আমার কলেজ জীবনের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শর্মিলা এমন একজনের ফাঁদে পড়েছিল। যিনি ফাঁদ পেতেছিলেন, তিনি আমাদের অংক স্যার জহির খন্দকার। জহির খন্দকার সুপুরুষ ছিলেন না, কিন্তু সুকথক ছিলেন। অংক ভালো শেখাতেন। অংকের সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ির পুকুরে নাকি একটা মাছ আছে, সেই মাছের মুখ দেখতে অবিকল মানুষের মতো। স্যার বললেন, তোমরা কেউ দেখতে আগ্রহী হলে আমার সঙ্গে যেতে পারো। আমরা সবাই বললাম, স্যার দেখতে চাই দেখতে চাই। মুখে বলা পর্যন্তই, স্যারের বাড়ি বরিশালের এক গ্রামে। সেখানে গিয়ে মানুষের মতো মাছ দেখার প্রশ্ন ওঠে না।
শৰ্মিলা আলাদাভাবে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করল এবং কাউকে কিছু না জানিয়ে মানুষের মতো মাছ দেখতে গেল। সে সাত-আট দিন স্যারের সঙ্গে থেকে ফিরে এল, তারপর পরই ইন্টারনেটে তার যৌনকর্মের ভিডিও চলে এল। ভিডিওতে তার পুরুষসঙ্গী যে জহির স্যার তা বোঝা যায় না। কারণ পুরুষসঙ্গী সচেতনভাবেই অন্ধকারে নিজের চেহারা আড়াল করেছিল।
শৰ্মিলা দুই ফাইল ডরমিকাম খেয়ে আত্মহত্যা করে। দুই ফাইলের কথা আমি জানি, কারণ ডরমিকাম কেনার সময় আমি তার সঙ্গে ছিলাম। রাতে ঘুম হয় না। বলে এতগুলো ডরমিকাম সে কিনেছিল। স্যারের সঙ্গে তার কী কী হয়েছিল শৰ্মিলা সবই আমাকে জানিয়েছিল। স্যারের এক বন্ধুও যুক্ত ছিল। সেই বন্ধুর চোখ কটা এবং থুতনিতে একটা দাগ। বন্ধুর নাম পরিমল এবং তার বন্ধু পরিমল নিশ্চয়ই আরও অনেক বেকুব মেয়েকে মানুষের মতো দেখতে সেই অদ্ভুত মাছ দেখিয়েছেন। তিনি একটা কোচিং সেন্টারও শুরু করেছেন। কোচিং সেন্টারের নাম ‘ম্যাথ হাউজ’। ম্যাথ হাউজে মেয়ের সংখ্যাই বেশি। স্যারের জন্যে সুবিধাই হয়েছে।
কোচিং সেন্টারে আমি একদিন জহির স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করলেন। শৰ্মিলার মৃত্যুসংবাদ শুনে ব্যথিত গলায় বললেন, আহারে, কীভাবে মারা গেল! ঘুমের ওষুধ খেয়ে মারা গেছে শুনে তিনি হতাশ গলায় বললেন, মেয়েগুলো এত বোকা কেন? মৃত্যু কোনো সলিউশন হলো! লাইফকে ফেস করতে হয়।
আমি বললাম, স্যার, শৰ্মিলার খুব ইচ্ছা ছিল আপনার গ্রামের বাড়ির পুকুরের মাছটা দেখতে, যেটার মুখ দেখতে মানুষের মতো।
স্যার বললেন, এই শখ ছিল জানতাম না তো। জানলে নিয়ে যেতাম।
আমি বললাম, আমাকে কি নিয়ে যাবেন স্যার? আমারও খুব শখ। আমি বন্ধুর হয়ে তার শখ মিটাব।
স্যার বললেন, সত্যি যেতে চাও?
