শ্ৰোডিনজারের মতো কেউ একজন আবেগের সমীকরণ বের করে ফেললে মানবজাতির কল্যাণ হতো। আবেগের সমীকরণ বের করা কি সম্ভব হবে? এই বিষয়ে আমি একটা চেষ্টা করব কি না ভাবছি।
নিউরো বিজ্ঞানীরা ছেলেখেলাটাইপ বিজ্ঞান করছে। তারা বলছে, অমুক আবেগের জন্ম মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোবে, তমুক আবেগের জন্ম থেলামসে। যত বুলশিট! জন্ম কোথায় তা দিয়ে কী হবে? আবেগটা কী তা বের করো। সময়ের সঙ্গে আবেগের পরিবর্তন বের করো। আমাদের দরকার টাইম ডিপেনডেন্ট সমীকরণ এবং সমীকরণের সমাধান।
লক্ষ করলাম, আমার রাগ পড়ে গেছে এবং আমি এক ধরনের অবসাদ বোধ করছি। রাগের সময় মস্তিষ্কের প্রচুর অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে। রাগ কমে যাওয়ার পর হঠাৎ শরীরে অক্সিজেনের সাময়িক ঘাটতি দেখা যায়। আমার যা হচ্ছে। অক্সিজেন ট্যাবলেট ফরমে পাওয়া গেলে ভালো হতো। টপ করে একটা গিলে ফেলা।
আমি হোটেলের রিসেপশনে টেলিফোন করলাম, হলুদ পাঞ্জাবি পরা কেউ বের হচ্ছে কি না? তারা জানাল, না।
হিমু ছেলেটিকে ‘সরি’ বলা উচিত। সমস্যা হচ্ছে, সে যোগাযোগ না করলে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব না। মিসেস মাজেদাকে বললে তিনি হয়তো ব্যবস্থা করবেন। তাঁর টেলিফোন নম্বর আমার কাছে নেই। তিনি নম্বর লিখে দিয়েছিলেন, আমি হারিয়ে ফেলেছি। জিনিস হারানোতে আমার দক্ষতা সীমাহীন। আমার Ph.D. থিসিসের ফাস্ট ড্রাফট হারিয়ে ফেলেছিলাম। বাংলাদেশে এসে হারিয়েছি আমেরিকান পাসপোর্ট। অ্যাম্বাসির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা সন্দেহজনক কথাবার্তা বলছে। ভাবটা এ রকম যেন আমি কাউকে পাসপোর্টটা দিয়ে দিয়েছি।
আমি ড্রয়ার খুলে কাগজ নিয়ে লিখলাম, হিমু। এটি একটি অর্থহীন কাজ। আমরা অর্থহীন কাজ করতে পছন্দ করি। অর্থহীন কাজ শুধু না, অর্থহীন প্রশ্ন করতেও পছন্দ করি।
একবার ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছি, আমার এক ছাত্রী বলল, স্যার বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে বিগ ব্যাং থেকে। বিগ ব্যাং-এর আগে কী ছিল?
অর্থহীন প্রশ্ন। আমি পড়াচ্ছি স্পেশাল থিওরি অব রিয়েলিটি। বিগ ব্যাং না।
আমি বললাম, তোমার নাম কী?
সে বলল, সুশান।
আমি বললাম, সুশান, সময়ের শুরু হয়েছে কোথেকে? সে বলল, বিগ ব্যাং থেকে। আমি বললাম, সময় যেহেতু বিগ ব্যাং থেকে শুরু হয়েছে, তার আগে তো কিছু থাকতে পারে না।
সুশান বলল, বিগ ব্যাং-এর আগে কি ঈশ্বরও ছিলেন না?
