খালা হতাশ গলায় বললেন, এত কথা বলছিস কেন? তুই কিন্তু বল্টুর সঙ্গে কোনো ফাজলামিটাইপ কথা বলবি না। ও অতি সম্মানিত একজন মানুষ। প্রফেসর ইউনূসের মতো নোবেল প্রাইজও পেয়ে যেতে পারে।
তাহলে তো বিরাট সমস্যা।
কী সমস্যা?
নানান মামলা মোকদ্দমায় জড়াতে হবে। বাংলাদেশে নোবেল প্রাইজ পাওয়া লোকজনদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়।
আবার বকবকানি শুরু করেছিস। চুপ করতে বললাম না?
বল্টুভাইকে দেখে আমি চমকালাম। Ph.D. শুনলেই আমাদের চোখে চাপাভাঙা বিরক্ত চোখের মানুষের ছবি ভাসে, যার ঠোঁটে থাকে অবজ্ঞার হাসি। যাদের এমন ভারী ডিগ্রি নেই তাদের দিকে এরা এমনভাবে তাকান যেন বনমানুষ দেখছেন। হার্ভার্ডের এই Ph.D. অত্যন্ত সুপুরুষ। মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। মাথাভর্তি সাদাকালো চুল। মাজেদা খালার কথা সত্যি। উনার চোখে দিশেহারা ভাব।
হার্ভার্ডের Ph.D.-র কোমরে হোটেলের টাওয়েল প্যাচানো। তিনি খালি গায়ে বিছানার ওপর বসে আছেন। তার বাঁ-হাতে চায়ের কাপ। ডানহাতে একটা চামচ। তিনি চায়ের কাপে চামচ ডুবিয়ে চা তুলে এনে মুখে দিচ্ছেন। শিশুরা গরম চা। এইভাবে খায়। বয়স্ক কাউকে এই প্ৰথম দেখলাম।
আমি বললাম, বল্টুভাই, ভালো আছেন?
তিনি বললেন, ভালো আছি।
আপনার জন্যে কয়েকটা জিনিস। এনেছি। মাজেদা খালা পাঠিয়েছেন।
ডিকশনারি কি আছে?
হ্যাঁ আছে।
একটু কষ্ট করে দেখবে ডিকশনারিতে ‘তুতুরি’ বলে কোনো শব্দ কি আছে? তুমি কি এই শব্দ আগে শুনেছ?
না।
প্লিজ খুঁজে দেখো। তোমাকে তুমি তুমি করে বলছি বলে ভেবে বসবে না আমি তোমাকে অবজ্ঞা করছি। তুমিও আমাকে তুমি বলতে পারো, কোনো সমস্যা নেই। বাংলা একটা স্ট্রেঞ্জ ভাষা—আপনি তুমি তুই।
আমি বললাম, জাপানি আরও খারাপ ভাষা, সেখানে পাঁচ সম্বোধন। অতি সম্মানিত আপনি, সম্মানিত আপনি, তুমি, তুই, নিম্নশ্রেণীর তুই।
বল্লুটুভাই ‘Oh God!’ বলে গরম চা খানিকটা বিছানায় ফেলে দিলেন। এখন তাকে শিশুদের মতো অপ্ৰস্তুত দেখাচ্ছে।
আমি ডিকশনারি খুলে বললাম, শব্দটা আছে। এর অর্থ ‘সাপুড়ের বাঁশি’।
গুড। ভেরি গুড।
আমি বললাম, আপনি চামচে করে চা খাচ্ছেন কেন?
ঠোঁট পুড়ে গেছে। গরম কাপ ঠোঁটে লাগাতে পারছি না। এইজন্যে চামচে খাচ্ছি। ঠোঁট কীভাবে পুড়েছে জানতে চাও?
না। ‘তুতুরি’ দিয়ে কী করবেন?
কিছু করব না। অর্থটা শুধু জানলাম। তুতুরি একটা মেয়ের নাম। আমি মেয়েটার কাছে তার নামের অর্থ জানতে চাইলাম। সে অর্থ বলতে পারল না।
এরপর যখন তার সঙ্গে দেখা হবে, তাকে নামের অর্থ বলে দেব। সে নিশ্চয়ই খুশি হবে। তোমার কি ধারণা, খুশি হবে না?
খুশি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কম কেন?
