যখন বুঝলাম বদ হিমু ফিরবে না, তখন লজ্জা-অপমান ভুলে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। গোপনে বাথরুমে ঢুকব। গোপনে বের হয়ে আসব। মনে মনে বলছি, হে আল্লাহপাক, মানুষটার সঙ্গে যেন দেখা না হয়। দরজা যেন খোলা পাই। যদি দেখি দরজা খোলা, যদি মানুষটার সঙ্গে দেখা না করে বের হয়ে আসতে পারি তাহলে একটা মুরগি ছদগা দিব। তিনজন ফকির খাওয়াব।
দরজা খোলা ছিল, ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখি, মানুষটা ইজিচেয়ারে কাত হয়ে আছে। গড়গড় শব্দ হচ্ছে। হার্ট অ্যাটাক নাকি? আমি বললাম, তোমার কী হয়েছে? সে জবাব দিতে পারল না, গোঙানির মতো শব্দ করল। তার সারা শরীর ঘামে ভেজা। মাথায় হাত দিয়ে দেখি মাথা বরফের মতো ঠান্ডা।
আমি তাকে কীভাবে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম তা বলতে পারব না। মহাবিপদের সময় সব এলোমেলো হয়ে যায়। মোবাইল ফোন খুঁজে পাওয়া যায় না, হাসপাতালের টেলিফোন নম্বর যে খাতায় লেখা সেই খাতা খুঁজে পাওয়া যায় না, ঘরে তখনই শুধু ক্যাশ টাকা থাকে না, ড্রাইভার বাসায় থাকে না, আর থাকলেও গাড়ি স্টার্ট নেয় না। গাড়ির চাবি লক হয়ে যায়।
হাসপাতালে ডাক্তাররা যমে-মানুষে টানাটানির মতোই করল। নতুন নতুন ওষুধপত্র বের হওয়ায় যমের শক্তি কমে গেছে। একসময় ডাক্তার বলল, মনে হয়। বিপদ কেটে গেছে। ম্যাসিভ হার্টঅ্যাটাক হয়ে গেছে। আর দশ মিনিট দেরি হলে রোগী বাঁচানো দুঃসাধ্য ছিল। আপনার হাজব্যান্ড ভাগ্যবান মানুষ। হেপারিন নামের ড্রাগটা খুব কাজ করেছে।
হঠাৎ মনে হলো, হিমু সাবান-পানি নিয়ে আসে নাই বলে মানুষটা বেঁচে গেল। হিমু কি কাজটা জেনে শুনে করেছে? ফুটপাতে কাঁচা গুয়ে পাড়া না পড়লে আমি চলে যেতাম। মানুষটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মরে পড়ে থাকত। মানুষটার বেঁচে থাকার পেছনে ফুটপাতের হাগুরও বিরাট ভূমিকা। এই দুনিয়ার অদ্ভূত হিসাবনিকাশ। কী থেকে কী হয় কে জানে!
আমি সিসিইউ-র সামনের বেঞ্চিতে বাসা। রাত তিনটার উপর বাজে। ডাক্তার এসে বলল, আপনার হাসবেন্ডের জ্ঞান ফিরেছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে।
আমি মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষটা এমন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। কী যে মায়া লাগছে! সে ক্ষীণ গলায় বলল, মাজেদা, ভালো আছ?
আমি বললাম, আমি যে ভালো আছি তা তো দেখতেই পারছি। তুমি কেমন আছ?
সে বলল, বুকের ব্যথাটা নাই।
আমি বললাম, কথা বলতে হবে না। চোখ বন্ধ করে ঘুমাও।
সে বলল, মরে টরে যদি যাই, একটা কথা তোমাকে বলা দরকার। তুমি এটা জানো না। যে অ্যাপার্টমেন্টে আমরা থাকি, সেটা তোমার নামে কেনা। উত্তরাতে আমার আরেকটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে। সেটাও তোমার নামে কেনা। তোমাকে বলা হয় নাই, সরি।
এখন চুপ করো তো। শুনলাম।
সে বলল, তোমার অ্যাপার্টমেন্টে দেয়াল টেয়াল ভেঙে কী করতে চাও করবে। আমার বলার কিছু নাই। ওই মেয়ে তুতুরি না। কী যেন নাম তাকে কাজ শুরু করতে বলো।
তোমার শরীর কি এখন যথেষ্ট ভালো বোধ হচ্ছে?
