কাসেম অন্তঃপুরে আসিয়া মোহসেনাকে বুঝাইলেন যে, মামলা মোকদ্দমায় অনেক হেঙ্গাম ; ওসব গোলমাল না করাই ভাল! অভাগিনী ক্রোধে, অভিমানে নীরবে দগ্ধ হইতে থাকিলেন ! !
ঐরূপ আরও কত উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। খদিজা প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী, তাঁহার স্বামী হাশেম দরিদ্র কিন্তু কুলীন বিদ্বান। হাশেম ছলে কৌশলে সমস্ত জমিজমা আত্মসাৎ করিয়া লইলেন ; খদিজার হাতে এক পয়সা নাই। খদিজার পৈত্রিক বাড়ীতে বসিয়াই হাশেম আর দুই তিনটা বিবাহ (?) করিয়া তাহাকে সতিনী জ্বালায় দগ্ধ করিতে লাগিলেন। এরূপ না করিলে আর ক্ষমতাশালী পুরুষের বাহাদুর কি? ইহাতে যদি খদিজা সামান্য বিরক্তি প্রকাশ করেন, তবে প্রবীণ মহিলাগণ তাঁহার হৃদয়ে স্বামভক্তির অভাব দেখিয়া নিন্দ করেন, কেহ দুই একটা জীর্ণ পুথি (মসলামসায়েলের বঙ্গানুবাদ) দেখাইয়া বলেন, “স্বামী মাথা কাটিলে “আহ বলিতে নাই!” কেহ সুরযোগে আবৃত্তি করিলেন:
“নারীর মোর্সেদ(৩) স্বামী সের্তাজ(৪) জানিবে
মোর্সেদের সম নারী পতিকে ভজিবে ”
যাহা হউক খদিজার দুঃখে সহানুভূতি করিবে, এমন লোকটি পর্যন্ত নাই! ইহাকে নরকযন্ত্রণা ভিন্ন আর কি বলিব ? কোন মৌলভী বক্তৃতা (ওয়াজ) করিতে যাইয়া বলিয়াছেন, “স্ত্রীলোকে বেশী গুণা (দোষ) করে ; হযরত মেয়ারাজ গিয়া দেখিয়াছেন নরকে বেশীর ভাগে স্ত্রীলোক শাস্তি পাইতেছে।” আমরা কিন্তু এই পৃথিবীতেই দেখিতেছি—কুলকামিনীরা অসহ্য নরকযন্ত্রণা ভোগ করিতেছেন!
৮। পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ হইতে কন্যাকে বঞ্চিত করিবার নিমিত্ত কি কি জঘন্য উপায় অবলম্বন করা হইয়া থাকে, তাহা কে না জানে? কোন ভ্রাতা তাহা মুখ ফুটিয়া বলেন না—বলিলে অবলাকে প্রশ্ৰয় দেওয়া হইবে যে !(৫) সুতরাং সে শোচনীয় কথা আমাদিগকেই বলিতে হইতেছে। কোন স্থলে আফিংখোর, গাজাখোর, নিরক্ষর, চিররোগী বৃদ্ধ—যে মোকদ্দমা করিয়া জমিদারীর অংশ বাহির করিতে অক্ষম এইরূপ লোককে কন্যাদান করা হয়! অথবা ভগীর দ্বারা বিবাহের পূবেবই লা-দাবী লিখাইয়া লওয়া হয় কিম্বা ভগ্নীদিগকে চিরকুমারী রাখা হয় ; এবং ভ্রাতৃবধূ ননদদিগকে দাসীর মত ভাবেন! আর যদি কোন পরিবারে পুত্র মোটেই না থাকে, কেবল ডজন, অদ্ধ ডজন কন্যাই থাকে,—তবে জ্যেষ্ঠ ভগ্নীর ভাগ্যবান স্বামীটি অবশিষ্ট শ্যালিকা কয়টিকে চিরকুমারী রাখিতে চেষ্টা করেন! ইহাই সমাজের নালীঘা! হায় পিতা মোহাম্মদ (দঃ) ! তুমি আমাদের উপকারের নিমিত্ত পিতৃসম্পত্তিতে অধিকারিণী করিয়াছ, কিন্তু তোমার সুচতুর শিষ্যগণ নানা উপায়ে কুলবালাদের সৰ্ব্বনাশ করিতেছে! আহা! “মহম্মদীয় আইন” পুস্তকের মসি-রেখারূপে পুস্তকেই আবদ্ধ থাকে। টাকা যার, ক্ষমতা যার, আইন তাঁহারই। আইন আমাদের ন্যায় নিরক্ষর অবলাদের নহে !
