আবার ইহাও বলি, লেডীকেরাণী হওয়ার কথা কেবল বঙ্গদেশে যেমন shocking বোধ হয়, সেরূপ অন্যত্র বোধ হয় না। আমেরিকায় লেডীকেরাণী বা লেডীব্যারিষ্টার প্রভৃতি বিরল নহে। এবং এমন একদিনও ছিল, যখন অন্যান্য দেশের মুসলমানসমাজে “স্ত্রীকবি, স্ত্রীদার্শনিক, স্ত্রীঐতিহাসিক, স্ত্রীবৈজ্ঞানিক, স্ত্রীবক্তা, স্ত্রীচিকিৎসক, স্ত্রীরাজনীতিবিদ্” প্রভৃতি কিছুরই অভাব ছিল না। কেবল বঙ্গীয় মোসলেমসমাজে ওরূপ রমণীরত্ন নাই।
০৪.নিরীহ বাঙ্গালী
আমরা দুর্ব্বল নিরীহ বাঙ্গালী। এই বাঙ্গালী শব্দে কেমন সমধুর তরল কোমল ভাব প্রকাশ হয়। আহা! এই অমিয়াসিক্ত বাঙ্গালী কোন বিধাতা গড়িয়াছিলেন? কুসুমের সৌকুমার্য্য, চন্দ্রের চন্দ্রিকা, মধুর মাধুরী, যূথিকার সৌরভ, সুপ্তির নীরবতা, ভূধরের অচলতা, নবনীর কোমলতা, সলিলে তরলতা-এক কথায় বিশ্বজগতের সমুদয় সৌন্দর্য এবং স্নিদ্ধতা লইয়া বাঙ্গালী গঠিত হইয়াছে! আমাদের নামটি যেমন শ্রুতিমধুর তদ্রুপ আমাদের সমুদয় ক্রিয়াকলাপও সহজ ও সরল।
আমরা মূর্ত্তিমতী কবিতা-যদি ভারতবর্ষকে ইংরাজী ধরণের একটি অট্রালিকা মনে করেন, তবে বঙ্গদেশ তাহার বৈঠকখানা (drawing room) এবং বাঙ্গালী তাহাতে সাজসজ্জা (drawing room suit)! যদি ভারতবর্ষকে একটি সরোবর মনে করেন, তবে বাঙ্গালী তাহাতে পদ্মিনী! যদি ভারতবর্ষকে একখানা উপন্যাস মনে করেন, তবে বাঙ্গালী তাহার নায়িকা! ভারতের পুরুষসমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা!!১ অত্রএব আমরা মূর্ত্তিমান কাব্য।
আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলি,-পুঁইশাকের ডাঁটা, সজিনা ও পুঁটি মৎস্যের ঝোল-অতিশয় সরস। আমাদের খাদ্যদ্রব্যগুলি-ঘৃত, দুগ্ধ, দধি, ছানা, নবনীত, ক্ষীর, সর, সন্দেশ ও মধুর। অতত্রব আমাদের খাদ্যসামগ্রী ত্রিশুণাত্মক-সরস, সুস্বাদু, মধুর।
খাদ্যের গুণ অনুসারে শরীরের পুষ্টি হয়। তাই সজিনা যেমন বীজবহুল, আমাদের দেহে তেমনই ভুঁড়িটি স্থুল। নবনীতে কোমলতা অধিক, তাই আমাদের স্বভাবের ভীরুতা অধিক। শারীরিক সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে অধিক বলা নিস্প্রয়োজন; এখন পোষাক পরিচ্ছদের কথা বলি।
আমাদের বর অঙ্গ যেমন তৈলসিক্ত নবনিগঠিত সুকোমল, পরিধেয়ও তদ্রূপ অতি সূক্ষ্ম শিমলায় ধূতি ও চাদর। ইহাতে বায়ু সঞ্চলনের (Ventilation এর) কোন বাধা বিঘ্ন হয় না! আমরা সময় সময় সভ্যতার অনুরোধে কোট শার্ট ব্যবহার করি বটে, কারণ পুরুষমানুষের সবই সহ্য হয়। কিন্তু আমাদের অর্দ্ধাঙ্গী-হেমাঙ্গী, কৃষ্ণাঙ্গিগণ তদনুকরণে ইংরাজললনাদের নির্লজ্জ পরিচ্ছদ (শেমিক জ্যাকেট) ব্যবহার করেন না। তাঁহার অতিশয় সুকুমারী ললিতা লজ্জাবতী লতিকা, তাই অতি মসৃণ ও সূক্ষ্ম “হাওয়ার সাড়ী” পরেন! বাঙ্গালীর সকল বস্তুই সুন্দর, স্বচ্ছ ও সহজলব্ধ।
বাঙ্গালীর গুণের কথা লিখিতে হইলে অনন্ত মসী, কাগজ ও অকান্ত লেখকের আবশ্যক। তবে সংক্ষেপে দুই চারিটা গুণের বর্ণনা করি।
ধনবৃদ্ধির দুই উপায়, বাণিজ্য ও কৃষি। বাণিজ্য আমাদের প্রধান ব্যবসায়। কিন্তু তাই বলিয়া আমরা (আরব্যোপন্যাসের) সিন্ধবাদের ন্যায় বাণিজ্যপোত অনিশ্চিত ফললাভের আশায় অনন্ত অপার সাগরে ভাসাইয়া দিয়া নৈরাশ্যের ঝঞ্জাবাতে ওতপ্রোত হই না। আমরা ইহাকে (বাণিজ্য) সহজ ও স্বল্পায়াসসাধ্য করিয়া লইয়াছি। অর্থাৎ বাণিজ্য ব্যবসায়ে যে কঠিন পরিশ্রম আবশ্যক, তাহা বর্জ্জন করিয়াছি। এই জন্য আমাদের দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিষ নাই, শুধু বিলাসদ্রব্য-নানাবিধ কেশতৈল ও নানাপ্রকার রোগবর্দ্ধক ঔষধ এবং রাঙা পিত্তলের অলঙ্কার, নকল হীরার আংটী, বোতাম ইত্যাদি বিক্রয়ার্থ মজুদ আছে। ঈদৃশ ব্যবসায়ে কায়িক পরিশ্রম নাই। আমরা খাঁটী সোণা রূপা জওয়াহেরাৎ রাখি না, কারণ টাকার অভাব। বিশেষতঃ আজি কালি কোন জিনিষটার নকল না হয়?
