———————–
* বাঙ্গালী ও গুর্খায় প্রভেদ দেখুন; যৎকালে বাঙ্গালী ছেলেরা ভয়ে চীৎকার করিয়া দৌড়াদৌড়ি করিয়া পলাইত, সে সময় গুর্খাশিশু আত্মরক্ষার জন্য ঢিল তুলিয়াছে সে ভয়াবহ বস্তুকে মারিতে!
অবরোধ বাসিনী – ৩০
[ ৩০ ]
কোন একটী কুলে শীলে ধন্য সৎ পাত্রের সহিত এক জমীদারের বয়োপ্রাপ্তা কন্যার বিবাহ ঠিক হইয়াছিল। কি কারণে বরের পিতার সহিত কন্যাকর্ত্তার ঝগড়া হওয়ায় বিবাহের সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়া গেল। ইহাতে পাত্রী যাহার পর নাই দুঃখিতা হইল।
কন্যার পিতা তাড়াতাড়ি অন্য বর না পাইয়া নিজের এক দুরাচার ভ্রাতুস্পুত্রের সহিত কন্যার বিবাহ দিতে বসিলেন। সে বেচারী তাহার খুড়তাতো ভাইয়ের কুকীর্ত্তির বিষয় সমস্তই অবগত ছিল,-কত দিন সে নিজেই ঐ মাতালটাকে তেঁতুলের শরবত খাওয়াইয়া এবং মাথায় জল ঢালিয়া তাহার মাতলামী দূর করিতে চেষ্টা করিয়াছে। সুতরাং এ বিবাহে তাহার ঘোর আপত্তি ছিল।
কিন্তু পাত্রী ত মূক,-তাহার বাকশক্তি থাকিয়াও নাই। তাহার একমাত্র সম্বল নীরব রোদন। তাই সে কেবল কাঁদিয়া চক্ষু ফুলাইয়াছে, আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়াছে। কিন্তু নিষ্ঠুর পিতামাতার ভ্রক্ষেপ নাই,-তাঁহারা ঐ মাতালের সহিত তাহার বিবাহ দিবেনই দিবেন। এইরূপেই আমাদের কাঠমোল্লা মুরুব্বিগণ শরিয়তের গলা টিপিয়া মারিয়া ইসলাম ও শরিয়ত রক্ষা করিতেছে।
বিবাহ-সভায় বসিয়া পাত্রী কিছুতেই “হুঁ” বলিতেছিল না। মাতা, পিতামহী প্রভৃতির অনুনয়, সাধ্য-সাধনা, মিষ্ট র্ভৎসনা,-সবই সে দুই চরে জলে ভাসাইয়া দিতেছিল। অবশেষে একজনে অতর্কিতে কন্যাকে খুব জোরে চিমটি কাটিল; সেই আঘাতে সহসা “উহু-!” বলিয়া সে কাতর ধ্বনি করিয়া উঠিল। সেই “উহু” কে “হুঁ” বলিয়া ধরিয়া লইয়া তাহার বিবাহ ক্রিয়া সমাপ্ত হইল। সোবহান আল্লাহ্! জয়, অবরোধের জয়!
অবরোধ বাসিনী – ৩১
[ ৩১ ]
একবার কোন স্থলে চলন্ত ট্রেণে মেয়েমানুষদের কক্ষে একটা চোর উঠিল। চোর বহাল তবিয়তে একে একে প্রত্যেকের অলঙ্কার খুলিয়া লইল; কিন্তু লজ্জায় জড়সড় লজ্জাবতী অবলা সরলা কুলবালাগণ কোন বাধা দিলেন না। তাঁহারা সকলে ক্রমাগত ঘোমটা টানিয়া থাকিলেন। “তওবা! তওবা! কাঁহা সে মর্দ্দুয়া আ গয়া!” বলিয়া কেহ কেহ বোরকার “নেকাব” টানিলেন। পরে চোর মহাশয় ট্রেণের এলার্মের শিকল টানিয়া গাড়ি থামাইয়া নির্ব্বিঘ্নে নামিয়া গেল।
অবরোধ বাসিনী – ৩২
[ ৩২ ]
ভাংনীর জমীদার সাহেবের ডাকনাম,-ধরুন-বাচ্চা মিয়া। তাঁহার পত্নীর নাম হাসিনা খাতুন। হাসিনার পিতার বিশাল সম্পত্তি,-অগাধ টাকা। একবার বাচ্চা মিয়া স্ত্রীকে বলিলেন, “আমার টাকার দরকার, আজই তোমার পিতার নিকট পত্র লিখাইয়া টাকা আনাইয়া দাও।” যথাসময়ে টাকার পরিবর্ত্তে তথা হইতে মিতব্যয়ের উপকারিতা সম্বন্ধে এক বক্তৃতার ন্যায় পত্র আসিল।
