আমি তার কেঁদে ফেলার দৃশ্য দেখার জন্যে অপেক্ষা করছি। সে চোখ তুলে আমাকে দেখে তার কান্না সামলে ফেলল। কিছু কিছু মেয়ে দ্রুত কান্না সামলাতে পারে। এ মনে হয় সেই দলের। আমি মেয়েটিকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। মাজেদা খালা রান্নাঘরের টুলে বসে আছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনিও কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁদবেন। তবে তাকে রূপবতী দেখাচ্ছে না। বরং কদাকার লাগছে। কেঁদে ফেলার আগে সব মেয়েকে রূপবতী মনে হয়, এই তথ্য ঠিক না।
খালা, সমস্যা কী?
এই বাড়িতে সমস্যা তো একটাই—তোর খালু। অপরিচিত এক মেয়ের সামনে তোর খালু আমাকে কুত্তি ডেকেছে।
আমি বললাম, বাংলায় কুত্তি বলেছেন, নাকি ইংরেজিতে বলেছেন? বাংলায় কুত্তি ভয়ঙ্কর গালি, ইংরেজিতে ‘বিচ’ তেমন গালি না। বাংলা ‘গু’ শব্দ ভদ্রসমাজে উচ্চারণ করা যায় না, কিন্তু ইংরেজিতে ‘শীট’ কথায় কথায় বলা যায়।
খালা মনে হয়। অনেকক্ষণ কান্না ধরে রেখেছিলেন, আর পারলেন না। শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। শোবার ঘর থেকে খালু ইংরেজিতে হুঙ্কার দিলেন। কঠিন গলায় বললেন, Get lost! হুঙ্কার বাংলায় অনুবাদ করলে হয়, ‘হারিয়ে যাও।’ Get lost হলো গালি, আর ‘হারিয়ে যাও’ হলো বেদনার্তা দীর্ঘনিঃশ্বাস। বাংলা ভাষায় ঝামেলা আছে। বাংলা একাডেমীর ডিজি সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
মাজেদা খালা নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বললেন, তোর খালুকে কি তুই বলে আসতে পারবি যে আমি তার সঙ্গে আর বাস করব না?
আমি বললাম, আমাকে কিছু বলে আসতে হবে না। তুমি কথাবার্তা যথেষ্ট উচু গলায় বলছি। খালু শোবার ঘর থেকে পরিষ্কার শুনতে পারছেন। আশপাশের অ্যাপার্টমেন্টের লোকজনও শুনছে।
তারপরেও তুই বলে আয়।
ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হলো?
তোর খালুকে জিজ্ঞেস কর কীভাবে হলো।
সোফায় বসে যে মেয়ে কাদার চেষ্টা করছে, সে কে?
আমার এক বান্ধবীর মেয়ে। আর্কিটেক্ট। ডিজাইনে গোন্ড মেডেল পাওয়া মেয়ে। হেজিপেজি কেউ না।
আমি বললাম, গোন্ড মেডালিস্ট কাঁদার চেষ্টা করছে কেন?
তোর খালু সুপার ট্যালেন্টেড এই মেয়েকে পেত্নী বলেছে। বলেছে পেত্নীটাকে বিদায় করো। তাকে কোনো একটা বাঁশগাছে পা বুলিয়ে বসে থাকতে বলো।
আমি বললাম, ঘটনা যথেষ্ট জটিল বলে মনে হচ্ছে। তুমি কড়া করে চা বানাও। চা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করি, তারপর অ্যাকশান।
চা বানাচ্ছি, তুই তোর খালুকে বলে আয়, আমি তার সঙ্গে এক ছাদের নিচে বাস করব না।
আমি খালু সাহেবের শোবার ঘরের দিকে (অনিচ্ছায়) রওনা হলাম। ছুটির দিনের সকালে মাজেদা খালার বাড়িতে আসাটা বোকামি হয়েছে। খালা-খালির সব ঝগড়া ছুটির দিনের সকালে শুরু হয়। দুপুরের দিকে শেষ হয়। দুপুরে খালু সাহেব দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমান। তবে আজ মনে হয়। ঘুমাবেন না। কিংবা বাসায় ঘুমের ট্যাবলেট নেই।
খালু সাহেব ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। তাঁর ঠোঁটে পাইপ। ছুটির দিনে তিনি পাইপ টানেন। তার কোলের ওপর ওরহান পামুকের বই My name is red। খালু সাহেবের চেহারা শান্ত। ঝড়ের কোনো চিহ্নই নেই। তিনি আমাকে দেখে মিষ্টি গলায় বললেন, কেমন আছ হিমু?