আপনি তাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন, তুমি মুর্থ মেয়ে, নিজের নামের অর্থ জানো না। এটা তার ভালো লাগার কথা না।
তাহলে ওই প্ৰসঙ্গ থাক। নামের অর্থ বলার দরকার নেই। একটা কাজ করলে কেমন হয়—বাংলা ডিকশনারিটা তাকে উপহার দিয়ে যদি বলি, এই মেয়ে, দেখো তো তোমার নামের অর্থ খুঁজে পাও কি না। এই বুদ্ধি তোমার কাছে কেমন মনে হচ্ছে?
বল্টুভাইকে আমার কাছে মোটামুটি স্বাভাবিক মানুষ বলেই মনে হলো। তবে আমার প্রতি তাঁর আচরণে কিছুটা অস্বাভাবিকতা আছে। আমি তাঁর কাছে নিতান্তই অপরিচিত একজন। তিনি আমার সঙ্গে এমন আচরণ করছেন যেন আমি তাঁর অতি পরিচিত একজন। এত পরিচিত যে তাকে বল্টুভাই ডাকতে পারে।
বল্টুভাই বললেন, একটু কি কষ্ট করে দেখবে ‘ফুতুরি’ বলে কোনো শব্দ আছে কি না?
আমি ডিকশনারি উল্টেপাল্টে বললাম, নাই।
বল্টুভাইয়ের চোখমুখ হঠাৎ খানিকটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, বাংলায় নতুন একটি শব্দ যুক্ত করলে কেমন হয়? ফুতুরি!
এর অর্থ কী?
ফুঁ দিয়ে যে বাঁশি বাজায়—ফুতুরি। বাঁশি, সানাই, ব্যাগপাইপ, ট্রাম্পেট সব হবে ফুতুরি গ্রুপের বাদ্যযন্ত্র। তোমার কাছে কি পরিষ্কার হয়েছে? নাকি আরও পরিষ্কার করব?
পরিষ্কার হয়েছে।
নতুন নতুন শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডারে যুক্ত করা প্রয়োজন।
অবশ্যই প্রয়োজন।
বল্টুভাইয়ের চোখ চকচক করে উঠল। নিশ্চয়ই নতুন কিছু মাথায় এসেছে। এই শ্রেণীর মানুষ আমি আগেও দেখেছি। মুখে কথা বলার আগে এদের চোেখ কথা বলে। সারাক্ষণ মাথায় নতুন নতুন আইডিয়া আসতে থাকে।
বল্টুভাই বললেন, তুমি ডিকটেশন নিতে পারো? আমি বলব, তুমি লিখবে। পারবে না?
পারব।
টেবিলের ড্রয়ারে হোটেলের কাগজ আছে, কলম আছে। কাগজ-কলম নিয়ে টেবিলে বসো। আমি খুবই লজ্জিত, তোমার নাম ভুলে গেছি।
আপনার লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। আমি এখনো আপনাকে নাম বলার সুযোগ পাই নি। আমার নাম হিমু।
হিমু, তুমি কি তৈরি? ডিকটেশন দেওয়া শুরু করব?
করুন।
লিখো—
সভাপতি
বাংলা একাডেমী
শ্রদ্ধাভাজনেষু।
বিষয়; বাংলা শব্দভাণ্ডারে নতুন শব্দ সংযোজন।
জনাব,
ফুতুরি নামের একটি শব্দ আমি বাংলা শব্দভাণ্ডারে যুক্ত করতে চাচ্ছি। ফুঁ দিয়ে যেসব বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয় তাদের সাধারণ নাম হবে ফুতুরি। যেমন, বাঁশি, সানাই, ট্রাম্পেট, ব্যাগপাইপ।
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্ৰহণ করে আমাকে বাধিত করুন।
বিনীত
বল্টু
আমি বললাম, বল্টু নাম ব্যবহার করবেন? পোশাকি নামটা দিন।
তিনি বললেন, তুমি বল্টুভাই বল্টুভাই করছ তো, এ জন্যে মাথায় বল্টু নামটা ঘুরছিল। বল্টু কেটে দিয়ে আমার ভালো নাম দিয়ে দাও—চৌধুরী আখলাকুর রহমান। তবে বল্টু নামটা আমার পছন্দের। আমি যখন স্বপ্নে নিজেকে দেখি, তখন সবাই আমাকে বল্টু ডাকে। স্বপ্ন-বিষয়ে তোমাকে একটা ইন্টারেষ্টিং তথ্য দিতে পারি। দেব?