কিসের পাণ্ডুলিপি?
বাংলার ভূত।
ডিজি স্যার বিড়বিড় করে কী বললেন বুঝলাম না।
আমি বললাম, স্যার কিছু বলেছেন?
ডিজি স্যার বললেন, একজন ডাক্তার ডেকে আনা উচিত, ডাক্তার দেখুক। একটা লোক মাজারে আটকে আছে, এটা কেমন কথা?
হুজুর বললেন, জনাব, এই জিনিস মেডিকেলের আন্ডারে না। এটা গায়েবি।
ডিজি স্যার বললেন, আপনি কে?
হুজুর বললেন, আমি এই মাজারের প্রধান খাদেম। হিমু আমার শিষ্য। জনাব, আপনার পরিচয়টা?
আমি ডিজি, বাংলা একাডেমী।
হুজুর আনন্দিত গলায় বললেন, সোবাহানাল্লাহ। বিশিষ্ট লোকজন আসা শুরু করেছেন। সবই পীর বাচ্চাবাবার কেরামতি।
এত বড় ঘটনা ঘটছে, বল্টু স্যার এবং খালু সাহেব দু’জনের কেউ নেই। তারা জোড়া বাঁদর কিনতে গেছেন। জোড়া বাঁদর কেনায় খালু সাহেব কীভাবে যুক্ত হলেন আমি জানি না।
মাজারের সামনে প্রচুর লোক জমে গেছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আপনা আপনি কিছু ভলেন্টিয়ার বের হয়। লাঠি হাতে একজন ভলেন্টিয়ারকে দেখা যাচ্ছে। ভলেন্টিয়ারের পরনে লাল পাঞ্জাবি মাথায় লাল ফেষ্ট্রি। ভলেন্টিয়ার কঠিন গলায় বলছে, লাইন দিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে আসেন। ছবি তোলা নিষেধ। মোবাইল বন্ধ করে রাখেন। গরম মাজার! কেউ হাত দিবেন না। হাত দিলে কী অবস্থা নিজের চোখে দেখে যান।
জহিরের শিক্ষাসফর হয়ে গেছে। সে এখন হার্ট অ্যাটাকের সময় যেভাবে ঘামে সেইভাবে ঘামছে। ঘামে শার্ট ভিজে গেছে। প্যান্টও ভিজেছে। তবে এই ভেজা ঘামের ভেজা না, অন্য ভেজা।
তুতুরিকে আসতে দেখা যাচ্ছে। সে ভয়ে ভয়ে এগুচ্ছে। জহির তুতুরিকে দেখে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমাকে বাঁচাও। আমি তোমার পায়ে ধরি, তুমি আমাকে বাঁচাও।
তুতুরি বলল, স্যার, আপনার কী সমস্যা?
জহির বলল, রেলিংয়ে হাত রেখেছি আর ছুটাতে পারছি না।
তুতুরি বলল, আমরা তাহলে আপনার গ্রামের বাড়িতে যাব কীভাবে?
জহির বলল, রাখো গ্রামের বাড়ি। একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা করো। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
তুতুরি বলল, আপনি মাজারের রেলিংয়ে হাত দেওয়ামাত্ৰ হাত আটকে গেল? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা? মাজারের রেলিং কোনো চুম্বক না, আর আপনিও লোহা না।
জহির ইংরেজিতে বলল, Please, no argument, do something.
