যাহা হউক, পর্দা কিন্তু শিক্ষার পথে কাটা হইয়া দাড়ায় নাই। এখন আমাদের শিক্ষয়িত্রীর অভাব আছে। এই অভাবটি পূরণ হইলে এবং স্বতন্ত্র স্কুল কলেজ হইলে যথাবিধি পর্দা রক্ষা করিয়াও উচ্চশিক্ষা লাভ হইতে পারে। প্রয়োজনীয় পর্দা কম করিয়া কোন মুসলমানই বোধ হয় শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর হইবেন না।(২)
আশা করি, এখন আমাদের উচ্চশিক্ষা-প্রাপ্ত ভগ্নীগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে বোরকা জিনিষটা মোটের উপর মন্দ নহে।
————————
১. ঐ উপদেশে আমরা কোরণ শরীফের অষ্টাদশ “পারাব” “সুবা নূবের” একটি উক্তির প্রতিধ্বনি শুনিতে পাই। যথা-“বিশ্বাসী স্ত্রীলোকদিগকে বল, তাঁহারা যেন দৃষ্টি সতত নীচের দিকে রাখে (অর্থাৎ চঞ্চল নয়নে ইতস্ততঃ না দেখে !) এবং তাঁহারা যেন আভরণ (বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি ব্যতীত) অন্য লোককে না দেখায়।”
২. এই সন্দর্ভটি লিখিত হইবার পর বর্ত্তমান ছোটলাট Sir Andrew Fraser-এর “The purdah of ignorance” শীর্যক বক্তৃতার অংশবিশেষ দৃষ্টিগোচর হইল। তিনি বলিয়াছেন—“Let the efforts of educationists be first directed to the instruction of out girls within the purdah, and let women begin to exercise her chastening influence on society in spite of the system of seclusion, which only time can modify and violent efforts to shake which can only arouse opposition to female education, instead of doing any immediate practical good in the direction, of emancipation of women” (গত ৮ই মার্চ্চের ‘Telegraph” সংবাদপত্র হইতে উদ্ধৃত হইল।)
আমাদের মতের সহিত ছোটলাট বাহাদুরের মতের কি আশ্চৰ্য্য সাদৃশ্য দেখা যায় !
০৮. গৃহ
গৃহ বলিলে একটা আরাম বিরামের শান্তি-নিকেতন বুঝায়— যেখানে দিবাশেষ গৃহী কৰ্ম্মক্লান্ত শ্ৰান্ত অবস্থায় ফিরিয়া আসিয়া বিশ্রাম করিতে পারে। গৃহ গৃহীকে রৌদ্র বৃষ্টি হিম হইতে রক্ষা করে। পশু পক্ষীদেরও গৃহ আছে। তাঁহারাও স্ব স্ব গৃহে আপনাকে নিরাপদ মনে করে। ইংরাজ কবি মনের আবেগে গাহিয়াছেন :
“Home, sweet home ;
There is no place like home.
Sweet sweet home.”
পিপাসা না থাকিলে জল যেমন উপাদেয় বোধ হয় না, সম্ভবতঃ সেইরূপ গৃহ ছাড়িয়া কতকদিন বিদেশে না থাকিলে গৃহসুখ মিষ্ট বোধ হয় না। বিরহ না হইলে মিলনে সুখ নাই। পুরুষেরা যদিও সর্ববদা বিদেশে যায় না, তবু সমস্ত দিন বাহিরে সংসারক্ষেত্রে থাকিয়া অপরাহ্লে গৃহে ফিরিয়া আসিবার জন্য উৎসুক হয়—বাড়ী আসিলে যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচে।
আবাস বিশ্লেষণ করিলে দুই অংশ দেখা যায়—এক অংশ আশ্রয়স্থান, অপরাংশ পারিবারিক জীবন (অর্থাৎ Home)। গৃহরচনা স্বাভাবিক ; বিহগ বিহগী পরস্পরে মিলিয়া নীড় নিৰ্ম্মাণ করে, শৃগালেরও বাসযোগ্য গৰ্ত্ত প্রস্তুত হয়। ঐ নিলয় ও গৰ্ত্তকে আলয় বলা যাইতে পারে, কিন্তু তাহা প্রকৃত “গৃহ” নয়। সে যাহা হউক,—পশুদের “গৃহ আছে কি না এস্থলে তাহা আলোচ্য নয়।
