আমার কাজ শেষ। ডিজি স্যারের দিকে তাকিয়ে বিনয়ে নিচু হয়ে বললাম, স্যার যাই। আপনার সঙ্গে কথা বলে বিমল আনন্দ পেয়েছি।
ডিজি স্যার বললেন, আচ্ছা আচ্ছা।
আমি বললাম, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সামান্য সেবা করার সুযোগ যদি দেন। আমি একটা নতুন শব্দ দিতে চাই। শব্দটা হলো ‘ভুতুরি’।
ভুতুরি?
জি স্যার, ভুতুরি। এর অর্থ হবে ভূতের নাকে ফুঁ দিয়ে বাজানো বাঁশি।
ভূতের বঁশি?
জি স্যার, ভূতের বাঁশি। এটা বিশেষ্য। বিশেষণ হবে ভুতুরিয়া। ডাকাতিয়া বাঁশির মতো ভুতুরিয়া বাঁশি। শচীন কর্তার ডাকাতিয়া বাঁশি গানটা কি শুনেছেন? আমি সুর করে গাইবার চেষ্টা করলাম— ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।’ ডিজি সাহেব অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। হিসাব মিলাতে পারছেন না। আমি হাত কচলাতে কচলাতে বললাম, কাউন্সিল মিটিংয়ে বল্টুভাইয়ের ফুতুরি’ শব্দটার সঙ্গে আমার ‘ভুতুরি’ শব্দটা যদি তোলেন খুব খুশি হব।
বল্টুভাই কে?
হার্ভার্ডের Ph.D.-র ডাকনাম বল্টু। সবাই তাকে বল্টু’ নামে চেনে। এই নামেই ডাকে। আপনি যদি তাকে মিস্টার বল্টু ডাকেন, উনি রাগ করবেন না। খুশিই হবেন। তাঁর ভাইয়ের নাম নাট। দুই ভাই মিলে নাট-বল্টু। স্যার যাই।
হতাশ এবং খানিকটা হতভম্ব অবস্থায় ডিজি সাহেবকে রেখে আমি বের হয়ে এলাম। ফুতুরির সঙ্গে ভুতুরি যুক্ত হওয়ায় তিনি খানিকটা বিপর্যস্ত হবেন—এটাই স্বাভাবিক। বেচারার আজ সকালটা খারাপভাবে শুরু হয়েছে। তাঁর কপালে। আজ সারা দিনে আর কী কী ঘটে কে জানে!
আমার জন্যে দিনটা ভালোভাবে শুরু হয়েছে, এটা বলা যেতে পারে। দিনের প্রথম চায়ের কাপে একটা মরা মাছি পেয়েছি। মৃত মাছি চায়ে ভেসে থাকার কথা, এটি আর্কিমিডিসের সূত্র অগ্রাহ্য করে ডুবে ছিল। চা শেষ করার পর স্বাস্থ্যবান মাছিটাকে আমি আবিষ্কার করি। চায়ের কাপে মৃত মাছি ইঙ্গিতবহ। চায়নিজ গুপ্তবিদ্যায় চা শেষ করে কাপের তলানির চায়ের পাতার নকশা বিবেচনা করা হয়। চায়ের পাতায় যদি কোনো কীটপতঙ্গের আকার দেখা দেয়, তাহলে বুঝতে হবে আজ বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটবে। আমার চায়ের কাপের তলানিতে চায়ের পাতায় কীটপতঙ্গের নকশা না, সরাসরি মাছি।
আজ নিশ্চয়ই কিছু ঘটবে।
‘মনে মনে সোনার মাছি খুন করেছি’ কবিতার লাইন বলে বাংলা একাডেমী থেকে বের হলাম। হাতের মুঠোয় ডিজি সাহেবের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনের নম্বর। পিএস সাহেব আগ্রহ করে লিখে দিয়েছেন। এই নম্বর হটলাইনের নম্বরের মতো। যত রাতেই ফোন করা হোক, ডিজি সাহেব লাফ দিয়ে টেলিফোন ধরবেন। ফুতুরি-ভুতুরি নিয়ে তিনি কী পরিকল্পনা করেছেন মাঝে মাঝে টেলিফোন করে জানতে হবে।
আকাশে মেঘ আছে। মেঘ। সূর্যকে কাবু করতে পারছে না। মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে, চনমনে রোদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। গায়ে রোদ মাখতে মাখতে এগোচ্ছি। শরীরে ভিটামিন ‘ডি’ জমা করে নিচ্ছি। সূর্যের আলো ছাড়া শরীরে এই ভিটামিন তৈরি হয় না। সূর্য থেকে ধার করে চন্দ্ৰ যে আলো ছড়াচ্ছে সেখানে কি কোনো ভিটামিন আছে? নরম-টাইপের ভিটামিন?
