হিমু টেলিফোন ফেরত দিয়ে বলল, হুজুর, ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেছি।বিছমিল্লাহ হোটেলের বাবুর্চি কেরামত চাচা নিজে খানা নিয়ে আসবেন।
আমি বললাম, হিমু, তুমি এমন এক কথা বলেছি যে আল্লাহপাক গোস্বা হয়েছেন। খাবারের ব্যবস্থা তুমি করো নাই। খাবারের ব্যবস্থা করেছেন আল্লাহপাক। তুমি উছিলা মাত্র। বলো, আস্তাগাফিরুল্লাহ।
হিমু বলল, আস্তাগাফিরুল্লাহ।
বলো, সোবাহানাল্লাহ। আলহামদুল্লিল্লাহ, আল্লাহু আকবর। সে ভক্তি নিয়ে বলল, সোবাহানাল্লাহ, আলহামদুল্লিল্লাহ, আল্লাহু আকবর।
আমি বললাম, আচ্ছা এখন যাও, কাজকর্ম করো। সে ঝাটা নিয়ে মাজার পরিষ্কার করতে লাগল। এই ছেলের উপর আমার দিলখোশ হয়েছে। আমি তাকে গোপন কিছু জিনিস শিখিয়ে দিব। যেমন, ফজরের নামাজের পর তিনবার সূরা হাসরের শেষ তিন আয়াত পড়লে সত্তুর হাজার ফেরেশতা তার জন্যে দোয়া করবে। বিরাট ব্যাপার।
আমি যে সোয়াবের একটা কাজ করেছি—এটা আমি ছেলেটাকে বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঘটনাটা হলো, অনেক বছর আগে আমি ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি একটা বাচ্চা মেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, আর তার দিকে ট্রাক আসছে। মেয়েটা ট্রাক দেখে নাই, আমি মেয়েটার উপর ঝাপ দিয়ে পড়লাম। মেয়েটা বাঁচল, ট্রাকের চাকা চলে গেল আমার পায়ের উপর দিয়ে। দুটা পা শেষ। অবশ্যি যা হয়েছে আল্লাহপাকের হুকুমে হয়েছে। ট্রাকচালকের এখানে কোনো দোষ নাই। তার উপর আল্লাহপাকের হুকুম হয়েছে ট্রাকের চাকা আমার পায়ের উপর দিয়ে নিতে। সে নিয়েছে। তার কী দোষ?
মেয়েটার নাম জয়নাব। নবী-এ-করিমের স্ত্রীর নামে নাম। অনেক দিন মেয়েটার জন্যে দোয়া খায়ের করা হয় না। আগে নিয়মিত দোয়া করতাম। আবার শুরু করা প্রয়োজন। অন্যের জন্য দোয়া করলেও নেকি পাওয়া যায়।
আছর ওয়াক্তে হিমুর পরিচিত এক ভদ্রলোক এসে উপস্থিত। মাশাল্লাহ অত্যন্ত সুন্দর চেহারা। সুন্দর চেহারা আল্লাহপাকের নিয়ামত। হযরত ইউসুফ আলাহেস সালামের সুন্দর চেহারা ছিল। ভদ্রলোককে দেখে হিমুর ব্যস্ততা চোখে পড়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। মানুষকে সম্মান এইভাবে দিতে হয়। যে অন্যকে সম্মান দেয়, আল্লাহপাক তাকে সম্মান দেয়।
হিমু বলল, স্যার, এখানকার ঠিকানা কোথায় পেলেন?
ভদ্রলোক বললেন, ঠিকানা কীভাবে জোগাড় করেছি এটা জানা কি অত্যাবশ্যক?
হিমু বলল, জি-না স্যার। আপনাকে এত অস্থির লাগছে কেন?
ভদ্রলোক বললেন, দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়েছিলাম। আবারও সেই জিনিস।
ইলেকট্রন হয়ে গেলেন?
হ্যাঁ, তবে চার্জ নেগেটিভ না হয়ে পজেটিভ ছিল। অর্থাৎ আমি হয়েছি পজিট্রন। ভয়াবহ ব্যাপার!
