আমি বললাম, বাঁদরের বিষয়ে অনুসন্ধান না করলে আমরা কত দিন পিছাব?
স্যার আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজেই অনুসন্ধানে গেলেন। যা জানা গেল তা হলো এরা হচ্ছে ‘ট্রেনিং বান্দর’। ওস্তাদ এদের ট্রেনিং দেন। ট্রেনিংয়ের শেষে যারা বাঁদর নিয়ে খেলা দেখায়, তারা কিনে নিয়ে যায়। তখন দাম জোড়া দশ হাজার টাকা। সিঙ্গেল বিক্রি হয় না। ট্রেনিংয়ের খরচ আলাদা।
বল্টু স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দশ হাজার টাকায় দুটা ট্রেইনড মাংকি পাওয়া যাচ্ছে। প্রাইস আমার কাছে রিজনেবল মনে হচ্ছে। পার পিস পঞ্চাশ ডলারের সামান্য বেশি পড়ছে।
আমি বললাম, কিনবেন নাকি স্যার? এখনো বুঝতে পারছি না। তবে কেনা যেতে পারে। দুটা বাঁদর পাশে থাকলে জীবন যথেষ্ট ইনারেস্টিং হবে বলে আমার ধারণা। ট্রেনিংয়ের পর এরা কী কী খেলা দেখাবে?
আমি বললাম, জানি না। চলুন ভালোমতো খোঁজখবর করি।
দোকানের মালিক তক্ষক-চোখা বলল, তিন আইটেমের খেলা পাবেন। স্বামী-স্ত্রীর শ্বশুরবাড়ি যাত্রা, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, স্বামী-স্ত্রীর মিল মহব্বত। তিনটাই হিট আইটেম।
স্যার চকচকে চোখে বললেন, ইন্টারেস্টিং! আমেরিকায় ট্রেইনড পশুপাখির অসম্ভব কদর। হলিউডে ট্রেইনড পশুপাখির একটা শো দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমরাও যে পিছিয়ে নেই এটা জেনে আনন্দ পাচ্ছি।
দোকানি বলল, স্যার নিয়া যান। খেলা দেখায়ে দৈনিক তিন-চার শ’ টাকা আয় করতে পারবেন।
স্যার আমার দিকে সমর্থনের আশায় তাকালেন। অতি মেধাবীরা তারছেড়া মানুষ হয়। দুই বাঁদর নিয়ে উনি কী করবেন কিছুই ভাবছেন না। এই মুহুর্তে তাঁর বিষয়টা মনে ধরেছে। তাঁরছেড়া মানুষের জন্য মুহুর্তের বাসনার মূল্য অসীম।
আমি বললাম, এখনই কিনে ফেলতে হবে তা-না। স্যার, আপনি চিন্তাভাবনা করুন। এদের রাখাও তো সমস্যা। ফাইভ স্টার হোটেল নিশ্চয় বাঁদর রাখতে দিবে না।
দোকানি উদাস গলায় বলল, কার্ড নিয়া যান। চিন্তাভাবনা করেন। যদি মনে করেন কিনবেন মোবাইল করবেন। মাল ডেলিভারি দিয়া আসব। দাম নিয়া মুলামুলি চলবে না।
স্যারকে নিয়ে ফিরছি। তাঁর হাতে বাঁদরের দোকানের ভিজিটিং কার্ড। স্যারের চেহারা একটু মলিন ৷ ঘানি ভাঙানো তেলের দোকানে এসে আবার তার চোখ উজ্জ্বল হলো। তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, সবাই বোতল হাতে নিয়ে বসে আছে কেন?
আমি ব্যাখ্যা করলাম।
স্যার বললেন, এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে মেশিনে তেল না ভাঙিয়ে ঘোড়া দিয়ে কেন ভাঙাচ্ছে?
আমি বললাম, ঘোড়াদের মুখের দিকে তাকিয়েই এটা করা হচ্ছে। ঘোড়াদের এখন কোনো কাজ নেই। এরা বেকার। কেউ ঘোড়ায় চড়ে শ্বশুরবাড়ি যায় না। ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করার রেওয়াজও উঠে গেছে। এই কারণেই এদের আমরা ঘানিতে লাগিয়ে ঘোরাচ্ছি।
স্যার বললেন, ভেরি স্যাড!
তিনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই আটকে যাচ্ছেন। তাকে নড়ানো যাচ্ছে না। ঘানির দোকানের সামনেও তিনি আটকে গেলেন। আমি বললাম, স্যার, এক ছটাক খাটি সরিষার তেল কি আপনার জন্য কিনব?
স্যার বললেন, এক ছটাক তেল দিয়ে আমি কী করব?
বাংলাদেশে খাটি সরিষার তেল নাকে দিয়ে ঘুমানোর সিস্টেম আছে স্যার। ঘুম খুব ভালো হয়।
কেন?
নাকের এয়ার প্যাসেজ ক্লিয়ার থাকে। সরিষার ঝাঁঝও হয়তো কাজ করে।
স্যার বললেন, ইন্টারেস্টিং।
আমি তাঁর জন্য এক ছটাক তেল কিনে মাজারে ফিরে এলাম। তার দু’ঘণ্টা পর আমাদের সঙ্গে খালু সাহেব যুক্ত হলেন। মাজেদা খালার তাড়া খেয়ে তিনি কিছুটা বিপর্যস্ত। আমাকে বললেন, হিমু! বেঁচে থাকার বিষয়ে কোনো আগ্ৰহ বোধ করছি না। তোমার মাজেদা খালা আমাকে বলেছে, Go to hell.
আমি বললাম, এখানকার ঠিকানা কোথায় পেয়েছেন?
খালু ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, এখানকার ঠিকানা কোথায় পেলাম এটা ইস্পরটেন্ট, নাকি তোমার খালা যে বলল, গো টু হেল, সেটা ইস্পরটেন্ট?
খালার কথাই ইম্পরটেন্ট।
আমি ঠিক করেছি, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কারও বাড়িতে গিয়ে উঠব না। কারও করুণা ভিক্ষা করব না। পথেঘাটে থাকব।
আমি বললাম, সোনারগাঁ হোটেলের একটা রুম আমাদের নেওয়া আছে। রুমটা ডক্টর চৌধুরী আখলাকুর রহমান ওরফে বল্টু স্যারের। সেখানে উঠবেন? রুম খালি আছে।
সে গেছে কোথায়?
ওই যে কোনায় মশারি খাটিয়ে ঘুমাচ্ছেন। তাঁর নাকে দুফোঁটা খাঁটি সরিষার তেল দেওয়া হয়েছে। নেজাল প্যাসেজ ক্লিয়ার থাকায় ভালো ঘুম হচ্ছে। আগে ঘুমের মধ্যে ইলেকট্ৰন, পজিট্রন এইসব হয়ে যেতেন। এখন হচ্ছেন না।
খালু সাহেব অবাক হয়ে বললেন, সে এখানে বাস করে নাকি?
জি। তাঁর জন্যে নতুন মশারি কেনা হয়েছে।
খালু মশারি তুলে উঁকি দিয়ে বললেন, আসলেই তো সে! মাথা পুরো মনে হয় কলাপস করেছে। তার ভাই নাটের মতো অবস্থা। নাট লালমাটিয়া কলেজে জিওগ্রাফি পড়ােত। হঠাৎ একদিন বলে কী, কাক হলো মানবসভ্যতার মাপকাঠি। কাকের সংখ্যা গোনা দরকার। কাকের সংখ্যার সঙ্গে সভ্যতা ইনভারলি রিলেটেড।
তারপর উনি কি কাক গোনা শুরু করলেন?
বাকি খবর রাখি না। আমার রাখার প্রয়োজন কী? তার নিজের ভাই বল্টু কোনো খবর রাখে? সে তো নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমেরিকান ইউনিভার্সিটির এত বড় প্রফেসরশিপ ছেড়ে চলে এসেছে। এখন এক মাজারের চিপায় শুয়ে আছে। পদ্মার পাড়ে তাদের বিশাল দোতলা বাড়ি। সেই বাড়ি খা-খা করছে। দুই ভাইয়ের কেউই নেই। একজন মাজারে শুয়ে আছে, আরেকজন কাকশুমারি করছে। দুজনকেই থাপড়ানো দরকার।