজারের পিছনে যে কাঠগোলা, হাওয়াই চটি পায়ে, হাতে বোমা নিয়ে পেছল কাঠের উপর দিয়ে দৌড়াতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে যায় সে। তখন হাতের বোমা হাতেই ফেটে যায়।
আর সেদিন, চিরদিনের নিপীড়িত নির্যাতিত দরিদ্র দুর্বল এক মানুষ আমি, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে সেদিন আমার মনে হয়েছিল আমি লেলিন আমি মাওসেতুং, আমিই সেই মহান বিপ্লবী চেগুয়েভারা।
আমি লেখা পড়া জানি না বটে তবে এদের নাম জানি। এদের ইতিহাসও জানি। সে সব আমাকে বলেছিলেন রামকৃষ্ণ উপনিবেশের আর.এস.পি নেতা “ছেলেধরা” প্রণব চক্রবর্তী। কে জানে যদি আমাকে সি.পি.এমরা না মারত, যদি আমার বাবাকে মারা অনিল, তার দলের সাথে যুক্ত না থাকত, আমি প্রণবদার সাথেই থাকতাম কী থাকতাম না। আর এখন সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম লালগড় এবং বাসন্তীর ঘটনার পরেও আর.এস.পির লালবাড়ির নেশায় পড়া নেতা মন্ত্রিদের নির্লজ্জ লেজুড়বৃত্তি দেখে দল ছেড়ে বসে গিয়ে প্রণবদার মত নষ্ট করা চল্লিশ বছরের জন্য মাথার চুল ছিড়তাম কী না!
গরফায় আমার থাকা ও কাজের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল সেলিমপুর রেল কলোনি। নকুল গোষ্ঠ মন্টু হারু মাধাই রতন নিতাই এবং রাজাপুরের ননীদা যে আমারই মতো নিজের পাড়া ছেড়ে এখানে এসে থাকে, এরাই সব সাথী হল আমার। একমাত্র ননীদা মধ্যবিত্ত বাড়ির সন্তান। এছাড়া আর যারা, সবাই গরিব। এদের কেউ আগে রিকশা চালাত, কেউ স্টেশনে মোট বইত, কেউ বেঁচত উনুন ধরাবার কুঁচো কাঠ, কেউ ছিল টিউবওয়েল মিস্ত্রি। এদের মধ্যে মন্টু রতন হারু অন্য পাড়া থেকে এসেছে নকুল গোষ্ট মাধাই নিতাই এই রেল কলোনিতে থাকে। বিপ্লবী সাজা এদের কাছে বাবুঘরের বিপ্লব বিলাসিতা নয়। ভীষণ জরুরি সুস্থ সুন্দর স্বপ্ন, প্রাণধারণের পক্ষে এক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। যা প্রাপ্ত করার জন্য শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়াই আবশ্যক।
কিছু মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষিত ছেলে পড়াশোনা চাকরি বাকরি ভবিষ্যত সুখ সব জলাঞ্জলি দিয়ে এই লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। তবে তাদের চাইতে আমার এই বস্তির ছেলেদের সাথে স্বাচ্ছন্দ হতো বেশি। শিক্ষিত ছেলেদের বইয়ের ভাষার চাইতে আমি এদের ভাষা সহজে বুঝতে পারতাম। এরা বলত গ্রামদেশের অত্যাচারী জোতদার মহাজন মাতব্বরদের কথা। কী ভাবে এদের সর্বসান্ত করে দিয়েছে সেইসব কথা।
এদের সাথে আমার দিনরাত কাটে। রাত এবং দিনের প্রতিটা মুহূর্তই শঙ্কা সংকট দিয়ে ঘেরা। সশব্দ ও রক্তাক্ত। আক্রমণ প্রতি আক্রমণে রক্ত দু পক্ষেরই ঝরছে। যাদবপুর স্টেশনের পূর্বদিকে কামার পাড়া। ওটা সি.পি.এম পার্টির একটা বড় ঘাঁটি। পশ্চিম দিকে পালবাজার, গরফা এটা নকশালদের শক্ত ঘাঁটি। স্টেশনকে মাঝখানে রেখে দু দলের যোদ্ধারা দাঁড়িয়ে যায় দু পাশে। গুলি চলে বোমা চলে রক্ত ঝরে। বেশ কিছুদিন এই লড়াই চালাবার পর আমি ক্লান্তিবোধ করি। মনে প্রশ্নও জাগে। ওদিক থেকে-যারা লড়ছে তারাও তো আমাদের মতোই গরিব। আমরা এক গরিব আর এক গরিবকে মারছি, পুলিশ আমাদের দুদলকে মারছে, ধরে নিয়ে জেলে ভরে দিচ্ছে, বড়লোকের তো কারও কিছু হচ্ছে না। তবে এত রক্তপাতের সার্থকতা কোথায়!
গরফায় ঢোকবার যে কয়টা রাস্তা সেগুলো দিয়ে পুলিশ যাতে ঢুকতে না পারে আমরা দিনরাত পাহারা দিতাম। এক রাতে রেল লাইনের দিকটা পাহারা দিচ্ছিলাম আমি আর নিতাই। পাহারা দিতে দিতে কখন যে আমাদের ঘুম এসে গেছে আর আমরা রেল লাইনের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি তা জানি না। ওদিকে ভোর চারটের ডাইমন্ড হারবার ট্রেন যাদবপুর স্টেশন থেকে ভো বাজিয়ে রওনা দিয়েছে ঢাকুরিয়া স্টেশনের দিকে। ঠিক সেই সময় রেল কলোনির একজন লোক প্রস্রাব করতে বেরিয়ে আমাদের দেখে ডেকে শোয়া থেকে তুলে দেয়। সে যাত্রা বেঁচে যাই আমরা দুজন। আর তার দিন দশেক পরে একই ভুল করে ঘুমন্ত মাধাই রেলে কেটে মারা যায়। ওকে কেউ ঘুম থেকে ডেকে দেয়নি।
এভাবেই এসে গেল ১৯৭১ সাল। এই সময় শুরু হয়ে গেল পূর্বপাকিস্থানের তথাকথিত মুক্তি যুদ্ধ। একদিকে আওয়ামী লিগ আর অপরদিকে খানসেনা-রাজাকার। লেগে গেল দুপক্ষের ঘোরতর লড়াই। আওয়ামী লিগের পিছনে যাবতীয় যুদ্ধ সম্ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ইন্দিরাগান্ধীর সরকার। ভারতবর্ষ দেশটা পাকিস্তানের শাসকদের কাছে চিরদিনই এক শত্রু রাষ্ট্র। যা বিধর্মী কাফেরদের আবাস। যেহেতু ভারতমুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, সেই রাগে খানসেনারা আর তাদের সহযোগী রাজকার বাহিনী আওয়ামী লিগের সাথে ওদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর শুরু করে দিল ব্যাপক খুন জখম বলাকার লুটপাট। ফলে তখন পর্যন্ত যে সব হিন্দু পরিবার ওপার বাংলার রয়ে গিয়েছিল এবার তারা প্রাণ ভয়ে পলায়ন শুরু করে দিল। আবার একবার বাংলার সীমান্তে ভিড় জমল বাস্তুহারা মানুষের। এখন আর এদের নাম রিফিউজি নয়–শরণার্থী।
সেই ১৯৫৮ সালের ভারত সরকারের দণ্ডকারণ্য প্রকল্প তখনও বন্ধ হয়নি।এতগুলো দাঙ্গার পরেও–সব রকম সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ওই অঞ্চলে আশানুরূপ জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়নি। কিছু কিছু রিফিউজিদের নানান ক্যাম্প থেকে নানান কায়দায় ওখানে পাঠানো হয়েছিল বটে কিন্তু তার বড় অংশটাই সেখানে থাকতে পারেনি। পালিয়ে এসে মিশে গেছে পশ্চিমবঙ্গের জন সমুদ্রের মধ্যে। যার ফলে দণ্ডকারণ্যের বিশাল বনাঞ্চলে মজুরের অভাবে কোটি কোটি টাকার বন সম্পদ বনে পড়ে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সংগ্রহ সম্ভব হয়ে উঠছে না।
এবার চালাক সরকার আর আগের ভুলের ফাঁদে পা দিলেন না। কোন ক্যাম্পে না রেখে শরণার্থীদের টাকি থেকে সোজা–সরাসরি পাঠিয়ে দিতে লাগলেন মধ্য প্রদেশের মানা ক্যাম্পসহ দণ্ডকারণ্যের নানা অঞ্চলে। অংক একেবারে সরল, যতদিন এরা এখানে থাকতে চায়, থাকুক। যুদ্ধ শেষ হলে যদি সে দেশে ফিরে যেতে চায় তাতেও কোন আপত্তি নেই। যদি না যায় পুরাতন রিফিউজি পরিবারের স্থলে এদেরই সেই ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ি জমির মালিকানা দিয়ে দেওয়ায় কোন অসুবিধা নেই।
