আমি বরাশি ফেলে আরামে মাছ ধরে যাব। মাছগুলির কঠিন চক্ষুলজ্জা আর মান-সম্মানের ভয়। তারা কাউকে কিছু জানাবে না। আর বাবা-মা’র কাছে যদি বলেও ফেলে, তারা ধমক দিয়ে চুপ করবেন। একবার প্রচার হয়ে গেলে বিয়ে বন্ধ। বাঙালিমেয়েদের মধ্যে ‘বিবাহ’ অতি গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনা ঘটে যাওয়া মেয়ের বিবাহ বাংলাদেশে হয় না। অতি বদ ছেলেও খোঁজে পবিত্ৰ কুমারী কন্যা।
পরিমল বদটা বিয়ে করবে। পবিত্ৰ কন্যা খোঁজা হচ্ছে। বাইশ ক্যারেট মেয়ে লাগবে। আঠার ক্যারেটে হবে না।
তুতুরি বিষয়ে আমার পরিকল্পনা হলো, সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া। পুকুরঘাটে মাছের সন্ধানে কিছুক্ষণ বসে থাকা। এর মধ্যে পরিমল জগভর্তি করে বরফ দেওয়া মার্গারিটা নিয়ে উপস্থিত হবে।
মাৰ্গারিটা এমনই এক মজাদার ককটেল যে লাগবে শরবতের মতো; সঙ্গে টাকিলা মেশানো। তা নাবালকরা বুঝতে পারবে না। তিন পেগেই খবর হয়ে যাবে। কাত হয়ে পড়ে যাবে। তখন তাকে কোলে করে বিছানায় নিয়ে যাওয়া।
না, আমি এই নিয়ে কখনো মানসিক সমস্যায় ভুগি না। যে মেয়ে কাউকে কিছু না-জানিয়ে একা রওনা হতে পারে, তার উচিত পরবর্তী ঝামেলার জন্যে তৈরি থাকা। তোমরা বদের হাড্ডি, আমিও বদের হাড্ডি। হা হা হা। হাড্ডিতে হাড্ডিতে কাটাকাটি।
তবে তুতুরি অতিরিক্ত চালাক বলে আমার ধারণা। পীর বাচ্চাবাবার মাজারে গিয়ে হয়তো দেখা যাবে, হিমুও সঙ্গে যাচ্ছে। চিন্তার কিছু নাই, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
প্রথম যে মেয়ে আমার সঙ্গে মানুষের মুখের মতো দেখতে মাছ দেখতে গেল তার কথাই ধরা যাক। মেয়েটার নাম মালা। সে এক যাবে এমনই কথা। বদ মেয়ে তার সঙ্গে এগার-বার বছরের ছেলে নিয়ে উপস্থিত। তার মামাতো ভাই। এই ছেলেও নাকি মাছ দেখবে। আমি বললাম, ok, খোকা তোমার নাম কী?
সে বলল, আমার নাম সবুজ।
তুমি হচ্ছে সবুজ
তুমি খুবই অবুজ
মাছ দেখতে যাবে
মাছের দেখা পাবে
মাছ কিন্তু মন্দ
মাছের গায়ে গন্ধ।
ছড়া শুনে সবুজ হেসে কুটিকুটি। যাই হোক, গ্রামে পৌঁছে যথারীতি মার্গারিটা ককটেল ট্রিটমেন্ট হলো। দু পেগ খেয়েই মালা জড়ানো গলায় কথা বলতে লাগল। আমি বললাম, মালা! শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি?
মালা বলল, জ্বি স্যার। আমি বললাম, কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। দীর্ঘ জার্নি করে এসেছ, এইজন্য মনে হয় শরীর খারাপ করেছে। এসো তোমাকে শোবার ঘর দেখিয়ে দেই। আমার বন্ধু পরিমল আছে তোমার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে। পরিমল তাকে মাছ দেখাবে। মাছটা সূর্য ডোবার পর মাঝে মাঝে মাথা ভাসায়। ভাগ্য ভালো থাকলে আজও ভাসবে।
মালা বলল, স্যার আমি দেখব না?
