হুজুর মনে হয় আমাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। তিনি খালু সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, জনাব আপনার মন মিজাজ মনে হয় অত্যধিক খারাপ।
খালু সাহেব জবাব দিলেন না। হুজুর বললেন, একমনে জিগির করেন, মন শান্ত হবে।
কী করব?
জিগির। আপনার কানে কানে আল্লাহপাকের একটা জাতনাম বলে দিব। দমে দমে জিগির করবেন। প্রতি দমের জন্য সোয়াব পাবেন।
খালু সাহেব বললেন, স্টুপিড!
হুজুর বললেন, অত্যধিক খাঁটি কথা বলেছেন। আমি মূর্খ। ইহা সত্য। আমি একা না। আমরা সবাই মুর্থ। শুধু আল্লাহপাক জ্ঞানী। উনার এক নাম আল আলীমু। এর অর্থ মহাজ্ঞানী। এই নাম জালালী গুণ সম্পন্ন। উনার আরেক নাম আল মুহছিউ। এর অর্থ সর্বজ্ঞানী। এই নোমও জালালী। উনার কিছু নাম আছে জামালী, যেমন আর রাযযাকু। এর অর্থ মহান অন্নদাতা।
খালু সাহেব একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার হুজুরের দিকে তাকাচ্ছেন। মাথায় জট পাকানো অবস্থায় খালু এসেছেন। সময় যতই যাচ্ছে জট না খুলে আরও পাকিয়ে যাচ্ছে। তাঁর জন্যেও মশারি কিনতে হবে কি না, কে জানে!
বল্টু স্যারের সঙ্গে খালু সাহেবের দীর্ঘ বৈঠক হলো। খালু এক নাগাড়ে কথা বলে গেলেন, বল্টু স্যার শুনে গেলেন।
খালু সাহেব বললেন, তোমাদের ‘জীনে’ কিছু সমস্যা আছে। তোমার এক ভাই কাক গুনে বেড়াচ্ছে আর তুমি মাজারে শুয়ে ঘুমোচ্ছ। শুনলাম নাকে সরিষার তেলও দিয়েছ।
স্যার বললেন, এক ফোঁটা করে দিয়েছি। এতে সুনিদ্রা হয়েছে। আমেরিকানরা টেন পারসেন্ট সোডিয়াম ক্লোরাইডের সলিউশন দিয়ে নাক পরিষ্কার করে। সরিষার তেলের পাশে ওই জিনিস দাঁড়াতেই পারবে না। আমি চিন্তা করছি সরিষার তেলের বিশেষ এই ব্যবহার পেটেন্ট করে ফেলব।
খালু সাহেব বললেন, পেটেন্ট করতে চাও করো। যাদের কাজকর্ম নাই তারা তো। এই সবই করবে। আমি জানতাম না যে, তুমি প্রফেসরশিপ ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি। কয়েকদিন আগে জেনেছি। চাকরি ছাড়ার কারণটা কী?
স্যার বললেন, স্ট্রিং-এর সমস্যা।
খালু সাহেব বললেন, স্ট্রিং-এর সমস্যা মানে কী?
এই জগৎ শেষটায় থেমেছে string থিওরিতে। এই থিওরি বলছে, মহাবিশ্বে যা আছে সবই কম্পন। স্ট্রিংয়ের মতো কম্পন।
কম্পন?
জি কম্পন। সুপার স্ট্রিং থিওরিটা কি ব্যাখ্যা করব? পাচ ডাইমেনশন, একটু জটিল মনে হতে পারে।
না।
আমি, আপনি, চন্দ্ৰ, সূৰ্য-সবই কম্পনের প্রকাশ।
কিসের প্রকাশ?
কম্পনের।
খালু সাহেব বললেন, তোমার মাথায় তো দমকল দিয়ে পানি ঢালা দরকার। সবকিছু মাথা থেকে দূর করো। বিয়ে করো। এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করো যার মাথা ঠিক আছে। মাজেদা তুতুরি নামে যাকে ঠিক করেছে, এই মেয়ে তোমার জন্য খারাপ হবে না। সে স্কু ড্রাইভার টাইপ মেয়ে। তোমাকে টাইট দিতে পারবে। বুঝেছ?
