তুতুরি বলল, আপনি আবার তুমি বলা শুরু করেছেন।
আমি বললাম, সরি। আপনি-তুমি চক্র ভুলে গিয়েছিলাম। আর ভুল হবে না।
তুতুরি বলল, আপনি কি আপনার মাজেদা খালার খোঁজ নিয়েছিলেন?
নিয়েছিলাম। তবে তার সঙ্গে কথাবার্তা হয় নি। তিনি আমাকে ত্যাজ্য করেছেন। ত্যাজ্য করেই ক্ষান্ত হন নি, আমাকে হারামজাদাও বলেছেন।
আপনি মনে হয় তাতে খুশি। হ্যাঁ খুশি।
কেন খুশি তা কি জানতে পারি?
আমি দার্শনিকের ভঙ্গিতে বললাম, একজন মানুষের অনেক পরিচয় থাকে। মানুষ নিজেও সব পরিচয় সম্পর্কে জানে না। যে যত বেশি জানে ততই তার জন্যে মঙ্গল। আমার মধ্যে একজন হারামজাদাও আছেন, এটা জেনে ভালো লাগছে।
হারামজাদা ছাড়া আপনার ভেতর আর কী আছে?
সেটা আমার বলা ঠিক হবে না। আমার আশপাশে যারা আছে তারা বলবে।
তুতুরি বলল, আমি আপনার বিষয়ে মাজেদা খালার কাছে জানতে চেয়েছিলাম।
কী বলেছেন?
আপনার খালার ধারণা। আপনি অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন।
ভুঁয়া কথা।
তুতুরি বলল, আমি জানি ভুঁয়া কথা। মানুষ কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে আসে না। দুষ্টুমি করার ক্ষমতা নিয়ে আসে। কুকর্ম করার ক্ষমতা নিয়ে আসে। আপনি নিশ্চয়ই অনেক কুকর্ম করেছেন।
আমি বললাম, এখনো করি নি, তবে করব। একজনকে জন্মের শিক্ষা দেব, সেটা তো কুকর্মের মতোই।
কাকে শিক্ষা দেবেন?
আপনার পরিচিত একজনকে।
তুতুরি অবাক হয়ে বলল, সে কে?
এখনো বুঝতে পারছি না। সে কে। ভাসা ভাসা ভাবে মনে হচ্ছে, সে তোমার অংকের শিক্ষক। সরি, তুমি বলে ফেলেছি।
তুতুরি বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, আমার এই শিক্ষকের কথা আপনাকে কে বলেছে? নিশ্চয়ই কেউ-না-কেউ বলেছে। আপনি অলৌকিক ক্ষমতায় বিষয়টা জেনেছেন-এটা আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করব না।
আমি বললাম, খামাখা কেন বিশ্বাস করবে? পৃথিবী অবিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম বাসস্থান। তুমি বরং এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দাও হুজুরের জন্য, নিয়ে চলে যাই।
তুতুরি বলল, সিগারেট আমি আপনাকে কিনে দিচ্ছি, তার আগে প্লিজ বলুন, কেথেকে জেনেছেন? কে বলেছে আপনাকে?
তুমি বলেছ।
আমি কখন বললাম?
মনে মনে বলেছ। আমি মনে মনে বলা কথা হঠাৎ হঠাৎ বুঝতে পারি।
এই মুহুর্তে আমি মনে মনে কী বলছি বলুন।
তুমি মনে মনে বলছি, হিমু নামের মানুষটা ভয়ঙ্কর এক শয়তান। এর কাছ থেকে সব সময় এক শ’ হাত দূরে থাকতে হবে। তুমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দাও, আমি এক শ’ হাত দূরে চলে যাচ্ছি।
আপনি তো আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছেন।
আমি বললাম, কনফিউজড অবস্থায় থাকা ভালো। প্রকৃতি চায় না। আমরা কোনো বিষয়ে পুরাপুরি নিশ্চিত হই। হাইজেনবার্গের Uncertainity principle নিশ্চয়ই জানেন। ব্যাখ্যা করব?
