স্যার, আমি হিমু। ভুঁতুরির হিমু।
কী ব্যাপার?
হুজুর জানতে চাচ্ছিলেন আমি এত রাতে কার সঙ্গে কথা বললাম। আপনার সঙ্গে কথা বলছি শুনে খুশি হয়েছেন।
আচ্ছা।
হুজুর বললেন, ফজর ওয়াক্ত হয়ে গেছে, নামাজটা যেন আদায় করেন। আপনি কি হুজুরের সঙ্গে কথা বলবেন?
আমি টেলিফোন বন্ধ করে বারান্দায় এসে বসলাম।
সালমা ঘুম থেকে উঠে বলল, কী ব্যাপার?
আমি বললাম, কোনো ব্যাপার না। চা করে দাও, চা খাব।
সালমা বলল, রাতে কোনো খারাপ স্বপ্ন-টপ্ল দেখেছ?
আমি বললাম, না।
সালমা বলল, আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। খুবই খারাপ। তুমি আমাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছ। ছাদ থেকে মাটিতে পড়তে পড়তে আমার ঘুম ভেঙেছে।
আমি বললাম, এটা খুবই ভালো স্বপ্ন। স্বপ্নে যা দেখা যায়। তার উল্টোটা হয়। পতন দেখা মানে উত্থান।
সকাল সাড়ে সাতটায় আমি দবিরকে টেলিফোন করলাম। নানা কথার পরে জিজ্ঞেস করলাম সে হিমু নামের কাউকে আমার প্রাইভেট নম্বর দিয়েছে কি না।
দবির বলল, অসম্ভব। সে কি বলেছে যে আমি দিয়েছি?
আমি বললাম, না। সে সময়ে অসময়ে আমাকে টেলিফোন করে বিরক্ত করছে। কাল রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশে একবার টেলিফোন করেছে। শেষরাতে আরেকবার করেছে।
দবির বলল, যে নম্বর থেকে টেলিফোন করেছে সেই নম্বর আমাকে দিন, আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এই ছেলে কি সাংবাদিক?
তা তো স্যার জানি না। আপনি বললে আমি খোঁজ নিতে পারি।
আমি ইতস্তত করে বললাম, একাডেমীতে আমার বিরুদ্ধে কি কোনো কথাবার্তা হয়?
দবির বলল, আপনার বিরুদ্ধে কী কথাবার্তা হবে? আপনি হচ্ছেন হার্ডকোর অনেষ্ট।
আমি বললাম, থ্যাংক য়্যু।
দবির বলল, তবে বাংলার ঐতিহ্য চেপা শুঁটকির একশত রেসিপি’ বইটি যে আপনি প্রেসে ছাপার জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন এটা নিয়ে কথা হবে। পত্রপত্রিকায় লেখা হবে।
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। দবির বলল, চেপা শুঁটকির লেখক আরও একটা পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছে, ‘রবীন্দ্রনাথ এবং গ্রামবাংলার ভর্তাভাজি’। সে দুটা বইয়ের রয়েলটির টাকা অ্যাডভান্স চায়। রয়েলটির টাকা পরিশোধ করার জন্যে রেল এবং ধর্মমন্ত্রীর জোরালো সুপারিশও আছে।
আমি বললাম, ও আচ্ছা আচ্ছ। আমার বিরুদ্ধে কঠিন ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। বাংলা ভাষায় নতুন শব্দ, বাংলার ঐতিহ্য চেপা শুঁটকি-সব এক সুতায় গাঁথা মালা। ‘এ মণিহার আমার নাহি সাজে।’
মন শান্ত করার জন্যে কী করতে পারি কিছুই বুঝতে পারছি না। ফজরের নামাজ পড়ে ফেলব নাকি? অনেকদিন নামাজ পড়া হয় না।
অজু করে জায়নামাজে দাঁড়িয়েছি। সালমা অবাক হযে বলল, কী ব্যাপার?
ব্যাপার কিছু না। নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছি।
সালমা বলল, কেন?
