দিন।
একমাত্ৰ স্বপ্লেই মানুষ নিজেকে নিজে দেখতে পায়। বাস্তব জগতে মানুষ নিজেকে দেখে না।
আয়নায় তাকালেই তো নিজেকে দেখবে।
না, দেখবে না। আয়নায় দেখবে তার মিরর ইমেজ। এখন বুঝেছি?
জি।
গুড, ভেরি গুড। তোমাকে চাকরিতে বহাল করা হলো। কাল সকালে জয়েন করবে। সকাল দশটা থেকে ডিউটি।
আমি সব সময় অন্যদের চমকে দিয়ে আনন্দ পাই। এই প্রথম বল্টুভাই আমাকে চমকালেন। আমি তার কাছে কোনো চাকরির জন্যে আসি নি। কয়েকটা জিনিস দিতে এসেছিলাম।
বল্টুভাই বললেন, এসি আছে এমন একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করবে। এই মাইক্রোবাস দশ দিন আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমরা নেত্রকোনা জেলার সোহাগী গ্রামে চলে যাব। দশ দিন থাকব।
আমি বললাম, জি আচ্ছা স্যার।
স্যার বলছি কেন?
আপনি আমার বস, এইজন্যে স্যার বলছি।
তুমি বল্টুভাই ডাকছিলে, শুনতে ভালো লাগছিল। আমি ট্রেডিশনাল বস না। তোমার চাকরিও চুক্তিভিত্তিক। আমি বই লেখা যেদিন শেষ করব, তার পরদিন তোমার চাকরিও শেষ।
বল্টুভাই, আমার কাজটা কী?
মিসেস মাজেদা তোমাকে কিছু বলেন নি?
জি-না।
তুমি নানানভাবে আমাকে সাহায্য করবে, যেন বইটা লিখে শেষ করতে পারি।
কী বই?
বইয়ের নাম হচ্ছে “ঈশ্বর শূন্য আত্মা শূন্য’। বইয়ে প্রমাণ করব, ঈশ্বর বলে কিছু নেই। আত্মা বলেও কিছু নেই।
আমি বললাম, আপনার তো রাগ কেটে ফেলবে।
বল্টুভাই অবাক হয়ে বললেন, কে রগ কাটবে?
আমাদের রগ কাটার লোক আছে। এনাটমিতে বিশেষ পারদর্শী। এরা আল্লাহ, ধর্ম, এইসব বিষয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বললে হাসিমুখে রগ কেটে দিয়ে চলে যায়।
কী অদ্ভুত কথা!
আমি বললাম, বল্টুভাই! আপনি চিন্তিত হবেন না। এরা শুধু রগ কাটে, মেরে ফেলে না। যাদের রাগ কেটেছে, তারা বলেছে যে ব্যথাও তেমন পাওয়া যায় না। শুধু বাকি জীবন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়।
লেগ পুলিং করছ নাকি?
জি-না স্যার। সত্যি কথা বলছি।
প্রবলেম হয়ে গেল। তো।
স্যার, আপনি বরং অন্য একটা বই লিখুন। বই লিখে প্রমাণ করুন। ‘ভূত আছে’।
ভূত আছে প্ৰমাণ করব কীভাবে?
জটিল সব ইকোয়েশন লিখে প্রমাণ করবেন ভূত আছে। হার্ভার্ডের Ph.D. যদি বই লিখে প্রমাণ করে ভূত আছে, তাহলে হইচই পড়ে যাবে। হাজার হাজার কপি বই বিক্রি হবে। নানান ভাষায় অনুবাদ হবে। হিন্দি ভাষায় বইটার নাম হবে ‘ভুত হ্যায়’।
বল্টুভাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, আপনি চাইলে বাংলাদেশের নানান শ্রেণীর ভূতদের বিষয়ে আমি আপনাকে তথ্য দেব। মামদো ভূতের নাম শুনেছেন স্যার?
মামদো ভূত?
