ঠিক এই অবস্থায় বেগম মেরী বিশ্বাস কাঁদছে কেন?
মানুষ যা চায় সব তো পেয়েছিল মরিয়ম বেগমসাহেবা। গ্রামের অখ্যাত এক নফরের মেয়ে হয়ে জন্মে একদিন চেহেল-সুতুনের বেগমসাহেবা হয়েছিল। তারপরে হল কর্নেল ক্লাইভের প্রিয়পাত্রী। তখন কর্নেল ক্লাইভ মানেই বাংলা মুলুকের নবাব। তবু কেন সে কাঁদে?
মরিয়ম বেগমসাহেবারা যে কেন কাঁদে তা জানতে হলে উদ্ধব দাসের কাব্যের আরও অনেক পাতা, ওলটাতে হবে।
যে-কান্ত একদিন নিজামতের হুকুমত পেয়ে হাতিয়াগড়ের হিন্দু রানিবিবিকে এই চেহেল্-সুতুনে নিয়ে এসেছিল তাকে আর তখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বশির মিঞা ছুটোছুটি করছে চারদিকে। সেই কাফের কান্তটা কোথায় গেল?
ওদিকে চারদিকে কড়া পাহারা বসেছে। চেহেল সুতুনের ভেতর থেকে কোনও জিনিস না বাইরে বেরিয়ে যায়। মিরজাফর আলি সাহেব কড়া হুকুম দিয়ে দিয়েছে কোতোয়ালিতে। হারেমের ভেতরে খোঁজা-সর্দার পিরালি খাঁ তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে বেগমসাহেবাদের ওপর। বাইরে থেকে জাল পাঞ্জা নিয়ে কেউ যেন না ভেতরে ঢুকতে পারে। যদি কেউ ঢুকে পড়ে তো তাকে সোজাসুজি মিরজাফর আলি সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। ফিরিঙ্গি কোম্পানির কাছ থেকে হুকমত এসেছে যতক্ষণ না কর্নেল ক্লাইভ সাহেব নিজে এসে তদন্ত করেন ততক্ষণ একটি জিনিসও কারও সরাবার এক্তিয়ার নেই। এ হুকুমতের নকল বাইরেও পাঠানো হয়েছে। মুৎসুদ্দিয়ান, কানুনগোয়ান, চৌধুরীয়ান, করোরিয়ান, জমিদারান পংনসরৎসাহী ওরফে হাতিয়াগড় সরকার ও পং হোসেন প্রতাপ সরকার সিলেট জায়গির নবাব সমসদ্দৌলা সুবে বাংলা। তোমরা সকলে অবগত হও যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল ক্লাইভ মুর্শিদাবাদে আগত হইতেছেন। উক্ত দিবসে উক্ত মুৎসুদ্দিয়ান, কানুনগোয়ান, চৌধুরীয়ান, করোরিয়ান, জমিদারান, প্রভৃতি সকলে তাহার নিকট হাজিরা দিয়া সরকারি হুকুমতের মর্যাদা নির্বাহ করিবা।
মোতালেক মুসুবাদ কাজির দেউড়ি,
–জনাব মনসুর আলি মেহের মোহরার ॥
এই পরোয়ানা বেরোবার পর থেকেই সবাই উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। এবার কী হবে! এবার কে নবাব হবে! যে নবাবকে খুন করেছে তার কী হবে! কিন্তু কারও মুখে কোনও কথা নেই। সবাই ভয়ে। ভয়ে মুখ বন্ধ করে ঘরের ভেতরে দরজায় হুড়কো এঁটে বসে আছে।
তবু রাস্তাতেও ভিড়ের কমতি নেই। মনসুরগঞ্জ-হাবেলিতে এসে উঠেছে মিরজাফর আলি খাঁ। উঠেছে তার ছেলে মিরন আলি খাঁ। ফটকের সামনে কড়া পাহারা বসে গেছে। বন্দুক কাঁধে নিয়ে তারা দিন রাত পাহারা দেয়। জগৎশেঠজি আসে, হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই আসে, ডিহিদার রেজা আলি আসে, মেহেদি নেসার আসে। পরামর্শ আর ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়। কে নবাব হবে, ক্লাইভ সাবে কাকে নবাব করবে! লোকের কৌতূহলের শেষ নেই!
