জি।
খাদেম। হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে বললেন, আমার পক্ষে মাজার ছেড়ে যাওয়া সম্ভব না। একটু চা খাওয়া প্রয়োজন। তুমি কি আমাকে এক কাপ চা খিলাতে পারবে? গলির মাথায় একটা চায়ের দোকান আছে, আবুলের চায়ের দোকান। আমার কথা বললে চা দিবে। টাকা নিবে না।
হুজুর, চায়ের সাথে আর কিছু খাবেন? টোষ্ট বিস্কুট, কেক?
সিগ্রেট খাব। একটা সিগ্রেট নিয়ে আসবে।
আমি বললাম, সিগ্রেট কি আবুল ভাই মাগনা দিবে? নাকি খরিদ করতে হবে?
হুজুর জবাব দিলেন না, খানিকটা বিষন্ন হয়ে গেলেন। এর অর্থ, আবুল ভাই চা মাগনা দিলেও সিগারেট দিবে না।
আবুল ভাইয়ের চেহারা মনে রাখার মতো। মানুষের কিছু দাঁত মুখের বাইরে থাকতে পারে, উনার প্রায় সবগুলোই মুখের বাইরে। মুখের বাইরে থাকার কারণেই মনে হয় দাঁতের যত্ন বেশি। প্রতিটি দাঁত ঝকমক করছে। ক্লোজ-আপ এই দাঁতের একটা বিজ্ঞাপন করলে ইন্টারেস্টিং হতো। বিজ্ঞাপনের ভাষা—‘মুখের বাইরের দাঁতের জন্যেও কোজআপ’।
হুজুরের জন্যে মাগনা চা নিতে এসেছি শুনে আবুল ভাই ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। অতি অশালীন কিছু কথা বললেন। অশিক্ষার কারণেই হয়তো বললেন। গরম চা শরীরের এক বিশেষ প্রবেশদ্বার দিয়ে সাইকেলের পাম্পার দিয়ে ঢুকাতে বললেন। আমাকে চা এবং টোষ্ট বিস্কুট নগদ টাকায় কিনতে হলো।
হুজুরের সামনে চা, একটা টেস্ট বিস্কুট এবং এক প্যাকেট বেনসন এন্ড হেজেস রাখলাম। সিগারেটের প্যাকেট দেখে হুজুরের চেহারা কোমল হয়ে গেল। তিনি নরম গলায় বললেন, বাবা, ম্যাচ এনেছ? আমি বললাম, জি হুজুর।
তোমার উপর আমি দিলখোশ হয়েছি। আমার যেমন দিলখোশ হয়েছে। বাচ্চাবাবাও সন্তুষ্ট হয়েছেন। উনার সন্তোষ আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি। তোমার কোনো মানত থাকলে বাচ্চাবাবারে বলো। আমি নিজেও দোয়া বখশায়ে দিব। আছে কোনো মানত?
জি আছে। বাংলা ভাষায় দুটা শব্দ ঢুকাতে চাই।
হুজুর চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে তৃপ্তি নিয়ে বললেন, দুটা কেন, দশটা ঢুকাও। কোনো সমস্যা নাই। বাবার দরবারে এসেছ, খেয়াল রাখবা, বাবা কৃপণ না। যা চাবা অধিক চাবা।
হুজুরের মোবাইলে কি একটা ফোন করতে পারব?
অবশ্যই পারবে, তবে কথা অল্প বলবে। বেশি কথা আমাদের নবীজী সাল্লালাহু আলেয়স সালাম পছন্দ করতেন না। আমিও করি না। সর্ব কর্মে আমি নবীজীকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি।
আমি বাংলা একাডেমীর ডিজি সাহেবকে টেলিফোন করলাম। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, কে বলছেন?