আমার বাবারা আট ভাই। তিন ভাই মারা গেছে। একভাই সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। এক ভাই পূর্ববঙ্গে থেকে গিয়েছিল। এবার সেই ভাই বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন এপার বাংলায়। পরিবারের সবাইকে টাকির অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে রেখে তিনি দেখা করতে এলেন বহু বছরের বিচ্ছিন্ন নিজের ভাইদের সাথে। প্রথমে গিয়েছিলেন ঘোলা-দোলতলার ক্যাম্পে। সেখান থেকে সংবাদ জেনে যাদবপুরে এলেন আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে। আমরা তখন শ্যামা কলোনির যে ঘরে আগে ছিলাম আমি গরফায় চলে যাবার পর এবং সে কথা গোপন না থাকায় কিছু লোক বাবাকে আর সেখানে থাকতে দেয়নি। তারা তখন রেল কলোনির এক ঝুপড়িতে থাকছিল। আমার এক জ্যেঠামশায় ও সেই কাকা দুজনে বাবাকে খুঁজে পেয়ে দেশের সমাচার পরিবার পরিজনের কুশল বিনিময়ের পর জানতে চান, রঞ্জনকে দেহি না ক্যান। হে কই? আবার পলাইছে নাকি বিদ্যাশে? তখন বাবা আমার বিষয়ে আদ্যপান্ত সব খুলে বলেন ভাইদের কাছে। “হেয়ারে মোনে কয় আর বাঁচাইতে পারমুনা। এইখানে রোজ মানুষ খুন হয়। কবে শুনমু ও মইরা পইড়া আছে।”
তখন কাকা আর জ্যেঠা দুজনে বুদ্ধি বিবেচনা করে বাবাকে পরামর্শ দেন আমরা সব যাইতে আছি দণ্ডকারণ্যে। এত বছর এইখানে রইলাম, ভালো কিছু তো হইল না। কই কী, তুমিও আমাগো লগে চইল্যা চলল। হেইখানে গেলে আর কিছু না হউক পোলার পরান তো বাঁচবে।
যে বিপিন ব্যাপারী একদিন দণ্ডকারণ্যের নামে কেঁপে উঠতেন এখন পুত্রের প্রাণ রক্ষার্থে সেই গভীর বনে যেতে রাজি হয়ে গেলেন। এই হয়। যদি কারও পিছনে বাঘ তাড়া করে, লোকটার সামনে যদি নদী থাকে, সাঁতার না জানলেও সে নদীতেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার জীবন রক্ষার্থে এক বিপন্ন বাপ শেষকালে অরণ্যকেই পরিত্রাতা হিসাবে গ্রহণ করে নিতে বাধ্য হলেন। সে যে কী অরণ্য তা বুঝতে পেরেছিলেন সেখানে যাবার পর। সেখানকার বনের বাঘ মানুষ খায় না। মানুষই মানুষকে খেয়ে নেয়।
আমার মেজভাই চিত্ত সেই ভয়াবহ দিনে চারদিকে চলা গুলি-বোমার মধ্যে গরফায় গিয়ে আমাকে খুঁজে বের করে সব কথা বিস্তারিত জানাল। কিন্তু আমি এখন কি করি? যাদের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি, যারা নিজের প্রাণ বিপন্ন করে দু তিনবার আমাকে নিশ্চিন্ত মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছে, তাদের ফেলে নিজের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাব?
ওদিকে, মা বাবার প্রতি সন্তানের যে কর্তব্য, জীবনে আমি তার কিছু মাত্র পালন করতে পারিনি। বাবার শরীরের যে অবস্থা কদিন আর বাঁচবেন বলা মুশকিল। সে মৃত্যুও আসবে তার বড় বেদনার সঙ্গে। আমার চিন্তায় তখন প্রাণটা ছটফট করবে। বারবার দরজার দিকে তাকাবেন। এই বোধহয় মুখে জল দেবে বলে বড় ছেলে এল। কারও পায়ের শব্দে চমকে উঠে মাকে জিজ্ঞাসা করবেন–অ খোকার মা, বড়খোকায় কি ঘরে আইলো? অবশেষে এক ব্যর্থ আশা বুকে নিয়ে চির ঘুমে ঘুমিয়ে পড়বেন তিনি। ধর্মবিশ্বাসী সব বাবার যা কামনা মৃত্যুর পরে মুখে আগুন, আমার হাতে তাও তিনি পাবেন না।
এর চেয়েও বড় কথা তারপরও যারা বেঁচে থাকবে, আমাদের সেই পরিবার যাদের সরকারি কোন কাগজে নাম নেই, এদেশের এক অবাঞ্ছিত উদ্বৃত্ত মানুষ ভোটার লিস্টে নাম ওঠেনি রেশ্বন কার্ড পাওয়া যায়নি, কোন নাগরিক অধিকার নেই। এদের কী হবে? যারা অকারণে আমার জন্য বিপদে পড়তে পারে।
আমার সবচেয়ে ভয় ভাই চিত্তকে নিয়ে।বিজয়গড়ের এক কংগ্রেস নেতার নাম ভজন নাগ। তাকে নাগালে না পেয়ে তার শত্রুপক্ষ তার এক ভাই পূজন নাগ, যে তিনফুট উচ্চতার এক বামন–তাকে গলা কেটে মেরে দিয়েছে। আমি এখন এক নিরাপত্তার বলয়ের মধ্যে আছি। আমার নাগাল না পেয়ে আমার শত্রুরা যদি চিত্তকে মেরে দেয়। অনেক ভেবে চিন্তে শেষে সিদ্ধান্ত নিই, যে যা বলে বলুক যে যা ভাবে ভাবুক, আমার এখন প্রধান কাজ পরিবারের সবাইকে যদি একটা আতঙ্ক মুক্ত পরিবেশে কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলবার সুযোগ করে দিতে পারি সেই চেষ্টা করা। এটা ঠিক যে তারা যদি আমাকে রেখে একলাই সেখানে চলে যান নির্ভয়ে বাঁচতে পারবেন। কিন্তু এই ভয়ংকর যুদ্ধের পরে–যদি তখনও আমি বেঁচে থাকি, সেই অরণ্য থেকে খুঁজে বের করব কী করে তাদের।
ভাইকে বলি–কবে তোরা যাবি? আমি শিয়ালদায় গিয়া খাড়াইয়া থাকুম।
অবশেষে বন্ধুদের কাছে বিল্টুদায় নিয়ে পরের দিন পরিবারের সাথে গিয়ে পৌঁছালাম টাকি রেল স্টেশনে। কাকার কাছে বর্ডার পার হয়ে এপারে আসার প্রমাণপত্র ছিল। সেই কাগজ দেখিয়ে–”মোরা পূর্ববাংলার থিকা আইছি” বলে অফিসের খাতায় নাম লিখিয়ে ঢুকে পড়লাম অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরের তাবুর মধ্যে।
এবার আমাদের এখানে থাকতে হল দিন পনের। তারপর যাবার “ডাক” এল। আমরা শিয়ালদহে এসে দাঁড়িয়ে থাকা একখানা ট্রেন, যার নাম রিফিউজি স্পেশাল তাতে উঠে পড়লাম। সেই ট্রেন আউট লাইন দিয়ে ঘুরে ঘুরে যে পথ সাধারণ ট্রেন বারো ঘন্টায় পার হয়, তিনদিন সময় নিয়ে পৌঁছাল জগদ্দলপুর। জগদ্দলপুর আদিবাসী জেলা বস্তারের সবচেয়ে বড় শহর। এখান থেকে ট্রাক ভরে কিছু পরিবারকে নিয়ে যাওয়া হল উড়িষ্যার মালকানগিরি, উমরকোট আর কিছু পাঠানো হল বস্তার জেলার পারালকোটে। পারালকোটে সর্বমোট ১৩৩টা বাঙালী গ্রাম আছে। কোন নাম নেই, শুধু নাম্বার। নাম্বার দিয়ে তাদের পরিচয়। পারালকোট ভিলেজ সংক্ষেপে পি.ভি.। আমাদের রাখা হল পি.ভি. ৯৮তে। যেখান থেকে নিকটস্থবাজার, পঁচিশ মাইল দূরে। বাসস্ট্যান্ডও সেখানেই। যেখান থেকে রেল স্টেশনের দূরত্ব দুশো মাইল। চারদিকে ঘন গভীর জঙ্গল। কোথাও কোন জন মানবের চিহ্ন নেই। সেই জঙ্গলের খানিকটা সাফ করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এই গ্রামটা, এ এমন এক গ্রাম যদি বিশ্বযুদ্ধও হয়ে যায় এখানকার মানুষ টের পাবে না। যদি এই গ্রামটা কোন কারণে ধ্বংস হয়ে যায়, বিশ্ববাসী জানতে পারবে না।
