আমার এই প্রবন্ধ পাঠ করিয়া ভ্রাতা ভগ্নীগণ হয়ত মনে করিবেন যে আমি কেবল ভ্রাতৃবৃন্দকে নরাকারে পিশাচরূপে অঙ্কিত করিবার জন্যই কলম ধরিয়াছি। তাহা নয়। আমি ত কোথাও ভ্রাতাদের প্রতি কটু শব্দ ব্যবহার করি নাই-কাহাকেও পাপিষ্ঠ, পিশাচ, নিষ্ঠুর বলিয়াছি কি ? কেবল রমণীহৃদয়ের ক্ষত দেখাইয়াছি। ঐ যে কথায় বলে, “বলিতে আপন দুঃখ পরনিন্দ হয়”, এক্ষেত্রে তাহাই হইয়াছে-ভগ্নীর দুঃখ বৰ্ণনা করিতে ভ্রাতৃনিদা হইয়া পড়িয়াছে।
সুখের বিষয় আমাদের অনেক ভ্রাতা এরূপ আছেন, যাঁহারা স্ত্রীলোকদিগকে যথেষ্ট শান্তিতে গৃহসুখে রাখেন। কিন্তু দুঃখের সহিত আমরা ইহাও বলিতে বাধ্য যে অনেক ভ্রাতা আপন আপন বাটীতে অন্যায় স্বামীত্বের পরিচয় দিয়া থাকেন।
এখন বোধ হয় সুযোগ্য ভ্রাতৃগণ বুঝিবেন যে “এত বড় সংসারে আমরা নিরাশ্রয়া” বলিয়া আমি ভুল করি নাই—ঐ কথার প্রতিবর্ণ সত্য। আমরা যে কোন অবস্থায় থাকি না কেন, অভিভাবকের বাটীতে থাকি। প্রভুদের বাটী যে আমাদিগকে সৰ্ব্বদাই রৌদ্র, বৃষ্টি, হিম হইতে রক্ষা করে, তাহা নহে। তবু :
যখন আমাদের চালের উপর খড় থাকে না, দরিদ্রের জীর্ণতম কুটীরের শেষ চালখানা ঝঞ্চানিলে উড়িয়া যায়,–টুপ-টাপ বৃষ্টিধারায় আমরা সমস্ত রাত্রি ভিজিতে থাকি,-চপলাচমকে নয়নে ধাধা লাগে,—বজুনাদে মেদিনী কাপে, এবং আমাদের বুক কঁপে,—প্রতি মুহূৰ্ত্তে ভাবি, বুঝি বজ্রপাতে মারা যাই—তখনও আমরা অভিভাবকের বাটীতেই থাকি !
যখন আমরা রাজকন্যা, রাজবধুরূপে প্রাসাদে থাকি, কখনও প্রভু-গৃহে থাকি। আবার যখন ঐ প্রাসাদতুল্য ত্রিতল অট্টালিকা ভূমিকম্পে চূর্ণ হয়,—সোপান অতিক্রম করিয়া অবতরণ কালে আমাদের মাথা ভাঙ্গে, হাত পা ভাঙ্গে—রক্তাক্ত কলেবরে হতজ্ঞান প্রায় অবস্থায় গোশালায় গিয়া আশ্রয় লই,—তখনও অভিভাবকেব বাটীতে থাকি ! ! ‘
অথবা গৃহস্থের বেী-বী রূপে প্রকাণ্ড আটচালায় বাস করিলেও প্রভুর আলয়ে থাকি ; আর যখন চৈত্র মাসে ঘোর অমানিশীথে প্রভুর বাটীতে দুষ্টলোক কর্তৃক লঙ্কাকাণ্ডের অভিনয় হয়,—সব জিনিষপত্রসহ ঘরগুলি দাউদাউ করিয়া জুলিতে থাকে,—আমরা একবসনে প্রাণটি থাকি,–তখনও অভিভাবকের বাটীতে থাকি ! ! ! (জানি না, কবরের ভিতরও অভিভাবকের বাটীতে থাকা হয় কি না ! !)
ইংরাজিতে Home বলিলে যাহা বুঝায়, “গৃহ” শব্দ দ্বারা আমি তাহাই বুঝাইতে চাই। উপরে যে রাণী, রমা, হামিদ, জোবেদা প্রভৃতির অবস্থা বলা হইয়াছে, তাঁহারা কি গৃহসুখ ভোগ করিতেছেন ? শারীরিক আরাম ও মানসিক শান্তিনিকেতম যাহা, তাহাই গৃহ। বিধবা হইলে স্বামীগৃহ একরূপ বাসের অযোগ্য হয় ; হতভাগিনী তখন পিতা, ভ্রাতার শরণাপন্ন হয় কিন্তু তাহাতে তাঁহার যে দশা হয়, সৌদামিনী-চিত্রে বর্ণিত হইয়াছে। একটা হিন্দুপ্রবাদ আছে:
“ঘর কি জ্বলি বনমেঁ গেয়ী—বনমেঁ লাগি আগ
বন বেচারা কেয়া করে,–কর্মমেঁ লাগি আগ!”
অর্থাৎ “গৃহে দগ্ধ হইয়া বনে গেলাম, বনে লাগিল আগুন ; বন বেচারা কি করিবে, (আমার) কপালেই লাগিয়াছে আগুন!”
তাই বলি, গৃহ বলিতে আমাদেরই একটি পর্ণকুটীর নাই। প্রাণি-জগতে কোন জন্তুই আমাদের মত নিরাশ্রয়া নহে। সকলেরই গৃহ আছে–নাই কেবল আমাদের।(৬)
————————–
১. এ প্রবন্ধে উল্লিখিত ব্যক্তিদেব নামগুলি কল্পিত। বর্ণনার সুবিধার নিমিত্ত এরূপ নাম দেওয়া হইল।
২. কোন বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ কোন ঘটনা আমাদেব লক্ষ্য নহে। এদিক ওদিককাব সত্য ঘটনাসমূহ হইতে উপকরণ সংগ্ৰহ করিয়া একটা সাধাবণ চিত্র অঙ্কিত হইল মাত্র। ইহাতে কোন নদীব একধরে আম্রকানন, অন্য তীবে (আমেবিকার) নায়েগাবা ফলসএব তটস্থিত নীহাবাবৃত পত্রহীন তরুরাজি দেখিয়া কেহ চিত্রকরকে আনাভী মনে কবিবেন না,-যেহেতু নদী, আমুকানন, তুষাবাবৃত তরু—এ সবই সত্য।
৩. মোর্সেদ—গুরু।
৪. সের্তাজ–সেব—তাজ) মাথার মুকুট, অর্থাৎ মুকুটতুল্য শ্ৰদ্ধাস্পদ ।
৫. স্ত্রীলোকদের দুঃখকাহিনীপূৰ্ণ একটি প্রবন্ধ কোন উর্দু সংবাদপত্রে প্রকাশের নিমিত্ত দেওয়া হইয়াছিল। সম্পাদক তাহা প্রকাশ করিতে সাহসী হন নাই—লিখিলেন যে, এরূপ প্রবন্ধ প্রকাশ করিলে সাধারণ পূরুষসমাজ চটিবেন! সুখের বিষয়, বাঙ্গাল কাগজগুলির যথেষ্ট সৎসাহস আছে, তাই বক্ষা ; নচেৎ আমাদের দুঃখেব কান্না কাদিবার উপাযও থাকিত না !
৬. আমাদের যে সকল ভগ্নী গৃহসুখভোগ করেন, এ সন্দর্ভটি তাহদের জন্য লিখা হয় নাই—ইহা গৃহহীনাদের জন্য।