বাইরে বিরাট হইচই। দুটি টিভি চ্যানেলের লোকজন চলে এসেছে। কালো পোশাকের কিছু র্যাবও দেখতে পাচ্ছি। হিমুকে কোথাও দেখছি না। আমি নিশ্চিত, হিমু এখানে নেই। সে সবাইকে এখানে জড়ো করেছে। তার কাজ শেষ হয়েছে। মাজেদা খালা বলেছিলেন, হিমু একটা ঘটনা ঘটিয়ে ডুব দেয়। অনেক দিন তার আর খোঁজ পাওয়া যায় না। আবার উদয় হয়, নতুন কিছু ঘটায়। তুতুরি, তুমি এর কাছ থেকে দূরে থাকবে।
ভেতর থেকে হুজুর ডাকলেন, জয়নাব মা। ভেতরে আসো।
আমি ঘরে ঢুকে দেখি, দুই বাঁদরের শ্বশুরবাড়ি যাত্রা দেখানো হচ্ছে। বল্টু স্যার এবং মাজেদা খালার স্বামী দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের ওপর ভেঙে পড়ে যাচ্ছেন। শুধু ডিজি স্যার চোখমুখ শক্ত করে আছেন। বাংলা ভাষার মানুষ হয়েও ইংরেজিতে বলছেন, I can’t believe it.
আমাকে কাছে ডেকে হুজুর বললেন, বাঁদর-বাঁদারির খেলাটা দেখো। মজা পাবে।
আমি বাঁদর-বাঁদারির খেলা দেখছি, তেমন মজা পাচ্ছি না।
বল্টু স্যার হুজুরের দিকে তাকিয়ে আনন্দময় গলায় বললেন, এই দুই প্রাণীকে আপনি এত পছন্দ করেছেন বলে ভালো লাগছে। এরা আপনার সঙ্গেই থাকবে।
হুজুর বললেন, আল্লাহপাক আমাকে স্ত্রী দেন নাই, পুত্র-কন্যা কিছুই দেন নাই, উলটা আমার দুটা ঠ্যাং নিয়ে গেছেন। এখন বুঝতে পারছি তিনি আমাকে সবই দিয়েছেন। আমি মূর্খ বলে বুঝতে পারি নাই।
তার চোখ ছলছল করছে। বাঁদর দুটি দেখাচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলনের দৃশ্য।
আমি হিমু।
মাজার জমজমাট অবস্থায় রেখে আমি বের হয়ে এসেছি। তুতুরির সঙ্গে একবার দেখা হলে ভালো লাগত। দেখা হয় নি। এও বা মন্দ কী? আমাদের সবার জগৎ আলাদা। তুতুরি থাকবে তার জগতে, বল্টু স্যার তাঁর জগতে। আমি বাস করব আমার ভুবনে। শুধু পশুদের আলাদা কোনো ভুবন নেই। সেটাও খারাপ না। পশুদের আলাদা ভুবন নেই বলেই তারা অন্যরকম আনন্দে থাকে। যে আনন্দের সন্ধান মানুষ জানে না। আমি হাঁটছি, আমার পেছনে পেছনে একটা কুকুর হাঁটছে। আমি আমার মতো চিন্তা করছি। কুকুর চিন্তা করছে তার মতো। আমি কুকুরের চিন্তায় ঢুকতে পারছি না, কুকুর আমার চিন্তায় ঢুকতে পারছে না।
ঝুম বৃষ্টি শুরু হতেই কুকুর দৌড়ে এক গাড়ি-বারান্দায় আশ্রয় নিল। অবাক হয়ে দেখল আমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এগুচ্ছি। সে কী মনে করে আবারও আমার পেছনে পেছনে হাঁটতে শুরু করল।
রাস্তায় পানি জমেছে। আমি পানি ভেঙে এগুচ্ছি। আমার পেছনে পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে আসছে একটা কালো কুকুর। আমি তাকে চিনি না, সেও আমাকে চেনে না। বন্ধুত্ব তখনই গাঢ় হয় যখন কেউ কাউকে চেনে না।