আমরা এখানে আসবার আগে পঁচিশটি পরিবার ছিল, এবার আমাদের পঁয়ত্রিশ পরিবার মিলে মোট ষাট হয়ে গেল। কয়েকদিন পরে অবশ্য দশ পরিবার এখান থেকে সরিয়ে পিভি ৫৬তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই দশ পরিবারের চার পরিবার আমরা এবং আমার কাকা জ্যেঠা।
সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের ইচ্ছা ছিল প্রতি ভিলেজে ১০০ পরিবার এনে রেখে দেবার। কিন্তু সেই ৫৮ সাল থেকে ৬৪ সাল পর্যন্ত বহু চেষ্টার পরেও টার্গেট পুরো করা যায়নি। কোন ভিলেজে পঞ্চাশ কোনটায় তারও কম। আর ৬৪ সালের পর থেকে তো পলায়ন পর্ব চলছে। মোড়ে মোড়ে পাহারা “নাকা” বসিয়েও যে পলায়ন ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ফলে বহু ভিলেজে বহু ঘর খালি পড়ে আছে। কোন ভিলেজে কতঘর ফাঁকা সেই হিসাবে এখন লোক এনে ভরাট করা হচ্ছে।
চারদিকে মোটা মাটির দেওয়াল। উপরে টিনের ছাউনি। লম্বায় আঠেরো হাত, চওড়ায় বারো হাত। এমন ঘর পূর্ববঙ্গের শতকড়া আটানব্বই জন নমঃ পোদ জেলে কামার কুমোর ঘরামির কাছে অকল্পনীয় ব্যাপার। সেই ঘর ফেলে মানুষ কেন যে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে রেল লাইন, খালধার, ফুটপাতে থাকে সেটা তখন আমার কাছেও এক অবোধ্য ব্যাপার ছিল। যা পরে আর অবোধ্য থাকেনি।
এখানে আসবার পর আমাদের সরকারি অফিস থেকে কিছু জামাকাপড় কিছু হাড়িকুড়ি আর শাবল কোদাল, গাইতি কুড়ুল এসব দেওয়া হল। দেওয়া হল কিছু চাল ডাল নগদ টাকা। চাল ডালের পরিমাণটা কত ছিল মনে নেই। তবে টাকা মনে হয় মাসে পঁচাত্তর দিত। সেই চাল টাকা যাকে শিরোমণিপুরে বলা হোত ডোল এখন বলা হয় সাবসিডি, তা দিয়ে আমাদের পাঁচজন প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক সর্বমোট সাতজনের পরিবার, অনেক মেপে, অংক কষে, হিসেব করে, আধপেট খেয়ে দিন পনেরোর বেশি চলত না।
চলবে না সে ওরা-ও জানে। এটা ওদের তো অংক কষে হিসেব করে বার করা। সেই বাকি পনের দিন খাবার জন্য মজুর খাটতে যেতে হবে। আর নাম মাত্র মজুরি দিয়ে আমাদের খাঁটিয়ে নেওয়া যাবে। রিফিউজিদের এখানে আনাইতো হয়েছে সেই জন্যে। এবং একদিন নিয়ে যাওয়া হল এক ঠিকাদারের অধীনে এক জঙ্গলে, জঙ্গল সাফ করাবার জন্য। জঙ্গল তো এখানে সর্বত্র। কোথাও ঘন কোথাও পাতলা। সেই জঙ্গল একটু একটু সাফ করে বসানো হয়েছে ভিলেজ, বের করা হয়েছে চাষের জন্য জমি, এখন আমাদের সেখানে আনা হয়েছে এই জঙ্গল সাফ করে যে জমি বের হবে তা আমাদের পরে কৃষিকার্যের জন্য দেওয়া হবে। এই জঙ্গলের পরিচয় এখন আর জঙ্গল নয় ল্যানডম্যাপে কৃষিকর্মের উপযোগী ভূমি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
আমরা সেখানে গিয়ে দেখি জমি জুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অগনন বৃক্ষ। ঠিকাদার ফিতে মেপে গাছের গায়ে দাগ মেরে দিয়ে বললেন–এই হচ্ছে এক একর। প্রথমে গাছগুলো কাটতে হবে। তারপর গোড়া খুঁড়ে শেকড় সহ তুলে ফেলতে হবে। এর জন্য মজুরি মিলবে দেড়শো টাকা। সেই এক একর জমি” সাফ করতে আমি, আমার ভাই চিত্ত এবং বাবা তিনজনের বাইশ দিন সময় লেগে গেল। তিন একর জমি সাফ করতে গাইতি কোদাল সব ক্ষয়ে গিয়েছিল। এখানকার মাটি তো মাটি নয়, পাথর। গাইতি দিয়ে মাটিতে কোপ মারলে ঠন করে শব্দ হয়, আগুন ঠিকরে ওঠে।
গাছ কাটার পর বাঁশ কাটা, মাটি কাটা, পাথর ভাঙা, বিড়ির পাতা তোলা এক ঠিকাদার থেকে আর এক ঠিকেদারের অধীনে এভাবেই কাজ চলতে রইল। এবং যে কাজই হোক যত পরিশ্রমই করি মজুরি তার দিনে দুই আড়াই টাকার চেয়ে বেশি পড়ে না। একদিন আমি আর আমার বাবা আর ভাই গেছি খ্যারকাটা নামের এক জায়গায় মাটি কাটার কাজে। আমাদের নিয়ে গেছে এক ঠিকাদার তার ট্রাকে করে। খ্যারকাটায় বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সহায়তায় বিশাল একটা বাঁধের নির্মাণকার্য চলছে। যা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৫৮ সালে। যথেষ্ট মজুর না পাওয়ায় যা আজও সম্পূর্ণ করা যায়নি। এবার প্রচুর শরণার্থী আসায় পূর্ণউদ্যমে শুরু করা হচ্ছে বাঁধ নির্মাণের কাজ। বাঁধের কাজ সম্পূর্ণ হলে রিফিউজিরা জমিতে চাষের জন্য কতটা জল পাবে, পারাল কোটের কতটা উন্নয়ন হবে তা এখনও বোঝা যাচ্ছেনা। তবে কন্ট্রাকটার, মজুর যোগানদার, কিছু মন্ত্রী নেতা যে কোটিপতি হয়ে যাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
খ্যারকাটা ড্যামের সব কাজই ফুরনে চলে। যত কাজ তত পয়সা। দশ ফুট লম্বা দশ ফুট চওড়া এক ফুট গভীর, মাটির মাপে যা একশো, এইটুকু মাটি কাটার মজুরি পচাত্তর টাকা শুনে আনন্দে আমরা লাফিয়ে গিয়ে ট্রাকে উঠেছিলাম। নিজেদের শ্রমক্ষমতার উপর আমাদের আস্থা আছে। ভেবেছিলাম শুয়ে বসে জিরিয়ে আমি আর ভাই দুজনে একশো মাটি নিশ্চয় কেটে ফেলব। বাবার হাত লাগাবার দরকারই পড়বে না। কাজের কাছে গিয়ে মাটি দেখে বুক কেঁপে গেল। যা কাটতে হবে তা মাটি নয় চুনের মত নরম আঠালো এক ধরনের পাথর। এ মাটিতে গাইতি চলে না কোদাল বসেনা। ছেনি হাতুড়ি দিয়ে খুঁচে খুঁচে তুলতে হবে। এ কাজে অতি বড় পরিশ্রমীও দুটাকা মজুরি তুলতে পারবে না।
সে সময়টা আবার মে-জুন মাস। এটা বছরের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়। বাতাসে তখন বইছে। বস্তার জেলার সেই কুখ্যাত-লু! যা গায়ে লাগলে চামড়া পুড়ে ফোঁসকা পড়ে যায়। বেলা আটটা-নটাতেই মাটি যেন রুটি সেকা চাটুর মতো তেতে ওঠে। আমাদের পায়ে চপ্পল গায়ে জামা নেই। রাগীরোদ তার ইচ্ছামত আমাদের উদ্যোমশরীরে ছোবল মারে। বাংলার নরম জল হাওয়ায় গঠিত এই দেহ বস্তার জেলার পরিবর্তিত প্রকৃতির দাপট সহ্য করতে পারল না। অসুস্থ হয়ে পড়লাম আমি। আবার সেই বাল্যবেলার রোগ-আমাশা আমাকে চেপে ধরল। এবার তা আগের চেয়ে তীব্র। এবার হাসপাতাল ছিল। সারারাত চলল স্যালাইন, ওষুধ,ইনজেকসান। দিন ছয়-সাত লেগেছিল রোগমুক্ত হতে।
এরপর ভিলেজে ফিরে এসে ভাঙাচোরা মন আর অর্ধেক সুস্থ শরীর নিয়ে কাজে যাবার ক্ষমতা ছিল না। বসে রইলাম ঘরে। আমি কাজে যেতে পারছি না, বাবারও শরীর ভালো নয়। একা চিত্ত কী কাজ করবে।ক পয়সা পাওয়া যায় তাতে?তখন এমন হল যে সাবসিডির চালে যে কয়দিন চলে তারপর আর চাল কেনা যায় না। ফলে যে ভয় আমাদের সারা জীবন তাড়া করে বেড়ায়, যে কষ্ট বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে থাকে সেই না খাওয়া দরজায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা এই গ্রহের এমন এক অভাগা জীব যে কিছুতেই অনাহার আমাদের পিছন ছাড়ে না। এই আমাদের মতো মানুষদের জন্যই বোধহয় এমন কথার উদ্ভব–আমি যাই বঙ্গে কপাল যায় সঙ্গে। ধনধান্যে ভরা বাংলাতেই আমাদের অন্ন জোটেনি। আর এতো বস্তার। এখানকার আদিবাসী মানুষরাই ভাতের বদলে কেঁদো কুটকি মান্ডিয়া এই সব ঘাসের দানা খেয়ে বাঁচে। তরকারি বানায়। কচি বাঁশের ডগা দিয়ে। এবার খিদের জ্বালায় আমরাও ওই সব খেতে বাধ্য হলাম।