তুতুরি বলল, আপনাকে আর কিছু ব্যাখ্যা করতে হবে না। সিগারেট কিনে দিচ্ছি, বিদায় হোন।
হুজুরের সামনে সিগারেটের প্যাকেট রাখতেই হুজুর বললেন, অজু করে ফেলো। আছরের নামাজের ওয়াক্ত হয়েছে। অজুর নিয়মকানুন জানো তো? কঠিন নিয়ম। উনিশ-বিশ হলে কিন্তু নামাজ হবে না। আমাকে দেখো—পা নাই, তারপরেও অজুর সময় পা যেখানে ছিল সেই জায়গা ধুই! পায়ের আঙুলের ফাঁকে পানি দেই।
আমি বললাম, হুজুর!! দুপুরে কিছু খেয়েছেন?
হুজুর বললেন, না। খাওয়া খাদ্যের সমস্যা হচ্ছে। এইজন্যে গত রাতে নিয়ত করে রোজা রেখে ফেলেছি। রোজা রাখায় খাওয়াদাওয়ার সমস্যা কিছু কমল, আবার সোয়াবের খাতায় জমা পড়ল। কাজটা ভালো করেছি না?
অবশ্যই ভালো করেছেন। সিগারেট ধরাচ্ছেন কেন? রোজা নষ্ট হবে না?
ধোঁয়াজাতীয় কিছুতে রোজা নষ্ট হয় না। গাড়ির ধোঁয়া নাকে গেলে রোজা নষ্ট হয় না। ফুলের গন্ধ নাকে গেলেও রোজা নষ্ট হয় না।
এমন কোনো মোসালা কি আছে?
এটা আমার মোসালা।
চিন্তাভাবনা করে বের করেছি। এখন বাবা যাও, এক কাপ চা এনে দাও।
চা খেলে রোজা ভাঙবে না?
চায়ের গন্ধটা নাকে নিব। চায়ের গন্ধের সঙ্গে সিগারেট খাব। আরেকটা মাসালা শোনো, তৃপ্তির সাথে কিছু খেলেও রোজার সোয়াব লেখা হয়।
আপনি তো হুজুর প্রচুর সোয়াব জমা করে ফেলেছেন।
হুজুর বললেন, তা করেছি। একজীবনে একটা বড় সোয়াব করাই যথেষ্ট। ব্যাংকে টাকা যেমন বাড়ে, আল্লাহর ব্যাংকে সোয়াবও বাড়ে। লাইলাতুল কদরে আল্লাহপাক সব জমা সোয়াব ডাবল করে দেন। বিরাট সোয়াব একটা করেছি যৌবন বয়সে।
কী সোয়াব?
এটা বলা যাবে না। সোয়াবের গল্প করলে আল্লাহপাক সঙ্গে সঙ্গে সোয়াব অর্ধেক করে দেন। দুইজনের সঙ্গে গল্প করলে সোয়াব অবশিষ্ট থাকে চাইরের এক অংশ। তিনজনের সঙ্গে গল্প করলে থাকে মাত্র আটের এক অংশ।
আপনি কারও কাছেই কী বড় সোয়াব করেছেন এটা বলেন নাই?
নাহি। সোয়াব যতটুকু করেছি, সবটা আল্লাহপাকের দরবারে জমা আছে। প্রতি বছর বাড়তেছে। যাও বাবা, চা-টা নিয়ে আসো, তৃপ্তি করে সিগারেট খেয়ে আরেকটা সোয়াব হাসিল করি। যা করে তৃপ্তি পাওয়া যায়, তাতেই সোয়াব।
খাদেম (পীর বাচ্চাবাবার মাজার)
হিমু আজু করছে। অজু করা দেখে মনটা খারাপ হয়েছে। অনেক ভুলভ্রান্তি। ডান পা আগে ধুবে, তারপর বাম পা। সে করেছে উল্টা। তিনবার কুলি করার জায়গায় সে করেছে চারবার। হাতের কনুই পর্যন্ত অজুর পানি পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। এইসব বরখেলাফ আল্লাহপাক পছন্দ করেন না। হিমুকে ধরে ধরে সব শিখাতে হবে। সে ছেলে ভালো। আদব-কায়দা জানে। আমার প্রতি তার আলাদা নজর আছে। রোজা রেখেছি শুনেই আমার মোবাইল নিয়ে কাকে যেন বলল, হুজুর রোজা রেখেছেন। হুজুরের জন্যে ইফতার আর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।