শহরবানু (হোসেনের স্ত্রী) অনেক যন্ত্রণা নীরবে সহিয়াছেন-আজ আসগরের যাতনা তাঁহার অসহ্য! তিনি অনেক বিনয় করিয়া হোসেনের কোলে শিশুকে দিয়া জল পার্থনা করিতে অনুরোধ করিলেন। বলিলেন,-“আর কেহ জল চাহে না; কেবল এই শিশুকে একটু জল পান করাইয়া আন। শক্র যেন ইহাকে নিজ হাতে জল পান করায়,-জলপাত্রটা যেন তোমার হাতে নাই দেয়!!”
মহাত্মা হোসেন স্ত্রীর কাতরতা এবং শিশুর দুরবস্থা দেখিয়া জল প্রার্থনা করিতে বাধ্য হইয়াছেন। কাতরস্বরে বলিলেন, “আমি বিদেশী পথিক, তোমাদের অতিথি, আমার প্রতি যত ইচ্ছা অত্যাচার কর, সহিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু এ শিশু তোমাদের নিকট কোন দোষে দোষী নহে। পিপাসায় ইহার প্রাণ ওষ্ঠাগত-একবিন্দু জল দাও! ইহাতে তোমাদের দয়াধর্ম্মের কিছুমাত্র অপব্যয় হইবে না!” শক্রগণ কহিল, “বড় বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিয়াছে,-শীঘ্র কিছু দিয়া বিদায় কর।”
বিপক্ষ হইতে শিশুর প্রতি জলের পরিবর্ত্তে তীর বৃষ্টি হইল!!
“পিয়াস লাগিয়া জলদে সাধিনু
বজর পড়িয়া গেল।”
উপযুক্ত অতিথি-অভ্যর্থনা বটে! হোসেন শর-বিদ্ধ আসগরকে তাহার জননীর কোলে দিয়া বলিলেন, “আসগর চিরদিনের জন্য তৃপ্ত হইয়াছে! আর জল জল বলিয়া কাঁদিয়া কাঁদাইবে না! আর বলিবে না-‘পিপাসা, পিপাসা’! এই শেষ!”
*
শহরবানু কি দেখিতেছেন? কোলে পিপাসু শর-বিদ্ধ আসগর, সম্মুখে রুধিরাক্ত কলেবর “শহীদ” (সমরশায়ী) আকবর! অমন চাঁদ কোলে লইয়া ধরণী গরবিণী হইয়াছিল-যে আকবর ক্ষতবিক্ষত হইয়া, পিপাসায় কাতর হইয়া মৃত্যুকালে এক বিন্দু জল পায় নাই। শোণিত-ধারায় যেন লেখা আছে “পিপাসা, পিপাসা”! শহীদের মুদ্রিত নয়ন দুটি নীরবেই বলে যেন “পিপাসা, পিপাসা”!! দৃশ্য ত এইরূপ মর্ম্মভেদী তাহাতে আবার দর্শক জননী!-আহা!!
যে ফুল ফুটিত প্রাতে,-নিশীথেই ছিন্ন হ’ল,
শিশিরের পরিবর্ত্তে রুধিরে আপ্লুত হ’ল!
আরও দেখিলাম,-মহাত্মা হোসেন সমরশায়ী। সমরক্ষেত্রে কেবলই পিপাসী শহীদগণ পড়িয়া আছেন। তাঁহাদের শুঙ্ক কণ্ঠ যেন অস্ফুট ভাষায় বলিতেছে “পিপাসা, পিপাসা”! জয়নব (হোসেনর ভগিনী) মুক্ত কেশে পাগলিনী প্রায় ভ্রাতার নিকট বিদায় চাহিতেছেন। ডাকিয়া, উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিতেছেন,-“ভাই! তোমাকে মরুভূমে ফেলিয়া যাইতেছি! আসিয়াছিলাম তোমার সঙ্গে,-যাইতেছি তোমাকে ছাড়িয়া! আসিয়াছিলাম অনেক রত্নে বিভূষিত হইয়া-যাইতেছি শূন্য হৃদয়ে! তবে এখন শেষ বিদায় দাও! একটি কথা কও, তবে যাই! একটিবার চক্ষু মেলিয়া দেখ-আমাদের দুরবস্থা দেখ, তবে যাই!” জয়নবের দুঃখে সমীরণ হায় হায় বলিল,-দূর দূরান্তরে ঐ হায় হায় শব্দ প্রতিধ্বনিত হইল!