এদিকে সরকার থেকে বলা হয়েছিল, এখানে আমাদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে জমি জায়গা দেওয়া হবে। যদি তা পাওয়া যেত একবার চেষ্টা করে দেখা যেত কিছু করা যায় কিনা। বছর ঘুরে গেল কিন্তু সে বিষয়ে সরকারের তরফে কোন উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না। কবে যে তারা ঘুমভেঙে জেগে উঠবে তা কে জানে।
মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে আমার। নিজের উপর নিজের ধিক্কার আসে। বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, আদিবাসী অধ্যুষিত এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে এভাবে খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করে কী হবে। এভাবে বেঁচে থাকাটাই তো কষ্টের। যত বেশি দিন বাঁচা হবে ততটাই বেশি কষ্ট। মনে মনে স্থির করি–পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যাব। সেখানে গিয়ে যা হয় হোক, তবু এখানে আর নয়।
আমার মেজভাই চিত্তকে বলি সে কথা–এখন একসাথে সবার পশ্চিমবঙ্গে যাওয়াটা ঠিক হবে না। গিয়ে থাকব কোথায়। কী কাজ করব। খাব কী? আগে আমি একা যাই। পশ্চিমবঙ্গ অনেক বড় জায়গা। শুধু তো যাদবপুর না। কোথাও একটু মাথা গোঁজার ঠাই করে তারপর সবাইকে নিয়ে যাব। ওরও এখানে মন টিকছিল না তাই মত দিল সে–যা, গিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারিস আমাদের নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর। মরণ এইখানে, মরণ সেইখানে। তয় বাংলার মানুষ বাংলায় গিয়া মরি।
আমার কাছে তখন পথখরচা বলতে আছে মাত্র পাঁচটা টাকা। এখান থেকে নিকটস্থ রেল স্টেশন রায়পুর দুশো মাইল দূরে। যার বাসভাড়া সাড়ে দশ টাকা। রেলে বিনা টিকিটে যাওয়া যায়, বাসে যায় না। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম আর একটা রেল স্টেশন আছে দল্লী-রাজহারায়। কখন যেন সেখান থেকে এক আধটা যাত্রী ট্রেন কোথায় যেন যায়। তখন আর আমার ভাবনা চিন্তা করবার অবকাশ ছিল না। একদিন কাপসী থেকে একটাকা দশ পয়সার টিকিট কেটে চেপে বসলাম দল্লী যাবার বাসে। সকালে বাসে চেপে ছিলাম দুঘন্টা পরে বেলা এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম দল্লী।
দল্লীকে আমি চিনি না । দল্লীও আমাকে চেনে না। কিন্তু একদিন এই দল্লী শহরকে আমি চিনবো। সেদিন এই ছোট্ট শহরটা অনেক বড়, অনেক প্রিয় হয়ে উঠবে। এই দল্লী আমাকে দেবে প্রাণের আরাম-বেঁচে থাকার অবলম্বন আর এক মহত্তম পরিচয়। তবে সে অনেক পরে ঘটবে। এখন সবে ৭২/৭৩ সাল। এখনও শংকর গুহ নিয়োগী দল্লী এসে পৌঁছাননি। উনি আসবেন ৭৭ সালে। ইতিহাস গড়বেন, তবে তো আমি সেই ইতিহাসে যুক্ত হবো।
দল্লী স্টেশনে এসে শুনি আমি এখানে আসবার দু ঘন্টা আগে–বেলা নটার ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে। যার যাত্রা ভিলাই পর্যন্ত। সেই ট্রেন আবার রাত আটটায় ফিরে আসবে। না যাবার না আসবার আর কোন ট্রেন নেই। কী আর করি, সারাটা দিন এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিই। বাজার দেখি, বাস দেখি, পাহাড় দেখি, খাদানে কাজ করে ফেরা মানুষ দেখি, লাল পতাকা ওড়া একটা ইউনিয়ন অফিস দেখি। আর রাত হয়ে গেলে মুড়ি ভোলা খেয়ে স্টেশনের পাশে এক মন্দিরের চাতালে শুয়ে থাকি। এখন এই মন্দিরটা খুব ছোট। কুড়ি পঁচিশ বছর পরে আবার যখন আসব বিরাট বড় হয়ে যাবে। ইউনিয়ন অফিসটা বড়, ওটা তখন আর থাকবে না। মজুররা ঝান্ডার রঙ বদলে নেবে। সি.পি.আই ছেড়ে সব ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চায় যোগ দেবে।
পরের দিন ট্রেনে চেপে এসে পৌঁছাই ভিলাই। ভিলাই থেকেও হাওড়া যাবার ট্রেন ধরা যায় সেটা তখন আমার জানা ছিল না। তাই সেখান থেকে আর একটা ট্রেনে চেপে এসে নামলাম রায়পুর। শুনলাম, ঘন্টা খানেক পরেই এখানে আসছে বম্বে টু হাওড়া মেল। বসে থাকি সেই ট্রেনে চাপবার আশায়। এমনিতে স্টেশনটা বেশ ফাঁকাই ছিল, স্টেশনে ট্রেন ঢোকবার মিনিট দশেক আগে কোথা থেকে কে জানে শত শত পুলিশ, চেকার এসে সারা প্লাটফর্মে ছড়িয়ে গেল। পুলিশ লাঠি উঁচু করে স্টেশনের যত ভিখারি ভবঘুরে মুটে হকার সব খেদিয়ে এক নাম্বার প্লাটফরম থেকে দুরে সরিয়ে দিল। তাড়া খেয়ে আমিও রেল ব্রিজের উপর দিয়ে দু নাম্বার প্লাটফর্মে এসে পড়ি। দাঁড়িয়ে থাকি সেখানে এই আশা নিয়ে, ওই ট্রেন এলে উল্টো দিক থেকে রেল লাইন টপকে ছুটে গিয়ে ট্রেনে চেপে বসব। দুনাম্বার প্লাটফর্মের এক গেটের চেকার আমার অভিসন্ধি বোধ হয় বুঝে গিয়ে থাকবে। সে এসে আমাকে ধরল। টিকিট নেই জেনে গেটের বাইরে বের করে দিল। বাইরে এসে লোহার রেলিংয়ে থুতনি ঠেকিয়ে বড় কাতর চোখে দেখলাম সেই ট্রেনখানা স্টেশনে প্রবেশ করল।
এটা কোন সাধারণ ট্রেন নয়। এ হচ্ছে বম্বে টু হাওড়া উইকলি স্পেশাল। এর ভাড়া বেশি। যাত্রীদের সুখ সুবিধাও বেশি। চলে দ্রুত, থামে খুবই কম স্টেশনে। মিনিট পাঁচেক থেমে থাকার পর সিটি দিয়ে সে রওনা দিল হাওড়া উদ্দেশ্যে। এখন আমি কী করি! আমাকে না নিয়ে আমার স্বপ্নের গাড়ি চলে যাচ্ছে। চলে যাবে এত সহজ নাকি? মাথা গরম হয়ে গেল আমার। গেটে চেকার, যে যেতে দেবে না আমাকে। না দিক, আমি আমার জন্য অন্যপথ খুঁজে নেব। সারাটা জীবনই তো আমি অন্যপথের পথিক। উঠে পড়লাম রেলিংয়ের উপর। তারপর লাফিয়ে পড়লাম দু নাম্বার প্ল্যাটফর্মের মধ্যে। তাড়া ছিল বলে অবতরণ সঠিক হল না। আছাড় খেয়ে পড়লাম কংক্রিটের মেঝেয়। হাটুর মালাইচাকি ছড়ে গেল। সেদিকে তখন আর দেখার সময় নেই। আমি দেখছি ট্রেন, যার ক্রমে গতি বেড়ে যাচ্ছে। আর দেরি নয়। ছুটে গিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়লাম নিচে, রেল লাইনের উপরে। তারপর আর একটু ছুটে ধরে ফেললাম চলন্ত ট্রেনের দরজার পাশের হাতল। ঝুলে পড়লাম হাতল ধরে। তখন সারা প্লাটফর্মে লোক ভয়ে চিৎকার করছে এ্যাই রে। গেল বুঝি। গেলাম, তবে চাকার তলে নয়, কামরার মধ্যে। এক হাতে হাতল ধরে রেখে অন্য হাতে দরজার লক খুলে অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ ঘটল আমার। এই ট্রেনে আমার মত দৈনদশার-চেহারা পোষাকের আর একজন যাত্রী পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। আমি কোনদিকে না তাকিয়ে–আমার মত যাত্রীর জন্য ঈশ্বর দ্বারা নির্ধারিত যে স্থান-দরজার পাশে পায়খানা বাথরুমের সামনে বসে পড়ি।
