৬। আমরা একটি রাজবাটী দেখিতে গিয়াছিলাম। অবশ্য রাজার অনুপস্থিতি সময় যাওয়া হইয়াছিল। তিনি উপাধিপ্রাপ্ত রাজা-রাজ্যের বার্ষিক আয় প্রায় ৫০০০০০ টাকা।
বাড়ীখানি কবি-বর্ণিত অমরাবতীর ন্যায় মনোহর। বৈঠকখানা বিবিধ মূল্যবান সাজসজ্জায় ঝলমল করিতেছে ; এদিকে সেদিকে ৫/৭ খানা রজত-আসন শূন্য হৃদয়ে রাজাকে আহবান করিতেছে! এক কোণ হইতে রবির একটু ক্ষীণরশ্মি একটি দর্পণে পড়িয়াছিল ; তাঁহার প্রতিরশ্মি চারিদিকে বেল্লুরের ঝাড়ে প্রতিভাত হইয়া এক অভিনব আলোকরাজ্য রচনা করিয়া ফেলিয়াছে ! এক কক্ষে রাজার রৌপ্যনির্মিত পৰ্য্যঙ্কখানা মশারী ও শয্যায় পরিশোভিত হইয়া প্রবাসী রাজার অপেক্ষা করিতেছে। পাঠিকা হয়ত বলিবেন, “খাটখানা রাণী ব্যবহার করেন না কেন ?” তাহা হইলে সমাগত লোকেরা ও লক্ষ টাকার পর্য্যঙ্কখানা দেখিতে পাইত না যে ! বহিববাটী পরিদর্শন করিয়া আমরা রাণীর মহলে গেলাম ।
রাণীর ঘর কয়খানাতেও টেবিল, টিপাই, চেয়ার ইত্যাদি সাজসজ্জা আছে। কিন্তু তাঁহার উপর ধূলার স্তর পড়িয়াছে। রাজা কোন কালে এসব কক্ষে পদার্পণ করেন বলিয়া বোধ হইল না। রাণীর শয্যাপার্শ্বে কয়েকখানা বাঙ্গালা পুস্তক এলোমেলোভাবে ছড়ান রহিয়াছে।
রাণীকে দেখিয়া আমি হতাশ হইলাম। কারণ বৈঠকখানা দেখিয়া আমি রাণীর যেরূপ মূৰ্ত্তি কল্পনা করিয়াছিলাম, এ মূৰ্ত্তি তাঁহার সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি পরমা সুন্দরী (১৬/১৭ বৎসরের) বালিকা—পরিধানে সামান্য লালপেড়ে বিলাতি ধুতি ; অলঙ্কার বলিতে হাতে তিন তিন গাছি বেল্লুরের চুড়ি, মাথায় রুক্ষ কেশের জটা—অনুমান পনের দিন হইতে তৈলের সহিত চুলগুলির সাক্ষাৎ হয় নাই, মুখখানি এমনই করুণ ভাবে পূর্ণ যে রাণীকে মূৰ্ত্তিমতী “বিষাদ” বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অনেকের মতে চক্ষু মনের দর্পণ স্বরূপ। রাণীর নয়ন দুটিতে কি কি হৃদয়বিদারক ভাব ছিল, তাহা আমি বর্ণনা করিতে অক্ষম |
রাজা সৰ্ব্বদা বিদেশে,–বেশীর ভাগে কলিকাতায় থাকেন। সেখানে তাঁহার অপ্সরা, বিদ্যাধরীর অভাব হয় না, এখানে রাণী বেচারী চিরবিরহিণী ! ! বাড়ীতে দাস দাসী, ঠাকুর দেবতা, পুরোহিত ইত্যাদি সবই আছে ; আনন্দ কোলাহলও যথেষ্ট আছে, কেবল রাণীর হৃদয়ে আনন্দ নাই! গৃহখানা তাঁহার নিকট কারাগার স্বরূপ বোধ হইতেছে। রাণী যেন একদল দাসীসহ নিৰ্জ্জন কারাবাসদণ্ডভোগ করিতেছেন ! ! আমাদের সঙ্গীয়া একটি মহিলা জনাস্তিকে বলিলেন, “এমন চমৎকার বাড়ী, আর ঘরে এমন পর র্যার, তিনি কি সুখে বিদেশে থাকেন !”