*
এখন আর স্বপ্ন নাই-আমি জাগিয়া উঠিয়াছি। দূরে শৃগালের কর্কশ শব্দে শুনিলাম-“পিপাসা, পিপাসা”! একি, আমি পাগল হইলাম নাকি? কেবল “পিপাসা” দেখি কেন। কেবল “পিপাসা” শুনি কেন?
আমার প্রিয়তমের সমাধিস্থানে যাইলাম। বনপথ দিয়া যাইতে শুনিলাম, তরুলতা বলে “পিপাসা, পিপাসা”! পুত্রে মর্ম্মর শব্দে শুনিলাম “পিপাসা, পিপাসা”! প্রিয়তমের গোর হইতে শব্দ আসিতেছিল-“পিপাসা, পিপাসা”! ইহা অতি অসহ্য! প্রিয়তম মৃত্যুকালে জল পায় নাই-চিকিৎসরে নিষেধ ছিল। সুতরাং পিপাসী মরিয়াছে।
আহা! এমন ডাক্তারী কে রচনা করিয়াছেন? রোগীর প্রতি (রোগ বিশেষে) জল-নিষেধ ব্যবস্থা কোন হৃদয়হীন পাষাণের বিধান? যখন রোগীকে বাঁচাইতে না পার, তখন প্রাণ ভরিয়া পিপাসা মিটাইয়া জল পান করিতে দিও। সে সময় ডাক্তারের উপদেশ শুনিও না। নচেৎ আমারই মত আজীবন পিপাসায় দগ্ধ হইবে।
কোন রোগী মৃত্যুর পূর্বদিন বলিয়াছিল, “বাবাজ্বান! তোমারই সোরাহির জল অবশ্যই শীতল হইবে। পিতা তাহার আসন্নকাল জানিয়া স্বহস্তে সোরাহি আনিয়া দিলেন। অন্যান্য মিত্ররূপী শক্রগণ তাহাকে প্রচুর জল সাধ মিটাইয়া পান করিতে দেয় নাই। ঐ রোগীর আত্মা কি আজ পর্যন্ত কারবালার শহীদদের মত “পিপাসা, পিপাসা” বলিয়া ঘুরিয়া বেড়ায় না? না; স্বর্গসুখে পিপাসা নাই! পিপাসা-যে বাঁচিয়া থাকে,-তাহারই! অনন্ত শান্তি নিদ্রায় যে নিদ্রিত হইয়াছে, পিপাসা তাহার নহে! পিপাসা-যে পোড়া স্মৃতি লইয়া জাগিয়া থাকে,-তাহারই!!
কিন্তু কি বলিতে কি বলিতেছি,-আমার হৃদয়ানন্দ মৃত্যুর পূর্বদিন গোপনে জননীর নিকট জল চাহিয়াছিল। ডাক্তারের নিষেধ ছিল বলিয়া কেহ তাহাকে জল দিত না। জননী ভয়ে ভয়ে অল্প জল দিয়াছিলেন। মৃত্যুকালে সে তৃষ্ণায় অত্যন্ত কাতর ও অধীর হইয়াছিল-হায়! না জানি সে কেমন পিপাসা!
হৃদয়ানন্দ জানিত, আমি তাহাকে জল দিব না। আমি চিকিৎসকের অন্ধ আজ্ঞাবহ দাস, তাহাকে জল দিব না। তাই সে আমার উপস্থিত থাকা সময় জল চাহিতে সাহস করে নাই! কি মহতী সহিষ্ণুতা! জলের পরিবর্ত্তে চা চাহিল। শীতল জলের পিপাসায় গরম চা!! চা তখনই প্রস্তুত হইয়া আসিল। যে ব্যক্তি চা পান করাইতেছিল, সে চার পেয়ালার কড়া ধরিতে পারিতেছিল না-পেয়ালা এত তপ্ত ছিল। আর সেই পিপাসী সে পেয়ালাটি দুই হস্তে (যেন কত আদরের সহিত জড়াইয়া) ধরিয়া চা পান করিতে লাগিল!! আহা! না জানি সে কেমন পিপাসা!! অনলরচিত পিপাসা!! কিম্বা গরলরচিত পিপাসা!!
সে সময় হয় ত তাহার শরীরে অনুভব শক্তি ছিল না,-নচেৎ অত গরম পেয়ালা ও কোমল হস্তে সহিবে কেন? আট বৎসরের শিশু-ননীর পুতুল, তাহার হাতে গরম পেয়ালা!-আর সেই তপ্ত চা-স্বাস্থ্য ভাল থাকিলে নিশ্চয় গলায় ফোস্কা হইত! আর ঐ মাখন-গঠিত কচি হাত দুটি জ্বলিয়া গলিয়া যাইত!! সেই চা তাহার শেষ পথ্য-আর কিছু খায় নাই।