আমি যখন এই ট্রেনে চেপেছিলাম তখন বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামছে। এখন কামরার মধ্যে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। বোধহয় আধঘন্টা চলেছে ট্রেন। এমন সময় এলো এক চেকার। কী অদ্ভুত চোখ তার। আমাকে দেখেই সে বুঝে গেছে আমি কোন শ্রেণির যাত্রী। শ্রেণি তো মাত্র দুটো এই কামরায়-হ্যাব আর হ্যাঁব নটস। যাদের টিকিট আছে আর যাদের টিকিট নেই। আমি শেষ দলের। সে তার বেয়নেটের মত তর্জনি আমার দিকে উঁচিয়ে হুকুম দিল–”দো ডাব্বা ছোড়কে আগে নিকল যা।” এই দুটো কামরার দায়িত্বে তিনি আছেন। তিনি তার দায়িত্বের এলাকা থেকে আমাকে স্রেফ আবর্জনার যত অন্যের এলাকায় নিক্ষেপ করে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু যার এলাকায় আমি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সে বা আমাকে সহ্য করবে কেন। আধঘন্টা পরে সে এসে অনুরূপ আদেশ দেয়–দো কামরা ছোড়কে ট্রেনে উঠেছিলাম মনে হয় পাঁচটায়, সেই থেকে কোথাও স্থির হয়ে বসতে পারলাম না। রাত দুটো আড়াইটা পর্যন্ত এভাবে কুকুর খেদা চলতে রইল।
এবার যে কামরাটায় গিয়ে পৌঁছালাম তার প্লাটফর্মের উল্টোদিকের দরজাটা হাট করে খোলা। খোলা দরজা দিয়ে হু হু করে মধ্যরাতের ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। আমি আর দেরি না করে গামছা বিছিয়ে সেখানে শুয়ে পড়লাম। যতক্ষণ পারা যায় একটু ঘুমিয়ে নিই। এবং তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে। কতক্ষণ এভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা। হঠাৎ যেন একটা বিস্ফোরণ হল। বিকট শব্দের সাথে একটা ভারী কিছু আছড়ে পড়ল আমার মাথার উপরে। মনে হল মাথাটা বুঝি চুরমার হয়ে গেল। কিসের আঘাত এটা? তবে কী দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা এই ট্রেনখানা লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে গেল হাজার ফুট নিচে কোন গিরিখাদে। তারই ফলে মাথায় এই আঘাত। সেই আঘাতে মাথাটা খানিক সময় ঝনঝন করে শেষে অবশ হয়ে গেল। অন্ধকার ঘনিয়ে এল চারিদিকে। কিছু সময় পরে সম্বিত ফিরলে চোখ মেলে দেখি–ঠিক আমার মাথার উপরে উঁচু হয়ে আছে একটা বুটসহ পা। আঘাতটা এসেছে ওই বুট থেকে। বুটের মালিক একটা লাথি মারবার পর আর একটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। লোকটা একজন চেকার। এই কামরা যার দায়িত্বে সে চেহারা, পোষাক, আর ধুলি শয্যা দেখে বুঝে গেছে আমার কোন টিকিট নেই। ফলে এই কামরায় আমি অনধিকার প্রবেশকারী। যা লাথি খাবার উপযুক্ত অন্যায়-অপরাধ। তাই বিনা দ্বিধায় সে সেটা করে দিয়েছে।
লাথি খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি। উঠে দাঁড়াল আমার মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সেই শয়তানটাও। চারদিকে তাকালাম। রাত এখন গভীর। কেউ কোথাও জেগে নেই। সব মানুষ যেন মরে পড়ে আছে। তাকালাম খোলা দরজা দিয়ে অন্ধকার পৃথিবীটার দিকে। যার মধ্য দিয়ে দুরন্ত বেগে ছুটে চলছে এই নৈশ্যযানখানা। এই সময় দরকার মাত্র একটা আচমকা ধাক্কা। পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের রোগা চেকারটা সেই ধাক্কায় খোলা দরজা দিয়ে শোলার মত উড়ে চলে যাবে। এখন আমাকে তাই করতে হবে। ওকে উড়িয়ে দিতে হবে।
এসব কথা লিখতে সময় লেগে গেল দশ মিনিট ভাবতে সময় লেগেছিল দশ সেকেন্ড। তারপর আমার সেই কালো হাত যা থেকে এখনও আমি রক্তের গন্ধ পাই, সেই খুনি হাত তুলে চেকারের দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমি এগিয়ে ছিলাম মাত্র এক পা। কিন্তু সে আমার চোখ মুখ চেহারায় ফুটে ওঠা পরিবর্তনের অর্থটা বুঝে ফেলেছে। বুঝে ফেলেছে, এই রাত আঁধারে তাকে খুন করা হবে। তাই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তারপর কুকুরের মত লেজ তুলে ছুটে পালিয়ে চলে গেল। সারারাতে আর আমার ত্রিসীমানায় এল না।
রাত শেষ হয়ে পরের দিন সকাল সাতটা নাগাদ নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশনে। তাকালাম প্লাটফর্ম থেকে বাইরে যাবার পথের দিকে। পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কতগুলো পাষাণ হৃদয় পাহারাদার।ওদের হাতে হয় টিকিট নয় ঘুষ দাও, তবেইমিলবে মুক্ত দুনিয়ায় পৌঁছাবার ছাড়পত্র। আমার যে কিছুই নেই। না তির না তুণীর, খালি হাতেই আমাকে এই ব্যুহচক্র ভেদ করতে হবে।
জীবন তো একটা যুদ্ধ। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকেরা সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে এগোয়। দূর থেকে লক্ষ্য করে দেখলাম বাইরে যাবার গেটের সামনে যে অবরোধক চক্র, তার একটায় তালা মেরে গেট কিপার কোথায় যেন গেছে। একটু ভানদিক ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে সেই চক্রের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লাম নিচে। তারপর বুকে হেঁটে চক্রের তলা থেকে বের হয়ে গেলাম বাইরে। এরপর হাঁটতে শুরু করলাম শিয়ালদহের দিকে।মনে হয় তখন হাওড়া থেকে শিয়ালদহের বাসভাড়া বেড়ে কুড়ি পয়সা হয়ে গিয়েছিল। সেদিন আমার কাছে কুড়ি পয়সাও ছিল না। পুঁজির পাঁচটাকা রায়পুরে পৌঁছাবার আগেই খরচ হয়ে গিয়েছিল। কাল বিকেল থেকে পেটে জল ছাড়া আর কিছু পড়েনি। খিদেয়, পথশ্রমে, মানসিক ধকলে আমার শরীর আর শরীর নেই–একটা বোঝা হয়ে গেছে। এই বোঝা নিয়ে কোথায় যে যাব তা বুঝে উঠতে পারি না।
অবশেষে স্থির করি সেই পুরাতন জায়গা যাদবপুরেই যাব। গরফায় আমার বন্ধুরা আছে। যদি কিছু সহায়তা পাওয়া যায়–যা আমার এখন একান্ত দরকার, তা এদের কাছেই পাওয়া যেতে পারে। না হলে আর তো কেউ নেই।
