পাঠিকা কি মনে করেন যে হসিনা বা জমিলা গৃহে আছেন? অবশ্য না ; কেবল চারি প্রাচীরের ভিতর থাকিলেই গৃহে থাকা হয় না। এদেশে বাসরঘরকে “কোহ্বর” বলে, কিন্তু “কবর” বলা উচিত ! ! বাড়ীখানা ত শরাফতের, সেখানে যেমন এক পাল ছাগল আছে, হংস কুকুট আছে, সেইরূপ একদল স্ত্রীলোকও আছেন! অথবা স্ত্রীলোকদের “বন্দিনী” বলা যাইতে পারে! যেহেতু র্তাহাদের পারিবারিক জীবন নাই! আপনার নিজের বাড়ীর কথা মনে করুন। তাহা হইলে হসিনর অবস্থা বুঝবেন।
২। অনেক পরিবারের গৃহিণীদের সম্বন্ধে এরূপ বলা যাইতে পারে—“বাহার মিঁয়া হফ্ত্ হাজারী, ঘরমেঁ বিবি কাহাৎ কি মারী।” অর্থাৎ, বাহিরে ত যথেষ্ট জাঁকজমক—যেন স্বামী সাতহাজার সেনার অধিনায়ক ; আর অন্তঃপুরে গৃহিণী দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িতা ! ! বাহিরে বৈঠকখানা আছে, আস্তাবল আছে—অনেক কিছু আছে, আর ভিতরে গৃহিণীর নমাজের উপযুক্ত স্থান নাই!
৩। এখন আমরা অন্তঃপুরের ক্ষতস্থল দেখাইব। সাধারণতঃ পরিবারের প্রধান পুরুষটি মনে করেন গৃহখানা কেবল “আমার বাটী”—পরিবারস্থ অন্যান্য লোকেরা তাঁহার আশ্রিতা। মালদহে কয়েকবার আমরা একজনের বাটতে যাতায়াত করিয়াছি। গৃহস্বামী কলিমের স্ত্রীকে আমরা কখনো প্রফুল্লময়ী দেখি নাই। তাঁহার ম্নান মুখখানি নীরবে আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি আকর্ষণ করিত। ইহার কারণ এই—কয় বৎসর অতীত হইল, কলিম স্বীয় ভায়রাভাইএর সহিত বিবাদ করিয়াছেন; তাঁহার ফলে কলিমের পত্নী স্বীয় ভগ্নীর সহিত দেখা করিতে পান না। তিনি এতটুকু ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া বলিতে পারেন না, “আমার ভগ্নী আমার নিকট অবশ্য আসিবেন।” হায় ! বাটী যে কলিমের । তিনি যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন, যাহাকে ইচ্ছা আসিতে দিবেন না! আবার ওদিকে ও বাটখানা সলিমের। সেখানে কলিমের পত্নীর প্রবেশ নিষেধ !
বলা বাহুল্য কলিমের স্ত্রীর অন্ন, বস্ত্র বা অলঙ্কারের অভাব নাই। বলি, অলঙ্কার কি পিতৃমাতৃহীনা অবলার একমাত্র ভগ্নীর বিচ্ছেদ-যন্ত্রণা ভুলাইতে পারে? শুনিলাম, তিনি সপত্নী-কন্টক হইতেও বিমুক্ত নহেন। এরূপ অবস্থায় তাঁহার নিকট গৃহ কি শান্তিনিকেতন (sweet home) বলিয়া বোধ হয় ? তিনি কি নিভৃতে নীরবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ভাবেন না, “আমার মত হতভাগী নিরাশ্রয়া আর নাই।”
