হিমু আগ্রহী হয়ে জুতা-মোজা খুলল। জহির স্যার কয়েকবার পা ওঠানামা করলেন। তখন হিমু বলল, জুতা-মোজা খোলা মনে হয় ঠিক হয় নাই। এখন মেঝের সঙ্গে পা আটকে যেতে পারে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, হিমুর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জহির স্যার কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন, পা আটকে গেছে।
ডাক্তার সাহেব ঘটনা দেখে ঘাবড়ে গেছেন, মাসল রিলাক্সের ইনজেকশন দিয়ে লাভ হবে না। প্রবলেমটা নিওরো; নিওরো মেডিসিনের কাউকে আনতে হবে।
ডিজি স্যার নিচু গলায় আমাকে বললেন, হিমু নামের ওই যুবকের এখানে কিছু ভূমিকা আছে। অতি দুষ্টপ্রকৃতির যুবক। আমাকে নানান ভুজং ভাজং দিয়ে সে এখানে নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। মাজারের খাদেমটাও বদ। সে এই ঘটনায় যুক্ত।
আমি বললাম, স্যার, হিমু বদ না ভালো–এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারছি না। তবে যিনি খাদেম, তিনি চলন্ত ট্রাকের নিচে পড়া থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। ট্রাকের চাকা তার পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। তার পা কেটে বাদ দিতে হয়।
ডিজি স্যার বললেন, কী বলো তুমি!! উনি তো তাহলে সুফি পর্যায়ের মানুষ। উনার সম্পর্কে অতি বাজে ধারণা ছিল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
আমি এবং ডিজি স্যার হুজুরের সামনে বসে আছি। হিমু আমাদের জন্যে চা নিয়ে এসেছে, আমরা চা খাচ্ছি। হিমু নিজে জহির স্যারকে চা খাওয়াচ্ছে। চায়ের কাপ স্যারের মুখে ধরছে, স্যার চুক চুক করে খাচ্ছে।
হুজুর চোখ বন্ধ করে জিগিরে বসেছেন। ডিজি স্যারের হাতে কিছু কাগজ। কাগজগুলো হিমু তাকে ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি আমাকে বললেন, হার্ভার্ডের ফিজিক্সের একজন Ph.D. ভূত নিয়ে বই লিখছে। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
আমি বললাম, একজন মানুষের মাজারের রেলিংয়ে আটকে যাওয়া যদি বিশ্বাসযোগ্য হয় তাহলে হার্ভার্ডের Ph.D.-র ভূতের ওপর বই লেখাও বিশ্বাসযোগ্য। আমি উনাকে চিনি। তিনি ম্যাথমেটিক্সের একটি বই লিখেছেন, The Book of infinity. বইটি New York Times-as G3 Gieliss Wifrits আছে। ম্যাকমিলন বুক কোম্পানি বইটির প্রকাশক।
ডিজি স্যার চোখ কপালে তুলে বললেন, বলো কী!
আমি বললাম, আপনি কয়েক পাতা পড়ে দেখুন। হয়তো দেখা যাবে এই বইটিও হবে বেষ্ট সেলার।
ডিজি স্যার পড়া শুরু করেছেন। আগ্রহ নিয়ে পড়ছেন।
আমি বাইরে কী হচ্ছে দেখার জন্যে বের হলাম। পরিস্থিতি শান্ত। জনসমাগম বেড়েছে। পুলিশ চলে আসায় শৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। ছেলে এবং মেয়ের জন্যে আলাদা লাইন হয়েছে। জহির স্যারের স্ত্রী চলে এসেছেন। মহিলা মৈনাক পর্বত সাইজের। তিনি খড়খড়ে গলায় বলছেন, তুমি যে কতটা ভয়ঙ্কর মানুষ এটা আমি জানি। এত দিন মুখ খুলি নি। আজ খুলব। তুমি এখানে আটকা পড়েছ, আমি খুশি। সারা জীবন এখানে আটকে থাকো এই আমি চাই।
হিমু মহিলাকে বলল, ম্যাডাম, আপনি উত্তেজিত হবেন না। যেভাবেই হোক আমরা জহির ভাইকে রিলিজ করে আপনার হাতে তুলে দিব। তখন আপনি ব্যবস্থা নিবেন। প্রয়োজনে ডাক্তারের উপস্থিতিতে কাজি কেটে উনাকে রিলিজ করা হবে। জহির ভাই! রাজি আছেন?
