বলেন কী? অদ্ভুত তো।
অদ্ভুতেরও অদ্ভুত। আমি নতুন নতুন জায়গায় যাচ্ছি, আর মুখে বলছি— অনিকেত।
অনিকেত আবার কী?
বাংলা শব্দ। ডিকশনারি ছিড়ে ফেলেছি বলে মানে জানতে পারছি না।
আমি আনন্দিত ভঙ্গিতে বললাম, ইলেকট্রন বাংলা ভাষায় কথা বলে জেনে ভালো লাগছে। যাই হোক, স্যার কি সকালের নাশতা খেয়েছেন?
এক মগ ব্ল্যাক কফি খেয়েছি। ঘুম ভাঙার পর থেকে আমি চিন্তায় অস্থির। ব্রেকফাস্ট করব কী!
আমি বললাম, যে যে লাইনে থাকে তার স্বপ্নগুলি সেই লাইনেই হয়। মাছ যে বিক্রি করে, তার বেশির ভাগ স্বপ্ন হয় মাছ নিয়ে। রুই মাছ, পুটি মাছ, বোয়াল মাছ। আপনি ইলেকট্রন প্রোটন নিয়ে আছেন, এইজন্য ইলেকট্রন প্রোটন স্বপ্ন দেখছেন।
বোকার মতো কথা বলবে না হিমু। আমি ইলেকট্রন প্রোটন স্বপ্নে দেখছি না। আমি ইলেকট্রন হয়ে যাচ্ছি। মাছওয়ালা কখনোই স্বপ্নে দেখে না সে একটা বোয়াল মাছ হয়ে গেছে। বিলো সে দেখে?
সেই সম্ভাবনা অবশ্যি কম।
ইলেকট্রন হয়ে যাওয়া যে কী ভয়াবহ তা তুমি বুঝতেই পারিছ না। চিন্তা করতে পারো, আমি একটা ওয়েভ ফাংশান হয়ে গেছি! ওয়েভ ফাংশান কী জানো?
জি-না স্যার।
কাগজ-কলম আনো, চেষ্টা করে দেখি তোমাকে বোঝাতে পারি কি না।
জটিল অংক আমার মাথায় ঢুকবে না স্যার।
বোকার মতো কথা বলবে না। অংক মোটেই জটিল কিছু না। অংক খুবই ৷ সহজ। অংকের পেছনের কিছু ধারণা জটিল।
পরবর্তী আধা ঘণ্টা আমি অনেক রকম অংক দেখলাম। স্যার খাতায় অনেক আঁকিবুকি করে একসময় নিজের অংকে নিজেই অবাক হয়ে বললেন, এটা কী?
আমি বললাম, কোনটা কী?
স্যার জবাব দিলেন না। নিজের অংকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তিনি এতক্ষণ আমাকে অংক বোঝাচ্ছিলেন না। নিজেকেই বোঝাচ্ছিলেন। আমি বললাম, স্যার, আপনার মাথার গিট্টু আন্ধা গিস্ট্রর রূপ নিচ্ছে। চলুন গিট্টু ছুটানোর ব্যবস্থা করি। কেরামত চাচার কাছে যাবেন?
স্যার লেখা থেকে চোখ না তুলে বললেন, কার কাছে যাব?
কেরামত চাচার কাছে। উনি হাসি-তামাশা করে আপনার মাথার গিট্টু ছুটিয়ে দিবেন। আপনাকে তার কথা আগেও বলেছি।
স্যার বললেন, আমি একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি। এখন আমাকে বিরক্ত করবে না।
জি আচ্ছা স্যার।
চুপ করে বসে থাকো, নড়বে না।
আমি চুপ করে বসে আছি। স্যারের হাতে কলম। তিনি কলম দিয়ে কিছু লিখতে যাচ্ছেন, আবার না লিখে কলম হাতে সরে আসছেন। আমি মোটামুটি মুগ্ধ হয়েই তার কলম ওঠানামা দেখছি।
হিমু, তুমি অধ্যাপক ফাইনম্যানের নাম শুনেছ?
