আক্ষেপ এই যে, জল কেন দিলাম না। রোগ সারিবার আশায় জল দিতাম না।- রোগ যদি না সারিল, তবে জল কেন দিলাম না? এই জন্যই ত রাত্রি দিন শুনি,-“পিপাসা, পিপাসা”! ঐ জন্যই ত এ নরকযন্ত্রণা ভোগ করি। আর সেই গরম চা’র পেয়ালা চরে সম্মুখে ঘুরিয়া বেড়ায়, হৃদয়ে আঘাত করে, প্রাণ দগ্ধ করে! চক্ষু মুদ্রিত করিলে দেখি-অন্ধকারে জ্যোতির্স্ময় অরে লেখা-“পিপাসা, পিপাসা”!
নিশীথ সময়ে গৃহছাদে উঠিলাম। আকাশমণ্ডল পরিস্আরর ছিল কোটী কোটী তারকা ও চন্দ্র হীরক প্রভায় জ্বলিতেছিল। আমার পোড়া চক্ষে দেখিলাম-ঐ তারকা-অরে লেখা-“পিপাসা, পিপাসা”! আমি নিজের পিপাসা লইয়া ব্যস্ত, তাহাতে আবার বিশ্বচরাচর পিপাসা দেখায়-পিপাসা শুনায়! বোধ হয় নিজের পিপাসার প্রতিবিম্ব দেখিতে পাই মাত্র,-আর কেহ পিপাসী নহে। অথবা এ বিশ্বজগৎ সত্যিই পিপাসু!
কুসুমকাননে আমি কি দেখিতে পাই? কুসুম হেলিয়া দুলিয়া বলে “পিপাসা, পিপাসা” লতায় পাতায় লেখা-“পিপাসা, পিপাসা”। কুসুমের মনোমোহিনী মৃদু হাসি আমি দেখি না। আমি দেখি, কুমুদের সুধাংশু-পিপাসা।
বিহগ-কুজনে আমি কি শুনিতে পাই? ঐ “পিপাসা, পিপাসা”! ঐ একই শব্দ নানাসুরে নানারাগে শুনি,-প্রভাতে ভৈরবী, নিশীথে বেহাগ-কিন্তু কথা একই। চাতক পিপাসায় কাতর হইয়া ডাকে-“ফটিক জল”! কোকিল ডাকিয়া উঠে “কুহু” ঐ কুহুস্বরে শত প্রাণের বেদনা ও হৃদয়ের পিপাসা ঝরে! এ কি, সকলে আমাকে পিপাসার ভাষা শুনায় কেন? আহা! আমি কোথাই যাই? কোথায় যাইরে “পিপাসা” শুনিব না?
চল হৃদয়, তবে নদী তীরে যাই,-সেইখানে হয় ত “পিপাসা” নাই। কিন্তু ঐ শুন! স্নিগ্ধসলিলা গঙ্গা কুলকুল স্বরে গাহিতেছে। “পিপাসা, পিপাসা” আপন মনে গাহিয়া বহিয়া যাইতেছে! একি তুমি স্বয়ং জল, তোমার আবার পিপাসা কেমন? উত্তর পাইলাম, “সাগর-পিপাসা”। আহা! তাই ত, সংসারে তবে সকলেই পিপাসু? হইতে পারে, সাগরের-যাহার চরণে, জাহৃবি! তুমি আপনার প্রাণ ঢালিতে যাইতেছ, তাহার পিপাসা নাই। তবে দেখা যাউক।
একদিন সিন্ধু’তটে সিক্ত বালুকার উপর বসিয়া সাগরের তরঙ্গ গণনা করিতেছিলাম। ঊর্ম্মিমালা কি যেন যাতনায়, কি যেন বেদনায় ছটফট করিয়া গড়াইয়া গড়াইয়া আছাড়িয়া পড়িতেছিল। এ অস্থিরতা, এ আকুলতা কিসের জন্য? সবিস্ময়ে সাগরকে জিজ্ঞাসা করিলামঃ
তব এই সচঞ্চল লহরীমালায়
কিসের বেদনা লেখা?-পিপাসা জানায়!
পিপাসা নিবৃত্ হয় সলিল-কৃপায়,
বল হে জলধি! তব পিপাসা কোথায়?
আবার তাহার গভীর গর্জ্জনে শুনিলাম, “পিপাসা, পিপাসা”! হায়! এই পোড়া পিপাসায় জ্বালায় আমি দেশান্তরে পলাইয়া আসিলাম, এখানেও ঐ নিষ্ঠুর কথাই শুনিতে পাই। চক্ষু মুদ্রিত করিলাম-ঐ তরঙ্গে তরঙ্গে আর পিপাসা দেখিতে ইচ্ছা ছিল না। সমুদ্র আবার গম্ভীর গর্জ্জন করিল। এবারও তাহার ভাষা বুঝিলাম,-স্পষ্ট শুনিলাম,-“পিপাসা, পিপাসা।”!!