এখন আমাদের গৃহ সম্বন্ধে দুই একটি কথা বলিতে চাই। আমাদের সামাজিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখি, অধিকাংশ ভারত নারী গৃহসুখে বঞ্চিত। যাঁহারা অপরের অধীনে থাকে, অভিভাবকের বাটীকে আপন ভবন মনে করিতে যাহাদের অধিকার নাই, গৃহ তাহাদের নিকট কারাগার তুল্য বোধ হয়। পারিবারিক জীবনে যে সুখী নহে, যে নিজেকে পরিবারের একজন গণ্য (member) বলিয়া মনে করিতে সাহসী নহে, তাঁহার নিকট গৃহ শান্তি-নিকেতন বোধ হইতে পারে না। কুমারী, সধবা, বিধবা—সকল শ্রেণীর অবলার অবস্থাই শোচনীয়। প্রমাণ স্বরূপ কয়েকটি অন্তঃপুরের একটু একটু নমুনা দিতেছি। এরূপে অন্তঃপুরের পর্দা উঠাইয়া ভিতরের দৃশ্য দেখাইলে আমার ভ্রাতৃগণ অত্যন্ত ব্যথিত হইবেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু কি করি—নালীঘায় অস্ত্র চিকিৎসার একান্ত প্রয়োজন ! ইহাতে রোগীর অতীব যন্ত্রণা হইলেও তাহা রোগীর সহ্য করা উচিত। উপরের চম্পর্মাবরণ খানিকটা না কাটিলে ভিতরের ক্ষত দেখাইব কিরূপে ? তাই ভ্রাতাদের নিকট অন্তঃপুরের কোন কোন অংশের পর্দা তুলিবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করি।
আমি ইহা বলি না, যে আমাদের সমাজের গুণ মোটেই নাই। গুণ অনেক আছে, দোষও বিস্তর আছে। মনে করুন, একজনের এক হাত ভাল আছে, অন্য হাতে নালীঘা হইয়াছে। এক হাত ভাল আছে বলিয়া কি অন্য হাতের চিকিৎসা করা উচিত নহে? চিকিৎসা করিতে হইলে রোগের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করা আবশ্যক।
অদ্য আমরা সমাজ-অঙ্গের ক্ষত স্থলের আলোচনা করিব। সমাজের সুস্থ অংশ নিশ্চিন্ত থাকুক। আমাদের সমাজে অনেক সুখী পরিবার আছেন, তাহদের বিষয় আমাদের আলোচ্য নহে—তাঁহারা সুখে শান্তিতে ঘুমাইতে থাকুন। আসুন পাঠিকা! আমরা লৌহপ্রাচীর-বেষ্টিত অন্তঃপুরের নিভৃত কক্ষগুলি পরিদর্শন করি।
১। বলিয়াছি ত কখন বিদেশে না গেলে গৃহ-আগমন সুখ অনুভব করা যায় না। আমরা একবার (বেহারে) জামালপুরের নিকটবৰ্ত্তী কোন সহরে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। সেখানে আমাদের জনৈক বন্ধুর বাড়ী আছে। সে বাটীর পুরুষের সহিত আমাদের আত্মীয় পুরুষদের . খলাম, মহিলাকয়টি অতিশয় শান্ত শিষ্ট মিষ্টভাষিণী, যদিও কুপমণ্ডুক ! তাঁহারা আমাদের যথোচিত অভ্যর্থনা করিলেন। সেখানে শরাফতের পত্নী হসিনা, ভগ্নী জমিলা, জমিলার কন্যা ও পুত্রবধু প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন। অতঃপর জমিলাকে যখন আমাদের বাসায় যাইতে অনুরোধ করিলাম, তখন তিনি বলিলেন যে তাঁহারা কোন কালে বাড়ীর বাহির হন না, ইহাই তাহাদের বংশগৌরব ! কখনও ঘোড়ার গাড়ী বা অন্য কোন যানবাহনে আরোহণ করেন নাই। শিবিকা—আরোহণের কথায় “হা” কি “না” বলিয়াছিলেন, তাহা আমার ঠিক মনে নাই ! আমি সবিস্ময়ে বলিলাম, “তবে আপনারা বিবাহ করিয়া শ্বশুরবাড়ী যান কিরূপে ? আপনার ভ্রাতৃবধূ আসিলেন কি করিয়া?” জমিলা উত্তর দিলেন, “ইনি আমাদের আত্মীয়-কন্যা—এ পাড়ায় কেবল আমাদেরই গোষ্ঠীর বাড়ী পাশাপাশি দেখিবে।” এই বলিয়া তিনি আমাকে অন্য একটা ঘরে লইয়া গিয়া বলিলেন, “এই আমার কন্যার বাড়ী ; এখন আমার বাড়ী চল।” তিনি আমাকে একটা অপ্রশস্ত গলির (ইহার একদিকে ঘরবাড়ী, অন্যদিকে উচ্চ প্রাচীর) ভিতর দিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া লইয়া গেলেন। তাঁহার সকলগুলি কক্ষ দেখাইলেন। কক্ষগুলি “অসূৰ্য্যম্পশ্য” বলিয়া বোধ হইল। অতঃপর একটি দ্বাব খুলিলে দেখিলাম অপরদিকে হসিনার পুত্রবধু আছে –জমিলা বলিলেন, “দেখিলে, এই দ্বারের ওপাশ্বে আমার ভাইএর বাড়ী, এপাশ্বে আমার বাড়ী। ও কক্ষে বধূ থাকেন বলিয়া এ দ্বারটি বন্ধ রাখি। আমাদের সওয়ারীর দরকার হয় না কেন, তাহা এখন বুঝিলে?” ঐরূপে সকল বাড়ীই প্রদক্ষিণ করা যায়। সমস্ত মহাল্লাটা পৰ্যটন করা আমার অভিপ্রেত না থাকায় আমরা গৃহতুল্য বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। জমিলা বলিয়াছেন, তিনি শীঘ্রই মক্কা শরীফ যাইবেন,—এ পাপদেশে তাঁহার আর থাকিবার ইচ্ছা নাই! আমরা আশা করি, তিনি মক্কা শরীফ হইতে ফিরিয়া আসিলে গৃহ-আগমন সুখটা অনুভব করিবেন।