হিমু তার স্যারকে মাজার দেখাচ্ছে। তার স্যার একটু পর পর বলছেন, ‘ইলেকট্রন’।
ইলেকট্রন ব্যাপারটা কী আমি জানি না। বেশি না-জানাই ভালো। কম জানার মধ্যেই মুক্তি। ছোবাহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবর।
অনেক কিছুই বই পড়ে শেখা যায় না। যে কোনোদিন মিষ্টি খায় নাই, সে কি কোনো বই পড়ে বুঝতে পারবে মিষ্টির স্বাদ কী! যে কোনোদিন লাল রঙ দেখে নাই, বই পড়ে সে কি বুঝবে লাল রঙ কী?
আমরা আয়োজন করে ইফতার খেতে বসেছি
আমরা আয়োজন করে ইফতার খেতে বসেছি। পাটি পেতে সবাই বসেছি। হুজুরকে যখন চেয়ার থেকে নামানো হলো, বল্টু স্যার তখনই লক্ষ করলেন হুজুরের পা নেই। স্যার অবাক হয়ে বললেন, আপনার পা কোথায়?
হুজুর বললেন, আল্লাহপাক নিয়ে গেছেন। উনি নির্ধারণ করেছেন আমার পায়ের প্রয়োজন নাই। এই কারণেই নিয়ে গেছেন। তিনি অপ্রয়োজনীয় জিনিস পছন্দ করেন না।
বল্টু স্যার বললেন, আপনার অবস্থা দেখে খারাপ লাগছে। তবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন না। আপনার পা আবার গজাবে।
হুজুর অবাক হয়ে বললেন, জনাব কী বললেন, বুঝতে পারলাম না। আমার পা। আবার গজাবে?
স্যার বললেন, নিম্নশ্রেণীর পোকামাকড়দের ভেঙে যাওয়া নষ্ট হওয়া প্রত্যঙ্গ আবার জন্মায়। মাকড়সার ঠ্যাং গজায়। টিকটিকির লেজ গজায়। এখন স্টেমাসেল নিয়ে যে গবেষণা হচ্ছে তাতে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গজাবে।
হুজুর বিড়বিড় করে বললেন, আস্তাগাফিরুল্লাহ।
বল্টু স্যার প্রবল উৎসাহে বলতে লাগলেন-বিজ্ঞানের উন্নতির ধারাটা হলো এক্সপোনেনশিয়াল। এই ধারায় উন্নতির রেখা শুরুতে সরলরেখার মতো থাকে। একটা পর্যায়ে রেখায় শোল্ডার অর্থাৎ কাঁধ দেখা যায়, তারপর এই রেখা সরাসরি উঠতে থাকে। বিস্ফোরণ যাকে বলে।
হুজুর বললেন, এইসব হাবিজাবি কী বলতেছেন জনাব!
বল্টু স্যার বললেন, এক শ’ ভাগ সত্যি কথা বলছি। আমরা পয়েন্ট অব সিঙ্গুলারিটির দিকে এগুচ্ছি। পৃথিবীর নানান জায়গায় সিঙ্গুলারিটি সোসাইটি হচ্ছে। এইসব সোসাইটি ধারণা করছে, দুই হাজার দুশ’ সনের দিকে আমরা সিঙ্গুলারিটির দিকে পেঁৗছে যাব। তখন আমরা অমরত্ব পেয়ে যাব। আজরাইল বেকার হয়ে যাবে।
হুজুর বললেন, জনাব, আপনি কী বলছেন? আজরাইল বেকার হয়ে যাবে?
মানুষ যদি মৃত্যু রোধ করে ফেলে, তাহলে আজরাইল তো বেকার হবেই। আজরাইলের তখন কাজ কী?
হুজুর বললেন, ইফতারির আগে আপনি আর কোনো কথা বলবেন না।
কথা বলব না কেন?