কয়েকজন ভিক্ষুকের সঙ্গে দেখা হলো। এরা ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখল, কাছে এগিয়ে এল না। ভিক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে ভিক্ষুকদের সিক্সথ সেন্স প্রবল হয়ে থাকে। এরা ধরে ফেলেছে আমার কাছে কিছু পাওয়ার আশা নেই।
কদমফুল বিক্রেতা দুজন ফুলকন্যাকে দেখলাম। এদের নজর প্রাইভেট কারে বসা যাত্রীদের দিকে, আমার মতো ভবঘুরের দিকে না। তারপরেও একজন হেলাফেলা ভঙ্গিতে বলল, ফুল নিবেন?
আমি বললাম, হুঁ।
এমন তো হতে পারে, যে বিশেষ ঘটনা ঘটবে বলে মনে হচ্ছে সেই ঘটনার প্রধান চরিত্র ফুলকন্যা। মেয়েটার চেহারা মিষ্টি, তবে হাতভর্তি ফুলের কারণেও চেহারা মিষ্টি মনে হতে পারে। ফুল হাতে নেওয়ামাত্র যে-কোনো মেয়ের চেহারা মিষ্টি হয়ে যায়। একইভাবে বন্দুক হাতে সুশ্ৰী মহিলা-পুলিশকেও কর্কশ দেখায়। বন্দুকের কারণেই দেখায়। তাদের নাকের নিচে হালকা গোঁফের মতো ভেসে ওঠে। বন্দুক হাত থেকে নামানোমাত্ৰ গোঁফ মিলিয়ে যায়।
আমি ফুলকন্যার দিকে তাকিয়ে বললাম, ফুলের দাম কত?
দুই টেকা পিস।
এত দাম! পাইকারি দর কত?
ফুলকন্যা আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রেড লাইটে দাঁড়িয়ে পড়া লাল রঙের প্রাইভেট কারের দিকে ছুটে গেল। আমি বুঝলাম, আজকের বিশেষ ঘটনার সঙ্গে এই মেয়ে যুক্ত না।
‘নাক বরাবর এগিয়ে যাওয়া’ বলে একটা ভুল কথা প্রচলিত আছে। নাক বরাবর অর্থ হলো সোজা যাওয়া। কেউ যদি ডানদিকে ফিরে তার নাক ডানদিকে ফিরবে, সে নাক বরাবরই যাবে। আমি একটি বিশেষ ভঙ্গিতে নাক বরাবরই হাটছি। রাস্তায় যতবার ডান-বা গলি পাওয়া যাচ্ছে ততবারই আমি ডানে মোড় নিচ্ছি। গোলকধাঁধা থেকে বের হতে হলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ঢাকা শহরকে গোলকধাঁধা ভাবলে হাঁটার এই পদ্ধতি শেষটায় আমাকে কোথায় নিয়ে যায় তা দেখা যেতে পারে। গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়ার এই পদ্ধতি ব্রিটিশ ম্যাথমেটিশিয়ান তুরিন বের করেছেন। শেষটায় অবশ্যি তাঁর নিজের মাথায় গোলকধাঁধা। ঢুকে যায়। তিনি পিস্তল দিয়ে গুলি করে তাঁর মাথার খুলি গুড়িয়ে দেন। পৃথিবীর সেরা অংকবিদদের প্রায় সবার মাথায়ই এক পর্যায়ে জট লেগে যায়। তারা পাগল হয়ে যান। যারা পাগল হতে পারেন না তারা আত্মহত্যা করেন। অংকবিদদের জীবনে এই ঘটনা কেন ঘটে তা বল্টু স্যারকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।