তুতুরি বলল, আপনার বন্ধু পরিমল! সে আটকায় নি কেন? তারও তো আটকানোর কথা।
তুতুতি
একজন মানুষ নাকি সারা জীবনে সাতবারের বেশি বিস্ময়ে অভিভূত হতে পারে না। এই সাতবারের মধ্যে একবার জন্মের পর পর পৃথিবী দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়। আরেকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে। এই দুইবারের স্মৃতি কোনো কাজে আসে না। বাকি থাকে পাঁচ।
এই মাজারে এসে পাঁচের মধ্যে দুটা কাঁটা গেল। আমি দু’বার বিস্ময়ে অভিভূত হলাম।
জহির স্যার মাজারের রেলিং ধরে আটকে আছেন—এটা দেখে প্রথম বিস্ময়ে অভিভূত হওয়া। এই ঘটনার পেছনে হিমুর নিশ্চয়ই হাত আছে। মাজারের রেলিংয়ে সুপার গ্রু লেগে থাকে না যে হাত দিলেই হাত আটকে যাবে। এরচেয়ে বড় বিস্ময় আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। মাজারের প্রধান খাদেম পা কাটা হুজুর সেই বিস্ময়। এই হুজুর আমাকে ট্রাকের নিচে পড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বঁচিয়েছিলেন। তার পা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, এই খবর ছোটবেলায় পেয়েছিলাম। বাবা কয়েকবারই আমাকে হুজুরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি অচেতনের মতো ছিলেন, কোনোবারই ঠিকমতো আমাকে দেখেন নি।
আশ্চর্যের ব্যাপার, হুজুর আমাকে দেখেই বললেন, জয়নাব না? সোবাহানাল্লাহ। কেমন আছ মা? আহারে কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম। এত বড় হয়ে গেলা কীভাবে? সোবাহানাল্লাহ! সোবহানাল্লাহ!
আমি জানি তাঁর পা নেই, তারপরেও আমি কদমবুসি করার জন্যে নিচু হলাম। হুজুর বললেন, পা নাই তাতে কোনো সমস্যা নাই গো মা। তুমি কদমবুসি করো-জিনিস জায়গামতো পৌঁছে যাবে। তোমার পিতামাতা কেমন আছেন?
তাঁরা দু’জনই মারা গেছেন।
আহারে আহারে আহারে। চিন্তা করবা না মা, আল্লাহপাক এক হাতে নেন। আরেক হাতে ডাবল করে ফেরত দেন। এটাই উনার কাজের ধারা। মা, তুমি কি বিবাহ করেছ?
জি-না।
এই বিষয়েও চিন্তা করবে না। খাসদিলে দোয়া করে দিব। প্রয়োজনে জ্বিনের মারফত দোয়া করাব, জ্বিনের সুবিধা যখন আছে। সুবিধা কেন নিব না? মা, ফ্যানের নিচে বসে। মাথাটা ঠান্ডা করো। তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই–ইনি ডিজি বাংলা একাডেমী। বিশিষ্টজন। মাজারের টানে চলে এসেছেন।
আমি ডিজি সাহেবকে সালাম দিলাম। নিজের পরিচয় দিলাম। তিনি কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, তুমি একজন আর্কিটেক্ট?
জি স্যার।
নাম কী?
ভালো নাম জয়নাব, ডাকনাম তুতুরি।
তুতুরি?
জি স্যার তুতুরি।
ডিজি স্যার বিড়বিড় করে বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। তুতুরি থেকেই কি ফুতুরি ভুতুরি?
জি স্যার।
ডিজি স্যার হতাশ গলায় বললেন, আমি তো মনে হয় ভালো চক্করে পড়ে গেছি।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে বাইরে হইচই হতে লাগল। আমি এবং ডিজি স্যার ঘটনা। কী দেখার জন্যে বের হলাম।
ঘটনা হচ্ছে–অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে একজন ডাক্তার এসেছেন। ডাক্তারের সঙ্গে পরিমল। এই বদমায়েশ মনে হয় ডাক্তার নিয়ে এসেছে।
ডাক্তার জহির স্যারকে বললেন, হাতের সব মাসল স্টিফ হয়ে গেছে। আপনি কি পা নাড়াতে পারেন?
জহির স্যার বললেন, পারি। তবে পায়ের তালু গরম হয়েছে। কাউকে বলেন, জুতা-মোজা খুলে দিতে।