আমি বললাম, কেন মানে? মুসলমানের ছেলে, নামাজ পড়ব না?
কোনোদিন তো পড়তে দেখি না।
আমার সামনে থেকে যাও। ঘ্যানঘ্যান করবে না।
সালমা বলল, ঘ্যানঘ্যান কী করলাম?
আমি বললাম, ঘ্যানঘ্যান কী করছ বুঝতে পারছি না? স্টুপিড মহিলা!
আমাকে স্টুপিড বললে?
যে স্টুপিড। তাকে স্টুপিড বলব না? তুমি এই মুহুর্তে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।
সালমা চলে গেল। আমার নামাজ পড়া হলো না। কারণটা অদ্ভুত। অনেক চেষ্টা করেও সূরা ফাতেহা মনে করতে পারলাম না। সব সূরা মনে পড়ছে, শুধু সূরা ফাতেহা মনে পড়ছে না। এর কোনো মানে হয়!
সকালে নাশতার টেবিলে বসে শুনলাম সালমা কিছুক্ষণ আগে সুটকেস নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে।
এটা নতুন কিছু না। এর চেয়ে অনেক তুচ্ছ কারণে সালমা বাপের বাড়ি চলে গেছে। তাকে ফিরিয়ে আনতে অনেক কলকব্জা নাড়াতে হয়েছে। একবার তার গাবদা পায়ে পর্যন্ত ধরেছি।
টেলিফোন বাজছে। মনে হচ্ছে আমার শ্বশুর সাহেব টেলিফোন করেছেন। সাধারণত সালমা তার বাড়িতে উপস্থিত হওয়ামাত্র তিনি টেলিফোন করেন। গলা কঠিন করে বলেন, বাবা, তোমার কাছ থেকে এই ব্যবহার আশা করা যায় না। তুমি ঢাকা শহরের কোনো রিকশাচালক না। তুমি বাংলা একাডেমীর ডিজি। তোমার একটা পজিশন আছে।
আমি টেলিফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে হিমু বলল, ভুঁতুরি বিষয়টা নিয়ে শেষ কথাটা বলব, আর বিরক্ত করব না। চন্দ্ৰবিন্দু ক’টা রাখবেন তা আপনার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। যদি মনে করেন তিনটা চন্দ্ৰবিন্দু দেবেন, তাও দিতে পারেন। শুনতে খারাপ লাগবে না-ভুঁতুঁরিঁ…।
আমি ভাবলাম বলি, চুপ থাক শালা! নিজেকে শেষ মুহুর্তে সামলালাম, কিছুই বললাম না। আমি ঢাকা শহরের কোনো রিকশাচালক না। আমি বাংলা একাডেমীর ডিজি। আমার একটা পজিশন আছে।
মাইকেল এঞ্জেলো বলেছেন
মাইকেল এঞ্জেলো বলেছেন, ‘মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর দেখায় তাদের কেঁদে ফেলার আগমুহুর্তে।’
মাইকেল এঞ্জেলোর কথা সত্যি হতে পারে। মাজেদা খালার বসার ঘরের সোফায় রোগা-পাতলা এক তরুণী বসে আছে। সে হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে। শাড়ির সবুজ রঙ ছায়া ফেলেছে মেয়েটির মুখে। সবুজ আভায় তার চেহারা খানিকটা করুণ হয়েছে। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার চোখের পাতা যেভাবে কাঁপছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে কাঁদবে। তাকে অপরূপ দেখাচ্ছে। মাইকেল এঞ্জেলো এই মেয়েকে দেখলে বাটালি দিয়ে পাথর কাটা শুরু করতেন। যে ভঙ্গিতে মেয়েটি বসে আছে, তিনি সেই ভঙ্গি হয়তো সামান্য পাল্টাতেন, যাতে মেয়েটির মুখ ভালোভাবে দেখা যায়। এখন মেয়েটির মুখ ভালো দেখা যাচ্ছে না।