আপনি মাজারে কাজ করেন?
জি। হুজুরের পা দাবাই। মাজার ঝাড়পোছ দিয়ে পরিষ্কার করি। সন্ধ্যাবেলা মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালাই। ভালো কথা, আপনি কি আমাদের মাজারের জন্য সুন্দর একটা ডিজাইন করে দিতে পারেন? এমন একটা ডিজাইন হবে যেন মাজারে ঢোকামাত্ৰই আধ্যাত্মিক ভাব হবে। মন উদাস হবে। সৃষ্টির অসীম রহস্যের অনুভবে মন বিষণ্ণও হবে।
তুতুরি অবাক হয়ে বলল, আমি পীর বাচ্চাবাবা মাজারের ডিজাইন করব?
আমি বললাম, আপনারা আর্কিটেক্টরা যদি পেট্রলপম্পের ডিজাইন করতে পারেন, মাজারের ডিজাইন করতে অসুবিধা কী? পৃথিবী বিখ্যাত আর্কিটেক্টরা মাজার ডিজাইন করেছেন।
তুতুরি চোখ সরু করে বলল, কয়েকজনের নাম বলুন।
আমি বললাম, ইশা আফেন্দি।
তুতুরি বলল, আমি আর্কিটেকচারের ছাত্রী। ইশী আফেন্দির নাম প্রথম শুনলাম।
আমি বললাম, তাজমহল সম্রাট শাজাহানের স্ত্রীর মাজার ছাড়া কিছু না। তাজমহলের ডিজাইন করেন ইশা আফেন্দি। তিনি সম্রাটের চোখ এড়িয়ে গম্বুজে তার নাম লিখে গেছেন।
তুতুরি বলল, এই তথ্য জানতাম না।
আমি বললাম, অটোমান সাম্রাজ্যে একজন আটিটেক্ট ছিলেন, তার নাম সিনান। এই নাম তো আপনার জানার কথা।
হ্যাঁ জানি। উনার ডিজাইন আমাদের পাঠ্য।
সিনান অনেক মাজারের ডিজাইন করেছেন। এখন বলুন, আপনি কি আমাদের মাজারের ডিজাইন করে দেবেন?
তুতুরি বলল, আসুন আপনাকে চা খাওয়াচ্ছি, সিগারেটও কিনে দিচ্ছি। সত্যি কি আপনি মাজারে কাজ করেন? আমি কি আপনার মোবাইল নম্বর পেতে পারি?
আমার কোনো মোবাইল ফোন নেই। আমার হুজুরের নম্বরটা রেখে দিন। হুজুরের নম্বরে টেলিফোন করলেই আমাকে পাবেন, নম্বর দিব?
তুতুরি শান্ত গলায় বলল, দিন।
আমি চা খাচ্ছি, তুতুরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে বিস্ময় এবং বিরক্তি। বিরক্তির কারণ বুঝতে পারছি, বিস্ময়ের কারণ বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, চলুন আপনাকে পীর বাচ্চাবাবার মাজার শরিফ দেখিয়ে নিয়ে আসি। বিশেষ কোনো ডিজাইনের আগে আশপাশের স্থাপত্য দেখতে হয়।
তুতুরি বলল, দয়া করে আমাকে উপদেশ দেবেন না।
আমি বললাম, যারা উপদেশ নিতে পছন্দ করে না তারা উপদেশ দিতে পছন্দ করে। আপনি বরং আমাকে একটা উপদেশ দিন।
তুতুরি কঠিন মুখ করে বলল, উপদেশ চাচ্ছেন উপদেশ দিচ্ছি। কোনো মেয়ে। আপনাকে চা খাওয়াছে, তা থেকে ভেবে বসবেন না সে আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। মেয়েরা এত সহজে প্রেমে পড়ে না।
আমি বললাম, আমি এ রকম ভাবছি না। তা ছাড়া খালিপায়ে যে সব ছেলে হাঁটে কোনো মেয়ে তাদের প্রেমে পড়ে না।
তুতুরি অবাক হয়ে বলল, আপনি খালিপায়ে হাঁটেন নাকি? আশ্চর্য তো! আসলেই তো তা-ই। আমি আগে কেন লক্ষ করলাম না? খালিপায়ে হাঁটেন কেন?