“পিপাসা পিপাসা”-মুর্খ মানব! জান না এ কিসের পিপাসা? কোথায় শুনিয়াছ সাগরের পিপাসা নাই? এ হৃদয়ের দুর্দ্দান্ত পিপাসা কেমন করিয়া দেখাইব? আমার হৃদয় যত গভীর, পিপাসাও তত প্রবল! এ সংসারে কাহার পিপাসা নাই? পিপাসা পিপাসা-এইটুকু বুঝিতে পার না? ধনীর ধন-পিপাসা, মানীর মান-পিপাসা, সংসারীর সংসার-পিপাসা। নলিনীর তপন-পিপাসা, চকোরীর চন্দ্রিকা-পিপাসা! অনলেরও তীব্র পিপাসা আছে! আহা! এই মোটা কথা বুঝ না? পিপাসা না থাকিলে ব্রহ্মাণ্ড ঘুরিত কি লক্ষ্য করিয়া? আমার হৃদয়ে অনন্ত প্রণয়-পিপাসা,-যতদিন আছি, পিপাসাও থাকিবে! প্রেমিকের প্রেম-পিপাসা,-প্রকৃতির ঈশ্বর পিপাসা! এইটুকু কি বুঝিতে পার না?····”
তাই বটে, এত দিনে বুঝিলাম, আমার হৃদয়ে কেন সদা হু হু করে, কেন সদা কাতর হয়। এ হৃদয়ের পিপাসা তুচ্ছ বারি পিপাসা নহে। ইহা অনন্ত প্রেম-পিপাসা। ঈশ্বর একমাত্র বাঞ্জনীয়, আর সকলে পিপাসী-ঐ বাঞ্জনীয় প্রেমময়ের প্রেম-পিপাসী!!
আমি তবে বাতুল নহি। আমি যে পিপাসা দেখি, তাহা সত্য-কল্পিত নহে! আমি যে পিপাসা শুনি, তাহাও সত্য-কল্পনা নহে! ঈশ্বর প্রেম, এ বিশ্বজগৎ প্রেম-পিপাসু।
********************
১
একদা জয়নাল আবেদীন (হোসেনের পুত্র) জনৈক কসাইকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ছাগল জবেহ করিতে আনিয়াছ, উহাকে কিছু খাইয়াইয়াছ?” কসাই উত্তর করিল, “হ্যাঁ, ইহাকে এখনই প্রচুর জলপান করাইয়া আনিলাম!” ইহা শুনিয়া তিনি বলিলে, “তুমি ছাগলটাকে প্রচুর জলপানে তৃপ্ত করিয়া জবেহ করিতে আনিয়াছ; আর শিমর আমার পিতাকে তিন দিন পর্যন্ত জলাভাবে পিপাসায় দগ্ধ করিয়া জবেহ করিয়াছে!!”
কারবালার যুদ্ধের সময় জয়নাল ভুগিতেছিলেন বলিয়া শহীদ (সমরশায়ী) হয় নাই।
২
ধর্মগুরু মহাত্মা মোহাম্মদের (দঃ) মৃত্যুর পর, ক্রমান্বয়ে আবুবকর সিদ্দিক, ওমর খেতাব ও ওসমান গনি “খলিফা” হইলেন। চতুর্থবারে আলী খলিফা হইবেন, কি মোয়াবীয়া খলিফা হইবেন, এই বিষয়ে মতভেদ হয়। একদল বলিল, “মোয়াবীয়া হইবেন,” একদল বলে “আলী মোহাম্মদের (দঃ) জামাতা, তিনি সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারী”। এইরূপে বিবাদের সূত্রপাত হয়।
অতঃপর মোয়াবীয়ার পুত্র এজিদ, আলীর পুত্র হাসান ও হোসেনের সর্ব্বনাশ করিতে বদ্ধপরিকর হইল। এজিদ মহাত্মা হাসানকে কৌশলে বিষ পান করাইয়া হত্যা করে। ইহার এক বৎসর পরে মহাত্মা হোসেনকে ডাকিয়া (নিয়ন্ত্রণ করিয়া) কারবালায় লইয়া গিয়া যুদ্ধে বধ করে।
কেবল যুদ্ধ নহে-এজিদের দলবল ইউফ্রেতীজ নদী ঘিরিয়া রহিল; হোসেনের পরে কোন লোককে নদীর জল লইতে দেয় নাই। পানীয় জলের অভাবেই তাঁহারা আধমরা হইয়াছিলেন। পরে যুদ্ধের নামে একই দিন হোসেন আত্মীয়স্বজনসহ নিহত হইলেন। এ কথায় মতভেদ আছে; কেহ বলেন, তিন দিন যুদ্ধ হয়, কেহ বলেন একই দিন যুদ্ধ করিয়া সকলে সমরশায়ী হইয়াছেন। নদীর জল হইতে হোসেনকে বঞ্চিত করিয়া এজিদ অশেষ নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করিয়াছে।