জি।
তাকে নিয়ে তোমার গ্রামের বাড়িতে সংসার পাতো।
জি আচ্ছা।
নাট-কে খুঁজে বের করো। নাট-বল্টু একসঙ্গে থাকো।
হুজুর খালু সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি উনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন না। উনি মাসুক অবস্থায় আছেন।
খালু সাহেব বললেন, মাসুক অবস্থাটা কী?
হুজুর বললেন, আল্লাহর পথে যে দেওয়ানা হয়। সে মাসুক। যেমন, লাইলী মজনু।
খালু সাহেব কঠিন গলায় বললেন, আমি তো যদ্দুর জানি মজনু লাইলীর প্রেমে দেওয়ানা হয়েছিল।
হুজুর বললেন, মূলে আল্লাহপাকের প্রেমে মাসুক। মাজারে কিছুদিন থাকেন। জিগির করেন বা না-করেন, আপনার মধ্যেও মাসুকীভাব হবে।
খালু সাহেব গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে রইলেন।
তাঁকে খানিকটা উদভ্ৰান্ত দেখাচ্ছে। তাঁর স্ট্রিংয়ের কম্পন বেশি হচ্ছে। সেই তুলনায় বল্টু স্যার শান্ত। খালু সাহেবকে গোসল করিয়ে আনব কি না বুঝতে পারছি না। রেস্টুরেন্ট থেকে সিঙ্গেল শাম্পু দিয়ে গোসল করে আনানোর ফল শুভ হতে পারে। ফেরার পথে বান্দরের খেলা দেখিয়ে আনা যেতে পারে। বাঁদর দেখা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো।
খালু সাহেব বল্টু স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, মাথা থেকে Physics দূর করে দাও। অন্য কিছু নিয়ে ভাবো। ডিরেকশন চেঞ্জ করো। Physics যদি হয় উত্তর তাহলে চলে যাও দক্ষিণে। পদার্থবিদ্যার ‘অপজিট’ কী হবে?
বল্টু স্যার বললেন, ভূত-প্রেত হতে পারে।
খালু সাহেব বললেন, ভূত-প্ৰেত খারাপ কী? ওই নিয়ে চিন্তা করো। প্রয়োজনে বই লিখে ফেলো। ফিজিক্সের ওপর তোমার লেখা কী বই নাকি আছে? New York Times-এর Best seller। নাম কী বইটার?
ফিজিক্সের বই না। ম্যাথমেটিক্স— The Book of infinity,
আমি বললাম, ‘বাংলার ভূত’ এই নামে স্যারের একটা বই লেখার পরিকল্পনা আছে। গবেষণাধর্মী বই। ভূতদের পরিচিতি থাকবে। তাদের কর্মকাণ্ড থাকবে।
খালু সাহেব অবাক হয়ে বললেন, সত্যি কি এরকম কিছু লিখছি নাকি?
বল্টু স্যার বললেন, ট্র্যাক বদলের জন্যে লেখা যেতে পারে। কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা।
খালু সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। হুজুর তখন বললেন, সব সমস্যার সমাধান জিগির। দমে দমে সোয়াব।
খালু সাহেব বললেন, আমি বল্টুর সঙ্গে জটিল কিছু কথা বলছি। আপনি এর মধ্যে জিগির জিগির করবেন না।
হুজুর বললেন, জটিল কথার মধ্যেও জিগির করা যায়। আপনি মুখে কথা বলতে থাকবেন, আপনার ‘কলব’ জিগির করতে থাকবে।
খালু সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, চুপ!
হুজুর উদাস গলায় বললেন, আপনি চুপ করতে বলেছেন, চুপ করলাম। আমার ‘কলব’ কিন্তু চুপ করে নাই। সে জিগির করেই যাচ্ছে। আল্লাহপাকের কী অপূর্ব লীলা। একইসঙ্গে কথা, একইসঙ্গে না-কথা। সোবাহানাল্লাহ।
মাজার জমজমাট অবস্থা
আজ বৃহস্পতিবার। আবহাওয়া ব্যাঙদের জন্যে উত্তম। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বল্টু স্যারকে A4 সাইজের কাগজ কিনে দিয়েছি, তিনি বাংলার ভুত’ গ্রন্থ লেখা শুরু করেছেন। ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। অনুবাদ করে বাংলা একাডেমীতে জমা দেওয়া হবে। মূল ইংরেজিটি Penguin-ওয়ালাদের গছানোর চেষ্টা করা হবে।