জি-না স্যার।
তিনি ইলেকট্রন নিয়ে ডিরাক (Dirac)-এর মূল কাজ পরীক্ষা করতে গিয়ে অদ্ভুত একটা বিষয় দেখতে পান। তিনি ডিরাকের সমীকরণে সময়ের প্রবাহ উল্টো করে দেখলেন, সমীকরণ যে রূপ নেয় ইলেকট্রনের চার্জ উল্টে দিলেও একই রূপ নেয়। অদ্ভুত না?
আপনি যখন বলছেন তখন অবশ্যই অদ্ভুত।
আমি বলব কেন? প্রফেসর ফাইনম্যান নিজেই বলেছেন অদ্ভুত।
জি জি বুঝতে পারছি।
কেন অদ্ভুত সেটা বুঝতে পারছি?
জি-না স্যার।
অদ্ভুত, কারণ এই সমীকরণের সমাধান বলছে ইলেকট্রন সময়ের উল্টোদিকে চলে যাচ্ছে।
স্যার বলেন কী?
তুমি ‘স্যার বলেন কী’ বলে যেভাবে চিৎকার করলে, তা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারছি, তুমি কিছুই বুঝতে পারো নি। অবশ্যি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। অ্যাবসট্রাক্ট বিষয় বোঝা যায় না। তুমি কি আমার একটা উপকার করবে?
অবশ্যই করব।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। তুতুরি নামের একটা মেয়ের কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার এখানে আসার কথা। সে যেন আসতে না পারে।
আমি বললাম, দরজা বন্ধ করে সাইনবোর্ড বুলিয়ে দেই—Don’t Disturb.
আমার ক্লস্টোফোবিয়া আছে। সব সময় দরজা-জানোলা কিছুটা খোলা রাখি। মূল দরজা বন্ধ করা যাবে না। রুমের টেলিফোন লাইনটা কেটে দাও। জটিল সময়ে টেলিফোন বেজে উঠলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে।
আমি দরজার বাইরে। তুতুরির অপেক্ষা করছি। দরজার ফাঁক দিয়ে স্যারের দিকেও নজর রাখছি। স্যার কলম হাতে ওঠানামা করেই যাচ্ছেন। কলম এখনো কাগজ স্পর্শ করে নি। কে জানে কখন করবে! দেখা যাবে সারা দিন ওঠানামা করে তিনি রাতে ঘুমুতে গিয়ে আবার ইলেকট্রন হয়ে যাবেন। ইলেকট্রন হয়ে সময়ের উল্টোদিকে চলে যাবেন।
তুতুরি দরজার বাইরে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুবই অবাক হলো। বল্টু স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্কের বিষয়টা সে মনে হয় জানে না। তুতুরি বলল, আপনি এখানে কী করছেন?
আমি বললাম, যা বলার ফিসফিস করে বলুন। গলা উচিয়ে কথা বলা নিষেধ।
কার নিষেধ?
স্যারের নিষেধ। স্যার কাল রাতে ইলেকট্রন হয়ে গিয়েছিলেন, এখন অবশ্যি স্বাভাবিক অবস্থায় আছেন। তবে কতক্ষণ স্বাভাবিক থাকেন কে জানে! হয়তো আবার ইলেকট্রন হয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে সময়ের বিপরীত দিকে চলে যাবেন। সময়ের বিপরীতে যাওয়া স্যারের জন্যে সুখকর না হওয়ার কথা।
তুতুরি চোখ কপালে তুলে বলল, হড়বড় করে কী বলছেন? যা বলার পরিষ্কার করে বলুন।
আমি বললাম, বিজ্ঞানের জটিল কথা তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলতে পারব না। চলুন কোথাও বসে চা খেতে খেতে বলি। এক হাজার টাকার নোট কি আপনার কাছে আরও আছে?
তুতুরি বেশ কিছু সময় আমার চোখে চোখ রেখে একসময় বলল, আছে।
আমি এবং তুতুরি রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের সামনে। আমাদের একটা টুল দেওয়া হয়েছে। টুলটা লম্বায় খাটো। দু’জনের বসতে সমস্যা হচ্ছে। গায়ের সঙ্গে গা লেগে যাচ্ছে। তুতুরির অস্বস্তি দেখে আমি চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে গেলাম। তুতুরির দিকে তাকিয়ে বললাম, আরাম করে বসো।