বাচ্চা মিয়ার শ্বশুর অনেকবার জামাতাকে টাকা দিয়াছেন। এখন টাকা দানে তাঁহার অরুচি জন্মিয়া গিয়াছে। তাই কন্যাকে টাকা না পাঠাইয়া উপদেশ পাঠাইলেন। ইহাতে বাচ্চা মিয়া রাগ করিয়া স্ত্রীর “নাইওর” (পিত্রালয়) যাওয়া বন্ধ করিয়া দিলেন।
এক দিকে পিতামাতা কাঁদেন, অপর দিকে হাসিনা নীরবে কাঁদেন-পরস্পরে দেখা সাক্ষাৎ আর হয় না। কিছু কাল পরে হাসিনার ভ্রাতা তাঁহাকে দেখিতে আসিলেন।
তিনি সোজা ভাংনী না গিয়া পথে দুই ক্রোশ দূরে ফুলচৌকী নামক গ্রামে তাঁহার মাসীমার বাড়ীতে উপস্থিত হইলেন। পরদিন প্রাতঃকালে ভাংনীতে সংবাদ পাঠাইলেন যে তিনি অপরাহ্নে তথায় যাইবেন।
যাহাতে ভ্রাতা ও ভগিনীতে দেখা না হইতে পারে, সে জন্য বাচ্চা মিয়া এক ফন্দী করিলেন। তিনি স্ত্রীকে বলিলেন যে তাঁহাদের লইয়া যাইবার জন্য ফুলচৌকী হইতে লোক আসিয়াছে। হাসিনা স্বামীর চালবাজী জানিতেন, সহসা তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিলেন না। তিনি কোন প্রকারে জানিতে পারিয়াছিলেন যে অদ্য অপরাহ্নে তাঁহার ভাই সা’ব আসিবেন।
বাচ্চা মিয়া পুনরায় কহিলেন, “ভাই সা’বের মাথা ধরিয়াছে, তিনি আজ আসিতে পারিবেন না। সেই জন্য খালা আম্মা ইয়ার মাহমুদ সর্দ্দারকে পাঠাইয়াছেন আমাদের লইয়া যাইতে। তুমি আমার কথা বিশ্বাস না কর ত চল দেউড়ী ঘরে গিয়া স্বকর্ণে সর্দ্দারের কথা শুন।”
তদনুসারে দেউড়ী ঘরের দ্বারের বাহিরে ইয়ার মাহমুদকে ডাকিয়া আনা হইল। ঘরের ভিতর হইতে বাচ্চা মিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইয়ার মাহমুদ! তুমি এখন ফুলচৌকী হইতে আইস নাই?” সে উত্তর করিল, “হাঁ হুজুর! আমিই খবর নিয়া আসিয়াছি-” বাচ্চা মিয়া তাড়াতাড়ি অন্য কথা পাড়িয়া তাহাতে আর বেশী কিছু বলিতে দিলেন না।
হাসিনা হাসি-খুশী, মাসীমার বাড়ী যাইতে প্রস্তুত হইলেন। তাঁহার জন্য বানাতের ঘেরাটোপ ঢাকা পাল্কী সাজিল, তাঁহার বাঁদীদের জন্য খেরুয়ার ওয়াড ঘেরা গোটা আষ্টেক ডুলী সাজিল, বাচ্চা মিয়া মেয়ানা, (খোলা পাল্কী বিশেষ) সাজিল। আর্দ্দালী, বরকন্দাজ, আসাবরদার, সোটাবরদার ইত্যাদি সহ তাঁহারা বেলা ১টার সময় রওয়ানা হইলেন।
পথে যখন হাসিনা বুঝিতে পারিলেন যে দুইখানি ডিঙ্গী নৌকা যুড়িয়া, তাহার উপর তাঁহার পাল্কী রাখিয়া নদী পার করা হইতেছে, তখন তিনি রোদন আরম্ভ করিলেন যে ফুলচৌকী যাইতে ত নদী পার হইতে হয় না,-আল্লারে, আল্লাহ্! সা’ব তাহাকে এ কোন জায়গায় আনিলেন!! পাল্কীতে মাথা ঠুকিয়া কান্না ছাড়া অবরোধ-বাসিনী আর কি করিতে পারে?
অবরোধ বাসিনী – ৩৩
[ ৩৩ ]