ডানে মোড় নিয়ে এগুতে এগুতে আগে চোখে পড়ে নি এমনসব জিনিস চোখে পড়তে লাগল। একটা বান্দরের দোকান দেখতে পেলাম। খাচার ভেতর নানান আকৃতির বীদার। বান্দরের সঙ্গে হনুমানও আছে। সবগুলি বাঁদর ও হনুমান খাচার ভেতর শিকল দিয়ে বাধা। দোকানের সামনে দাঁড়াতেই প্রতিটি বাঁদর একসঙ্গে আমার দিকে তাকাল। তারা চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না, তবে নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করছে। বাঁদরের দোকানের মালিক সবুজ লুঙ্গি পরে লাঠি হাতে টুলের উপর বসা। তার বান্দরের মতোই লোমশ গা। চোখ তক্ষকের চোখের মতো কোটর থেকে বের হয়ে আছে। আমি বললাম, বাঁদর কত করে?
তক্ষক-চোখা বিরক্ত গলায় বলল, বিক্রি হয় না।
বিক্রি হয় না। তাহলে এতগুলি বাদর নিয়ে সে বসে আছে কেন, এই প্রশ্ন করা হলো না। কারণ এই লোক লাঠি হাতে তেড়ে এসেছে। তার দোকানের সামনে কিছু ছেলেপিলে জড় হয়েছে। বাদারদের ভেংচি দিচ্ছে। তক্ষক-চোখ লোকের লক্ষ্য এইসব ছেলেপিলে। শিশুর দল তাড়া খেয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হলো।
তারা আবার আসছে। এটাই মনে হয় তাদের খেলা।
একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল, যার সাইনবোর্ডে লেখা—’স্পেশাল মালাই চা’। বড় টিনের গ্লাসে করে চা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি গ্রাসের সঙ্গে পত্রিকার কাগজ ভাঁজ করে দেওয়া, গরম টিনের গ্লাস ধরার সুবিধার জন্যে। এই চায়ের মনে হয় ভালো কাটতি। কিছু কাস্টমার দোকানের বাইরে ফুটপাতে বসে চা খাচ্ছে।
একটা রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেল। যার বাইরে লেখা—’গোসলের সুব্যবস্থা আছে। পরিষ্কার গামছা দেওয়া হয়। মহিলা নিষেধ।’ একবার এসে ভালোমতো খোঁজ নিতে হবে ব্যাপারটা কী। রেস্টুরেন্টে গোসলের সুব্যবস্থা থাকার প্রয়োজনইবা পড়ল কেন? মহিলা নিষেধ কেন, তাও বোঝা গেল না। তাদেরও তো গোসলের অধিকার আছে।
ঘানি দিয়ে সরিষা ভাঙানোর প্রাচীন কল পাওয়া গেল। গরুর বদলে আধমরা এক ঘোড়া ঘানি ঘোরাচ্ছে। এদের সাইনবোর্ডটি চোখে পড়ার মতো—‘আপনার উপস্থিতিতে সরিষা ভাঙাইয়া তেল করা হইবে। ফাঁকি ঝুঁকি নাই।‘
বোতল হাতে বেঞ্চিতে কয়েকজন বসে আছে। এরা নিশ্চয়ই নিজে উপস্থিত থেকে সরিষা ভাঙিয়ে খাটি তেল নিয়ে বাড়ি ফিরবে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে রুগ্ন। তিনটি গাভির বাথান পাওয়া গেল। খাঁটি সরিষার তেলের মতো খাঁটি গরুর দুধের সন্ধানে মনে হয় লোকজন। এখানে আসে। কিংবা গাভিদের নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ি বাড়ি। খরিদ্দারের সামনে দুধ দোয়ানো হয়। তিনটি গাভির সামনেই খড় রাখা আছে, তারা খাচ্ছে না। হতাশ চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাছুরগুলো একটু দূরে বাঁধা। তাদের চোখেও রাজ্যের বিষন্নতা। তাদেরই মায়ের দুধ, অথচ তাদের কোনো অধিকার নেই।