বহুদিন আগে একদিন একটা পালকি এসে থেমেছিল চেহেল্-সুতুনের ফটকে। নিজামতের চর কান্ত সরকার সেদিন পালকিটাকে চেহেল সুতুনের ফটক পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে নিজের আস্তানায় চলে গিয়েছিল। আর কেউ জানত না সে-ঘটনাটার কথা। বড় গোপনে সে ব্যাপারটা সমাধা হয়েছিল বশির মিঞার সঙ্গে। কিন্তু যারা জানত না তারা একটু কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। নবাবি হারেম। সে বড় তাজ্জব জায়গা। আগে কান্ত সরকারের এ-সম্বন্ধে কোনও ধারণা ছিল না। এত তার অলিগলি, এত তার কানুন-কিসমত। দুনিয়ার সমস্ত আইন-কানুনের বাইরে যেন চেহেল্-সুতুন। সেখানে খুন হয়ে গেলেও নবাবের খেদমতে তার কোনও আর্জি নেই। অন্ধকারে সেখানে তোমাকে গলা টিপে খুন করে মেরে ফেললেও কেউ প্রতিকার করবার নেই। সেখানে তুমি যদি একবার যাও তা হলে আর কখনও বাইরে আসবার কথা মুখে আনতে পারবে না। ইন্তেকাল পর্যন্ত তুমি সেখানে বন্দি হয়ে রইলে।
পালকিটা গিয়ে চবুতরার সেই কোণের দিকে দাঁড়াল।
কান্ত সেই দিকেই সেদিন হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। বশির মিঞার কথাতে যেন তার ঘুম ভাঙল।
বশির মিঞা বললে–লে চল, ওদিকে আর দেখিসনে, নবাবের মালের দিকে নজর দিতে নেই, কেউ জানতে পারলে তোর গর্দান যাবে!
কথাটা কানে গিয়ে বিধেছিল খট করে।
কী বললি তুই?
বশির হেসে উঠল খিলখিল করে। চোখ মটকে বললে, নবাবের মাল—
তার মানে?
কান্তর আপাদমস্তক রিরি করে উঠল।
কী বলছিস তুই? ও তো হাতিয়াগড়ের রানিবিবি! ও তো হিন্দু বিবি রে—
বশির মজা পেয়ে গেল। বললে–হিন্দুদের বিবিরাই তো মজাদার মাল রে—
কান্তর মনে হল এক চড়ে বশির মিঞার মুখখানা ঘুরিয়ে দেয়। এমন জানলে কি আর সে রানিবিবিকে এমনভাবে এত দূর রাস্তা সঙ্গে করে পাহারা দিয়ে আনত। বশির মিঞা হয়তো রসিকতার চোটে ভুলেই গিয়েছিল যে কান্ত হিন্দু। কান্তর দিদিমা মুসলমানদের ছুঁয়ে ফেললে গঙ্গায় স্নান করে ফেলত। বড়চাতরার জমিদারবাবুরা ফৌজদারের কাছারিতে নাজিরের চাকরি করত বটে, কিন্তু সেরেস্তার কাজ সেরে বাড়িতে এসে কাপড়-পিরেন সব ছেড়ে ফেলত। তারপর স্নান করে শুদ্ধ হত। আর কান্ত আজ নিজামতে চাকরি করতে এসেছে বলে একথাও মুখ বুজে সহ্য করতে হল।
কিন্তু নবাবের কি মেয়েমানুষের অভাব যে হাতিয়াগড়ের রানিবিবিকে খুঁজে এনে এখানে চেহেল্-সুতুনে পুরতে হবে?
অভাব হবে কেন? তুই বড় বেকুবের মতো কথা বলিস! একটা মেয়েমানুষে কি কারও চলে? এই দ্যাখ না, আমার তো তিন-তিনটে আওরাত। একটু একঘেয়ে লাগলেই মুখ বদলে নিই। দুনিয়ায় মেয়েমানুষের পয়দা হয়েছে কেন বল তো?