যখনই কেহ একটু যতন্ পরিশ্রম স্বীকার পূর্ব্বক “দীর্ঘকেশী” তৈল প্রস্তুত করেন, অমনই আমরা তদনুকরণে “হ্রস্বকেশী” তৈল আবিস্কার করি। যদি কেহ “কৃষ্ণকেশী” তৈল বিক্রয় করেন, তবে আমরা “শুভ্রকেশী” বাহির করি। “কুন্তলীনের” সঙ্গে “কেশলীন” বিক্রয় হয়। বাজারে “মস্তিঙ্ক স্নিগ্ধকারী” ঔষধ আছে, “মস্তিঙ্ক উষ্ণকারী” দ্রব্যও আছে। এক কথায় বলি, যত প্রকারের নকল ও নিস্প্রোজনীয় জিনিষ হইতে পারে, সবই আছে। আমরা ধান্য তণ্ডুলের ব্যবসায় করি না, কারণ তাহাতে পরিশ্রম আবশ্যক।
আমাদের অন্যতম ব্যবসায়-পাশ বিক্রয়। এই পাশ বিক্রেতার নাম “বর” এবং ক্রেতাকে “শ্বশুর” বলে। এক একটি পাশের মূল্য কত জান? “অর্দ্ধেক রাজত্ব ও এক রাজকুমারী”। এম, এ, পাশ অমূল্যরত্ন, ইহা যে সে ক্রেতার ক্রেয় নহে। নিতান্ত সস্তা দরে বিক্রয় হইলে, মূল্য-এক রাজকুমারী এবং সমুদয় রাজত্ব। আমরা অলস, তরলমতি, শ্রমকাতর, কোমলাঙ্গ বাঙ্গালী কিনা তাই ভাবিয়া দেখিয়াছি, সশরীরে পরিশ্রম করিয়া মুদ্রালাভ করা অপেক্ষা Old fool শ্বশুরের যথাসর্ব্বস্ব লুণ্ঠন করা সহজ!
এখন কৃষিকার্য্যের কথা বলি। কৃষি দ্বারা অন্নবৃদ্ধি হইতে পারে। কিন্তু আমরা ভাবিয়া দেখিয়াছি কৃষিবিভাগের কার্য্য (Agriculture) করা অপেক্ষা মস্তিঙ্ক উর্ব্বর (Brain culture) করা সহজ। অর্থাৎ কর্কশ উর্ব্বর ভূমি কর্ষণ করিয়া ধান্য উৎপাদন করা অপো মুখস্থ বিদ্যার জোরে অর্থ উৎপাদন করা সহজ। এবং কৃষিকার্য্যে পারদর্শিতা প্রদর্শন করা অপেক্ষা কেবল M.R.A.C পাশ করা সহজ! আইনচর্চ্চা কথা অপেক্ষা কৃষি বিষয়ে জ্ঞানচর্চ্চা করা কঠিন। অথবা রৌদ্রের সময় ছত্র হস্তে কৃষিক্ষেত্র পরিদর্শন জন্য ইতস্ততঃ ভ্রমণ করা অপেক্ষা টানাপাখার তলে আরাম কেদারায় বসিয়া দুর্ভি সমাচার (Famine Report) পাঠ করা সহজ। তাই আমরা অন্নোৎপাদনের চেষ্টা না করিয়া অর্থ উৎপাদনে সচেষ্ট আছি। আমাদের অর্থের অভাব নাই, সুতরাং অন্নকষ্টও হইবে না! দরিদ্র হতভাগা সব অন্নাভাবে মরে মরুক, তা’তে আমাদের কি?