হুঁ। শুধু স্মেল সেন্সে সমস্যা হয়েছে। তুমি যে সেন্ট মাখো তার গন্ধ পাচ্ছি। না। তোমার গা থেকে কঠিন গুয়ের গন্ধ পাচ্ছি।
মানুষটার কথা শুনে মনে পড়ল, আমি নোংরা পায়েই ছোটাছুটি করছি। এখন পর্যন্ত পা ধোঁয়া হয় নি।
আমার ইচ্ছা ছিল সারা রাতই মানুষটার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা, সম্ভব হলো না। আমাকে বের করে দিল।
বারান্দায় এসে দেখি হিমু বদটা দাঁড়য়ে আছে। হাতে নতুন কেনা গামছা, লাইফবয় সাবান, একটা স্যাভলন। হিমু বলল, পা নিশ্চয়ই এখনো পরিষ্কার হয় নি। তোমার গা থেকে খোলা পায়খানার গন্ধ আসছে।
আমি বললাম, তুই জীবনে কখনো কোনোদিনও এক সেকেন্ডের জন্যে আমার সামনে পড়বি না। তোকে আমি ত্যাজ্য করলাম।
হিমু নির্বিকার গলায় বলল, খালু সাহেবের অবস্থা কী আগে বলে। সে কি স্টেবল?
আমি বললাম, আমার সঙ্গে কোনো কথা বলবি না। চুপ হারামজাদা।
হিমু হেসে ফেলল। আচ্ছা, একজন পুরুষমানুষ এত সুন্দর করে কীভাবে হাসে? আমার বলতে ইচ্ছা করছে, কাছে আয়। মাথায় চুমু দিয়ে আদর করে দেই। তা না বলে বললাম, Go to hell! আমার স্বামীর কাছ থেকে শোনা বাক্য।
হিমু আবারও আগের মতোই সুন্দর করে হাসল।
বল্টু স্যারের ঘরের দরজা
বল্টু স্যারের ঘরের দরজা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। ভেতরে কী হচ্ছে বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখা যায়। আমি উঁকি দিতেই বল্টু স্যার বললেন, হিমু, প্লিজ গেট ইন।
স্যার যেভাবে বসে আছেন, আমাকে তার দেখার কথা না। তার সামনে আয়নাও নেই যে আয়নায় আমাকে দেখবেন। সব মানুষই কিছু রহস্য নিয়ে জন্মায়।
আমি ঘরে ঢুকতেই স্যার বললেন, গত রাতে অকল্পনীয় এক ঝামেলা গেছে। কী হয়েছে মন দিয়ে শোনো। ঘুমুতে গেছি। রাত দশটা একুশ মিনিটে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম; ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম আমি ইলেকট্রন হয়ে গেছি।
কী হয়ে গেছেন?
ইলেকট্রন। ইলেকট্রন চেনো না?
চিনি।
ইলেকট্রন হয়ে নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছি।
আমি বললাম, আপনার তো তাহলে ভয়ংকর অবস্থা।
বল্টুভাই বললেন, ভয়ংকর অবস্থা তো বটেই। তবে আমি কণা হিসেবে ছিলাম না, তরঙ্গ হিসেবে ছিলাম।
ইলেকট্রন হওয়ার পর আপনার ঘুম ভাঙল?
না, আমি সারা রাত ইলেকট্রন হিসেবেই ছিলাম। এখানে-ওখানে ছোটাছুটি করেছি। বর্ণনা করার বাইরের অবস্থা। কখনো যে বিছানায় শুয়ে ছিলাম তার খাটে ঢুকে যাচ্ছি। একবার আয়নায় ঢুকে নিজের মিরর ইমেজ দেখলাম।