জহিরের মাথা নিশ্চয়ই চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি মাজারের রেলিং ধরে চক্কর সামলালেন।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আপনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন না। পটাসিয়াম সায়ানাইডে মৃত্যু অতি দ্রুত হয়। কিছু বুঝবার আগেই শেষ। বমি, খিচুনি, ছটফটানি কিছুই হবে না। টেরও পাবেন না। হাসিমুখে যদি খান, মৃত্যুর পরেও হাসিমুখ থাকবে। মুখের হাসি মুছে যাবে না।
জহির মাজারের রেলিং ধরে তাকিয়ে আছেন। তার কপালে ঘাম। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পটাসিয়াম সায়ানাইড ঘটিত প্ৰবল ধাক্কায় তার স্বাভাবিক মানসিক প্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থায় সাজেশন খুব কার্যকরী হয়। আমি যদি বলি, জহির সাহেব! আপনি দুষ্টপ্রকৃতির লোক। অতি দুষ্ট। অতি দুষ্ট্ররা এই মাজার ধরলে সমস্যা আছে। তারা আটকা পড়ে যাবে। হাত ছুটিয়ে নিতে পারবে না।— এই সাজেশন জহিরের মস্তিষ্ক গ্রহণ করবে। মস্তিষ্ক থেকে হাতে কোনো সিগনাল পৌছাবে না। অতি দ্রুত হাত ও পায়ের মাসল শক্ত হয়ে যাবে।
বিশেষ এই সাজেশন দেওয়ার আগে আরও হ’কচাকিয়ে দেওয়া দরকার। আমি সহজ গলায় বললাম, আপনি নিশ্চয়ই মাইক্রোবাস নিয়ে এসেছেন। আপনার বন্ধু কোথায়? মাইক্রোবাসে? সে এলে ভালো হতো, দুজন হুজুরের কাছে তওবা করে নিতে পারতেন। মৃত্যুর আগে তওবা জরুরি। আপনার বন্ধু হিন্দু, এটা একটা সমস্যা। তবে সব সমস্যারই সমাধান আছে। উনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবেন। তারপর তওবা। তারপর মৃত্যু। তারপর বেহেশতের হুরদের সঙ্গে লদকা-লদকি।
জহির চাপা আওয়াজ করলেন। আমি বললাম, জহির ভাই, বিরাট সমস্যা হয়ে গেল। অতি দুষ্ট কেউ মাজারের রেলিং ধরলে আটকে যায়। অতীতে কয়েকবার এরকম ঘটনা ঘটেছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আপনি আটকে গেছেন। হাজার চেষ্টা করেও হাত ছুটাতে পারবেন না। যত চেষ্টা করেন হাত তত আটকাবে। আমার অনুরোধ, অস্থির হবেন না।
অটো সাজেশন কাজ করেছে। জহিরের পকেটে মোবাইল ফোন বাজছে। তিনি টেলিফোন ধরছেন না। মাজারের রেলিং থেকে হাত উঠাচ্ছেন না। তার মুখের মাসল শক্ত হয়ে উঠছে।
অনেকক্ষণ ‘আপনি আপনি’ করে জহির প্রসঙ্গ বলা হলো, এখন তুমি করে বলা যাক। সবচেয়ে ভালো হতো জাপানিদের মতো ‘সর্বনিম্ন তুই’ করে বললে। দুঃখের বিষয়, বাংলা ভাষায় তুই-এর নিচে কিছু নেই। বাংলা একাডেমীর ডিজি সাহেবের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতে হবে। আপাতত জহিরকে ‘তুমি’ সম্বোধন করেই চালাই।
জহির খুকখুক করে কাশছে। নাক টানছে। শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলছে। তার চাপা এবং কাতর গলা শোনা গেল, ভাই, একটু সাহায্য করেন।
আমি বললাম, অবশ্যই সাহায্য করব। ভূপেন হাজারিকা বলে গেছেন, মানুষ মানুষের জন্য। কী সাহায্য চান?