আমি অতি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, স্যার আমার নাম হিমু। সকালে আপনার সঙ্গে দুটা নতুন শব্দ নিয়ে কথা হয়েছে। একটা ফুতুরি, আরেকটা ভুতুরি। ভুতুরি শব্দটার বানানে দুটা চন্দ্ৰবিন্দু লাগবে। ভূতের বিষয় তো, এইজন্য চন্দ্ৰবিন্দু। শব্দটা হবে ‘ভুঁতুঁরি’।
ডিজি সাহেব লাইন কেটে দিলেন।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি হুজুরের সামনে বসে আছি। হুজুর সিগারেট টানতে টানতে বৃষ্টি দেখছেন। তার চেহারায় উদাসভােব চলে এসেছে। আমি বললাম, হুজুর, আরেক কাপ চা কি আনব?
হুজুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, প্রয়োজন নাই। তুমি কি পা টিপতে পারো?
আমি বললাম, আমরা বাঙালি। বাঙালি আর কিছু পারুক না-পারুক, পা টিপতে পারে। হুজুরের পা কি টিপে দিব?
হুজুর উদাস গলায় বললেন, দাও। মুরুব্বিদের পা দাবানোর মধ্যে সোয়াব আছে। মুরুব্বিদের সঙ্গে আদবের সঙ্গে কথা বলাতেও সোয়াব। জন্মের সময় আল্লাহপাক প্রত্যেকের নামে ব্যাংকে একটা সোয়াবের একাউন্ট খুলে দেন। আমাদের কাজ হলো একাউন্টে সোয়াব জমা দেওয়া। বুঝেছ?
আমি হুজুরের পা দাবাতে গিয়ে দেখলাম, তার দুটা পা হাঁটুর ওপর থেকে কাটা। পা কাটা মানুষের সঙ্গে ক্র্যাচ থাকে। ইনার নেই বলে কাটা পার বিষয়টা এতক্ষণ ধরতে পারি নি। তা ছাড়া লুঙ্গিও কায়দা করে পরেছেন। লুঙ্গির শেষ প্ৰান্তে স্যান্ডেল আছে।
আমি বললাম, হুজুরের পা কাটল কীভাবে?
হুজুর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আল্লাহর হুকুমে পা কাটা গেছে। এর সঙ্গে ডাক্তারের বদমাইশিও আছে। ডাক্তারের কানে শয়তান ধোঁয়া দিয়েছে। শয়তানের অছওয়াছায় ডাক্তার আমার দুটা ঠ্যাং কেটে ফেলে দিয়েছে। একটা কাটলেও চলত।
আমি বললাম, অবশ্যই নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।
হুজুর লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কাটা ঠ্যাং আমাকে দেয় নাই, এটা একটা আফসোস।
কাটা ঠ্যাং দিয়ে করবেন কী?
হুজুর বিষন্ন গলায় বললেন, কবর দিবার জন্য চেয়েছিলাম। কবর দিতাম। ঠ্যাং শরীরের একটা বড় অংশ। এর কবর হওয়া প্রয়োজন।
হুজুরের পা নেই, পা কীভাবে দাবাবে বুঝতে পারছি না। হুজুর বললেন, পা কাটা পড়েছে, কিন্তু ব্যথা বেদনা ঠিকই আছে। পা নাই, তার পরেও ব্যথা বেদনা হয়। রগে টান পড়ে। আঙুল পর্যন্ত কটকট করে। পায়ের আঙুলগুলা আগে ফুটায়ে দাও। অনুমান করে যেখানে আঙুল থাকার কথা সেখানে টান দাও, আঙুল ফোটানোর শব্দ শুনবে। খুবই আচানক ঘটনা।
আমি হুজুরের অদৃশ্য পা দাবাচ্ছি। অদৃশ্য আঙুল টানছি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আঙুল টানার সময় কট করে একটা আঙুল ফুটল।
হুজুর বললেন, আঙুল ফোটার শব্দ শুনেছ?
জি।
আচানক হয়েছ?
জি।
আল্লাহপাকের আজিব বিষয় বুঝতে পেরেছ?
বুঝার চেষ্টায় আছি।
এইসব দেখেও কেউ কিছু বুঝে না। মূর্থের মতো বলে, আল্লাহ নাই, বেহেশত-দোজখ নাই। বলে কি না বলো?