ভয়াবহ কেন?
পজিট্রন হলো ইলেকট্রনের অ্যান্টি ম্যাটার। পজিট্রন ইলেকট্রনের দেখা পেলেই এনিহিলেট করবে। এখন চারিদিকে ইলেকট্রনের ছড়াছড়ি। পজিট্রন হয়ে আমি ভয়ে অস্থির-কখন না ইলেকট্রনের সঙ্গে দেখা হয়! আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছ?
জি স্যার। একে সহজ বাংলায় বলে বেকায়দা অবস্থা। স্যার কোনো খাওয়াদাওয়া কি করেছেন?
না।
সকালের ব্ল্যাক কফির পর আর কিছু খান নাই?
না।
মাগরেবের ওয়াক্তে ইফতার চলে আসবে, তখন হুজুরের সঙ্গে ইফতার করবেন।
হুজুরটা কে?
পীর বাচ্চাবাবা মাজারের প্রধান খাদেম।
আমি লক্ষ করলাম, হিমুর স্যার সন্দেহের দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমি বললাম, জনাব! আসসালামু আলায়কুম। উনি বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম। কিছু মনে করবেন না, মাজারের খাদেম হিসেবে আপনার কাজটা কী?
পীর বাচ্চাবাবার মাজার রক্ষা করাই আমার কাজ।
মাজার কীভাবে রক্ষা করেন?
আমি বললাম, আপনি যে-কোনো কারণেই হোক অস্থির হয়ে আছেন। আপনার আত্মা কষ্ট পাচ্ছে। আত্মা শান্ত হোক, তখন কথা বলব।
ভদ্রলোক বললেন, আত্মা বলে কিছু নাই।
আমি হাসলাম! এই বুরবাক কী বলে?
ভদ্রলোক চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন, আপনি বলুন আত্মা কী? মানুষের শরীরের কোথায় সে থাকে?
আমি বললাম, ইফতারের পর এই বিষয়ে জনাবের সঙ্গে কথা বলব।
হিমু এই ফাঁকে আমার কানে কানে বলল, হুজুর, আপনি বলেছিলেন না। আত্মা গুলায়ে খাওয়ায়ে দিবেন। খাওয়ায়ে দেন। উনি বিরাট জ্ঞানী মানুষ। ফিজিক্সে Ph.D.। উনাকে একটা আত্মা খাওয়ায়ে দিতে পারলে লাভ আছে।
আমি একটু চিন্তায় পড়লাম। অতিরিক্ত জ্ঞানী মানুষ নানান সমস্যা করে। কারণ তারা সমস্যায় বাস করে। যত বই পড়ে তত তাদের মাথায় সমস্যা ঢোকে।
এ রকম এক সমস্যাওয়ালা মানুষের সঙ্গে একবার আমার বাহাস হয়েছিল। সে আমাকে বলল, হুজুর, রোজকেয়ামত কবে হবে? আমি বললাম, এই জ্ঞান শুধু আল্লাহপাকের আছে। তবে আছরের ওয়াক্তে রোজ কেয়ামত হবে।
সে বলল, আছরের ওয়াক্ত তো পৃথিবীর এক জায়গায় একেক সময় হয়। বাংলাদেশে এক সময় আবার আমেরিকায় আরেক সময়। তাহলে রোজকেয়ামত একেক জায়গায় একেক সময়ে হবে?
প্যাঁচের প্রশ্ন। আমাকে প্যাঁচে ফেলা এত সহজ না। আমি বললাম, বাবা শোনো! রোজ কেয়ামত হবে। আল্লাহপাকের ঠিক করা আছরের ওয়াক্তে।
হিমুর স্যার মনে হয় আমাকে প্যাচে ফেলবে। যারা প্যাচের মধ্যে আছে তারাই অন্যকে প্যাচে ফেলতে চায়। হে আল্লাহপাক, হে গাফুরুর রাহিমা! তুমি মানুষকে প্যাচ থেকে মুক্ত করো। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অহদাহু লা শরিকা লাহু, লাহুল মুলকু অ-লাহুল হামদ অ হুয়া আনা কুল্লে শাইন কাদির।