বাস্তবিক অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন ভিন্ন আর কিছুই নহে। যদি অলঙ্কারকে দাসত্বের নিদর্শন না ভাবিয়া সৌন্দর্য্যবর্দ্ধনের উপায় মনে করা যায়, তাহাই কি কম নিন্দনীয়? সৌন্দর্য্যবর্দ্ধনের চেষ্টাও কি মানসিক দুর্ব্বলতা নহে? পুরুষেরা ইহা পরাজয়ের নিদর্শন ভাবেন। তাঁহারা কোন বিষয় তর্ক করিতে গেলে বলেন, “আমার কথা প্রমাণিত করিতে না পারিলে আমি চুড়ি পরিব”! কবিবর সা’দী পুরুষদের উৎসাহিত করিবার জন্য বলিয়াছেন, “আয় মরদাঁ বকুশিদ্, জামা-এ-জানাঁ ন পুষিদ্”! অর্থাৎ “হে বীরগণ! (জয়ী হইতে) চেষ্টা কর, রমণীর পোষাক পরিও না।” আমাদের পোষাক পরিলে তাহাদের অপমান হয়! দেখা যাউক সে পোষকটা কি,-কাপড় ত তাঁহাদের ও আমাদের প্রায় একই প্রকার। একখণ্ড ধূতি ও একখণ্ড সাড়ির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে কিছুমাত্র তারতম্য আছে কি? যে দেশে পুরুষ পা-জামা পরে, সে দেশে নারীও পা-জামা পরে। “Ladies’s jacket” শুনা যায়, “Gentlemen’s jacket” ও শুনিতে পাই! তবে “জামা-এ-জানাঁ” বলিলে কাপড় না বুঝাইয়া সম্ভবতঃ রমণীসুলভ দুর্ব্বলতা বুঝায়।
পুরুষজাতি বলেন যে, তাঁহার আমাদিগকে “বুকের ভিতর বুক পাতিয়া বুক দিয়া ঢাকিয়া” রাখিয়াছেন, এবং এরূপ সোহাগ আমরা সংসারে পাইব না বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিয়া থাকেন। আমরা তাই সোহাগে গলিয়া-ঢলিয়া বহিয়া যাইতেছি! ফলতঃ তাঁহারা যে অনুগ্রহ করিতেছেন, তাহাতেই আমাদের সর্ব্বনাশ হইতেছে। আমাদিগকে তাঁহারা হৃদয়-পিঞ্জরে আবদ্ধ করিয়া জ্ঞান-সূর্যালোক ও বিশুদ্ধ বায়ু হইতে বঞ্চিতা রাখিয়াছেন, তাহাতেই আমরা ক্রমশঃ মরিতেছি। তাঁহারা আরও বলেন, “তাহাদের সুখের সামগ্রী, আমরা মাথায় বহিয়া আনিয়া দিব-আমরা থাকিতে তাহারা দুঃখ সহ্য করিবে কেন?” আমরা ঐ শ্রেণীর বক্তাকে তাঁহাদের অনুগ্রহপূর্ণ উক্তির জন্য ধন্যবাদ দিই; কিন্তুু ভ্রাতঃ! পোড়া সংসারটা কেবল কবির সুখময়ী কল্পনা নহে-ইহা জটিল কুটিল কঠোর সংসার! সত্য বস্তু-কবিতা নহেঃ
“কাব্য উপন্যাস নহে-এ মম জীবন,
নাট্যশালা নহে-ইহা প্রকৃত ভবন”-
তাই যা কিছু মুস্কিল!! নতুবা আপনাদের কৃপায় আমাদের কোন অভাব হইত না। বঙ্গবালা আপনাদের কল্পিত বর্ণনা অনুসারে “ক্ষীণাঙ্গী, কোমলাঙ্গী, অবলা, ভয়-বিহবলা-” ইত্যাদি হইতে হইতে ক্রমে সূক্ষ্ম শরীর (Aerial body) প্রাপ্ত হইয়া বাস্পরূপে অনায়াসে আকাশে বিলীন হইতে পারিতেন!! কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তদ্রুপ সুখের নহে; তাই এখন মিনতি করিয়া বলিতে চাইঃ
“অনুগ্রহ করে এই কর, অনুগ্রহ কর না মোদের।”
বাস্তবিক অত্যধিক যত্নে অনেক বস্তু নষ্ট হয়। যে কাপড় বহু যত্নে বন্ধ করিয়া রাখা যায়, তাহা উইএর ভোগ্য হয়। কবি বেশ বলিয়াছেনঃ
“কেন নিবে গেল বাতি?