ডানদিকে ঘোরা ভ্ৰমণ একসময় শেষ হলো। এমন এক জায়গায় এসেছি ডানে ঘোরার উপায় নেই। অন্ধগলি। শেষ প্রান্তে লালসালু দেওয়া মাজার শরিফ।
মনে হচ্ছে যে বিশেষ ঘটনা ঘটবে বলে সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল, সেই বিশেষ ঘটনা ঘটেছে। ডানে আর যাওয়ার উপায় নেই, আমার ভ্রমণের সমাপ্তি।
মাজারের রেলিং ধরে বিড়বিড় করবে। থালা হাতে ভিখিরি থাকবে। সারা রাত গাজা খেয়ে চোখ টকটকে লাল হওয়া খালি গায়ের রুগ্ন দু’একজন থাকবে। এরা মাজারের খাদেম না, তবে খাদেমের সাহায্যকারী। এই মাজার শূন্য। খাদেমের ঘরে খাদেম বসে আছেন। আর কেউ নেই। সম্ভবত অন্ধগলিতে মাজার হওয়ার কারণে নাম ফাটে নি।
খাদেমের চোখ বাথানের গাভিগুলির মতোই বিষন্ন। তিনি সবুজ রঙের পাঞ্জাবি পরেছেন। মাথায় পাগড়ি আছে। পাগড়ির রঙ সবুজ। বয়স ষাটের মতো হবে। দাড়ি মেন্দি দিয়ে রাঙানো। খাদেমদের চোখেমুখে ধূর্তভাব থাকে, ইনার নেই। বরং চেহারায় খানিকটা আলাভোলাভাব আছে। খাদেম মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। তার মাথার উপর লেখা—’বাচ্চাবাবার গরম মাজার’।
এই লেখার নিচেই লাল হরফে লেখা, ‘পকেটমার হইতে সাবধান’।
আমি খাদেমের দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনি তীক্ষু দৃষ্টিতে তাকালেন। মোবাইল ফোন কানে ধরেই বললেন, দোয়া খায়ের করার জায়গা বা দিকে। মহিলারা যাবেন ডানে। দানবাক্স মহিলা-পুরুষের আলাদা।
আমি বাঁ দিকে ঢুকেই দানবাক্স পেলাম। ‘লেড়কা সে লেড়কা কা গু ভােরী’র মতো দানবাক্সের তালা বড়। দান বাক্সে লেখা ‘পুং’ অর্থাৎ পুরুষদের।
বাচ্চাবাবা সম্ভবত বালক ছিলেন। রেলিং ঘেরা ছোট্ট কবর। কবরের ওপর একসময় গিলাফ ছিল, বৃষ্টির পানিতে ভিজে রোদে পুড়ে গিলাফ নানা ক্ষতচিহ্ন নিয়ে সেঁটে বসেছে। মাজারের পায়ের কাছে দর্শনীয় নিমগাছ। কংক্রিটের শহরে এই গাছ ভালোমতো শিকড় বসিয়ে স্বাস্থ্যে সৌন্দর্যে ঝলমল করছে। এত বড় নিমগাছ আমি আগে দেখি নি। নিমগাছের একটি প্ৰজাতির নাম মহানিম। মহানিম বটবৃক্ষে মতো প্ৰকাণ্ড হয়। এটি হয়তোবা মহানিম।
খাদেমের মোবাইলে কথা বলা শেষ হয়েছে। তিনি হাতের ইশারায় আমাকে ডাকলেন। আমি বিনীত ভঙ্গিতে তার সামনে দাঁড়ালাম। তিনি গভীর গলায় বললেন, পবিত্র কোরান শরিফে শয়তানের নাম কতবার আছে জানো?
আমি বললাম, জি-না।
তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বাহান্নবার। এর মরতবা জানো?
জি-না।
শয়তান এমনই জিনিস যে, স্বয়ং আল্লাহপাককে বাহান্নবার তার নাম নিতে হয়েছে। আমাদের চারিদিকে শয়তান। তার চলাফেরা রক্তের ভেতরে। বুঝেছ?