স্ত্রী গলা স্বামীর চেয়েও তিনগুণ উচিয়ে বললেন, তুমি বের হয়ে যাও। এই অ্যাপার্টমেন্ট আমার।
তোমার?
অবশ্যই আমার।
আচ্ছা তাই?
তাই করবে না। বের হয়ে যেতে বলছি, বের হয়ে যাও।
এটা তোমার শেষ কথা?
হ্যাঁ, শেষ কথা। Go to hell!
Go to hell!—বাক্যটি এই মহিলা স্বামীর কাছ থেকে শিখেছেন। প্রয়োগ করে মনে হলো খুব আনন্দ পেলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাসলেন। স্বামী বললেন, OK যাচ্ছি। আর ফিরব না।
স্ত্রী বললেন, ভুলেও উত্তরার অ্যাপার্টমেন্টে যাবে না। ওইটাও আমার।
স্বামী বেচারা দরজার দিকে যাচ্ছেন, তখন আমি বললাম, স্যার দয়া করে খালি পায়ে যাবেন না। স্যান্ডেল বা জুতা পরে যান।
উনি থমকে দাঁড়িয়ে আমার দিকে কঠিন চোখে তাকালেন। আমি তখন অবিকল হিমু যেভাবে বলত সেইভাবে বললাম, খালি পায়ে বের হলে আপনার পায়ে হাণ্ড লেগে যেতে পারে।
তিনি উল্কার বেগে খালি পায়ে বের হয়ে গেলেন। মাজেদা খালা বললেন, তুতুরি, কাগজ-কলম নিয়ে বসে। আমাকে বোঝাও তুমি কী কী কাজ করবে। তার ভাবভঙ্গি যেন কিছুই হয় নি। সব স্বাভাবিক। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, হিমুর জন্য একটা ঘর রাখবে; ও যখন ইচ্ছে তখন এখানে থাকবে। হিমুর ঘরের রঙ হবে হলুদ।
খালু সাহেবের পছন্দের রঙ কী?
মাজেদা খালা চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন, তার ঘর এমন করে বানাবে যেন আলো-হাওয়ার বংশ না ঢুকে। চিপা বাথরুম রাখবে। বাথরুম এমনভাবে বানাবে যেন বাথরুমে সামান্য পানি জমলেই সেই পানি চুইয়ে লোকটার ঘরে ঢুকে যায়। পারবে না?
অবশ্যই পারব। আপনি চাইলে রান্নাঘর এমন ডিজাইন করব যেন রান্নাঘরের ধোঁয়াও উনার ঘরে ঢোকে। কাশতে কাশতে জীবন যাবে।
ভালো তো। খুব ভালো। চা খাবে? আসো চা খাই।
আমি চা খেয়ে চলে গেলাম জহির স্যারের কোচিং সেন্টারে। অতি দুষ্ট এই মানুষটার মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে আমার রক্তে আগুন ধরে যায়। আগুন ধরার এই ব্যাপারটা আমি পছন্দ করি।
জহির স্যারের কাছে আজ। আমি বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে যাচ্ছি। তার সঙ্গে হিমুর মতো কিছুক্ষণ কথা বলে তাকে বিভ্রান্ত করব। জহির স্যারকে কী বলব তাও আমি গুছিয়ে রেখেছি। তবে গুছিয়ে রাখা কথা সব সময় বলা হয় না। এক কথা থেকে অন্য কথা চলে আসে। দেখা যাক কী হয়। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
জহির স্যার আমাকে দেখে খুশি খুশি গলায় বললেন, তোমার জন্য অসম্ভব ভালো খবর আছে।
আমি বললাম, কী খবর স্যার?
গ্রামের পুকুরের মানুষের মুখের মতো দেখতে মাছটা সবাই ভেবেছে মারা গেছে। অনেক দিন দেখা যেত না। গতকাল দেখা গেছে।
বলেন কী!
এই উইকএন্ডে যাবে? এরপর আমি খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ব! কোচিং সেন্টারে টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। ঠিক আছে?
