ঐরূপ আমাদের আত্মাদর লোপ পাওয়ায় আমরাও অনুগ্রহ আর সঙ্কোচ বোধ করি না। সুতরাং আমরা আলস্যের,-প্রকারান্তরে পুরুষের-দাসী হইয়াছি। ক্রমশঃ আমাদের মন পর্যন্ত দাস (enslaved) হইয়া গিয়াছে। এবং আমরা বহু কাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এইরূপে আমাদের স্বাবলম্বন, সাহস প্রভৃতি মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলি অনুশীলন অভাবে বারবার অঙ্কুরে বিনাশ হওয়ায় এখন আর বোধ হয় অঙ্কুরিতও হয় না। কাজেই পুরুষজাতি বলিতে সুবিধা পাইয়াছেনঃ
“The five worst maladies that afflict the female mind are : indocility, discontent, slander, jealousy and silliness … such is the stupidity of her character, that it is incumbent on her, in every particular, to distrust herself and to obey her husband.” (Japan, the Land of the Rising Sun)
(ভাবার্থ-স্ত্রীজাতির অন্তঃকরণের পাঁচটি দুরারোগ্য ব্যাধি এই-(কোন বিষয় শিক্ষার) অযোগ্যতা, অসন্তোষ, পরনিন্দা, হিংসা এবং মুর্খতা। ···নির্ব্বোধ স্ত্রীলোকের কর্ত্তব্য যে প্রত্যেক বিষয়ে নিজেকে অবিশ্বাস করিয়া স্বামীর আদেশ পালন করে)।
তারপর কেহ বলেন “অতিরঞ্জন ও মিথ্যা বচর রমণী-জিহবার অলঙ্কার!” আমাদিগকে কেহ “নাকেস-উল-আকেল” এবং কেহ “যুক্তিজ্ঞানহীন” (unreasonable) বলিয়া থাকেন। আমাদের ঐ সকল দোষ আছে বলিয়া তাঁহারা আমাদিগকে হেয় জ্ঞান করিতে লাগিলেন। এরূপ হওয়া স্বাভাবিক। একটা উদাহরণ দেখুন। এদেশে জামাতা খুব আদরণীয়-এমনকি ডাইনীও জামাই ভালবাসে। তবু “ঘরজামাইয়ের” সেরূপ আদর হয় না। তাই দেখা যায়, আমাদের যখন স্বাধীনতা ও অধীনতাজ্ঞান বা উন্নতি ও অবনতির যে প্রভেদ তাহা বুঝিবার সামর্থ্যটুকুও থাকিল না, তখন কাজেই তাঁহারা ভূস্বামী, গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে ক্রমে আমাদের “স্বামী” হইয়া উঠিলেন! আর আমরা ক্রমশঃ তাঁহাদের গৃহপালিত পশু পীর অন্তর্গত অথবা মূল্যবান সম্পত্তি বিশেষ হইয়া পড়িয়াছি!
সভ্যতা ও সমাজবন্ধনের সৃষ্টি হইলে পর সামাজিক নিয়মগুলি অবশ্য সমাজপতিদের মনোমত হইল! ইহাও স্বাভাবিক। “জোর যার মুলুক তা”। এখন জিজ্ঞাসা করি, আমাদের অবনতির জন্য কে দোষী?
আর এই যে আমাদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারগুলি-এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ! এখন ইহা সৌন্দর্য্যবর্দ্ধনের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে; কিন্তু অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তির মতে অলংকার দাসত্বের নিদর্শন (originally badges of slavery) ছিল। তাই দেখা যায় কারগারে বন্দীগণ পায় লৌহনির্ম্মিত বেড়ী পরে, আমরা (আদরের জিনিষ হাতকড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্য-নির্ম্মিত চুড়ি! বলা বাহুল্য, লোহার বালাও বাদ দেওয়া হয় না! কুকুরের গলে যে গলাবদ্ধ (dogcollar) দেখি, উহারই অনুকরণে বোধ হয় আমাদের জড়োয়া চিক নির্ম্মিত হইয়াছে! অশ্ব হস্তী প্রভৃতি পশু লৌহ-শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, সেইরূপ আমরা স্বর্ণ-শৃঙ্খলে কণ্ঠ শোভিত করিয়া মনে করি “হায় পরিয়াছি”। গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া “নাকাদড়ী” পরায়, এদেশে আমাদের স্বামী আমাদের নাকে “নোলক” পরাইয়াছেন!! ঐ নোলক হইতেছে “স্বামী”র অস্তিত্বের (সধবার) নিদর্শন! অতত্রব দেখিলেন ভগিনি! আপনাদের ঐ বহুমূল্য অলঙ্কারগুলি দাসত্বের নিদর্শন ব্যতীত আর কি হইতে পারে? আবার মজা দেখুন, তাঁহার শরীরে দাসত্বের নিদর্শন যত অধিক, তিনি সমাজে ততোধিক মান্যা গণ্যা!