হুজুর বিরক্ত গলায় বললেন, আপনার কথা শুনলে অজু নষ্ট হয়ে যাবে, এইজন্যে কথা বলবেন না। আসুন আমরা আল্লাহর নামে জিগির করি। সবাই বলেন-আল্লাহু, আল্লাহু।
সবাই বলতে আমরা তিনজন। হুজুর, আমি আর বল্টু স্যার। কেরামত চাচা টিফিন কেরিয়ার ভর্তি ইফতার রেখে চলে গেছেন। বলে গেছেন রাতে আবার আসবেন। হুজুরের নির্দেশে আমি বাংলা একাডেমীর ডিজি স্যারকে ইফতারের দাওয়াত দিয়েছি। ঠিকানা দিয়েছি। ডিজি স্যার ইংরেজিতে বলেছেন, I don’t understand what you are cooking. বাংলায় হয়, তুমি কী রাঁধছ বুঝতে পারছি না। তাঁর এই উক্তিতে তিনি ইফতারে সামিল হবেন এমন বোঝা যাচ্ছে না।
ইফতারের আয়োজন চমৎকার। বিছমিল্লাহ হোটেলের বিখ্যাত মোরগপোলাও, সঙ্গে খাসির বটিকাবাব। মামের পাঁচ লিটার বোতলে এক বোতল বোরহানি।
মাগরেবের আজান হয়েছে। হুজুর আজানের দোয়া পাঠ করেছেন। আমরা ইফতার শুরু করেছি। হুজুর বললেন, যারা রোজা না তারাও যদি কখনো অতি তৃপ্তিসহকারে খাদ্য খায়, তাহলে এক রোজার সোয়াব পায়।
বল্টু স্যার বললেন, তাহলে রোজা রাখার প্রয়ােজন কী? তৃপ্তি করে ভালো ভালো খাবার খেলেই হয়।
হুজুর বললেন, যত ভালো খাদ্যই হোক, আল্লাহর হুকুম ছাড়া তৃপ্তি হবে না। একবার রসুন শুকনা মরিচের বাটা দিয়ে গরম ভাত খেয়েছিলাম, এত তৃপ্তি কোনোদিন পাই নাই।
আমার মনে হয়, রোজা না-রেখেও আজ সবাই রোজার তৃপ্তি পেয়েছে। বল্টু স্যার বললেন, অসাধারণ। তেহারির রেসিপি নিয়ে যাব। রেসিপিতে কাজ হবে। না, রান্নার প্রসিডিউর ভিডিও করে নিয়ে যেতে হবে। যেসব স্পাইস এই রান্নায় ব্যবহার হয়, সেসব আমেরিকায় পাওয়া যায় কি না কে জানে! পাওয়া না গেলে বস্তাভর্তি করে নিয়ে যেতে হবে। শুধু একটা জিনিস মিস করছি—এক বোতল রেড ওয়াইন।
হুজুর আমাকে বললেন, তোমার স্যার কিসের কথা বলছেন?
আমি বললাম, রেড ওয়াইনের কথা বলছেন।
জিনিসটা কী?
মদ।
আস্তাগাফিরুল্লাহ! ইফতারের সময় এইসব কী শুনলাম! হে আল্লাহপাক, তুমি এই বান্দার অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে। আমিন।
বল্টু স্যার খাওয়ার পর নিমগাছের নিচে পাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে ইলেকট্রন বা প্রোটন হয়ে গেলেন কি না তা বোঝা গেল না। তবে তার যে তৃপ্তির ঘুম হচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে। ঘুমের সময় চোখের পাতা যদি দ্রুত কঁপে, তাহলে বুঝতে হবে ঘুম গাঢ় হচ্ছে। চোখের পাতার দ্রুত কম্পনকে বলে Rapid Eye Movement (REM)। স্যারের REM হচ্ছে।
হুজুর বললেন, হিমু! তোমার স্যারের পায়ের কাছে একটা মশার কয়েল জ্বালায়ে দেও। উনারে মশায় কাটতেছে। মানুষের সেবা করার মধ্যে নেকি আছে। ব্যাংক একাউন্টে নেকি জমা করে।
আমি বললাম, হুজুর’! মশার কি আত্মা আছে?