৯। নববিধবা সৌদামিনী দুই পুত্র ও এক কন্যাসহ ভ্রাতার আলয়ে আশ্ৰয় লইয়াছেন। ৯/১০ মাস পরে তাঁহার (১৫ ও ১২ বৎসরের) পুত্র দুইটি দশ দিনের ভিতর মারা যায়। সৌদামিনীর নিকট ১০০০০ টাকার কোম্পানীর কাগজ ছিল।
যে সময় বিধবা সৌদামিনী পুত্ৰশোকে পাগলপ্রায় ছিলেন, সেই সুযোগে (অর্থাৎ বালকদ্বয়ের মৃত্যুর একমাস পরেই) ভ্রাতা নগেন্দ্র ঐ টাকাগুলি তাঁহারই নামে গচ্ছিত রাখিতে ভগ্নীকে অনুরোধ করিলেন। বলিলেন, “স্ত্রীলোকের নামে টাকা জমা থাকলে গোলমাল হতে পারে। আমি ত আর তোমার পর নই।” ভগ্নার মাথা ঠিক ছিল না, নগেন্দ্র যাহা লিখাইলেন তিনি তাহাই লিখিলেন। ভাবিলেন, “আমন চাদ যদি গিয়াছে, তবে আর পোড়ার টাকা থেকে কি হবে? প্রতিভার বিয়ে ত নগেন্দ্র দিবেই। আমি এখন মলে র্বাচি। নগেন্দ্র ক্রমে দুই তিনটা কন্যাদায় হইতে মুক্ত হইলেন। কিন্তু প্রতিভার বিবাহের জন্য মোটেই ভাবেন না। তাঁহার বয়স ১২ বৎসর হইলে সৌদামিনী তাঁহার বিবাহের জন্য ব্যস্ত হইলেন। তিনি যত তাড়া করেন, নগেন্দ্র ততই বলেন, “বর পাওয়া যায় না !”
প্রতিভা ১৫ বৎসরের হইল—বিবাহ হইল না। ১০০০০ টাকা দিয়া বর পাওয়া যায় না, একথা কি পাঠিকা বিশ্বাস করেন ? প্রতিবেশিনীরা নিন্দা করে, অভিশাপ দেয়, “ছি ছি কেমন মামা ” বলে, তাহাতে নগেন্দ্রের কি ক্ষতি হয়। পল্লিগ্রামের নিন্দা অপবাদ চতুপাশ্বস্থিত শস্যক্ষেত্রেই বিলীন হয়। প্রকাণ্ড পাটক্ষেত্রে বড় বড় শূকর লুকায়িত থাকিতে পারে, আর ঐ নিন্দাটুকু লুকাইতে পারবে না?
এখন সৌদামিনী দেখিলেন তাঁহার স্বামীর কষ্টে উপাজ্জিত টাকা দ্বারা নগেন্দ্রের অবস্থা ভাল হইল, কন্যাদের বিবাহ হইল–কেবল তাঁহারই একমাত্র প্রতিভা কুমারী রহিল!!
ভগ্নী মানকুমারী বলিয়াছেন :
“কাঁদ তোরা অভাগিনী। আমিও কাঁদিব,
আর কিছুনাহি পারি, ক’ ফোটা নয়ন বারি
ভগিনী ! তোদেরি তরে বিজনে ঢালিব ;
যখন দেখিব চেয়ে অনুঢ়া “প্রাচীন মেয়ে”
কপালে যোটেনি বিয়ে—তখনি কাঁদিব,
যখন দেখিব বালা সহিছে সতিনি জ্বালা
তখনি নয়ন জলে বুক ভাসাইব;
সধবা বিধবা প্রায় পরান্ন মাগিয়া খায়—
এ তুচ্ছ এ হীন প্রাণ দিতে পারি বলিদান—
তোদেরি কল্যাণে বোন ! কিন্তু কি করিব ?
কাঁদিতে শকতি আছে, কাঁদিয়া মরিব।“
আমি কিন্তু তাঁহার সহিত একমত হইয়া কাঁদিবার সুরে সুর মিলাইতে পারিতেছি না। আমার ভগ্নীটি অবশেষে সবখানি শক্তি কেবল “কাঁদিয়া মরিতে” ব্যয় করিলেন। বাস। ঐরাপ বিজনে অশ্রু ঢালিয়া ঢালিয়াই ত আমরা এমন অবলা হইয় পড়িয়াছি।