মনে হয় বেলা বারোটায় এসে পৌঁছেছিলাম যাদবপুর স্টেশনে। ওখানে দেখা হয়ে গেল আমার এক পূর্ব পরিচিতর সাথে। তার মুখে খবর পেলাম বাহাত্তরের ইলেকশনের দিন আশু মজুমদার মিলিটারির সাথে এক মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা গেছেন। গরফা সেলিমপুরে এখন আর নকশালরা নেই। কিছু মারা গেছে, কিছু পালিয়ে গেছে, কিছু ধরা পড়ে জেলখানায় পচছে। আর কিছু যাদের রাজনৈতিক সচেতনার অভাব ছিল তারা প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে কংগ্রেসের ঝাণ্ডার নিচে। গরফা জুড়ে এখন দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে কংগ্রেসি গুণ্ডা হাতকাটা জীতেন এর দলবল। শুধু কামারপাড়া বাদে সমস্ত যাদবপুর কংগ্রেসের দখলে।
তাহলে আমি এখন কী করব। কোথায় যাব! সামান্য মাত্র কয়মাসে এই শহরটা আমার কাছে এমন নির্বান্ধব হয়ে যাবে এমন অনাত্মীয় শহর হয়ে যাবে কল্পনা করতে পারিনি। এখানে কার কাছে গিয়ে কি সাহায্য চাইব। আমি কোন সাধারণ মানুষের মতো নই। কে কোন গলিতে আমার জন্য ভোলা চাকু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা কে জানে। এই শহরে আজকাল মারপিট বোমাবাজি আগের তুলনায় কম হয়, তবে লাশ পড়ে বেশি। সব রাজনৈতিক দলের কর্মীরা মারপিটের সেই পুরাতন ছক বদলে ফেলেছে। এখন একদল তক্কে তক্কে থেকে আর একদলের কর্মীকে ধরে সোজা গলার নলিটা কেটে দেয়।
আমার তখন দিনটা তো নানাভাবে কেটে যায় মুশকিল হয় রাত কাটানো। শোবার কোন জায়গা ছিল না তাই কোনদিন স্টেশনের ওভার ব্রিজের সিঁড়ির নিচের অন্ধকারে, কোনদিন টিকিট কাউন্টারের সামনের বটগাছের আড়ালে কোনদিন রিকশা লাইনে তালামারা কোন রিকশার উপর এভাবেই রাত কাটে। এই অবস্থায় কাটিয়ে ছিলাম তিন-চার দিন। এই কদিন বলতে গেলে কিছুই খেতে পাইনি। চান করিনি ঘুমও হয়নি। সেদিন রাতে আমি ঘুমিয়েছিলাম গুঁড়িসুড়ি মেরে এক রিকশার উপরে। তখনও সূর্যের আলো ঠিকমত ফুটে ওঠেনি। একটা ছাই ছাই অন্ধকার পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে চারদিকে। সময় তখন মনে হয় ভোর ছয়টা কী সাড়ে ছয়টা। রিকশা লাইনের সামনের চা দোকানে কয়লার উনুনে সবে আগুন জ্বেলেছে। সাদা ধোয়ায় ভরে গেছে এলাকাটা। স্টেশনে রাত কাটানো কিছু রিকশাঅলা ঘুম চোখে এসে রিকশার তালা খুলে লাইনে লাগাচ্ছে। ভাড়া তোলবার সময় হল। বিহারি হোটেলঅলা ছেচন সাউ কানে পৈতা জড়িয়ে লোটায় জল নিয়ে রেল লাইনের পাশে প্রাতঃকৃত সারতে যাচ্ছে। খবরের কাগজের হকাররা যে যার সাইকেলে কাগজের বান্ডিল বাধছে। রোজকার এই স্বাভাবিক ছন্দে হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটে গেল। পরপর শোনা গেল এক ঝক কান ফাটানো গুলির শব্দ। সে শব্দে ভয় পেয়ে ডানা ঝাঁপটিয়ে সামনের বটগাছ থেকে উড়ে পালাল এক ঝাঁক পাখি। টিকিট কাউন্টার আর টি স্টলের মধ্যে দিয়ে স্টেশন থেকে বাইরে আসবার যে পথ, সেদিকে তাকিয়ে মনে হল যেন কোন সামুদ্রিক ঝড় আছড়ে পড়েছে, বাঘ তাড়া করেছে। কোন। তখন ক্যানিং থেকে আসা একটা ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকেছিল। সেই ট্রেন থেকে নামা যাত্রীরা প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সামনের দিকে ছুটে পালাচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে আসা বাবুবাড়ির কাজের মাসি ছুটতে গিয়ে কাপড়ে পা জড়িয়ে নিচে আছড়ে পড়ে হাত পা কেটে রক্তাক্ত। কেউ তাকে তুলছে না। মাড়িয়ে ডিঙিয়ে সবাই চলে যাচ্ছে। একজন মজুর খাটা লোকের কাধ থেকে ধাক্কা লেগে ছিটকে গেল কোদাল ঝুড়ি। এক মাছঅলার মাছের চাকন উল্টে গিয়ে জলে আর মাছে পথ একেবারে ছয়লাপ। এরই মধ্যে স্টেশনের সুইপার বিজয় পেটে গুলি খেয়ে রক্তপ্লুত অবস্থায় ছিটকে এসে পড়ল রিকশা লাইনের সামনে। কিছুক্ষণ কাটা ছাগলের মত হাত পা ছুঁড়ে শেষে চুপ হয়ে গেল। রিকশার উপর থেকে নেমে আসতেই কে একজন ছুটতে ছুটতে বলে গেল–পালাও। স্টেশনের পুলিশ ক্যাম্পে নকশালরা হামলা করে অস্ত্রশস্ত্র সব নিয়ে গেছে। দু তিনজন মার্ডার।
কিছুক্ষণ পরে জানতে পারলাম ফুটবল খেলবার ছলে দশবারো জনের একটা দল আক্রমণ করে পুলিশ ক্যাম্পে। দরজায় একজন রাইফেলধারী পুলিশ পাহারায় ছিল, অন্যরা ছিল ভিতরে শোয়া। সেইসময় ওরা অতর্কিত হামলা করে তিনখানা রাইফেল একটা রিভালবার নিয়ে পালিয়েছে। যারা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল সব আহত, নিহত।
যখন এইসব ব্যাপার ঘটছিল তখন সোনারপুর জি.আর.পির চার কনস্টেবল পেট্রোল ডিউটি সেরে ট্রেন ধরে সোনারপুরে ফিরে যাবে বলে এসে বসেছিল দু নাম্বার প্লাটফর্মে। তাদের চোখে পড়ে একদল ছেলে রাইফেল নিয়ে পালাচ্ছে। তারা তখন এলোপাথারি গুলি চালিয়ে বাধা দেবার একটা চেষ্টা করে। তবে সফল হতে পারেনি। তাদের ছোঁড়া একটু এসে লেগেছে নিরীহ বিজয়ের পেটে।
এরপর যা হবে তা কারও অজানা নয়। একটা বিশাল পুলিশ বাহিনী আসবে। চারদিক থেকে ঘিরে ধরে হৃত অস্ত্রের সন্ধানে শুরু হবে চিরুনি তল্লাশি। হবে ব্যাপক ধরপাকড়। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই চালিয়ে দেবে গুলি। কত যে মরবে কত যে আধমরা হবে তা কে জানে। ইতিমধ্যেই যাদবপুর থানা থেকে কিছু পুলিশ এখানে পৌঁছে গেছে। তারা তাদের সীমিত ক্ষমতায় সেই কাজ শুরুও করে দিয়েছে। প্রথম ধাক্কায় সন্ধ্যা বাজারের “রাতকানা জ্যোতে” শেষ। রেল লাইনে পাড়ে ঢোলকমলি ঝোপে পায়খানায় বসেছিল। পুলিশের মনে হয় লুকানো নকশাল। তাই গুলি চালায়। এতক্ষণ আমি রিকশার আড়ালে, বটগাছের পিছনে, জলের ট্যাঙ্কের পাশে নানাভাবে নিজেকে রক্ষা করেছি। বড় বাহিনী এসে গেলে আর তা পারা যাবে না। এখনই এখান থেকে পালাতে হবে। কিন্তু কোনদিকে পালাব তার কোন দিশা যে নেই। এক পালানো যায় পালবাজার সেলিমপুরের দিকে। কিন্তু নকশাল ছেলেরা সব সেইদিকে গেছে। পুলিশ তো ওইদিকে ধাওয়া করবে। আর এক যাওয়া যায় সন্তোষপুরের দিকে। কিন্তু সেদিকে যাব কেমন করে। একটা পুলিশ বাহিনী ওদিকে গিয়ে গুলি চালাচ্ছে। জ্যোতের পরে রাজাপুরের তপন শেষ। আর একটা পথ আছে স্টেশন রোড ধরে যাদবপুর মোড়ে গিয়ে বিজয়গড়ে ঢুকে পড়া। কিন্তু এখনই যদি সেই বড় বাহিনী আসে, আসবে তো ওইদিক থেকেই। যদি সামনে পড়ে যাই, যদি চিনে ফেলে, যদি কেউ আমাকে চিনিয়ে দেয়, তখন কী হবে?