পানি খাব ৷
জহির ভাই, পানি খাওয়া ঠিক হবে না। পানি খেলেই প্রস্রাবের বেগ হবে। মাজারে প্রস্রাব করা ঠিক হবে না। পীর বাচ্চাবাবা রাগ করতে পারেন। সিগারেট ধরিয়ে মুখে দিব?
ধূমপান করি না। আমাকে ছাড়াবার ব্যবস্থা করেন।
জহির ভাই! আমার অনুরোধ, অস্থির হবেন না। মাথা ঠান্ড রাখেন। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। ভাবি চলে এলে আপনার অস্থিরতা কমবে। উনাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি।
ভাবিটা কে?
আপনার স্ত্রীর কথা বলছি।
জহির ভাই বললেন, বদমাইশ! মেরে তোর হাড্ডি গুড়া করে দেব।
তিন ঘণ্টা পার হয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, জহির রেলিংয়ে আটকে আছে। হুজুর একটু পর পর বলছেন, সোবাহানাল্লাহ! আল্লাহপাকের এ-কী কেরামতি।
জহিরের বন্ধু পরিমল এসেছিল। সে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দেখল। জহির কাতর গলায় বলল, কোমর ধরে টান দাও। দেখার কিছু নাই।
পরিমল বলল, পাগল হয়েছ? তোমার কোমরে ধরলে আমিও আটকে যাব। বলেই দাঁড়াল না, অতি দ্রুত স্থান ত্যাগ করল।
এর মধ্যে মাজারের কেরামতি আশপাশের লোকজনের কাছে প্ৰকাশিত হয়েছে। অনেকেই এসে দেখছে মাজারে মানুষ আটকে আছে। ‘দৈনিক সাতসকাল’ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার এসে গেছে। রিপোর্টারের ধারণা, ইচ্ছা করে কেউ একজন রেলিংয়ে আটকে থাকার ভান করছে যেন মাজারের নাম ফাটে। এই রিপোর্টার হুজুরের কাছে গোপনে দশ হাজার টাকা চেয়েছে। টাকা পেলে পজেটিভ রিপোর্ট করা হবে, না পেলে নেগেটিভ রিপোর্ট। এমন রিপোর্ট যে ফ্রডবাজির দায়ে হুজুরকে পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।
হুজুর বললেন, আপনার যা রিপোর্ট করার করবেন। আমার হাতে কিছুই নাই, সবই পীর বাচ্চাবাবার হাতে। সোবাহানাল্লাহ।
সাংবাদিক থাকতে থাকতেই বাংলা একাডেমীর ডিজি সাহেব চলে এলেন। তিনি হতভম্ব। আটকে পড়া মানুষটিকে দেখে বললেন, আপনার নাম জহির না? আপনি বাংলা একাডেমীতে একটা পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে টাকা নিয়ে গেছেন। পাণ্ডুলিপির নাম ‘বাংলার ঐতিহ্য চেপা শুঁটকির একশত রেসিপি’।
জহির বলল, পাণ্ডুলিপি আমার বন্ধু পরিমলের লেখা। আমি সঙ্গে গিয়েছিলাম।
এখন মাজারে আটকে আছেন?
জি। স্যার, আমার জন্য একটু দোয়া করেন।
ডিজি স্যার বিড়বিড় করে বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।
হুজুর বললেন, বলেন সোবাহানাল্লাহ। এই ধরনের মাজেজা দেখলে সোবাহানাল্লাহ বলা দুরন্ত।
ডিজি স্যার আমাকে দেখেও চিনতে পারলেন না বলে মনে হলো। মাজারে মানুষ আটকা দেখে তার সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম।
স্যার, আমাকে চিনেছেন? আমি হিমু। ওই যে ফুতুরি ভুতুরি। আপনি হুজুরের ঘরে বসুন। পাণ্ডুলিপি দিয়ে দেই, দশ পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। নিরিবিলি বসে পড়ুন।