অবশ্যই ঠিক আছে। আপনার বন্ধু যাবেন না? পরিমল সাহেব।
জহির স্যার হাই তুলতে তুলতে বললেন, বলে দেখব। যেতেও পারে। বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় রওনা হব। তোমাকে কোথেকে তুলব?
পীর বাচ্চাবাবার মাজার থেকে তুলে নেবেন। আমি ওইখানে রেডি হয়ে থাকব।
পীর বাচ্চাবাবার মাজার মানে?
আমার পরিচিত একজন ওই মাজারের অ্যাসিসটেন্ট খাদেম। তার নাম হিমু। ঢাকা শহরের সবচেয়ে গরম মাজার।
মাজারের আবার ঠান্ডা-গরম কী?
ঠান্ডা-গরম আছে স্যার। হার্ভার্ডের ফিজিক্স-এর একজন Ph.D. সোনারগাঁ হোটেলের চার শ’ সাত নম্বর রুমে উঠেছিলেন। কী মনে করে একদিন মাজার দেখতে গিয়েছিলেন, তারপর আটকা পড়লেন।
আটকা পড়লেন মানে কী?
এখন তিনি মাজারে থাকেন। মাজারেই ঘুমান। এশার নামাজের পর হুজুরের সঙ্গে জিগির করেন।
অ্যাবসার্ড কথাবার্তা বলছি।
অনেক বড় বড় লোকজন সেখানে যান। মন্ত্রী-মিনিষ্টারেরা গোপনে যান, গোপনে চলে আসেন। বৃহস্পতিবারে আপনি তো আমাকে তুলতে যাচ্ছেন, নিজেই দেখবেন।
তুমি কি নিয়মিত মাজারে যাও?
জি-না স্যার। আমার মাজারভক্তি নাই। এই মাজারের ডিজাইন করার দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে। অল্প জায়গা তো, ডিজাইন করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছি। আমি ঠিক করেছি ওপরের দিকে উঠে যাব। স্পাইরেল ডিজাইন হবে। ফিবোনাচ্চি রাশিমালা ব্যবহার করব। কয়েক কোটি টাকার প্রজেক্ট।
কোটি টাকা কে দিচ্ছে?
উনার নাম গোপন। কাউকে জানাতে চাচ্ছেন না।
জহির স্যারকে খানিকটা হ’কচাকিয়ে বের হয়ে এলাম। এখন কী করব বুঝতে পারছি না।
হিমুর মতো হাঁটব? আমার সমস্যা কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। মাজারের একটা ডিজাইন সত্যি সত্যি আমার মাথায় এসেছে। ফিবোনাচ্চি সিরিজের চিন্তাটাও আছে। ১-১-২-৩-৫-৮… প্রতিটি সংখ্যা আগের দুটি সংখ্যার যোগফল।
পুরো স্ট্রাকচার হবে কংক্রিটের। ওপরটা হবে ফাঁকা। রোদ আসবে, বৃষ্টি আসবে। স্ট্রাকচারের রঙ হবে হলুদ।
আচ্ছা আমার মাথায় হলুদ ঘুরছে কেন? আজ যে শাড়িটা পরেছি, তার রঙও হলুদ। ইচ্ছা করে হলুদ পরিনি। হাতে উঠেছে। পরে ফেলেছি। কোনো মানে হয়?
Something is wrong, Something is very wrong.
আমি জহির
তুতুরি মেয়েটা বরশির টোপ গিলেছে। আমি বুঝতে পারি না, মেয়েগুলি টোপ গেলার জন্যে এত ব্যস্ত হয়ে থাকে কেন? সব ক্ষুধার্ত মৎস্যকুমারী।
আমার বরাশিতে টোপ গিলেছে তিনজন। এর মধ্যে একজন মরেই গেল। এটা ঠিক হয় নাই। পরিমল ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে ঝামেলাটা করেছে। তাকে এই কাজ আর করতে দেওয়া যাবে না। ডকুমেন্ট হিসেবে ভিডিও হাতে থাকতে পারে, প্রয়োজনে ব্যবহার করা গেল। ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে সবাইকে জানানোর কিছু নেই।