আর একটা পথ আছে, টিবি হাসপাতালের যে দেওয়াল, স্টেশনের দিকে তার কিছুটা ভাঙা। সেই ফোকর গলে হাসপাতালের মধ্যে ঢুকে পড়া। এরপর হাসপাতালের সেকেন্ড গেট থেকে বের হয়ে রাজা সুবোধ মল্লিক রোড় পার হয়ে সেন্ট্রাল রোডে গিয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকা।
এই পরিকল্পনা করে ঢুকেছিলাম হাসপাতালের মধ্যে। কিন্তু সেকেন্ড গেটে আর পৌঁছাতে পারলাম না। হাসপাতালের মেইন গেট থেকে শুরু হয়ে কামারপাড়া পর্যন্ত পৌঁছানোর যে রাস্তা সেটা পার হয়ে এপারে এসে সেকেন্ড গেটের দিকে বাঁক নিতেই হুংকার-হল্ট। হাত উপরে তোল। পালাবার চেষ্টা করেছিস কী মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। একজন বলেছিল কামারপাড়া ছাড়া আর কোথাও কোন সি.পি.এম নেই। আমার বোঝা উচিৎ ছিল যে তারা মাঝে মাঝে গুহা ছেড়ে শিকারে বের হয়।
মেইনগেট থেকে আসা আর সেকেন্ড গেটে যাওয়ার সংযোগস্থলের বাঁদিকে একটা ক্যান্টিন, তার পাশে আছে হাসপাতাল কর্মচারী ইউনিয়ন অফিস। আর আছে কিছু আম কদম সেগুন গাছ। কিছু আকন্দ ঝোঁপ ঢোলকমলি আর ঝাটি গাছের ঝোঁপঝাড়। সেই ঝোঁপের আড়াল থেকে বের হয়ে এসেছে দু দুটো মূর্তি। যাদের দেখে পা দুটো অবশ হয়ে গেল আমার, গেথে গেল মাটিতে। ওরা এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়াল। তখন পিঠের উপর অনুভূত হল একটা ধাতব নলের কঠিন স্পর্শ। ওই রকম আর একটা কুঁচকুচে কালো নল ঠেকে গেল বুকে। যার ছয়টা ছিদ্র থেকে উঁকি দিচ্ছে ছয়টা বিষাক্ত দাঁত। যা এক তর্জনির ইশারায় যে কোন মুহূর্তে দংশন করে দেবে আমার বুকের হাড়মাংসে।
এই দুই মুর্তি আমার চেনা। এর একজন তাতা দত্ত আর একজন নানু দাস। এরা দুজনও আমাকে চেনে। সে চেনা শব্দের, আগুন বারুদ আর রক্তের। এরা রণসাজে সেজে আসত স্টেশনের এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মে, আমরা আসতাম দুনাম্বারে। রেল লাইনকে মাঝখানে রেখে দুদিকে দাঁড়িয়ে আমরা একে অপরকে অকথ্য গালাগালি দিতাম, বোমাগুলি ছুড়তাম। এবং দু পক্ষই ভাবতাম বিপ্লব করছি।
তাতা দত্ত আমার পিছনে রিভলবারের গুতো দিয়ে হুকুম দিল, কামারপাড়ায় চল।
কামারপাড়া। এ কোন একটি পাড়ার নাম নয়। একটা ঘাটি, একটা বিশেষ ধরনের লোকদের দ্বারা পরিপূর্ণ স্থান। একটা পরিকল্পিত কার্যক্রম। এ এমন এক নাম যা অতি বড় সাহসীর বুকেও কাঁপন ধরিয়ে দেয়। সারা অঞ্চল দখল করে নিয়েছে তবু এত পুলিশ সি.আর.পি নিয়েও কংগ্রেসিরা এ পাড়ায় ত্রিসীমানায় আসার চেষ্টা করেনি। প্রবাদ আছে, কামারপাড়ায় যে আসে হেঁটে ফিরে যায় খাটে। এখন আমাকে সেই পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
টিবি হাসপাতাল থেকে কামারপাড়ার কার্লভাট মাত্র এক কিলোমিটার পথ। এই পথটা কী আমি সেদিন হেঁটে যেতে পেরেছিলাম? যে হেঁটে গিয়েছিল সে কী আমি? অনেক দিনের অনাহারী অর্ধমৃত অবশ অচৈতন্য একটা দেহ যেন ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে পার হয়ে এসেছিল জীবনের সব চেয়ে দুর্গম কঠিন পথ। যেভাবে ভোর বেলায় কসাইখানার পথে হেঁটে যেতে দেখা যায় বুড়ো, আধমরা জীর্ণশীর্ণ গরুর পাল। ধুলিধূসর দেহকে অতিকষ্টে টেনে টেনে সামনে আগায়। প্রতি পদক্ষেপে যার ঝরে ঝরে পড়ে সীমাহীন ক্লান্তি-অবসাদ। যার প্রতিটা পদক্ষেপে জীবন থেকে খসে খসে যায় বেঁচে থাকার মেয়াদ।কতরাত কতদিন যে সে এইভাবে কত পথ পার হয়ে এসেছে, কতপথ আর যে বাকি সে তার কোন হিসেব জানে না। ঘোলা চোখে চারদিকে তাকায় আর কেবল হাঁটে। অবসন্ন শরীরটা পথের ধুলোর উপর লুটিয়ে পড়তে চায়। পা যেন আর শরীরের ভার বইতে পারছে না। তবু উপায় নেই, হাঁটতেই হয়। চলার গতি সামান্য শ্লথ হলেই পিঠের উপর আঘাত হানে ক্রুদ্ধ কসাইয়ের নিমর্ম লাঠিচল্ চল্ হেট হেটু। গরুর মুখ থেকে গাঁজলা গালের কষ বেয়ে গড়িয়ে নামে। জল আর পিচুটি ভরা চোখের কোণ খোঁচায় ডাশ মাছি। শরীরের ক্ষত খোবলায় আঁড়িপাতাকাক। লেজ তুলে সেকাউকে ঝাঁপটাও মারতে পারেনা–শরীর এতশক্তিহীন। তবু হাঁটতে হয়। নিজের জীবনকে নিজে বয়ে নিয়ে যেতে হয় বধ্যভূমির দিকে।
আমি এখন এক এক পা টেনে এগিয়ে চলেছি, মাথায় কাটার মুকুট কাঁধে ক্রুশকাঠ নিয়ে হেঁটে চলা যিশুখৃষ্টের মতো। চারদিক তাকিয়ে কাতর চোখে দেখে নিচ্ছি আকাশ সূর্য রোদ মাটি মানুষ। যা আর কোনদিন দেখার সুযোগ পাবো না। এই পৃথিবী নিষ্ঠুর নির্দয় পৃথিবী অনাহার অপমান অত্যাচার ছাড়া আমাকে আর কিছুই দেয়নি। তবু একে ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছে। এই পৃথিবীর এককোণে বাস করে আমার বাবা মা ভাই বোন। যাদের প্রতি আমার অনেক দায়িত্ব কর্তব্য ছিল। তার কিছুই পালন করা হলো না।
কামারপাড়ার কার্লভাটের উপর এখন গিজগিজ করছে তোক। তাদের সংখ্যা অনেক। কেউই তারা স্থির নয়, উত্তেজনায় সব ছটফট করছে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে–দেড় দুশো গুলির আওয়াজ। নানা এলাকা থেকে যা তাদের টেনে নিয়ে এসেছে মূল ঘাটিতে। এত গুলিগোলা চলছে কেন। তবে কী জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূলঘাটি, দক্ষিণবঙ্গের লেলিনগ্রাদ, কামারপাড়া বিপন্ন। প্রতিক্রিয়াশীল কংগ্রেস দ্বারা আক্রান্ত! সব এখন রণসাজে সজ্জিত। তেমন হলে শেষ সংগ্রাম হবে এই মাটিতে। শত্রুপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে–এ মাটি দুর্জয়ঘাটি। এখানে দাঁত বসাতে গেলে দাঁত ভেঙে যাবে।
খবর এসে গেছে এই কিছুক্ষণ আগে। না, সে সব কিছু নয়। এতে আমাদের খুব একটা ভয়ের কিছু নেই। এটা হচ্ছে নকশাল আর পুলিশের ব্যাপার। আমরা নিরাপদ। তবে পাশের ঘরে আগুন লাগলে একটু তাপ তো লাগেই। সেই জন্য সতর্কতার প্রয়োজন আছে।
আমাকে দেখে এখন এখানকার বেশ কয়েকজনের চোখ ছানাবড়া। ওরা যে আমাকে চেনে। সেই চিনে ফেলাটাই আর লক্ষে বড় বিপদের। আরে তুই। বস বস ওইখানে।