আমি মোটামুটি ঘাবড়ে গেলাম। গত দশ বছরে খালু এমন গলায় ‘কেমন আছ হিমু জিজ্ঞেস করেন নি। আমি তাঁর কাছে কীটপতঙ্গের কাছাকাছি। আমার ভালো থাকা না-থাকায় তাঁর কিছু আসে যায় না।
খালু সাহেবের মধুর ব্যবহারে হকচাকিয়ে গিয়ে বিনীত গলায় বললাম, আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
খালু সাহেব বললেন, আমি ভালো আছি। ব্রিলিয়ান্ট একটা উপন্যাস পড়ছি। ওরহান পামুকের। বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকেরা কীসব অখাদ্য লেখে, তাদের উচিত ওরহান সাহেবের পায়ের কাছে বসে থাকা।
আমি ওই ভদ্রলোকের কিছু পড়ি নি। তারপরেও বললাম, অবশ্যই। শুধু পায়ের কাছে বসে থাকলে হবে না, মাঝে মাঝে পা চাটতেও হবে।
খালু সাহেব বললেন, বসার ঘরের সোফায় সবুজ শাড়ি পরা মেয়েটা কি এখনো আছে, না চলে গেছে?
এখনো আছে।
কাদছে নাকি?
না, তবে কাঁদবে কাঁদবে করছে।
খালু সাহেব বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, এই একটি মেয়েকে আমি পেত্নী ডেকেছি—তার জন্যে লজ্জিত! তুমি তাকে বলে দিয়ে যে, আই অ্যাপোলোজাইজ। উপন্যাসে একটা জায়গায় পেত্নীর বর্ণনা পড়ছিলাম, সেই থেকে পেত্নী মাথায় ঘুরছিল। উত্তেজনার মুহুর্তে মুখ থেকে পেত্নী বের হয়েছে। আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলাম।
আমি বললাম, খুবই স্বাভাবিক। মহান লেখা মানুষকে আচ্ছন্ন করবেই। খালাকেও নিশ্চয়ই এই কারণে বিচ ডেকেছেন। পামুক সাহেবের বইয়ে মহিলা কুকুরের বর্ণনা পড়েছেন। সব দোষ ওরহান পামুক সাহেবের।
খালু সাহেব শান্ত গলায় বললেন, তোমার খালাকে আমি মন থেকেই বিচ বলেছি। বাইরের প্রভাবমুক্ত উচ্চারণ।
ও আচ্ছা।
তুমি তোমার খালাকে গিয়ে বলো, সে যেন চলে যায়। আমি এই বিচের মুখ দেখতে চাই না।
আপনাদের দু’জনের মধ্যে তাহলে তো আন্ডারাষ্ট্যান্ডিং হয়েই গেল। খালা বলেছেন, তিনি আপনার সঙ্গে এক ছাদের নিচে বাস করবেন না।
সে মুখে বলছে, আসলে যাবে না। নানান যন্ত্রণা করে আমাকে পাগল বানিয়ে পাবনার পাগলাগারদে পাঠাবে।
আমি বললাম, ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হয়েছে, একটু কি বলবেন?
খালু সাহেব বললেন, আমি একটা বই পড়ছি, যথেষ্ট আনন্দ নিয়ে পড়ছি, এখন ঘটনার সূত্রপাত কিংবা মূত্রপাত কিছুই বলব না। তুমি তোমার খালাকে এবং পেত্নীটাকে নিয়ে আধাঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ছাড়বে। যদি সম্ভব হয় আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দাও। তুমি নিজে বানাবে, বিচটাকে বলবে না।