তুমি আগামীকাল সন্ধ্যায় দেখবে। এখন শরীরটা ঠিক করো।
আমি মালাকে শোবার ঘরে নিয়ে গেলাম। মেয়েদের সিক্সথ সেন্স প্রবল থাকে। সে ঘরে ঢুকেই আতঙ্কিত গলায় বলল, স্যার আপনার মা কোথায়?
আমি বললাম, মা গেছে তার বোনের বাড়ি। তাকে আনতে লোক পাঠিয়েছি। চলে আসবে।
মালা আতঙ্কিত গলায় বলল, আপনি ঘরের দরজা কেন বন্ধ করছেন?
আমি বললাম, তোমায় মাথায় বিলি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেব তো, এজন্য দরজা বন্ধ করলাম।
মালা ব্যাকুল গলায় ডাকল, সবুজ সবুজ! আমি বললাম, সবুজকে নিয়ে মোটেই চিন্তা করবে না। পরিমল তাকে মাছ দেখাবে।
পরিমল তাকে এমন মাছ দেখিয়েছে যে, তার জীবন থেকে মাছ পুরোপুরি মুছে গেছে বলে আমার ধারণা।
আমার সঙ্গে ফাজলামি! একা যাবে ঠিক করে মামাতো ভাই নিয়ে উপস্থিত। যেমন কর্ম তেমন ফল। বোন গেছে যেই পথে, মামাতো ভাই গেছে সেই পথে। হা হা হা।
পীর বাচ্চাবাবার মাজারে
বল্টু স্যার পীর বাচ্চাবাবার মাজারে পড়ে আছেন। ঝামেলামুক্ত মানুষকে যেমন দেখায় তাকে সেরকম দেখাচ্ছে। এখানে তিনি ঘুমের মধ্যে ইলেকট্রন, প্রোটন বা পজিট্রন হচ্ছেন না। তাঁকে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে না। রাতে শান্তিময় ঘুম হচ্ছে। মাঝে মাঝে তাঁকে মাথা দুলিয়ে ‘London bridge is falling down’ বলতে দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাদের এই রাইম কেন তার মাথায় ঢুকেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে হুজুর খুশি। হুজুরের ধারণা বল্টু স্যার জিগিরের মধ্যে আছেন। মাজারে তার গোসলের সমস্যা ছিল, আমি তাঁকে ‘গোসলের সুব্যবস্থা আছে।… মহিলা নিষেধ’ লেখা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গোসল করিয়ে এনেছি। গোসল করে তিনি মোটামুটি তৃপ্ত। তাকে দুই বালতি পানি দেওয়া হয়েছিল। এক বালতি গরম পানি, এক বালতি ঠান্ডা। একটা মিনিপ্যাক শ্যাম্পু এবং এক টুকরা সাবান।
গোসলখানা থেকে বের হয়ে তিনি মুগ্ধ গলায় বলেছেন, বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি করছে। টার্কিশ বাথের স্টাইলে স্নানের ব্যবস্থা করছে। পথেঘাটে যারা চলাফেরা করে তাদের স্নানের প্রয়োজন। এরা এই প্রয়োজন মেটাচ্ছে। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ দ্রুত মধ্য-আয়ের দেশ হয়ে যাবে।
বাঁদরের দোকান দেখেও বল্টু স্যার অভিভূত হলেন। চোখ বড় বড় করে বললেন, বাঁদরের দোকান নাকি?
আমি বললাম, স্যার বাঁদরের দোকান বলেই মনে হয়, তবে এরা বাঁদর বিক্রি করে না।
বাদর বিক্রি করে না। তাহলে এতগুলো বাঁদর নিয়ে দোকান সাজিয়েছে কেন?
জানি না স্যার।
জানবে না? জানার ইচ্ছা কেন হবে না? কৌতুহলের অভাব মানেই জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার মৃত্যু। গ্যালিলিও যদি কৌতুহলী হয়ে আকাশের দিকে দুরবিন তাক না করতেন তা হলে আমরা এক শ’ বছর পিছিয়ে থাকতাম।