হিমু হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে। আমি টেলিফোন রেখে দিলাম। হ্যালো হ্যালো করতে থাকুক। আমার রাগ আরও বেড়েছে। লেখক মার্ক টোয়েন বলেছেন, রাগ কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে পছন্দের কোনো বইয়ের কয়েকটা পাতা ছিড়ে ফেলা। ছেঁড়ামাত্ৰ মনে হবে, হায় হায় কী করলাম! প্রবল হতাশা তৈরি হবে। হতাশার নিচে রাগ চাপা পড়ে যাবে।
আমার হাতে বাংলা ডিকশনারি ছাড়া কোনো বই নেই। তার চারটা পাতা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে বাতাসে উড়িয়ে দিলাম। ছেড়া কাগজের একটা টুকরা পড়ল আমার কোলে। সেখানে লেখা—‘অনিকেত’। অনিকেত শব্দটার মানে কী? আমার কাছে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে শব্দটার মানে জানা দরকার।
যে করে হোক ipad খুঁজে বের করে পিঁপড়া মারতে হবে। সেখানে আরেকটা খেলা আছে, নাম মনে হয় office jerk, তার গায়ে নানান জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারা যায়। সে ব্যথা পেয়ে আহ্ উহ্ করে, তাতেও রাগ কমে।
মোবাইল ফোন ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের চেনা যায় ‘কান’ দিয়ে। তাদের দুটি ক্যানের একটি চ্যাপ্টা ধরনের হয়। কনের সঙ্গে মোবাইল ধরে সারাক্ষণ কথা বলার কারণে কর্ণ বেচারার এই দশা। মোবাইল ফোন ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
আমি বাংলা একাডেমীর ডিজি সাহেবের সামনে এক ঘণ্টা দশ মিনিট ধরে বসে আছি। মোবাইল কানে ধরে তিনি সারাক্ষণ কথা বলে যাচ্ছেন। একজনের সঙ্গে না, নানানজনের সঙ্গে। মাঝে মাঝে আঙুলের ইশারায় আমাকে অপেক্ষা করতে বলছেন। এই সময় তাঁর মুখ হাসিহাসি হয়ে যাচ্ছে। আমার দিকে হাসিমুখে তাকানোর একটাই কারণ-ডিজি সাহেব আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ভাবছেন। গুরুত্বপূর্ণ লোকজনকেই শুধু তাঁর পিএস খাসকামরায় ঢুকতে দেয়। অভাজনরা সেই সুযোগ পায় না। যেহেতু আমি পেয়েছি আমি গুরুত্বপূর্ণ কেউ।
আমার এই বিশেষ ঘরে ঢোকার রহস্য সরল মিথ্যাভাষণ। আমি পিএস সাহেবের দিকে ঝুকে ফিসফিস করে বলেছি, আমি প্রধানমন্ত্রীর একটি গোপন চিঠি নিয়ে এসেছি। এই চিঠি স্যারের হাতে হাতে দিতে হবে।
কারও সঙ্গে গলা নামিয়ে কথা বললে সেও গলা নামিয়ে কথা বলে, এটাই নিয়ম। পিএস সাহেব গলা নামিয়ে বললেন, চিঠিতে কী লেখা?
আমি বললাম, প্ৰধানমন্ত্রীর চিঠির বিষয়বস্তু তো আমার জানার কথা না, তবে অনুমান করছি ডিজি সাহেবের দিন শেষ।
বলেন কী?
ডিজি সাহেব প্রধানমন্ত্রীর ব্ল্যাকবুকে চলে গেছেন। কালো খাতায় তাঁর নাম উঠে গেছে।
পিএস বললেন, এরকম ঘটনা যে ঘটবে তার আলামত অবশ্যি পেয়েছি। যান আপনি স্যারের ঘরে চলে যান। আমি স্যারকে জানাচ্ছি যে আপনি যাচ্ছেন।
উনাকে আগেভাগে কিছু জানানোর দরকার নেই। যা বলার আমি সরাসরি বলব। গোপনীয়তার ব্যাপার আছে।
অবশ্যই! অবশ্যই!