কালর্ভাটের পাশে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। জ্বলছে কয়লার উনুন। দোকানদারের ভাবলেশহীন পাথর পাথর মুখ। সে জল ঢেলে চায়ের গেলাস ধুচ্ছে। গেলাসে চিনি দিচ্ছে। ছাঁকনিতে গুড়ো চা পাতা ফেলে তার উপর গরম জল ঢালছে। তারপর এক হাতে চায়ের গেলাস খদ্দেরের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য হাতে উনুনের পাশে রাখা ডজন খানেক থ্রি নট থ্রি বুলেট নেড়েচেড়ে গরম করছে। এ সব অতি স্বাভাবিক, রুটিন মাফিক ব্যাপার। দোকানদার পার্টির জঙ্গি কমরেড়। তার কাছে রুটি কাটা আর গলা কাটায় কোন প্রভেদ নেই। দুটোতেই সে সমান দক্ষ।
যারা আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে, তাদের কাজ শেষ। পুলিশ অপরাধীকে ধরে কোর্টে নিয়ে এসেছে। এখন যা করার তা বিচারপতি করবে। জহাদ করবে। তাতা দত্ত আর নানু দাস দু জনে এখন পরম নিশ্চিন্তে বসে লেবু চা খাচ্ছে। তারা বসে আছে রাস্তার ওপারে এক বিল্ডিংয়ের ছায়ায়। আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে চচঁড়ে রোদে এপারের চা দোকানের বেঞ্চিতে। আমার সামনে পিছনে সচেতন জনগণের জমায়েত। আমি এক যুদ্ধপরাধী। আমার সাজা কী হবে সে মোটামুটি সবারই জানা। এ বিষয়ে বিচারক, জুরি, এবং জনগণের কোন মতভেদ নেই। মতভেদ হচ্ছে দণ্ড কার্যকর করবার পদ্ধতির বিষয়ে। এখানে মারা হবে না অন্য কোনখানে নিয়ে, এখন মারা হবে, না, রাতে, গলার নলিকাটা হবে না কী গুলি করা হবে, ছোট ছোট ভাগ হয়ে তারা সেই আলোচনা করছে।
কে কী বলছে আমার শোনার কথা নয়। শুনে বা আমি কী করতে পারি। মাংসের দোকানের খুঁটীতে বাঁধা পাঠা তো দেখে, পাঠাকে কী করা হয়। তাকে কী করা হবে। সব জেনে বুঝে তার কী বা করার থাকে? আমি তো যখনই ধরা পড়েছি তখনই বুঝে গেছি কামারপাড়ায় আমাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু কি করার ছিল আমার? একে তো আমাশায় আক্রান্ত অসুস্থ শরীর। তার উপর অনাহারে দুর্বল। শস্ত্রধারী দুজন সবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কী করে লড়াই করে জয় পেতাম।
এখন আমার ভয় করছে। সারা বুক জুড়ে হিমশীতল এক আতঙ্কের নিঃশব্দ চলাচল। ওরা যদি এতক্ষণ আমাকে চড় ঘুষি লাঠি চালাত তাহলে শরীরের কষ্ট হোত কিন্তু ভয় করত না। ওই সব ক্রিয়ার দ্বারা ওদের ক্রোধ খানিকটা নির্গত হয়ে গেলে আমার বেঁচে যাবার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল। ওরা তা করছে না। সব ক্রোধ রাগ আগলে রেখে দিয়েছে মোক্ষম মার দেবে বলে। এটাই ভয়ের। খুবই ভয়ের। যার অপরাধ অতি অল্প তাকে মেরে মেরে আধমরা করে দেওয়া হয়। যার অপরাধ বিশিষ্ট শ্রেণির তাকে মারা হয় অতি বিশিষ্ট মার–মৃত্যু।
এক একজন এসে আমার আগাপস্তলা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। কেউ কোন কথা বলছে না, কিছু জিজ্ঞাসা করছে না। শুধু নির্মম নির্নিমেষ দৃষ্টি দিয়ে আমাকে দেখে চলে যাচ্ছে।
কত দেরি? কে যেন কাকে জিজ্ঞাসা করে। জবাব দেয় সেখোকা দা এসে গেলেই। আবার প্রশ্ন–কখন আসবে? জবাব–খবর তো অনেকক্ষণ আগে পাঠানো হয়েছে।
তাহলে আর কিছুক্ষণ থেকে দেখেই যাই কী বল?
খোকাদা মানে খোকা দাস। কামারপাড়ায় সেনাদলের সর্বাধিনায়ক। লোকে বলে সে নাকি এককুড়ি খুন করেছে। আঙ্গুলিমাল-এর মত সে যাকে মারে, প্রাণেই মারে। মানুষ মারা তার প্রিয় খেলা। ছুরিচাকু নাকি তার হাতে শিল্পীর তুলির মতো সাবলীলভাবে চলে। চোখের পলক পরার আগে পেট চিরে দ্যায়, নলি কেটে দ্যায়। সে এলেই আমার হয়ে যাবে। যতক্ষণ সে না আসে আমার পরমায়ু ততক্ষণ। আঃ। বেঁচে থাকার এমন অতলান্তিক আনন্দ এমন অনিঃশেষ স্বাদ, এক একটা নিঃশ্বাস যে এত মূল্যবান, আরাম দেয়, আগে কোনদিন এমনভাবে জানা হয়নি। এর জন্য এখন খুব মায়া হচ্ছে।
দম এখন যেন বন্ধ হয়ে আসছে আমার। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। চোখ ঘোলা ঘোলা হয়ে আসছে, ঝাপসা দেখাচ্ছে চারদিক। ঘুরপাক খাওয়া মানুষদের কেমন যেন প্রেতপুরির ছায়া মানুষ বলে মনে হচ্ছে। কান আর মাথার মধ্যে আঁ আঁ করছে। যেন বেসুরে ভেপু বাজাচ্ছে কেউ। চারপাশের লোকজন, মাথার উপরের নীল আকাশ উজ্জ্বল রোদ, সবুজ গাছপালা সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি যেন কোন দ্বীপে পৌঁছে গেছি। আমার চারপাশে বৃত্ত করে বসে আছে হায়না চিতা সাপ বাঘ। এখানে আমার আপনজন কেউ নেই।
এক সময় মনে হয় আমি মারা গেছি। জাগতিক যাবতীয় হিসাব নিকাশ–সব চাওয়া পাওয়া বন্ধুত্ব বৈরিতা নিচে ফেলে দেহমুক্ত আত্মা এখন মহাশূন্যে উড়ে গেছে। নিচে যে আমি বসে আছে সে বহুকাল আগে মরে যাওয়া “আমির” মৃত শরীরটাকে মমি করে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
একজন একটা দোনলা বন্দুকেদুটো এল.জি.কার্তুজ ভরে সেটা রাস্তার ওপাশে এক গ্যারাজের লোহার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে। তাহলে কী আমাকে গুলি করে মারবার সিদ্ধান্ত হয়েছে? বর্তমান দুর্মুল্যের বাজারে এক একটা গুলির কত দাম। ওরা কী আমার প্রতি এতটা সদয় উদার হবে? যদি হয়, সেটা খুবই উত্তম। গলা কাটা, পেট চিরে ফেলা, সাপের মত পিটিয়ে পিটিয়ে মারা, ইট দিয়ে থেত করা–এসবের চাইতে সেটা উভয় পক্ষেরই আরামদায়ক। এতে সময় এবং শ্রম দুটোরই সাশ্রয় হবে।
–এ্যাই ছোঁকড়া কী যেন নাম তোর। চা খাবি? বড় নরম বড় মোলায়েম গলায় একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করে, খাবি চা? লোকটার দিকে এক অবুঝ চোখে তাকিয়ে থাকি আমি। আমাকে চা খাওয়াবে। কিন্তু কেন? আমি তো তার কোন পূর্ব পরিচিত কেউ নই। তবে?
লোকটার পরিধানে পরিষ্কার ধুতি, পাঞ্জাবি। বয়স বছর চল্লিশ। ফরসা গোলগাল, কাপড়ের দোকানের মালিকের মতো চেহারা। আমি মাথা নাড়ি-না। সে নাছোড়–চা খাবি না! বেশ, তবে এক গেলাস দুধজল খা। তা-ও খাবি না! তবে কী খাবি? ডাব এনে দিই একটা?
এই লোকটার নাম ধরে নিচ্ছি বেনু সেন। একজন এসে তাকে থামাতে চায়-আঃ বেনুদা কেন ফালতু ওকে ডিসটার্ব করছ। হাসে বেনু নামের নোক