আমি অধিক যতনে ঢেকেছিনু তারে,
জাগিয়া বাসর রাতি,
তাই নিবে গেল বাতি।”
সুতরাং দেখা যায়, তাঁহাদের অধিক যত্নই আমাদের সর্ব্বনাশের কারণ।
বিপৎসঙ্কুল সংসার হইতে সর্ব্বদা সুরতিা আছি বলিয়া আমরা সাহস, ভরসা, বল একেবারে হারাইয়াছি। আত্মনির্ভর ছাড়িয়া স্বামীদের নিতান্ত মুখাপেক্ষী হইয়া পড়িয়াছি। সামান্য হইতে সামান্যতর বিপদে পড়িলে আমরা গৃহকোণে লুকাইয়া গগনভেদী আর্ত্তনাদে রোদন করিয়া থাকি!! ভ্রাতৃমহোদয়গণ আবার আমাদের “নাকি কান্নার” কথা তুলিয়া কেমন বিদ্রূপ করেন, তাহা কে না জানে? আর সে বিদ্রূপের নীরবে সহ্য করি। আমরা কেমন শোচনীয়রূপে ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, <তাহা ভাবিলে ঘৃণায় লজ্জায় মৃতপ্রায় হই।
ব্যাঘ্র ভল্লুক ও দূরে থাকুক, আরসুলা জলৌকা প্রভৃতি কীট পতঙ্গ দেখিয়া আমরা ভীতিবিহবলা হই! এমনকি অনেকে মূর্চ্ছিতা হন! একটি ৯/১০ বৎসরের বালক বোতলে আবদ্ধ একটি জলৌকা লইয়া বাড়ীশুদ্ধ স্ত্রীলোকদের ভীতি উৎপাদন করিয়া আমোদ ভোগ করে। অবলাগণ চীৎকার দৌড়িতে থাকেন, আর বালকটি সহাস্যে বোতল হস্তে তাঁহাদের পশ্চাৎ ধাবিত হয়। এমন তামাসা আপনারা দেখেন নাই কি? আমি দেখিয়াছি-আর সে কথা ভাবিয়া ঘৃণায় লজ্জায় মরমে মরিতেছি। সত্য কথা বলিতে কি, সে সময় বরং আমোদ বোধ করিয়াছিলাম; কিন্তু এখন সে কথা ভাবিলে শোণিত উত্তপ্ত হয়। হায়! আমরা শারীরিক বল, মানসিক সাহস, সব কাহার চরণে উৎসর্গ করিয়াছি? আর এই দারুণ শোচনীয় অবস্থা চিন্তা করিবার শক্তিও আমাদের নাই।
ভীরুতার চিত্র ত দেখাইলাম, এখন শারীরিক দুর্ব্বলতার চিত্র দেখাইব। আমরা এমন জড় “অচেতন পদার্থ” হইয়া গিয়াছি যে, তাঁহাদের গৃহসজ্জা (drawing room এর ornament) বই আর কিছুই নহি। পাঠিকা! আপনি কখন বেহারের কোন ধনী মুসলমান ঘরের বউ-ঝী নামধেয় জড়পদার্থ দেখিয়াছেন কি? একটি বধূবেগম সাহেবার প্রতিকৃতি দেখাই। ইহাকে কোন প্রসিদ্ধ যাদুঘরে (museum এ) বসাইয়অ রাখিলে রমণীজাতির প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা হইত। একটা অন্ধকার কক্ষে দুইটি মাত্র দ্বার আছে, তাহার একটি রুদ্ধ এবং একটি মুক্ত থাকে। সুতরাং সেখানে (পর্দার অনুরোধে?) বিশুদ্ধ বায়ু ও সূর্য্যরশ্মির প্রবেশ নিষেধ। ঐ কুঠরীতে পর্য্যঙ্কের পার্শ্বে যে রক্তবর্ণ বানাত মণ্ডিত তক্তপোষ আছে, তাহার উপর বহুবিধ স্বর্ণাঙ্কারে বিভূষিতা, তাম্বুলরাগে রঞ্জিতাধরা, প্রসন্নাননা যে জড় পুত্তলিকা দেখিতেছেন, উহাই দুলহিনবেগম (অর্থাৎ বেগমের পুত্রবধূ)”। ইহার সর্ব্বাঙ্গে ১০২৪০ টাকার অলঙ্কার! শরীরের কোন অংশে কত ভরি সোণা বিরাজমান, তাহা সুস্পষ্টরূপে বলিয়া দেওয়া আবশ্যক মনে করি।