এই অলঙ্কারের জন্য ললনাকুলের কত আগ্রহ! যেন জীবনের সুখ সমৃদ্ধি উহারই উপর নির্ভর করে! তাই দরিদ্রা! কামিনীগণ স্বর্ণরোপ্যের হাতকড়ী না পাইয়া কাচের চুড়ি পরিয়া দাসী-জীন সার্থক করে। যে (বিধবা) চুড়ি পরিতে অধিকারিণী নহে, তাহার মত হতভাগিনী যেন এ জগতে আর নাই! অভ্যাসের কি অপার মাহিমা! দাসত্বে অভ্যাস হইয়াছে বলিয়া দাসত্বসূচত গহনাও ভাল লাগে। অহিফেন তিক্ত হইলেও আফিংচির অতি প্রিয় সামগ্রী। মাদক দ্রব্যে যতই সর্ব্বনাশ হউক না কেন, মাতাল তাহা ছাড়িতে চাহে না। সেইরূপ আমরা অঙ্গে দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করিয়াও আপনাকে গৌরবান্বিতা মনে করি-গর্ব্বে স্ফীতা হই!
অলঙ্কার সম্বন্ধে যাহা বলিলাম, তাহাতে কোন কোন ভগ্নী আমাকে পুরুষপক্ষেরই গুপ্তচর মনে করিতে পারেন। অর্থাৎ ভাবিলেন যে, আমি পুরুষদের টাকা স্বর্ণকারের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য হয়ত এরূপ কৌশলে ভগ্নীদিগকে অলঙ্কারে বীতশ্রদ্ধ করিতে চেষ্টা করিতেছি। কিন্তু তাহা নয়, আমি আপনাদের জন্যই দু’কথা বলিতে চাই। যদি অলঙ্কারের উদ্দেশ্য পুরুষদের টাকার শ্রাদ্ধ করাই হয়, তবে টাকার শ্রাদ্ধ করিবার অনেক উপায় আছে দুই একটি উপায় বলিয়া দিতেছি।
আপনার ঐ জড়োয়া বাড়ীর আদুরে কুকুরটির কণ্ঠে পরাইবেন। আপনি যখন শকটারোহণে বেড়াইতে যান, তখন সেই শকটবাহী অশ্বের গলে আপনার বহুমূল্য হার পরাইতে পারেন! বালা ও চুড়িগুলি বসিবার ঘরের পর্দ্দার কড়া (drawing room Gi curtain ring) রূপে ব্যবহার করা যাইতে পারে। তবেই “স্বামী” নামধারী নরবরের টাকার বেশ শ্রাদ্ধ হইবে!! অলঙ্কারের মুখ্য উদ্দেশ্য ঐশ্বর্য্য দেখান বই ত নয়। ঐরূপে ঐশ্বর্য্য দেখাইবেন। নিজের শরীরের দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করিবেন কেন? উক্ত প্রকারে গহনার সদ্ব্যবহার করিলে প্রথম প্রথম লোকে আপনাকে পাগল বলিবে, কিন্তু তাহা গ্রাহ্য না করিলেই চলিবে। এ পোড়া সংসারে কোন ভাল কাজটা বিনা কেশে সম্পাদিত হইয়াছে? “পৃথিবীর গতি আছে” এই কথা বলাতে মহাত্ম গ্যালিলও (Galileo) কে বাতুলাগারে যাইতে হইয়াছিল। কোন সাধুলোকটি অনায়াসে নিজ বক্তব্য বলিতে পারিয়াছেন? তাই বলি, সমাজের কথায় কর্ণপাত করিবেন না। এ জগতে ভাল কথা বা ভাল কাজের বর্ত্তমানে আদর হয় না।