ডিজি সাহেবের টেলিফোন শেষ হয়েছে। তিনি হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, আপনার জন্যে কী করতে পারি?
আমি বললাম, আপনি আমার জন্যে কিছু করতে পারেন না। তবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্যে কিছু করতে পারেন।
তার মানে?
এক ভদ্রলোক বাংলা শব্দভাণ্ডারে নতুন একটি শব্দ যোগ করতে চাচ্ছেন। আমি সেই প্ৰস্তাব নিয়ে এসেছি। শব্দটা হলো ‘ফুতুরি’। ফুতুরি হবে ফুঁ দিয়ে যেসব বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয় তার সাধারণ নাম।
ডিজি সাহেব চোখ-মুখ কঠিন করে বললেন, এইসব ব্রেইন ডিফেক্টদের সকাল-বিকাল থাপড়ানো দরকার।
আমি বললাম, যথার্থ বলেছেন স্যার। উনি আপনাকে একটা চিঠি দিয়েছেন। চিঠিটাতে কি একটু চোখ বোলাবেন?
চিঠি আপনি আঁস্তাকুড়ে ফেলুন এবং আপনি এই মুহুর্তে ঘর ছেড়ে চলে যাবেন। আপনাকে এই ঘরে এন্ট্রি দিল কীভাবে?
আমি বললাম, আপনার পিএস সাহেব ব্যক্তিগত বিবেচনায় দিয়েছেন। উনার দোষ নাই। যখন শুনেছেন আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এসেছি তখনই উনি নরম হয়ে গেছেন। অবশ্যি নরম হওয়াটা উচিত হয় নাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আলতু-ফালতু লোকজন তো আসতে পারে। তাই না। স্যার?
ডিজি সাহেব সঙ্গে সঙ্গে নরম হয়ে গেলেন। তার চেহারায় হাবাগোবা ভাব চলে এল। আমি বললাম, যে ভদ্রলোক বাংলা ভাষায় নতুন একটি শব্দ দিতে চাচ্ছেন তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছেন। ভদ্রলোক পদার্থবিদ্যায় হার্ভার্ড থেকে Ph.D. করেছেন। এখন আছেন সোনারগাঁ হোটেলে। রুম নম্বর চার শ’ সাত। আপনি কি উনার সঙ্গে কথা বলবেন? আপনার পিএসকে বললেই সে ফোন লাগিয়ে দিবে।
অবশ্যই কথা বলব। কেন কথা বলব না! উনার চিঠিটা দিন। পড়ি। এর মধ্যে সোনারগাঁ হোটেলে লাইন লাগাতে বলছি।
ডিজি স্যারের মুখ তেলতেলে হয়ে গেল। শরীরের ভেতরের তেল চুইয়ে বের হওয়া শুরু হয়েছে। দর্শনীয় দৃশ্য। বল্টুভাইয়ের সঙ্গে তাঁর টেলিফোনে কথাবার্তা হলো। বল্টুভাই কী বললেন শুনতে পারলাম না, তবে ডিজি সাহেবের তৈলাক্ত কথা শুনলাম।
আপনার চিঠি পড়ে ভালো লাগল। বাংলা ভাষাকে আপনার মতো মানুষরা সমৃদ্ধ করবে না তো কারা করবে? শব্দটাও সুন্দর বের করেছেন-ফুতুরি। শুরু হয়েছে ফুঁ দিয়ে। ধ্বনিগত মাধুর্য আছে। আগামী মাসের পনের তারিখ কাউন্সিল মিটিং আছে। আপনার প্রস্তাব কাউন্সিল মিটিংয়ে তোলা হবে। আশা করছি, পাস হয়ে যাবে। যদি পাস হয় তাহলে বাংলা একাডেমীর অভিধানে এই শব্দ চলে আসবে। আপনাকে অগ্ৰিম অভিনন্দন। আমি খুবই খুশি হব। যদি একদিন সময় করে বাংলা একাডেমীতে ঘুরে যান।