মুসলমান মরে যে ভূত হয় তাকে বলে মামদো ভূত। হিন্দু ব্ৰাহ্মণ মারা গেলে হয় ব্রহ্মদত্তি। খান্ডারনী মহিলা মারা গেলে পেত্নী হয়। শাকচুন্নি নামের আরেক শ্রেণীর মহিলা ভূত আছে। এরা ভয়ঙ্করটাইপ। হিন্দু বিধবারা মরে হয় শাকচুন্নি। ফিজিক্সের Ph.D. মারা গেলে কী ভূত হয়, তা অবশ্য আমার জানা নেই।
বল্টুভাই হাত উচিয়ে আমাকে থামালেন। শান্ত গলায় বললেন, তুমি অতি বিপদজনক মানুষদের একজন। তুমি আমাকে কনফিউজ করার চেষ্টা করছি এবং খানিকটা করেও ফেলেছ। তোমার চাকরি নট। তোমাকে আমার এখানে আসতে হবে না। Now get lost!
স্যার, চলে যেতে বলছেন?
হ্যাঁ। খুব অভদ্রভাবে বলেছি, তার জন্যে দুঃখিত!
যাওয়ার আগে একটা কথা কি বলব?
বলো। মনে রেখো, এটা হবে তোমার লাষ্ট কথা।
আমি বললাম, স্যার, ফিজিক্সের জটিল বিষয় পড়ে আপনার মাথায় গিট্টু লেগে গেছে। কেরামত চাচার সঙ্গে দেখা করলে আপনার গিট্টু কেটে যাবে। আপনি বললে আপনাকে উনার কাছে নিয়ে যাব। উনি আপনার মাথার গিট্টু ছুটিয়ে দিবেন।
কেরামত কে?
গেণ্ডারিয়ায় থাকেন। বিসমিল্লাহ হোটেলের হেড বাবুর্চি।
সে কী করবে?
আপনার সঙ্গে হাসিতামাশা করবে, আপনার মাথার গিট্টু ছুটে যাবে।
বল্টুভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমি প্রচণ্ড রেগে গেছি। অনেক কষ্টে নিজের রাগ সামলাচ্ছি। খুব খুশি হব। তুমি যদি বিদায় হও।
জি আচ্ছা স্যার।
হোটেলের ঘর থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্ৰচণ্ড শব্দ করে বল্টুভাই দরজা বন্ধ করলেন। বেচারা নিষ্প্রাণ দরজাকে বল্টুভাইয়ের রাগ ধারণ করতে হলো। দরজার কথা বলার শক্তি থাকলে সে চেঁচিয়ে বলত, ‘উফরে গেছিরে!’ ফাইভ স্টার হোটেলের দরজার ভাষা। ‘উফরে গেছিরে’ টাইপ হবে না। সে বলবে, ‘ওহ শীট!’
আমি চৌধুরী আখলাকুর রহমান বল্টু।
আমি প্ৰচণ্ড রেগে গেছি। রাগ সামলানোর চেষ্টা করছি। প্ৰচণ্ড শব্দে দরজা বন্ধ করে রাগ কমানোর হাস্যকর চেষ্টা করেছি। রেগে গেলেই মানুষ হাস্যকর কর্মকাণ্ড করে। আমার ipad এ পিঁপড়া টিপে মারার একটা খেলা আছে; রেগে গেলে আমি পিঁপড়া মারি। তিন চার শ’ পিঁপড়া মারতে পারলে রাগ কমে যেত। ipad-টা খুঁজে পাচ্ছি না।
হিমু নামের ছেলেটির সঙ্গে রাগ করার তেমন যৌক্তিকতাও এখন খুঁজে পাচ্ছি। না। সে সরল ভঙ্গি করে কিছু পেচানো কথা বলেছে। এ রকম করে কথা বলাই হয়তো তার স্বভাব। সে যদি আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করত, তাহলে তার ওপর রাগ করা যেত।
বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়েছে, কিন্তু মানবিক আবেগের কোনো সমীকরণ এখনো বের করতে পারে নি।
পদার্থবিদ এবং ম্যাথমেটিশিয়ানদের উচিত নিউরো বিজ্ঞান পড়া। নিউরো বিজ্ঞানের বিজ্ঞানীরা অংক জানেন না। পদার্থবিদ্যা জানেন না।