জহির স্যার গোঙানির মতো শব্দ করলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি হিমুর দিকে। এই মানুষটা কে? মাজেদা খালা যেমন বলেছিলেন তেমন কিছু? অলৌকিক শক্তিধর কেউ?
ডিজি স্যার থতামত অবস্থায় আছেন। তিনি লেখা পড়ে শেষ করেছেন। বুঝতে পারছি লেখা তাকে অভিভূত করেছে। তিনি নিজের মনে বললেন, ব্রিলিয়ান্ট! এমন স্বাদু রচনা বহুদিন পাঠ করি নি। এই লেখককে রয়েল স্যালুট দিতে ইচ্ছা করছে। এই বইটির বঙ্গানুবাদ বাংলা একাডেমী থেকে অবশ্যই বের হবে। এতে যদি আমার চাকরি চলে যায় চলে যাবে।
ডিজি স্যারকে হুজুর তাবিজ লিখে দিয়েছেন। ডাবল একশান তাবিজ। এই তাবিজ ডান হাতে মুঠো করে নিলে স্ত্রী এবং হাকিম এই দুই শ্রেণীর দিলই নরম হবে।
ডিজি স্যার আগ্রহ নিয়ে তাবিজ হাতে নিয়েছেন। বাইরে তুমুল উত্তেজনা। কী হয়েছে দেখার জন্য বের হলাম।
পরিমলকে ধরে আনা হয়েছে। কোমরে দড়ি বেঁধে তাকে নিমগাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। একটি চোখে কালশিটা পড়েছে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। পা টেনে হাঁটছে। মনে হয় মেরে পা ভেঙে ফেলেছে।
পরিমল নামের মানুষটার মনে ভয়াবহ আতঙ্ক। সে একবার কোমরে বাধা দড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর একবার নিমগাছের উচু ডালের দিকে তাকাচ্ছে। সে কি ভাবছে তাকে এই দড়ি দিয়ে ফাঁসিতে বুলিয়ে দেওয়া হবে? হতেও পারে। উত্তেজিত জনতা ভয়ঙ্কর জিনিস। তারা পারে না এমন কাজ নেই।
ডিজি স্যারের কথা শেষ হওয়ার আগেই শিকলে বাধা দুই বাঁদর নিয়ে বল্টু স্যার এবং মাজেদা খালার হাজবেন্ড ঢুকলেন। বাইরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে তা নিয়ে দু’জনের কাউকেই আগ্রহী মনে হলো না। দু’জনের সমগ্ৰ চিন্তাচেতনা বাঁদর দম্পতিকে নিয়ে। আমি ডিজি স্যারের সঙ্গে দু’জনের পরিচয় করিয়ে দিলাম। এই বিষয়েও তাদের কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। বল্টু স্যার বললেন, শ্বশুরবাড়ি যাত্ৰা।
মাজেদা খালার স্বামী বললেন, এই আইটেম সবচেয়ে ফালতু। প্রথমে দেখাও স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলন।
দুই বাঁদর স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলন অভিনয় করে দেখাচ্ছে। হুজুর বললেন, সোবহানাদুল্লাহ!
ডিজি স্যার একবার বাঁদর দুটিকে দেখছেন, একবার হার্ভার্ড Ph.D.-র দিকে তাকাচ্ছেন, একবার তার হাতের কাগজের তাড়াতে চোখ বুলাচ্ছেন। একইসঙ্গে মানবজাতির তিনটি আবেগ তাঁর মধ্যে প্ৰকাশিত হয়েছে। তিনি বিস্মিত, হতভম্ব এবং স্তম্ভিত।