আমি বললাম, অবশ্যই। তবে গোপনে যাব স্যার। জানাজানি যেন না হয়। আমাদের দেশের মানুষ তো খারাপ, আপনার সঙ্গে যাচ্ছি, শিক্ষক পিতৃতুল্য, তারপরেও নানান কথা উঠবে।
স্যার বললেন, তোমার টেলিফোন নম্বর রেখে যাও, ব্যবস্থা করতে পারলে খবর দিব। কোচিং সেন্টার নিয়ে এমন ঝামেলায় আছি, সময় বের করাই সমস্যা।
কষ্ট করে একটু সময় বের করবেন স্যার প্লিজ।
স্যার বললেন, একটা কাজ করা যায়, বাই রোডে বরিশাল যাওয়া যায়। একটা রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কিনেছি, সকাল সকাল রওনা দিলে রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে পৌঁছে যাব। এক রাত থেকে পরদিন চলে এলাম, ঠিক আছে? ওই বাড়িতে আমার মা থাকেন। তুমি রাতে মা’র সঙ্গে ঘুমালে।
আমি বললাম, এক রাত কেন! আমি কয়েক রাত থাকব। কত দিন গ্রামে যাই না। বরিশাল হচ্ছে জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ভূমি, ভাবতেই কেমন লাগছে!
স্যার বললেন, তোমরা শহরের মেয়েরা গ্রাম থেকে দূরে সরে গেছ, এটা একটা আফসোস। গ্রামে যেতে হয়। ফার ফ্রম দ্যা মেডিং ক্রাউন্ড। আমার এক বন্ধু আছে, নাম পরিমল। একটা কোচিং সেন্টারে অংক পড়ায়। পনের দিনে একবার সে গ্রামে যাবেই।
আমি বললাম, হাউ। সুইট!
স্যার বললেন, পরিমল ট্যালেন্টেড ছেলে। বাংলা একাডেমী থেকে তার বই বের হচ্ছে—বাংলার ঐতিহ্য সিরিজের বই। একটার কম্পোজ চলছে, সে প্রুফ দেখছে। আরেকটার পাণ্ডুলিপি জমা পড়েছে।
বলেন কী স্যার!
তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব! কথা বললে তোমার ভালো লাগবে। তার মাথায় নতুন আইডিয়া এসেছে—ঢাকার মাজার। এই নিয়ে বই লিখছে। তার ইচ্ছা! মুনতাসির মামুন সাহেবের সঙ্গে কলাবরেশনে বইটা করা। মামুন সাহেব রাজি হচ্ছেন না।
রাজি হচ্ছেন না কেন?
নিজেকে বিরাট ইন্টেলেকচুয়েল ভাবেন তো, এইজন্যে রাজি হচ্ছেন না। খ্যাতি শেয়ার করতে চান না। যাই হোক, ঢাকার মাজার সম্পর্কে তুমি যদি কিছু জানো তাহলে পরিমলকে জানিয়ো, সে খুশি হবে। তোমার নামও বইয়ে চলে আসতে পারে।
আমি বললাম, তাহলে তো স্যার খুবই ভালো হয়। আপনার সঙ্গে কথা বলে এত ভালো লাগছে। এখন যাই।
যাও। খুব ভালো লাগল। তোমার সঙ্গে কথা বলে। খুব শিগগিরই একটা তারিখ করব। আমি, তুমি আর পরিমল।
স্যার কয়েকবার তারিখ ফেলেছেন, আমি নানা অজুহাত দেখিয়ে পাশ কাটিয়েছি। তবে আমি যাব শয়তানটাকে শিক্ষা দিব। আমার বিশেষ পরিকল্পনা আছে। আচ্ছা হিমুটাকে কি সঙ্গী করা যায়? পরিকল্পনা আমার, বাস্তবায়ন করবে হিমু।
শুধু শয়তানটাকে না, আমার সব পুরুষ মানুষকেই শিক্ষা দিতে ইচ্ছা করে। কারণ সব পুরুষের ভেতরই শয়তান থাকে। ছোট শয়তান, মাঝারি শয়তান, বড় শয়তান। চেহারা দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। যে যত বড় শয়তান, তার চেহারা ততটাই ‘ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারি না’-টাইপ। মেয়েদের প্রতি মনোভাব একজন রিকশাওয়ালার যা, জহির খন্দকারেরও তা, হার্ভার্ডের ফিজিক্সের Ph.D.-রও তা। পদার্থবিদ্যার মাথা স্বয়ং আইনস্টাইনের একটি জারজ মেয়ে ছিল। মেয়ের নাম লিসারেল, তার মা’র নাম ম্যারিক। যেখানে স্বয়ং আইনস্টাইনের এই অবস্থা, সেখানে হার্ভার্ডের Ph.D. কী হবে বোঝাই যায়।