৪। একস্থলে দুই ভ্ৰাতায় কলহ হইল—মনে করুন, বড় ভাইটির নাম “হাম”, ছোট ভাইটির নাম “সাম”। ভ্রাতার সহিত বিবাদ করিয়া হাম স্বীয় কন্যাকে বলিলেন, “হামিদা ! তুমি যতদিন আমার বাটীতে আছ, ততদিন জোবেদাকে (সামের কন্যা) পত্র লিখিতে পাইবে না।” পিতৃ-আদেশ অবশ্যই শিরোধাৰ্য্য। কিন্তু হামিদা আশৈশব যে পিতৃব্যতনয়াকে ভালবাসিয়াছে, তাহাকে হঠাৎ ভুলিয়া যাওয়া তাঁহার পক্ষে সহজ নহে। যন্ত্রণায় তাঁহার হৃদয় বিদীর্ণ হইতে লাগিল—যে দুইটি বালিকার শৈশবের ধূলাখেলার স্মৃতি উভয়ের জীবনে বিজড়িত রহিয়াছে—দূরে থাকিয়াও যাঁহারা পত্রসূত্রে একত্র গ্রথিতা ছিল, আজ সেই একবৃন্তের কুসুম দুইটিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া হাম গৃহস্বামিত্বের পরিচয় দিলেন। দুইটি অসহায়া অক্ষমা বালিকার কোমল হৃদয় দলিত ও চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া গৃহস্বামী স্বীয় ক্ষমতা প্রকাশ করিলেন!! বলা বাহুল্য, জোবেদাও হামিদাকে পত্র লিখিতে অক্ষম ! যদি তাঁহারা কোন প্রকারে পরস্পরকে চিঠি পাঠায়—তবে হামিদার পত্র সাম আটক (intercept) করেন, জোবেদার পত্র হামের কবলে পড়িয়া মারা যায় ! ! বালিকাদ্বয়ের রুদ্ধ-অশ্রু, হৃদয়বিদারী দীর্ঘনিশ্বাস যবনিকার অন্তরালেই বিলীন হয়! শুনা যায়, আইন অনুসারে ১৮ (কিম্বা ২২) বর্ষীয়া কন্যার চিঠিপত্র আটক (intercept) করিতে পিতা অধিকারী নহেন। সে আইন কিন্তু অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতে পায় না! কবি বেশ বলিয়াছেন :
“তোমরা বসিয়া থাক ধরা প্রান্তভাগে,
শুধু ভালবাস। জান না বাহিরে বিশ্বে
গরজে সংসার”—
তাইত ; আইন আছে, থাকুক, তাহাতে হামিদ বা জোবেদার লাভ কি ? ঐরাপ কত পত্র দেবর ভাসুর প্রভৃতি কর্ত্তৃক অবরুদ্ধ (intercepted) হয়, কে তাঁহার সংখ্যা করে ? বিধবা ভ্রাতৃবধূটি স্বীয় ভ্রাতা ভগিনীর চিঠিপত্র লইয়া কোনমতে কালক্ষেপ করেন—যদি আশ্রয়দাতা দেবরটি বিরক্ত হন, তবে আর তাঁহার ভ্রাতা ভগ্নীর পত্র পাইবার উপায় নাই! অসহায়া অন্তঃপুরিকাদিগকে ঈশ্বর ব্যতীত আর কে সাহায্য করবে?
৫। আমরা রমাসুদরীকে অনেকদিন হইতে জানি। তিনি বিধবা ; সন্তান সস্তুতিও নাই। তাঁহার স্বামীর প্রভূত সম্পত্তি আছে, দুই চারিটি পাকা বাড়ীও আছে। তাঁহার দেবর এখন সে সকল সম্পত্তির অধীশ্বর। দেবরটি কিন্তু রমাকে একমুঠা অন্ন এবং আশ্রয়দানেও কুষ্ঠিত। আমরা বলিলাম, “ইনি হয়ত দেবর-পত্নীর সহিত কোদল করেন।” এ কথার উত্তরে একজন (যিনি রমাকে ১৪/১৫ বৎসর হইতে জানেন) বলিলেন, “রমা সব করিতে জানে, কেবল কোদল জানে না। রমা বেশ জানে, কি করিয়া পরকে আপন করিতে হয় ; কেবল আপনাকে পর করিতে জানে না।”
“এতগুণ সত্ত্বেও দেবরের বাড়ী থাকিতে পান না কেন?”
“কপালের দোষ !”
হায় অসহায়া অবলা ! তোমরা নিজের দোযকে “কপালের” দোষ বল বটে, কিন্তু ভুগিবার বেলা তোমরাই স্বকীয় কৰ্ম্মফল ভুগিতে থাক! তোমাদের দোষ মূর্খতা, অক্ষমতা, দুৰ্ব্বলতা ইত্যাদি। রমাসুদরী বলিলেন, “বেঁচে থাকতে বাধ্য বলে বেঁচে আছি ; খেতে হয় বলে খাই—আমাদের সেই সহমরণপ্রথাই বেশ ছিল ! গবর্ণমেন্ট সহমরণ-প্রথা তলে দিয়ে বিধবার যন্ত্রণা বৃদ্ধি করেছেন!” ঈশ্বর কি রমার কথাগুলি শুনিতে পান না? তিনি কেমন দয়াময় ?