জুতা নেই, এই কারণে খালি পা।
তুতুরি চোখ পিটপিট করছে। দ্রুত কিছু ভাবছে। কী ভাবছে অনুমান করতে পারছি। সে আমাকে একজোড়া জুতা কিনে দিতে চাচ্ছে।
আমি চায়ের কাপ নিয়েই দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম। তুতুরির কাছ থেকেও বিদায় নিলাম না। আমার ধারণা, তুতুরি এখন রাগে কিড়মিড় করছে।
আমি তুতুরি
আমি এই মুহুর্তে একটা সাড়ে বত্ৰিশভাজা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দোকানে সবই পাওয়া যায়। চা বিক্রি হচ্ছে, বিস্কুট-কলা বিক্রি হচ্ছে, পানসিগারেট বিক্রি হচ্ছে, বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি হচ্ছে, এক কোনায় প্যানথারের ছবি আঁকা কনডম সাজানো আছে।
আমার সামনে হিমু নামের একজন চায়ে টোস্ট বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। চায়ে চুমুক দেওয়ার আগে সে কপি কপি করে বড় একটা সাগরকলা নিমিষে খেয়ে ফেলেছে। চা, টোস্ট বিস্কুট, কলা আমি তাকে কিনে দিয়েছি। এক প্যাকেট বেনসন এন্ড হেজেস সিগারেট তার জন্যে কিনেছি। এই সিগারেট সে নিয়েছে তার বসের জন্যে। এই বস নাকি পীর বাচ্চাবাবা নামের এক মাজারের খাদেম। হিমু সেই খাদেমের খিদমতগার, সহজ বাংলায় চাকর। বিষয়টা আমার কাছে যথেষ্ট খটমটে মনে হচ্ছে। আমি প্রায় নিশ্চিত হিমু আমার সঙ্গে চালাবাজি করছে।
পুরুষদের জীনে নিশ্চয়ই চালবাজির বিষয়টা প্রকৃতি ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্ৰাণীজগতে নারী প্রাণীদের ভোলানোর জন্যে পুরুষ প্রাণীরা নানান কৌশল করে। নাচানাচি করে, ফেরোমেন নামের সুঘাণ বের করে, নানান বর্ণে শরীর পাল্টায়। মানুষের প্রকৃতিদত্ত এই সুবিধাগুলো নেই বলে সে চালবাজি করে মেয়েদের ভোলাতে চায়। তাদের প্রধান চেষ্টা থাকে আশপাশের তরুণীদের ভুলিয়ে এবং চমকে দিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। হিমু তা-ই করছে। প্রথম সুযোগেই সে আমাকে ‘তুমি’ ডাকা শুরু করেছিল, আমি তাকে আপনিতে ফিরিয়ে দিয়েছি।
স্থাপত্যবিদ্যার কিছু জ্ঞান দিয়ে শুরুতে সে আমাকে খানিকটা চমকে দিয়েছিল। সেই চমক এখন আর আমার মধ্যে নেই। এখন আমি নিশ্চিত স্থাপত্যবিদ্যার বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই। সে নিশ্চয়ই তার মাজেদা খালার কাছ থেকে আমার কথা শুনেছে। শোনার কথা। কারণ, এই বুদ্ধিহীনা রমণীর স্বভাব হচ্ছে বকর বকর করা। মহিলা আগ বাড়িয়ে অবশ্যই হিমুকে নানান গল্প করেছেন। হিমু ইন্টারনেট ঘেটে কিছু তথ্য জেনে এসেছে আমাকে চমকে দেওয়ার জন্যে। ইন্টারনেটের কল্যাণে মুর্খরাও এখন সবজান্তার মতো কথা বলে। স্থপতি সিনানের কথা গাধা হিমুর জানার কথা না।
সে মাজারের খাদেমের সেবায়েত-এই তথ্যও আমাকে দিয়েছে চমকানোর জন্যে। সে আমাকে মাজারের একটা ডিজাইন করতে বলবে—এটা আগেই ঠিক করে রেখেছে। আমি কিছুটা হলেও তার ফাঁদে পড়েছি। কারণ, সে মাজারে চাকরি করে এটা বিশ্বাস করেছি। বোকা মেয়েরা এইভাবে ফাঁদে পড়ে এবং একসময় ফাঁদ থেকে বের হতে পারে না।