সব বড় ম্যাজিকের কৌশল যেমন সহজ হয়, সব বড় ঝগড়ার কারণও হয় তুচ্ছ। শেষ পর্যন্ত খালু সাহেবের মুখ থেকেই কারণ জানা গেল। তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, চা তুমি বানিয়েছ?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। খালু সাহেব বললেন, চুমুক দিয়েই বুঝেছি, ওই গুড ফর নাথিং মহিলা চা-ও বানাতে পারে না। সে শুধু পারে ঝামেলা বাড়াতে। আমার বন্ধুর ছেলে এসেছে, হার্ভার্ড Ph.D. তোমার খালা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাকে বিয়ে দিবে। মেয়ে একটা জোগাড় করেছে, তুতুরি ফুতুরি কী যেন নাম।
সোফায় যে মেয়ে বসে আছে সে নাকি?
হ্যাঁ সে। আজ সকালে কী হয়েছে শোনো-আরাম করে বই পড়তে বসেছি, ওই মেয়ে গজ ফিতা নিয়ে দেয়াল মাপামাপি শুরু করেছে। আমি শান্ত গলায় বললাম, কী করছ? সে বলল, দেয়াল মাপছি।
আমি বললাম, দেয়াল মাপাছ তা তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু কেন? হঠাৎ দেয়াল মাপার প্রয়োজন পড়ল কেন?
সব দেয়াল ভেঙে নতুন ইন্টেরিয়র হবে। ঘরে আলো-হাওয়া খেলবে।
আমি বললাম, আমার আলো-হাওয়ার দরকার নেই। তোমার যদি দরকার হয় তুমি বাঁশগাছে চড়ে বসে থাকো। পেত্নী কোথাকার!
খালু সাহেব বইয়ে মন দিলেন। বইয়ে খুব ইন্টারেস্ট্রিং কিছু নিশ্চয়ই পেয়েছেন। নিজের মনেই বললেন, Oh God!
খালা একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করলেন। আমরা তিনজন রাস্তায় নেমে এলাম। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে খালা শোবার ঘরে ঢুকলেন। খালু সাহেবকে বললেন, এই যে যাচ্ছি, আর কিন্তু এ বাড়িতে ঢুকব না। আমার বাবা’র কসম, আমার মা’র কসম।
খালু সাহেব বই থেকে চোখ না তুলেই বললেন, শুনে আনন্দ পেলাম, Go to hell.
বাড়ির গেট থেকে বের হয়ে আমরা এখন ফুটপাতে। প্রবল উত্তেজনার কারণে খালা স্যান্ডেল না। পরে খালি পায়ে বের হয়ে এসেছেন। এবং এই মুহুর্তে তিনি ভয়ঙ্কর কোনো নোংরা জিনিসে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। খালা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ও হিমু, কিসে পাড়া দিলাম!
আমি বললাম, মনুষ্যবর্জ্যে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছ।
মনুষ্যবর্জ্য আবার কী?
সহজ বাংলায় ‘গু’।
খালা কুঁ কুঁ জাতীয় শব্দ করলেন। তুতুরি খিলখিল করে হেসে ফেলল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এই মেয়ের হাসির শব্দে মধুর বিষাদ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—’কাহারও হাসি ছুরির মতো কাটে! কাহারও হাসি অশ্রুজিলের মতো।’ হিমু না হয়ে অন্য যে-কেউ হলে আমি এই মেয়ের প্রেমে পড়ে যেতাম। হিমু হয়ে পড়েছি বিপদে। প্রেমে পড়া যাচ্ছে না।
খালা বললেন, দাঁড়িয়ে মজা দেখছিস নাকি? পা ধোঁয়ার ব্যবস্থা কর। সাবান আন, পানি আন। সাধারণ সাবানে হবে না, কাৰ্বালিক সাবান আন। সারা শরীর ঘিনীঘিন করছে। গোসল করব।
ফুটপাতে তোমাকে গোসল করাব কীভাবে?
গাধা কথা বলিস না, ব্যবস্থা কর।
খালা আবার আর্তচিৎকার করলেন। তিনি একটু পিছনে ঘুরতে চেয়েছিলেন, নিষিদ্ধ বস্তু তার অন্য পায়েও লেগে গেছে। তিনি চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, কোন হারামজাদা ফুটপাতে হাগে?
মানবপ্রকৃতির সাধারণ নিয়ম হলো, অন্যের দুর্দশা দেখে আনন্দ পাওয়া। খালাকে ঘিরে ছোটখাটো ভিড় তৈরি হয়েছে। নানান মন্তব্য শোনা যাচ্ছে। একজন হাসিমুখে বলল, সিস্টার, গুয়ে পাড়া দিয়ে খাড়ায়ে আছেন কেন? সরে দাঁড়ান।
দেখছিস কেন? সাবান-পানি নিয়ে আসতে বললাম না!
আমি বললাম, পকেটে একটা ছেড়া দুটাকার নোটও নেই। তুতুরি বলল, আমার কাছে টাকা আছে। চলুন যাই।
আমরা রাস্তা পার হলাম। আশপাশে কোনো দোকান দেখতে পাচ্ছি না। একজন চাওয়ালাকে দেখা গেল চা বিক্রি করছে। গরম চা দিয়ে পা ধোঁয়া ঠিক হবে কি না তাও বুঝতে পারছি না। আমি তুতুরিকে বললাম, সবচেয়ে ভালো হয় খালাকে ফেলে আমাদের দু’জনের দু’দিকে চলে যাওয়া।
তুতুরি বিস্মিত গলায় বলল, কেন?
আমি বললাম, খালা পনের-বিশ মিনিট আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। আমাদের ফিরতে না দেখে বাধ্য হয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফেরত যাবেন। খালাখালুর মিলন হবে। এই মিলনের নাম মধুর মিলন না, গু মিলন।
আপনি তো অদ্ভুত মানুষ, তবে আপনার কথা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। চলুন দুজন দু’দিকে চলে যাই।
যাওয়ার আগে তোমার পক্ষে কি সম্ভব আমাকে এক কাপ গরম চা খাওয়ানো? চাওয়ালকে দেখে চা খেতে ইচ্ছে করছে।
তুতুরি ভুরু কুঁচকে বলল, আমাকে হঠাৎ তুমি তুমি করে বলছেন কেন?
আমি বললাম, সাত কদম পাশাপাশি হাঁটলেই বন্ধুত্ব হয়। আমরা এক শ’ কদম হেঁটে ফেলেছি।
আমাকে দয়া করে আপনি করে বলবেন। চা খেতে আপনার কত লাগবে?
পাঁচ টাকা লাগবে। চায়ের সঙ্গে একটা টোস্ট বিস্কুট খাব। একটা কলা খাব। টেস্ট বিস্কুটের দাম দুটাকা। কলা দুটাকা। সব মিলিয়ে ন’টাকা। সকালে নাস্তা না খেয়ে বের হয়েছি।
তুতুরি বলল, আমার কাছে ভাংতি নটাকা নেই। একটা এক হাজার টাকার নোট আছে।
আমি বললাম, নটাকার জন্য কেউ এক হাজার টাকার নোট ভাঙাবে সে রকম মনে হয় না। তারপরেও চেষ্টা করা যেতে পারে।
আপনার কি চা খেতেই হবে?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। তুতুরি অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। আমি বললাম, এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিলে এক হাজার টাকার ভাংতি পাওয়া যাবে।
তুতুরি বিস্মিত গলায় বলল, আমি আপনাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিব?
আমাকে না, আমার বসকে। আমার বস হলেন পীর বাচ্চাবাবা মাজারের খাদেম।