রাণী বাঙ্গালা বেশ জানেন । তিনি কেবল বই পড়িয়া দুৰ্ব্বহ সময় কাটান। তিনি— মিতভাষিণী, বেশী কিছু বলিলেন না, কিন্তু যে দুই একটি কথা বলিলেন, তাহা অতি চমৎকার। আমাদের একটি বর্ষীয়সী সঙ্গিনী বলিলেন, “তুমি রাজার রাণী, তোমার এ বেশ কেন? এস আমি চুল বেঁধে দিই।” রাণী উত্তর দিলেন, “জানি না কি পাপে রাণী হয়েছি।” ঠিক কথা ! অথচ লোকে এই রাণীর পদ কেমন বাঞ্ছনীয় বোধ করে !
অন্তঃপুরের ঐ সকল ক্ষতকে নালীঘা না বলিয়া আর কি বলিব ? এ রোগের কি ঔষধ নাই ? বিধবা ত সহমরণ-আকাঙ্ক্ষা করে ; সধবা কি করিবে ? ‘
৭। “মহম্মদীয় আইন” অনুসারে আমরা পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হই— “আমাদের বাড়ীও হয়। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়—বাড়ীর প্রকৃত কৰ্ত্তা স্বামী, পুত্র, জামাতা, দেবর ইত্যাদি হন। তাহাদের অভাবে বড় আমলা বা নায়েবটি বাড়ীর মালিক ! গৃহকর্ত্রীটি ঐ নায়েবের ক্রীড়াপুতুল মাত্র। নায়েব কত্রীকে যাহা বুঝায়, অবোধ নিরক্ষর কত্রী তাহাই বুঝেন।
গৃহকর্ত্রী মোহসেন স্বীয় জামাতার সহিত কলহ করিয়া দুই এক দিনের জন্য কোন দূর সম্পৰ্কীয় দেবর কাসেমের বাড়ী যান। এ বাড়ীখানা মোহসেনার পৈতৃক সম্পত্তি—সুতরাং ইহা তাঁহার একান্তু “আপন” বস্তু। কত্রীর একমাত্র দুহিতাও মারা গিয়াছেন ; তবু তিনি জামাতাকে (দুই চারিঞ্জন দৌহিত্রী ইত্যাদি সহ) বাড়ীতে রাখিয়াছেন। এরূপ স্থলে জামাতা জামালকে শাশুড়ীর আশ্রিত বলা যাইতে পারে। কিন্তু তামাসা দেখুন, মোহসেনা গৃহে ফিরিয়া আসিলে, দ্বারবান তাহাকে জানাইল, এ বাড়ীতে তাঁহার প্রবেশ নিষেধ। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধা হইয়া বলিলেন—“কি ? আমার বাড়ীতে আমারই প্রবেশ নিযেধ ? পৰ্দা কর, আমি (শিবিকা হইতে) নামিব।”
দ্বারবান–পর্দা করিতে পারি না, মালিকের হুকুম নাই।
কর্ত্রী–কে তোর মালিক ? একমাত্র মালিক ত আমি !
দ্বারবান—বে-আদবী মাফ হউক ; হুজুর কি আমাকে তাঁহার পয়জার হইতে রক্ষা করিতে পারেন? হুজুর ত পর্দায় থাকেন, আমরা জামাল মিয়াকেই জানি। আপনি মালিক, তাহা ত দুনিয়া জানে –কিন্তু আমার প্রতি দয়া করিয়া আপনি ফিরিয়া যান। আপনি এখানে নামিলে গোলামের উপর জুলুম হবে। হুজুরেরও অপমান হওয়ার সম্ভাবনা।
যাহা হউক, হুজুর ফিরিয়া গেলেন!! তিনি কাসেমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এমন কি কোন আইন নাই, যাহার দ্বারা আমার বাড়ী আমি দখল করিতে পারি?” কাসেম বলিলেন, “আছে। আপনি নালিশ করুন, আমরা সাহায্য করিব।” ওদিকে জামাল এই নালিশের বিযয় জানিতে পারিয়া কাসেমের নিকট আসিলেন। সবিনয়ে মিষ্ট ভাষায় কাসেমকে বুঝাইলেন, “আজ আপনি যদি আমার শাশুড়ীর সাহায্য করেন, তবে ত অন্তঃপুরিকদের প্রশ্ৰয় দেওয়া হয়। যদি কখন আপনার এরূপ বিপদ ঘটে তবে কেহ আপনার পরিবারের স্ত্রীলোকদের সাহায্য করবে, আপনি কি তাহা পসদ করবেন? ভাবিয়া দেখুন, এরূপ হওয়া কি ভাল? মিছামিছি শক্রতা পাতাইবেন কেন?”