আমি বললাম, ইয়াং লেডি, ঈশ্বরও ছিলেন না। সবকিছুর শুরু বিগ ব্যাং থেকেই! ঈশ্বর বলে কিছু থেকে থাকলেও তার শুরু বিগ ব্যাং থেকে।
সুশান মেয়েটি অর্থহীন প্রশ্ন করে আমার ভেতর অনেক অর্থহীন প্রশ্ন তৈরি করে দিয়েছে। মাথা খানিকটা এলোমেলো করে দিয়েছে। আমি এলোমেলো মাথা ঠিক করার জন্য বড় ভেকেশন নিয়েছি। প্রথম গোলাম স্পেনে। কারণ শ্ৰোডিনজারের মাথা যখন এলোমেলো হয়ে গেল, তখন মাথা ঠিক করার জন্য তার এক গোপন বান্ধবী নিয়ে গেলেন স্পেনের বার্সেলোনায়। বান্ধবীর সঙ্গে যৌনক্রিয়ার মাঝখানে তার মাথার এলোমেলো ভাব হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি পেয়ে গেলেন বিখ্যাত ‘শ্রোডিনজার ইকোয়েশন’।
বান্ধবীকে ফেলে লাফ দিয়ে কাগজ-কলম নিয়ে টেবিলে বসলেন। বান্ধবী বলল, কী হয়েছে?
শ্ৰোডিনজার বললেন, হয়েছে তোমার মাথা। You get lost.
স্পেনে আমার মাথার জট কাটে নি। আমার কোনো বান্ধবী ছিল না-এটা একটা কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশে এসে দামি হোটেলে বসে সময় কাটাচ্ছি। জানোলা দিয়ে একবার বাইরেও তাকাচ্ছি না। হিমু বলেছে জনৈক কেরামত আমার মাথার জন্ট খুলে দেবে। সে নাকি কোন রেস্টুরেন্টের বাবুর্চি। আমি হিমু নামের পেছনে লিখলাম ‘কেরামত’, তারপর লিখলাম ‘তুতুরি ’। ‘তুতুরি’ নাম লেখার পেছনে কোনো ফ্বয়েডিয়ান সাইকোলজি কি কাজ করছে?
আমি ‘তুতুরি’ নামটা কেটে দিলাম। নারীসঙ্গ আমার প্রিয় না। তাদের আমার আলাদা প্রজাতি মনে হয়। পৃথিবী নারীশূন্য হলে ভালো হতো।
হিমু মাথায় ‘ভূত’ চুকিয়ে গেছে। এই বিষয়গুলি Catalyst-এর মতো কাজ করে। catalyst নিজে কোনো রিঅ্যাকশনে অংশগ্রহণ করে না। তবে অন্য রিঅ্যাকশন শুরু বা শেষ করতে সাহায্য করে।
আমার সিস্টেমে ভূত ঢুকিয়ে দেওয়ায় হয়তো অন্য কোনো সমস্যা তৈরি হবে।
রুমের টেলিফোন বেজে যাচ্ছে। নিতান্ত অনিচ্ছায় আমি টেলিফোন ধরলাম।
বল্টুভাই, স্নামালিকুম।
আপনি কে?
আমি হিমু।
কিছুক্ষণ আগেই তো তোমার সঙ্গে কথা হলো, আবার টেলিফোন করেছ কেন?
আপনি যে ভূতের বইটা লিখবেন তা নিয়ে আরেকটা আইডিয়া এসেছে। স্যার, বলব?
আমি বুঝতে পারছি রেগে যাচ্ছি, তারপরেও রাগ সামলে বললাম, বলো শুনছি।
বাংলা ভূতের সঙ্গে আমেরিকান ভূতের একটা তুলনামূলক আলোচনা করলে কেমন হয়?
এই বিষয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না।
হিমু বলল, স্যার! প্লিজ, আমাকে দুটা মিনিট সময় দিন। ভূতের বইয়ে বিজ্ঞান নিয়ে আসুন। মানুষ মরলে ভূত হয়। ভূত মরলে কী হয় এই ধরনের আলোচনা। মাঝে মাঝে বিকট সব ইকোয়েশন দিয়ে দিন। যে ইকোয়েশনের আগামাথা কেউ কিছু বুঝবে না।
তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?
মাত্র এক মিনিট পার হয়েছে। আরও এক মিনিট বাকি আছে স্যার। আর এক মিনিট কি পাব?
আমি বললাম, You go to hell. বলেই খারাপ লাগল।
কাউকে নরকে যেতে বলার অর্থ হচ্ছে নরকে বিশ্বাস করা। যে নরকে বিশ্বাস করবে তাকে স্বর্গেও বিশ্বাস করতে হবে। স্বৰ্গে বিশ্বাস করলে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হবে। ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করতে হবে। ভাগ্যে বিশ্বাস করতে হবে। কোনো মানে হয়?